উপন্যাসাংশ: “আকালু” // কাজী মহম্মদ আশরাফ

কাজী মহম্মদ আশরাফ একজন একনিষ্ট পাঠক, সমালোচক ও কথাসাহিত্যিক। তিনি বেশ কিছু জীবনীগ্রন্থ রচনা করেছেন। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে  তিনি কথাসাহিত্য চর্চা করে আসছেন।  তাঁর কথাসাহিত্য সম্পর্কে অনেকেরই জানা নেই। “আকালু” তাঁর রচিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি উপন্যাস– যেখানে কেন্দ্রীয় চরিত্ররূপে একটি কুকুরকে উপস্থাপন করা হয়েছে। ব্যতিক্রমধর্মী দৃষ্টিকোণ থেকে উপন্যাসের বর্ণনা হওয়ায় এটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসের নতুন চমক। সমকালীন সময়ে শত শত মানহীন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নানান গ্রন্থের মাঝে আকালু একটি ব্যতিক্রমী ও উন্নত প্রয়াস। আকালু উপন্যাসের ১১তম অধ্যায়টি দর্পণের পাঠকদের জন্য উপস্থাপন করা হলো। গ্রন্থটি আপনারা রকমারি  ও বইবাজার থেকে সংগ্রহ করতে পারবেন।


এগারো ॥


শরৎ কাল চলে গেল। কালু ধলাগাঁয়ের মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পেই রইল। এ সময়ের মধ্যে সারাদেশে মুক্তিবাহিনীর সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা শক্তিশালীও হয়ে উঠেছেন যথেষ্ট। এখন আর পাকিস্তানি সেনারা কোথাও নির্বিঘ্নে হামলা করে সরে পড়তে পারে না। তাদের ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণও বাড়তে থাকল। হেমন্তকালের শুরুতে দেশে মুক্তিবাহিনী সমরশক্তিতে যেন প্রায় সমতা অর্জন করে ফেলেছে।

এর মধ্যে মুন্সীগঞ্জে কয়েকটি বড় ধরনের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে যেগুলোতে আর্মি হেরে গেছে। মুক্তিবাহিনী ও দেশপ্রেমিক জনতার জয় হয়েছে। এর মধ্যে একটা শ্রীনগরের গোয়ালীমান্দ্রার যুদ্ধ। এটি শরৎ কালের ঘটনা। সে যুদ্ধে নাকি দুই শ মেলেটারি খতম হয়ে গেছে। হেমন্তে এসে শ্রীনগরের কামারখোলার যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধেও মুক্তিবাহিনী জয়ী হয়। প্রায় একশ মেলেটারি নাকি ধরা পড়ে। পরে তাদের মেরে ফেলে দেওয়া হয় পদ্মা নদীতে। অগ্রহায়ণ মাসের শুরুতেই শ্রীনগর মেলেটারিমুক্ত ঘোষণা করা হয়। এলাকার নেতারা বলেছেন শ্রীনগর স্বাধীন হয়ে গেছে। শ্রীনগরের যুদ্ধেও অনেক মেলেটারি মারা যায় মুক্তিবাহিনীর হাতে।

অগ্রহায়ণ মাসের মাঝামাঝিতে সিরাজদিখানের সৈয়দপুরে আরো একটি বড় যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে সিরাজদিখান থানার মেলেটারি ক্যাম্প নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়। সব আর্মি খতম করার পরে সিরজদিখান থানাও স্বাধীন হয়।

এই সব যুদ্ধে ধলাগাঁও ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই অংশগ্রহণ করেন। তারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে সে সব যুদ্ধে চলে যান। কালু দেখতে পায় এখানে আর আগের মতো লোকসমাগম নেই। মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কমে গেছে। কালুর জন্য কিছুটা সমস্যাও হয়। আগের মতো সসপ্যান আর বড় বড় ডেক ভরে রান্না হয় না। অল্প পরিমাণ ভাত রান্না হয়। কখনো সময় ও খরচ বাঁচানোর জন্য খিচুড়িও রান্না করতে হয়। লোকজন আরো কমতে থাকলে কালু বুঝতে পারে এখানে তার থাকা কঠিন।

সব শেষ দলটি পায়ে একদিন হেঁটে মুক্তারপুরের দিকে যায়। কালুও তাদের পিছু পিছু যায়। এক সময় মুক্তিযোদ্ধারা আগে প্রস্তুত রাখা একটা নৌকায় উঠে মেঘনার দিকে চলে যান। কালু অসহায় চোখে চেয়ে থাকে। সে আবার পথের কুকুরে পরিণত হয়। সে মুক্তারপুর বাজার ও নদীতীরের এলাকায় হাঁটাহাঁটি করতে থাকে। তার কাছে এ জায়গাটি পূর্ব পরিচিত। সে মাস্টারবাড়ি চিনতে পারে। গিয়ে উপস্থিত হয়। কিন্তু সেখানে কাউকে তার আপন তো দূরের কথা চেনাও মনে হয় না। ঘরের ভেতর থেকে রুমাকে বের হতে দেখে। কিন্তু রুমা কুকুর-বেড়াল দেখতে পারে না। নাসিরকে খোঁজে কালু। পায় না। নাসিরের বড় ভাই আবু তাহেরকে দেখা যায়। কিন্তু সে তাকে খাবার দিতে আগ্রহ দেখায় না। কালু নিজেকে অবাঞ্ছিত মনে করে বাঁশঝাড়ের বাইরে পথের মধ্যে গিয়ে শুয়ে থাকে।

মাস্টার সাহেবের মেজভাই দুপুরবেলা নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে ফিরছিলেন। বড় রাস্তা দিয়ে না গিয়ে তিনি এই বাড়ির ভেতর দিয়ে যান। রোকেয়াকে ডেকে কিছুক্ষণ কথা বলেন। এটা ওটা জিজ্ঞাসা করেন। অনেকদিন ধরে এই বাড়ি তার আসা হয় না। ঠাণ্ডা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার হাঁপানির সমস্যাটা বেড়ে যায়। এখন একটু একটু করে শীত পড়ছে। তিনি চলে যাবার সময় কালুকে দেখে হাতের লাঠি দিয়ে পথ থেকে সরে যাবার জন্য ভয় দেখান। কালু ভয় না পেয়ে একটা চোখ মেলে তাকে দেখে আবার চোখ বুজে শুয়ে থাকে। এক সময় তিনি রোকেয়াকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেন,

“কি গো রুকিয়া তগো কুত্তারে খাওন দেছ নাই?”

রোকেয়া ঘর থেকে বলে, “আমাগো কুত্তা নাই তো। নাসির যেইটা পালত সেইটা জানি কই গেছে গা।”

“তাইলে এইডা আবার কোনডা?”

এই কথা বলে তিনি কালুকে ডাকেন, “আয়, আমার লগে আয়।”

কালু শোয়া থেকে উঠে লেজ নাড়তে নাড়তে তার সঙ্গে যায়। মাঝখানে ছোট জেঠার বাড়ি পার হয়েই ডান দিকে কলা বাগান আর বাম দিকে একটা বড় আর একটা ছোট ঘর। তিনি কালুকে বাড়ি নিয়ে গাইজুদ্দিনের বউকে ডেকে বলেন, “বউ ফেন আছেনিগো? থাকলে ওরে ইকটু দেও।”

কালু ফেন পায়। পরে ভাতও জোটে তার ভাগ্যে। সে দিন থেকে কালুর নতুন ঠিকানা কাজী বদরুদ্দিনের ঘরের পিরা। এখানেই সে খায়, ঘুমায়। রাতে শীত লাগলে রান্নাঘরে চুলার পাশে গোল হয়ে তুষের ঘষা আগুনের তাপে ঘুমায়। এর আগে সে মিন্টু নামে এই বাড়িতে থেকে গেছে। এখন কেউ তাকে চেনে না। এখন যে তার নাম কালু এটাও এ বাড়ির কেউ জানে না।

নাসিরের জেঠার কাছেই থাকে কালু। তিনিও ওর নাম গায়ের রঙ দেখে কালুই রেখেছেন। বিকালে বাজারে গেলে কালু তার সঙ্গে যায়। নামাজ পড়তে গেলে মসজিদ থেকে অনেকটা দূরে গিয়ে বসে থাকে। বাড়ি ফিরে তিনি যখন জলচৌকিতে বসে হুকা টানেন গড় গড় করে তখন কালু চেয়ে থাকে। তার শরীরের হুকার গন্ধটা কালুর কাছে আপন লাগে।

একদিন কালু ঘুমিয়েছিল হঠাৎ বিকট গর্জনে জেগে ওঠে। সে ওপরের দিকে চেয়ে দেখে আকাশে পাখির মতো যেন কতগুলো কী উড়ছে। আর কী যেন নিচে ফেলছে। কালো ওই জিনিসগুলো যেখানে পড়ে সেখানে আগুন ধরে যায়। কালু ভয় পেয়ে যায়। এই জিনিস আগে সে কখনো দেখেনি। অনেকগুলো একসঙ্গে আসে। সে কী ভয়ানক গর্জন করতে করতে আসে ওই পাখিগুলো! কালুর ঘুম হয় না। আকাশের দিকে চেয়ে সে প্রচণ্ড শব্দে ঘেউ ঘেউ করে ওঠে। দৌড়ে দৌড়ে যেতে চায়। নদীর পারে গিয়ে দেখে ওই পাখিগুলো অদূরেই আগুন বর্ষণ করে সে ভয়ে ও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। সে চুপ করে থাকে। বাড়ি এসে আবার রান্নাঘরে গিয়ে চুপ করে শুয়ে থাকে। রাতে দীর্ঘ স্বরে কূ-কূ-কূ করে কান্নার মতো শব্দ করে কুঁই দেয়।

শীতকালে চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হলে মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। বিমান থেকে বোমা হামলা হতে থাকে। নদীর ওপারে সেনাঘাঁটি থেকে এপার বরাবর মেশিনগান দিয়ে শেল নিক্ষেপ করতে থাকে তারা। এর মধ্যে শোনা গেল কোন কোল্ড স্টোরেজের দেয়াল ভেদ করে ভেতরে হিমাগারের দেয়ালে নাকি বিঁধে আছে। তেত্রিশ কেভি বিদ্যুৎ টাওয়ারের চারটি পায়ার মধ্যে একটি ভেঙে দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধারা। বণিক্যপাড়ার কাছের ব্রিজটিও তারা উড়িয়ে দিয়েছেন যাতে মেলেটারি সড়ক পথে ঐদিকে না যেতে পারে।

এলাকার লোকজন দক্ষিণ দিকে সরে যেতে থাকে। দক্ষিণ দিকের গ্রামগুলো স্বাধীন হয়ে গেছে। মুক্তাঞ্চলগুলোতে এদিক থেকে ছুটে যাওয়া মানুষের ভিড়। স্কুল ঘরগুলোতে আশ্রয় নিয়েছেন তারা। মুক্তারপুর বাজারের কাছাকাছি জায়গাগুলো নদীর ওপারের সেনাঘাঁটির আক্রমণের সহজ লক্ষ্য। মাঝখানে কোনো বাধা নেই। একেকবার মেশিনগানের গোলা দেড়-দুই-এমনকি আড়াই মাইল দূরে গিয়ে পড়ছে। এর মধ্যে বাগবাড়ির আলিঘোষের মেয়ে গোলার আঘাতে মারা গেছে। মুক্তারপুরের আরো কে যেন মারা গেছে। কার বউয়ের কোলে দুধ-খাওয়া অবস্থায় বাচ্চার মাথা ছিঁড়ে উড়ে গেছে।

সমারিক শক্তিবৃদ্ধির জন্য ঢাকা থেকে একটা গানশিপ ভরে আরো মেলেটারি এসে নামে নদীর ঐপারে। এপার গুদারাঘাটে, মসজিদ ঘাটলায় ও বাজারের পেছনে দাঁড়িয়ে যারা এ দৃশ্য দেখেছে তারা শ্বাস ফেলে সারতে পারছিল না। চিৎকার করতে করতে তারা দৌড়ে পালাতে লাগল। “আল্লা গো আরো মেলেটারি আইতাছে!”

একদিন বিমান হামলায় গানশিপে আগুন ধরে যায়। কিছুক্ষণ পরে ডুবেও যায়। মেলেটারিদের অনেকে পুড়ে মারা গেল। কেউ বাঁচার জন্য পানিতে লাফিয়ে পড়েছে কিন্তু সাঁতার না জানার কারণে ডুবে মারা যায়। ডাঙ্গায় যারা ছিল তারা কয়েক প্লাটুনে ভাগ হয়ে নানা দিকে অভিযানে বেরিয়ে গেল। এর মধ্যে কাত হয়ে ডুবে থাকা জাহাজটিতে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। তারা অস্ত্র-শস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে দ্রুত সরে যাওয়ার পরেই কিছু লোক নাও নিয়ে গিয়ে জাহাজ থেকে চাউল-আটা-ময়দা-ঘি-চিনিসহ রসদগুলো লুট করে পালিয়ে যেতে লাগল।

নদীর পারে দাঁড়িয়ে কালু এসব ঘটনার অনেক দৃশ্যই দেখতে পেয়েছে। সে দূর থেকেই মেলেটারিদের পোশাক দেখে চিনতে পারে। তাদের সম্পর্কে পূর্বধারণাও আছে। কালু এসব দেখে ভয় পেতে থাকে। সে এখানে থাকার ভরসা পাচ্ছে না। একবার দৌড়ে বাড়ি চলে যায় আবার নদীর পারে এসে দাঁড়ায়। কোথাও স্বস্তি পায় না। ঘুমাতে পারে না। সে যখন ঘুমাতে যায় তখনই দেখা যায় বিমান হামলা শুরু হয়।

একদিন সকাল থেকেই গোলাগুলির শব্দ পাওয়া গেল। শোনা গেল দশকানি-বণিক্যপাড়া-বুড়িপাড়া-ভট্টাচার্যেরবাগ-রতনপুর এলাকা জুড়ে যুদ্ধ চলছে। আতঙ্কগ্রস্ত লোকজন বাড়ি-ঘর ফেলে এক কাপড়ে কোলে-কাখে সন্তান নিয়ে পালাতে শুরু করেছে।

বদরউদ্দিন কাজীকে ছেলে আর বউ বলল, “বাবা আপনে ডরাইলে লন আমরা অন্য কোনো হানে যাই।”

বিপত্নীক বদরউদ্দিন কাজী এই শেষ বয়সে কোথায় যাবেন! তিনি জানতে চাইলেন, “কই যামু বউ?”

“সবাই তো টঙ্গিবাড়ি-বালিগাঁও-বেতকা ঐদিকে যাইতাছে। আমরাও যাই।”

“বাড়িঘর ফালাইয়া থুইয়া গেলে লুট কইরা সব লইয়া যাইব।”

সব শেষে কথা হয় গাইজুদ্দিনের বাবা আদারিয়াতলা এক আত্মীয়ের বাড়ি চলে যাবেন। দশকানি-বুড়িপাড়া যুদ্ধ চলছে; এদিক দিয়ে যাওয়া যাবে না। তাই তিনি একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে লাঠি হাতে দুর্গাবাড়ি-রামেরগাঁও-রতনপুর ঘুরে ভট্টাচার্যেরবাগ-বণিক্যপাড়া-তেলিরবিল ঘুরে আদারিয়াতলা রওনা হলেন। কালুও তার সঙ্গে হাঁটতে লাগল। তিনি ভাবলেন, যাক একটা সঙ্গী তো পাওয়া গেছে।

রতনপুরে গিয়ে শুনলেন বণিক্যপাড়া-ভট্টাচার্যেরবাগ যুদ্ধ চলছে। তিনি দশকানির দিকে রওনা হলেন। রাস্তা দিয়ে হাঁটা নিরাপদ না। রাস্তা থেকে নেমে নিচু জমি ও উঁচু-নিচু ভিটার ওপর দিয়ে ভয়ে ভয়ে যেতে লাগলেন। এখানে চারদিকেই গুলির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। মাথার ওপর দিয়ে সাঁ সাঁ করে ছুটে যাচ্ছে। যে গাছে লাগছে ঝর ঝর করে শুকনো পাতা ঝরে পড়ছে। পাখিরা কলরব শুরু করে দিয়েছে; ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে একেবারে থেমে যাচ্ছে। তিনি বুঝতে পারলেন ভুল পথে এসেছেন। মুক্তিযোদ্ধারা কোন দিকে আর মেলেটারি কোন দিকে বোঝা যাচ্ছে না।

তার বয়সে এসে বোঝার কথাও না। সত্তরের কাছে এসে পৌঁছেছেন। কানে একটু কম শোনেন। চোখেও ঠিক মতো ঠাহর করতে পারেন না। তার মনে হল যদি নদীর পারের গ্রাম দিয়ে মালিরপাথর-কুড়িপাড়া-ফিরিঙ্গিবাজার-বিনোদপুর হয়ে যেতেন তাহলে সেটাই ভালো হতো। সবাই বলল, “বাজারে অনেক মেলেটারি” তাই তিনি এই পথে এসেছেন।

এখানে অনেক আম আর হিজল গাছ। ভিটাগুলোতে কপি-লালশাক-পালংশাক-মূলা ইত্যাদি ফসল ফলেছে। ভিটাগুলোর চারপাশে বড় বড় আমগাছ। আর নিচে খাল ও ডোবার পারে হিজল গাছের সারি। তিনি একেকটা ভিটা পার হন আর খালের পারে হিজল গাছের গোড়ায় বসে বিশ্রাম নেন। হাঁপানির শ্বাসকষ্টটা যেন ভয়ে বেড়ে উঠছে।

গোলাগুলিতে জায়গাটা নির্জন হয়ে গেছে। লোকজন এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। নির্জনতা বড় বেশি ভয় দেখাচ্ছে। কালু চুপ করে আছে। বোঝা যায় সেও ভয় পেয়ে গেছে। ভুল জায়গায় এসে পড়ার ভয় বোধ হয় সেও পাচ্ছে।

একটা ভিটার কিনারে বসে তিনি ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছেন। গলার ভেতরে চিঁ চিঁ শব্দ হচ্ছে। কালুও তার পাশে বসা। এ সময় দেখলেন কাছা দেওয়া একজন লোক মাথা নিচু করে দৌড়ে আসছে। তার হাতে গামছা দিয়ে বাঁধা এক গামলা ভাত। পাশ দিয়ে চলে যাওয়ার সময় তাকে বলল, “আপনে এহানে বইয়া আছেন কেন? বাড়িত যান।”

তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “মেলেটারি কোন দিকে আছে?”

লোকটা দ্রুত হেঁটে যেতে যেতে কোন দিকের কথা বলল তিনি বুঝতে পারলেন না। এই যুদ্ধের মধ্যে কোনো জমিনে কি কেউ কাজ করছে? মনে হয় না। তাহলে লোকটা কার জন্য ভাত নিয়ে যাচ্ছে? সকাল থেকে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যই বোধ হয়। লোকটা চলে যাওয়ার পরে তার মনে হল ভালো মতো কথা বলা দরকার ছিল। তিনি কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। কোন দিকে যাবেন? নাকি এখানেই বসে থাকবেন? যুদ্ধ কতক্ষণ চলবে? সেই সকাল থেকেই শুরু হয়েছে।

তিনি বসেই রইলেন।

কালু ক্ষুধা অনুভব করছে। সকাল থেকে তার কিছু খাওয়া হয়নি। সে ভাতের গামলা নিয়ে যাওয়া লোকটাকে অনুসরণ করে হাঁটতে লাগল। লোকটা অনেকটা এগিয়ে গেছে। কোন দিকে গেল বোঝা যাচ্ছে না। কালু একটা ভিটার মাঝে দাঁড়িয়ে চারদিকে চেয়ে দেখে হতাশ হয়ে গেল। হঠাৎ তার নাকে গরম ভাতের মৃদু গন্ধ এসে লাগল। কালু বুঝতে পারল সামনের ভিটায় ঘন আঁটিকলা গাছের ঝোঁপের ভেতর মুক্তিযোদ্ধারা ভাত খেতে শুরু করেছেন।

সে সামনের ভিটায় যাওয়ার জন্য এগিয়ে গেল। সামনে একটা ডোবা পড়ল। পানি দেখে সে ডান দিক ঘুরে সহজ একটা পথ দেখতে পেল। হঠাৎ ডান দিকে দেখতে পেল প্রায় দশজন মেলেটারি। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান টের পেয়েছে মাথা নিচু করে অস্ত্র তাক করে এগিয়ে যাচ্ছে। কালু বুঝতে পারল এরা শত্রু। কাউকে মারার জন্য এগিয়ে যাচ্ছে। সে বিকট শব্দে ঘেউ ঘেউ করে চিৎকার করতে লাগল।

সামান্য দূরেই মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকজন খেতে বসেছিলেন। তারা কালুর চিৎকারে খাওয়া ফেলে নিঃশব্দে অস্ত্র হাতে লাফিয়ে উঠলেন। বৃষ্টির মতো গুলি শুরু হয়ে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই মেলেটারিদের কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হল। কয়েকজন পালিয়ে গেল। আহতরা শুয়ে পড়ে কাঁতরাচ্ছে। কালু তাদের দেখে ঘেউ ঘেউ করতে লাগল।

কতক্ষণ পরেই সব কিছু শান্ত হয়ে গেল। একেবারে নীরব হয়ে গেল পুরো এলাকাটা। পালিয়ে যাওয়া মেলেটারিরা এসে আহতদের সরিয়ে নিয়ে গেল। কালু আর সামনের দিকে যেতে সাহস পাচ্ছে না। চোখের সামনে কতবড় ঘটনা ঘটে গেল। সে শুকনো মাটিতে পাকিস্তানি মেলেটারির টাটকা গায়ের রক্ত দেখে শুঁকে শুঁকে দেখল।

কিছুক্ষণ পরে কালু ভয়ে ভুলে যাওয়া ক্ষুধা আবার অনুভব করতে লাগল। সে এবার ডোবার ডান পার ধরে এগিয়ে সেই কলাগাছে ঢাকা ভিটায় গিয়ে উঠল। দেখল সেখানে অনেক মাখাভাত পড়ে আছে। মাটিতে, থালায় ও গামলায়। সিলভারের পানির জগটা কাত হয়ে পড়ে আছে। কোনো লোকজন নেই। মুক্তিযোদ্ধারা সরে গিয়ে সতর্কভাবে হয়তো অন্য কোথাও অবস্থান নিয়েছে।

পেট ভরে ভাত খেয়ে কালু উল্টাপথে হাঁটতে লাগল। যেখানে তার প্রবীণ মনিব বদরউদ্দিন কাজী বসে আছে সেখানে গেল। গিয়ে দেখল তিনি সেখানে নেই। অন্য কোথাও সরে গেছেন। ভরা পেটে কালু দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিল। এ-ভিটা ওই ভিটা করে চারদিকে খুঁজতে লাগল। মেলেটারি যে দিকে সরে গেছে সে দিকে ভারী বুটের শব্দ শুনে সে ভিটায় গিয়ে উঠল। দূর থেকে কালু দেখতে পেল একটা হলদি খেতের কিনারে আমগাছের নিচে তিনি চাদরে মুখ ঢেকে বসে আছেন। কাছে যেতে যেতে দেখল। মুখে দোয়া পড়ছেন আর থর থর করে কাঁপছেন।

হঠাৎ সেখানে পেছন থেকে চারজন মেলেটারি উঠে হলদি খেতের কিনারে চাদরে মুখঢাকা দেখে অস্ত্র তাক করে গুলি শুরু করল। “ইয়া আল্লাহ” বলে অনুচ্চ স্বরে একটা চিৎকার দিয়ে বদরউদ্দিন কাজী মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। রক্তে শুকনো ধূসর মাটি ভিজে যেতে লাগল। মেলেটারি মনের ঝাল মিটিয়ে তাকে গুলি করতে লাগল। একটা হাত দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল।

কালু তার চোখের সামনে মনিবকে মেরে ফেলতে দেখে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। সে প্রচণ্ড শব্দে ঘেউ ঘেউ করতে করতে মেলেটারিদের দিকে এগিয়ে গেল। একজনের পায়ে হাঁটুর কাছে কামড় বসিয়ে দিল। জীবনে এই প্রথম কালু কাউকে কামড় বসাল। একজন মেলেটারি কালুকে পর পর তিনটা গুলি করল। গোঙাতে গোঙাতে কালু ভিটার কিনার থেকে ঢালু বেয়ে গড়িয়ে কিছুটা নিচে পড়ে একটা হিজল গাছে আটকে রইল।

বি. দ্র. দর্পণে প্রকাশিত সকল লেখার স্বত্ব দর্পণ ম্যাগাজিন কর্তৃক সংরক্ষিত। দর্পণ থেকে কোনো লেখার অংশ অন্যত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে দর্পণের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক।

একই ধরনের লেখা

দর্পণে লিখুন

গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, মুভি পর্যালোচনা, বই আলোচনা, ভ্রমণ অথবা দর্পণের যে কোনো বিভাগে

লেখা পাঠানোর ইমেইল

editor@dorpon.com.bd
নিয়মাবলী জানতে ক্লিক করুন
ADVERTISEMENT
মাসওয়ারি
গল্প

নয়নচারা

ঘনায়মান কালো রাতে জনশুন্য প্রশস্ত রাস্তাটাকে ময়ুরাক্ষী নদী বলে কল্পনা করতে বেশ লাগে। কিন্তু মনের চরে যখন ঘুমের বন্যা আসে,

কামাল পাশা

[তখন শরৎ-সন্ধ্যা। আস্মানের আঙিনা তখন কার্বালা ময়দানের মতো খুনখারাবির রঙে রঙিন। সেদিনকার মহা-আহবে গ্রীক-সৈন্য সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হইহা গিয়াছে। তাহাদের অধিকাংশ

১৩৩৩

তোমার শরীর — তাই নিয়ে এসেছিলে একবার — তারপর — মানুষের ভিড় রাত্রি আর দিন তোমারে নিয়েছে ডেকে কোন্‌ দিকে

কবিতা

একবেলা হাসি

মুজাহিদ আমিনের তিনটি কবিতা কুসুমগরম জল আজকাল তুমিহীনা তুমিটা বড্ডবেশি যাপন হয় যে দ্বিতীয় শ্রেণীতে আমি আর মানিক ক্লাসের একফাঁকে