এক সকালের অপেক্ষায়

সময় পেলেই আমি জানলার ধারে গিয়ে বসি। সকালে ঘুম থেকে উঠেই। স্কুলের ছুটি থাকলে দুপুরে ভাত খেয়ে উঠে। এক একদিন স্কুল থেকে ফিরে মাঠে না গিয়ে জানলার ধারে বসে থাকি। কোনো কোনো দিন তো এমনও হয় রাতে ঘুম না এলে আমি জানলায় গিয়ে বসি।

আমার জানলায় বসা মায়ের একদম পছন্দ নয়। আমি বুঝতে পারি, আমার জানলায় বসা নিয়ে মায়ের খুব চিন্তা। মা ভাবে এত ছোটো বয়সে ছেলে কেন জানলায় বসবে। আমার অবশ্য তা মনে হয় না। জানলায় বসার আবার বয়স হয় নাকি? তাছাড়া সবাই যা জানলা দিয়ে দেখে আমি তো তা দেখি না।

আমার জানলার সামনে দিয়েই একটা রাস্তা চলে গেছে। রাস্তার গায়েই একটা বাড়িতে একজন দাদু থাকে। ঠিক আমার জানলার মুখোমুখি দাদুর জানলা। দাদু আমাকে খোকা বলে ডাকে। আমায় জানলায় দেখলেই দাদু কথা বলে ওঠে – এ্যাই খোকা, আজ স্কুল যাসনি কেন?

– আমার রোজ স্কুলে যেতে ভালো লাগে না দাদু।

– ভাত খেয়েছিস?

– হ্যাঁ।

– তুই ভাতের সঙ্গে মাছ খাস না?

– খাই তো।

আমার কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে দাদু জানলা বন্ধ করে দেয়। অনেকক্ষণ পরে দাদু জানলা খোলে। আমি স্পষ্ট দেখতে পাই দাদুর মুখটা কেমন যেন শুকিয়ে গেছে। আসলে শরীরের জন্য দাদুর মাছ খাওয়া বারণ। তাই আমি মাছ খেয়েছি শুনলেই দাদু রাগে জানলা বন্ধ করে দেয়। এক একসময় ভাবি বলবো না। কিন্তু বলে ফেলি।

জানলায় বসে দেখি একজন মাঝবয়সী লোক কাঁধে চামড়ার কালো ব্যাগ নিয়ে শুকনো মুখে হেঁটে যায়। নাম জানি না। এইরকম কত লোকই তো হেঁটে যায়। তবু এই লোকটার দিকে আমি বেশি নজর রাখি। আমি ঘুম থেকে উঠেই যখন জানলায় বসি তখন লোকটা যায়। ঠিক সাড়ে ছ’টার সময়। একদিন বাবার সঙ্গে কলকাতা যাচ্ছি, দেখি লোকটা আদা, আমলকী, আনার দানা– এইসব বিক্রি করছে।

বুঝতে পারি লোকটার আজ ভালো বিক্রি হয়নি। সত্যিই তো, রোজ রোজ লোকেরা কত আদা আমলকী খাবে!  এক একদিন লোকটা সিগারেট ধরিয়ে ফেরে। সেদিন মুখ চোখের ভাব ভঙ্গিই আলাদা। কিছুতেই মাথায় ঢোকে না, এই সামান্য বিক্রিতে কি করে একটা সংসার চলে।

লোকটা আবার ঠিক ওবেলা কাঁটায় কাঁটায় পাঁচটায় গাড়ি ধরতে বেরোবে। যখন ফেরে আমি দেখতে পাই না। আমার জানলা বন্ধ থাকে।

 

(  দুই  )

– বিবু , কাল সকালেই অঙ্ক স্যার আসবেন। ওনার কাজগুলো করেছিস?

আমার বাবা। খুব জোর বাবার গলায়। হঠাৎ করে শুনলে অনেকে ভাববে বাবা বোধহয় খুব রেগে গেছে। কিন্তু একেবারেই না। বাবা জীবনের উচিত কাজগুলো খুব জোরের সঙ্গে আগে করতে বলে। কিন্তু সেগুলো কিছুতেই পারা যায় না। এই যেমন আমি, ঘুম, খাওয়া, টিভিতে খেলা দেখা– সব করার সময় পেয়েছি। কিন্তু অঙ্ক স্যারের বাড়ির কাজগুলো করা হয় নি। বাবা এইবার সারাক্ষণ বকবক করবে। এইখান থেকেই মায়ের সঙ্গে ঝগড়া। মূল কারণ কিন্তু আমি। বাবা এইসময় খুব চেঁচামেচি করে। অনেকেই ভাবে আমার বাবা বোধহয় খুব ঝগড়াটে। কিন্তু আমি তো জানি, আসল কারণটা কী।

আমি আমার বন্ধুদের বাবাদেরকে দেখেছি। কিন্তু তাদের সঙ্গে বাবার মূল তফাৎটা হল, তারা একবার বলে থেমে যান। কিন্তু আমার বাবা লেগে থাকে। যতক্ষণ না আমি অঙ্ক বই নিয়ে বসছি বাবা কিছুতেই থামে না। আসলে মানুষটা পড়াশোনাকে এতটাই ভালোবাসে যে, তার ক্ষেত্রে এটাই স্বাভাবিক।

বাবা খুব মূল্যবান একটা কথা বলে। আমি টিভিতে ঘন্টার পর ঘন্টা টেস্ট ক্রিকেট দেখলে বাবা কিছুতেই সহ্য করতে পারে না। তার মানে কিন্তু এই নয় বাবা খেলা দেখার বিরোধী। বাবা বলে– তুই তো ক্রিকেট খেলোয়াড় হবি না, তাহলে এত মনোযোগ সহকারে দেখার কি আছে? খেলা তোর কাছে বিনোদন হোক। পড়া আর কাজের ফাঁকে টিভি দেখে একঘেয়েমিটা কাটা।

খুব সত্যি কথা। কিন্তু বাবার কথা মানতে পারিনা। খেলা দেখতে বসলে কিছুতেই সময় জ্ঞান থাকে না। এই যুক্তিতে বাবাকে কেউ বোঝে না।

 

(  তিন  )

– এ্যাই খোকা, কবে বিয়ে করবি?

– করব দাদু, সময় আসুক।

স্কুল থেকে ফিরে যেদিন মাঠে যাই না, সেদিন জানলায় বসে দাদুর সঙ্গে কথা বলি। মা আমার কথা শুনে রেগে যায়। দাদুকেও পছন্দ করে না। ছোট ছেলেকে এসব কী প্রশ্ন!

আমি দেখি সারা দিন রাত দাদু একা। অনেক বছর আগে ঠাকুমা মারা গেছে। আমি দেখি নি। একজন কাজের মেয়ে আছে। কিন্তু সে কাজ করবে না দাদুর সঙ্গে কথা বলবে। তাই কথা বলার লোক বলতে শুধু আমি। আমি চুপ করে গেলে দাদু কার সঙ্গে কথা বলবে? আমি মাকে এইসব কথা একদিন বুঝিয়ে বলেছিলাম। মা এতে আরও রেগে যায়।

দাদুরা তো এমন কথা বলবেই। নাতির সঙ্গে সম্পর্কটাই তো এরকম। কিন্তু মা কিছুতেই বুঝতে চায় না। ভাবে আমার মুখে এত পাকা পাকা কথা কেন।

 

(  চার  )

আমার কোনো ঘনিষ্ঠ বন্ধু নেই। আমি খুব বেশি ছেলের সঙ্গে মিশিও না। আসলে বেশি কথা বলতে আমার ভালো লাগে না।

স্কুলে কেউ কথা বললে আমি বলি। তাই কারও সঙ্গেই আমার গভীর বন্ধুত্ব হয় নি। কিন্তু আমি দেখতে পাই স্কুলে সবাই সবার সাথে গল্প করছে, খেলছে। এই মেশামিশির একটা সমীকরণ আছে, যেটা আমি এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারি নি।

আমি যে একটুতেই রেগে যাই, এটা সবাই জেনে গেছে। তাই আমাকে সবাই রাগিয়ে দেয়। আমি মনে মনে ঠিক করে নিই আর রাগবো না যা-ই বলুক না কেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর নিজেকে আর রাখতে পারি না। মারপিট করে ফেলি। আমার মারাটাই সবাই দেখে। নালিশ জানালে স্যারই বরং আমাকে মারেন।

 

(  পাঁচ  )

সবাই আমাকে খুব ছোটো ছোটো ভাবে। অথচ আমি নাইনে পড়ি। অনেকের থেকে অনেক বেশি লম্বা। বাবার সঙ্গে কোথাও গেলে সবাই বলে– ছেলে তো একেবারে তোমার মাথায় মাথায় হয়ে গেছে। বাবা তখন বলে– ওই লম্বাতেই ! আর কিছুতে নয়।

বাবার কথা শুনে আমার রাগ হয়। পরে বাবার কথাগুলো ভেবে দেখি, তখন আর রাগ হয় না। সত্যিই তো বাবার মনের মতো আমি কী-ই বা হতে পেরেছি। আসলে আমাকে নিয়ে বাবার অনেক স্বপ্ন। ছোটোবেলায় বাবা অনেক কষ্ট করে আজ একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। বাবার জীবনটা বড় অদ্ভুত। সারা দিনরাত ছাত্র, পড়াশোনা আর লেখালিখি নিয়ে কেটে যায়। দরকার না থাকলে বাবা বাইরেও বেরোয় না। যখনই বাবার ঘরে যাই, দেখি পড়ছে। খাওয়া-দাওয়া, সাজসজ্জা নিয়ে বাবাকে কোনোদিন নামমাত্রও ভাবতে দেখি নি।

কোনোকিছুতেই বাবার না নেই। কিন্তু পড়াশোনা যখন করবে তখন ধ্যান দিয়ে করতে হবে। আমি ওটাই পারি না। দশ মিনিট পড়লে আধ ঘন্টা ঘরের মধ্যে হেঁটে চলে বেড়াই। এটাতেই বাবা মারাত্মক রেগে যায়। এক একদিন রাগ খুব বেশি হয়ে গেলে বাবা স্নান খাওয়া ছাড়া ঘর থেকেই বেরোয় না। এরকম করে চার পাঁচদিনও কেটে যায়। এইরকমই এক দিনে বাবা আমাকে মাঠে নিয়ে গিয়ে বসল। আমরা দুজনে পাশাপাশি বসে। বাবা আকাশের দিকে তাকিয়ে। কারও মুখে কোনো কথা নেই। বাবা হঠাৎ বলে উঠলো– জানিস বিবু, একদিন সকালে দেখব সবকিছু বদলে গেছে। আমরা রাস্তা দিয়ে গল্প করতে করতে হাঁটছি। তারপরেই বাবার কি কান্না। আমি থামাই নি। মানুষটা প্রাণ খুলে কাঁদুক।

আমারও তাই মনে হয়। একদিন সকালে খুব সুন্দর রোদ উঠবে। মাথার মধ্যে কোনো কিছুর একটা বদল ঘটে যাবে। সেদিন জানলায় নয়, বাবাকে ডেকে নিয়ে মাঠে চলে যাব। ছাত্র পড়ানো থাকলেও শুনবো না। বাবাকে বলবো– তোমার বিবু রাস্তা খুঁজে পেয়েছে। শুধু মাথায় নয়, মনেও অনেকটা বেড়ে উঠেছে। হ্যাঁ বাবা, খেলাটা আমার বিনোদন। আমি মানুষ হবো। আর একা একা নয়। আমি সবাইকে নিয়ে অনেকের মধ্যে মিশে যাব।

বি. দ্র. দর্পণে প্রকাশিত সকল লেখার স্বত্ব দর্পণ ম্যাগাজিন কর্তৃক সংরক্ষিত। দর্পণ থেকে কোনো লেখার অংশ অন্যত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে দর্পণের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক।

একই ধরনের লেখা

দর্পণে লিখুন

গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, মুভি পর্যালোচনা, বই আলোচনা, ভ্রমণ অথবা দর্পণের যে কোনো বিভাগে

লেখা পাঠানোর ইমেইল

editor@dorpon.com.bd
নিয়মাবলী জানতে ক্লিক করুন
ADVERTISEMENT
মাসওয়ারি

অন্ধকার থেকে

গাঢ় অন্ধকার থেকে আমরা এ-পৃথিবীর আজকের মুহূর্তে এসেছি। বীজের ভেতর থেকে কী ক’রে অরণ্য জন্ম নেয়,- জলের কণার থেকে জেগে

কবিতা

অনন্ত জীবন যদি পাই আমি

অনন্ত জীবন যদি পাই আমি—তাহ’লে অনন্তকাল একা পৃথিবীর পথে আমি ফিরি যদি দেখিব সবুজ ঘাস ফুটে উঠে—দেখিব হলুদ ঘাস ঝরে

তারুণ্যের জানালা – মনজুরুল ইসলাম

বাবলু, কেবলই শৈশব থেকে উত্তীর্ণ হয়ে এসেছিল কৈশোরের বৃত্তে। আর দশজন কিশোরের মতো বাবলুরও কৈশোরিক স্বপ্ন, ভাবনা, আবেগ ও উচ্ছ্বাস

গল্প

চাপ

প্রসব বেদনা উঠেছে এক মহিলার। চারিদিকে ঘিরে আছে দাইসহ অন্য মহিলারা। সবার মুখে দুঃশ্চিন্তার ছাপ। প্রসব বেদনায় মহিলা তারস্বরে কোকাচ্ছে।