কবি চন্দ্রাবতীর সুলুকসন্ধান

কবি চন্দ্রাবতী প্রাচীন ও মধ্যযুগে বাংলার প্রথম নারী কবি। মৈমনসিংহ গীতিকার সংকলক অধ্যাপক দীনেশচন্দ্র সেনের মতে তাঁর জন্ম ১৫৫০ সালে। তাঁর কিশোরবেলার প্রেম এবং তারুণ্যে বেদনাবিধুর জীবনাবসান যে কোনো পাঠকের মন আলোড়িত করবে। এই লেখাটি কলকাতা থেকে প্রকাশিত নিয়মিত সাহিত্য সাময়িকী ‘উদার আকাশ’-এর ঈদ ও শারদীয় সংখ্যায় বছর দুয়েক পূর্বে ছাপা হয়েছিল। সাময়িকীটি পশ্চিমবঙ্গ ছোটোপত্রিকা সমন্বয় সমিতির উদ্যোগে ২০১৮ সালে ২০১টি ছোটোপত্রিকার প্রতিযোগিতায় মেধাক্রমে প্রথম স্থান অধিকার করে।


কবি চন্দ্রাবতী প্রাচীন ও মধ্যযুগে বাংলার প্রথম নারী কবি। প্রবাদ ও বচনের ক্ষেত্রে আমরা খনার নাম জানি। কবি হিসেবে চন্ডীদাসের দয়িতা রামীর নাম শোনা গেলেও তার সাহিত্যকীর্তির পরিচয় অপ্রতুল। এসব বিবেচনায় বাংলার প্রাচীন ও মধ্যযুগের বিস্তৃত সময়ে ‘একমাত্র নারী কবি’ হিসেবে চন্দ্রাবতীই স্বীকৃত। চন্দ্রাবতী সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায় ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’র এক কবি নয়ানচাঁদ ঘোষ রচিত ‘চন্দ্রাবতী’ পালায়*। তবে চন্দ্রাবতীর কাব্য সংগ্রহে সর্বপ্রথম যাঁর নাম উচ্চারিত হয়, তিনি চন্দ্রকুমার দে (১৮৮১-১৯৪৫)। সাহিত্যিক, গবেষক ও লোকসাহিত্য সংগ্রাহক চন্দ্রকুমার দে ‘সৈৗরভ’ পত্রিকায় প্রবন্ধের মাধ্যমে চন্দ্রাবতীর কাব্য সম্পর্কে প্রথম সুধী সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। চন্দ্রকুমার লিখিত প্রবন্ধ পড়ে অধ্যাপক দীনেশচন্দ্র সেন তাঁকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতনভুক্ত সংগ্রাহক পদে নিযুক্ত করেন। চন্দ্রকুমার দে’ কর্তৃক সংগৃহীত কাব্যসমূহ নিয়ে দীনেশচন্দ্র সেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৩-৩২ সালে চার খণ্ডে প্রকাশ করেন ‘পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকা।’ [১ ]

চন্দ্রাবতী বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় নিম্নভূমি ও জলাশয় পরিপূর্ণ কিশোরগঞ্জ (পুরাতন ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহকুমা) জেলার মাইজখাপন ইউনিয়নের কাচারীপাড়া গ্রামে মৈমনসিংহ গীতিকায় গ্রামের নাম পাতুয়ারী বলা হলে বর্তমানে এর নাম কাচারীপাড়া)। গ্রামটি কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের ৬ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত। তাঁর পিতার নাম দ্বিজ বংশীদাস ভট্টাচার্য ও মাতা সুলোচনা অঞ্জনা। দ্বিজ বংশীদাসও ছিলেন একজন কবিয়াল তথা পালাকার। চন্দ্রাবতীর সঠিক জন্ম ও মৃত্যু তারিখ জানা যায় না, তবে তাঁর জীবনকাল ছিল ষোড়শ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ। ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’র সংকলক অধ্যাপক দীনেশচন্দ্র সেন এর মতে তাঁর জন্ম ১৫৫০ সালে।[২] রূপসী কবি চন্দ্রাবতীর সংক্ষিপ্ত জীবনকালের বেদনাবিধূর ঘটনাবলী পরবর্তীতে বিভিন্ন কবি ও পালাকারের বয়ানেও জানা যায়।

কবি চন্দ্রাবতীর মঠ, ছবিসূত্র: মো. রেজাউল করিম

কাচারীপাড়া গ্রামে দুটি শিবমন্দির রয়েছে। উঁচু মন্দিরটি দ্বিজ বংশীদাস শিবমন্দির ও আপেক্ষকৃত নীচুটি চন্দ্রাবতী শিবমন্দির নামে খ্যাত। শিব-মন্দিরের পাশের দ্বিতল বাড়িটিকে অনেকে কবি চন্দ্রাবতীর পৈত্রিক বাড়ি বলে মনে করেন। বস্তুত বাড়িটি ছিল তৎকালীন জমিদার নীলকণ্ঠ রায়ের। চন্দ্রাবতীর পিতা যে অতি দরিদ্র ছিলেন, তা তিনি নিজেই লিখে গেছেন:

“ধারাস্রোতে ফুলেশ্বরী নদী বহি যায়।
বসতি যাদবানন্দ করেন তথায়।
ভট্টাচার্য্য বংশে জন্ম অঞ্জনা ঘরণী।
বাঁশের পাল্লায় তাল-পাতার ছাউনী।
বাড়াতে দারিদ্র-জ্বালা কষ্টের কাহিনী।
তার ঘরে জন্ম নিলা চন্দ্রা অভাগিনী।।
সদাই মনসা-পদ পূজি ভক্তিভরে।
চাল-কড়ি কিছু পাই মনসার বরে।”

চন্দ্রাবতী

চন্দ্র্রাবতীর বাস্তব জীবনে ঘটে যাওয়া প্রেমের বিয়োগাত্মক ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায় নয়ানচাঁদ ঘোষ রচিত ‘চন্দ্রাবতী পালা’য়। চন্দ্রাবতী পালা ১২টি অধ্যায়ে ৩৫৪টি ছত্রে লোকগাথা চন্দ্রাবতীর জীবনীর তথ্যভিত্তিক একমাত্র লিখিত দলিল।[৩] বাল্যকালে চন্দ্রাবতী জয়চন্দ্র চক্রবর্তী নামের এক অনাথ বালককে খেলার সাথী ও বন্ধু হিসেবে পেয়ে যান। জয়চন্দ্রের নিবাস ছিল নিকটবর্তী ফুলেশ্বরী নদীর ওপারে সুন্দ্রা গ্রামে (বর্তমানে গ্রামটির অস্তিত্ব নাই। হয় নামটি পরিবর্তীত হয়েছে অথবা নদীভাঙনে গ্রামটি নদীগর্ভে হারিয়ে গেছে। অনাথ জয়চন্দ্র্র থাকতেন মাতুলালয়ে। চন্দ্রাবতীর বাবা দ্বিজ বংশীদাস নিজ কন্যা ও জয়চন্দ্রের করুনাখ্যান নিয়ে ছোটো ছোটো অনেক পদ লিখে গেছেন। সেই সুবাদে জানা যায়, চন্দ্রাবতীর সঙ্গে জয়চন্দ্রের পরিচয় ও সখ্যতা হয় পুষ্পবনে শিবপূজার ফুল তোলার সময়। ক্রমশ দু’জনের মাঝে সখ্য গড়ে ওঠে। নয়ানচাঁদ ঘোষের বর্ণনায়ও আছে, চন্দ্রাবতীর সঙ্গে বাল্যসখা জয়ানন্দের বন্ধুত্ব গভীর প্রেমে পরিণত হয়। চন্দ্রাবতী যখন কিশোরী সে সময়েই জয়চন্দ্রকে ভালোবেসে ফেলেন তিনি। বন্ধু, প্রেমিকের সাথে মিলনের আশায় উদ্বেলিত চন্দ্রাবতী লেখেন:

“তোমারে দেখিব আমি নয়ন ভরিয়া।
তোমারে লইব আমি হৃদয়ে তুলিয়া।
বাড়ির আগে ফুইট্যা রইছে মল্লিকা মালতী।
জন্মে জন্মে পাই যেন তোমার মত পতি।”

চন্দ্রাবতী

কী অসাধারণ আকুতি! সমকালীন সাহিত্যের প্রেম-ভালোবাসা পিয়াসী আধুনিক মানব-মানবীর ভাষা থেকে এ ভাষার অবস্থান খুব দূরে নয়।

চন্দ্রাবতীকে তার পিতা অত্যধিক স্নেহ করতেন। চন্দ্রাবতী পিতার কাছে তার প্রেম ও প্রেমিকের কথা জানান। পিতা বংশীদাস কন্যার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যান জয়চন্দ্রের অভিভাবকের কাছে। শাস্ত্রীয় পঞ্জিকা গণনা করে দুই পরিবারের সম্মতিতে জয়চন্দ্র ও চন্দ্রাবতীর বিয়ের দিন, ক্ষণ ঠিক হয়। চন্দ্রা জয়চন্দ্রকে অত্যধিক ভালোবেসেছিলেন। তিনি জয়জয়ন্দ্রকে নিয়ে কতই-না স্বপ্ন দেখতেন। একটি পদে তিনি লিখেছেন:

“তোমারে দেখিব আমি নয়ন ভরিয়া।
তোমারে লইব আমি হৃদয়ে তুলিয়া।
বাড়ির আগে ফুইট্যা রইছে মল্লিকা মালতী।
জন্মে জন্মে পাই যেন তোমার মত পতি।”

চন্দ্রাবতী

কিন্তু এরই মাঝে ঘটে যায় এক নাটকীয় ঘটনা। বাল্যপ্রেমকে পদদলিত করে চঞ্চলমতি জয়চন্দ্র আরও একজনের প্রেমের জালে জড়িয়ে পড়েন। ব্রাহ্মণ শাস্ত্রবিৎ জয়চন্দ্র আসমানী নামে এক পরমা সুন্দরী মুসলিম রমনীর প্রেমে পড়েন। আসমানীও জয়চন্দ্রের সাথে প্রেমে জড়িয়ে পড়েন। দু’জনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবেন বলে স্থির করেন। ত্রিভূজ এই প্রেমের পরিণতিতেই চন্দ্রাবতী ইতিহাসে ভিন্নধর্মী এক স্থান করে নেন। জয়চন্দ্র আসমানীকে বিয়ে করতে চাইলে তাঁরা স্থানীয় মুসলিম কাজীর স্মরণাপন্ন হন। কাজী জানান, দুটি ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর মাঝে বিয়ে দেয়ার এক্তিয়ার তাঁর নেই। আসমানীর রূপে মুগ্ধ জয়চন্দ্র তখন কাজীকে জানান, তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহন করবেন; তবুও তাঁদের বিয়ে দেয়া হোক। জয়চন্দ্র ইসলাম ধর্ম গহন করেন এবং দু’জনের বিবাহ হয়ে যায়। জয়চন্দ্র সেইদিন আসমানীকে বিয়ে করেন যেদিন তার সাথে চন্দ্রাবতীর বিবাহের দিন, ক্ষণ আগে থেকেই স্থির করা ছিল।

সেদিন সন্ধ্যাবেলা চন্দ্রাবতী বিবাহের সাজে পিত্রালয়ে বসে ছিলেন। তখনই সংবাদ পেলেন জয়চন্দ্র ধর্মান্তরিত হয়ে আসমানীকে বিয়ে করেছেন। চন্দ্রাবতী ভেঙে পড়েন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে চন্দ্রা লিখেছিলেন:

“না কাঁদে না হাসে চন্দ্রা নাহি কহে বাণী।
আছিল সুন্দরী কন্যা হইল পাষাণী।।
মনেতে ঢাকিয়া রাখে মনের আগুনে।
জানিতে না দেয় কন্যা জ্বলি মরে মনে।।”

চন্দ্রাবতী

এরপর শুরু হয় চন্দ্রাবতীর বিরহ-বিধুর জীবন। শোকবিহ্বল চন্দ্রাবতী পিতার কাছে আর্জি পেশ করেন, আজীবন তিনি অনূঢ়া থেকে শিবের সাধনায় আত্মনিবেদন করতে চান। চন্দ্রবতী পালায় একথা এভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছে:

“অনুমতি দিয়া পিতা কয় কন্যার স্থানে
শিব পূজা কর আর লেখ রামায়ণে”

নয়ানচাঁদ ঘোষ


চন্দ্রাবতীর শিব মন্দিরটি বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত স্থাপনা। একই প্রাঙ্গনে বর্তমানে দুটি শিবমন্দির রয়েছে। অপেক্ষকৃত ছোটো মন্দিরটি চন্দ্রবতীর পিতা কর্তৃক নির্মিত বলে ধারণা করা হয়। শিব-মন্দিরটি অষ্টভুজাকৃতির। মন্দিরের উচ্চতা প্রায় ৩২ ফুট। এর বাহু সমূহের প্রতিটির দৈর্ঘ্য ৮ ফুট। মন্দিরের নিচতলায় আছে একটি কক্ষ ও তাতে প্রবেশের পথ। কক্ষের ভেতরে রয়েছে ৭টি কুলুঙ্গি। মন্দিরের দ্বিতীয় তলাতে আছে একটি প্রশস্ত কুলুঙ্গি এবং পোড়ামাটির সুদৃশ্য কাজ। দ্বিতীয় তলা থেকেই মন্দিরটি ক্রমশ সরু হয়ে ৩২ ফুট পর্যন্ত উচ্চতায় গিয়ে শেষ হয়েছে। এর চূড়ায় রয়েছে কলস ও লোহার দন্ড। ১৯৯০ এর দশকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মন্দিরটি সংস্কার করে। নির্মাণকালে এতদঞ্চলে ইটের তৈরী স্থাপনায় পলেস্তারার ব্যবহার প্রচলিত ছিল না। সংস্কারকালে ইস্টক-নির্মিত শিবমন্দিরে সিমেন্ট ও বালুর পালেস্তারা দেয়া হয়েছে। এর ফলে স্থাপনাটির আদি রূপ নষ্ট করা হয়েছে।[৪]

কবি চন্দ্রাবতীর মঠ সংলগ্ন জনৈক জমিদারের বাড়ি, ছবিসূত্র: সংগৃহীত

বংশীদাস ভট্টাচার্য ফুলেশ্বরী নদীর তীরে চন্দ্রার জন্য শিবমন্দির নির্মাণ করিয়ে দেন। শাস্ত্রজ্ঞানী চন্দ্রাবতীর কৈশোরকাল থেকেই সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ ছিল। তিনি বাকী জীবন বীতস্পৃহভাবে শান্তমনে শিবের উপাসনা ও সাহিত্যচর্চা করে কাটাবেন বলে স্থির করেন। তিনি বাংলায় রামায়ণ রচনায় মনোনিবেশ করেন। চন্দ্রাবতী রচিত রামায়ণকে অনেকে দুর্বল এবং অসমাপ্ত বলে আখ্যায়িত করেছেন। বস্তুত চন্দ্রাবতী রচিত রামায়ণ দুর্বল বা অসমাপ্ত কোনোটিই নয়। এটি এমন এক কাব্য যা রচনা করেছেন সেই নারী যিনি তাঁর প্রেমিক পুরুষ কর্তৃক প্রতারিত হয়েছেন নিষ্ঠুরভাবে। ফলত এখানে তিনি রামের গুণগান না করে সীতার দুঃখ ও দুর্দশার দিকটাই বেশি তুলে ধরেছেন যা তৎকালীন পিতৃতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধাচারণ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। ফলে তিনি অন্য পালার জন্য খ্যাতি পেলেও রামায়ণ রচয়িতা হিসাবে গুরুত্ব পাননি।

বিয়ের বেশ কিছুকাল পরে জয়চন্দ্র বাল্যপ্রেমিকা চন্দ্রাবতীর অভাব অনুভব করেন। তিনি বুঝতে পারেন, আসমানীর প্রতি তার মোহ ছিল তার রুপমাধুর্যের কারণে। অনুতপ্ত জয়চন্দ্র স্থির করেন যে চন্দ্রাবতীকে তাঁর মনের কথা জানাবেন। যদিও তিনি খুব ভালো করেই জানতেন যে, পুনরায় ধর্ম পরিবর্তন করে চন্দ্রাবতীকে বিবাহ করা (সেকালীন সমাজে) দুঃসাধ্য বটে।

এক সন্ধায় জয়চন্দ্র ও চন্দ্রাবতীর বিচ্ছেদ হয়েছিল জয়চন্দ্রের সাথে আসমানীর বিবাহের মাধ্যমে। অপর সন্ধায় সেই বিচ্ছেদ মুছে পুনরায় দু’জনের মিলন হবে দু’জনার– এই আশায় জয়চন্দ্র ফুলেশ্বরী নদী পাড়ি দিয়ে রওনা দিলেন চন্দ্রাবতী বাড়ি আভিমুখে। জয়চন্দ্র যখন গন্তব্যস্থলে পৌঁছলেন তখন দিন ও রাত্রির সন্ধিক্ষণ– সাঁঝ বেলা। শিব মন্দিরের অভ্যন্তরে দ্বার রুদ্ধ করে সন্ধ্যা আরতি ও তপ জপে নিজেকে নিবিষ্ট রেখেছেন চন্দ্রাবতী। জয়চন্দ্র মন্দিরের দ্বারে এসে চন্দ্রাবতীকে ডাকলেন। শিব-ধ্যানে আত্মহারা হয়ে চন্দ্রবতী জাগতিক জ্ঞান লুপ্ত হয়েছেন তখন। কিন্তু দ্বার রুদ্ধ থাকায় এবং একাগ্রমনে ধ্যানে নিমগ্ন থাকায় জয়চন্দ্রের ডাক চন্দ্রাবতী শুনতে পাননি। জয়চন্দ্র চন্দ্রাবতীর নিরবতাকে প্রত্যাখান ভেবে নিলেন। জয়চন্দ্র মন্দির প্রাঙ্গন থেকে লালবর্ণের সন্ধ্যামালতী ফুল তুলে ফুলের নির্যাস দিয়ে মন্দিরের দ্বারে একটি ‘পদ’ চন্দ্রাবতীকে উদ্দেশ্য করে লিখলেন:

“শৈশবকালের সঙ্গী তুমি যৌবনকালের সাথী
অপরাধ ক্ষমা কর তুমি চন্দ্রাবতী
পাপিষ্ঠ জানিয়ো মোরে না হইল সম্মত।
বিদায় মাগি চন্দ্রাবতী জনমের মতো।”

মন্দির থেকে বের হয়ে দরজার সম্মুখে মেঝেতে জয়চন্দ্রের ‘পদ’ পড়ে চন্দ্রাবতীর সংকল্পিত ব্রহ্মচর্য, অবিচলিত সংযম ও ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। অশ্রুসিক্ত বদনে তিনি পিতার কাছে বিধান চাইলেন। কন্যার মানসিক শিথিলতা মেটাতে বংশীদাস তাকে সান্তনা দিলেন,

“তুমি যা লইয়াছ মাগো সেই কাজ কর।
অন্য চিন্তা মনে স্থান নাহি দিও আর।”

চন্দ্রাবতীর মনে হলো দেবালয় কলুষিত হয়েছে। দ্বার পরিষ্কার করার জন্য তিনি কলসী কাঁখে জল আনতে যান পার্শ্ববর্তী ফুলেশ্বরী (স্থানীয় নাম ফুলিয়া) নদীতে। ঘাটে পৌঁছেই চন্দ্রাবতী বুঝলেন সব শেষ। ফুলেশ্বরীর জলে নিজেকে নিমগ্ন করে প্রাণত্যাগ করেছেন জয়চন্দ্র। প্রাণহীন দেহ ভাসছে ফুলেশ্বরীর জলে। এই অবস্থায় নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না চন্দ্রাবতী। তিনিও অচিরে প্রেমিকের সাথে পরলোকে চিরমিলনের কামনায় ফুলেশ্বরীর জলে ডুবে প্রাণত্যাগ করেন।

চন্দ্রাবতীর কাব্য: চন্দ্রাবতী রচিত গীতিকাব্য ময়মনসিংহ অঞ্চলে খুবই জনপ্রিয়। মৈমনসিংহ গীতিকায় তাঁর নিজের রচিত ‘মলুয়া’ গীতিকাব্য ‘দস্যু কেনারামের পালা’ উল্লেখযোগ্য গীতিকাব্য। চন্দ্রাবতী নিজের কাব্য ছাড়াও পিতা বংশীদাসের ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যের অনেকাংশ রচনা করেছিলেন। তাঁর জীবনের ট্রাজেডি নিয়ে রচিত লোকগাঁথা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অবিভক্ত ময়মনসিংহ জেলার মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়। চন্দ্রাবতী অজস্র লোকগীতি রচনা করেছেন। নৌকার মাঝির কণ্ঠে, ব্রতে, বিয়েতে এবং দৈনন্দিন গার্হস্থ্য জীবনে আজও শোনা যায় চন্দ্রাবতী রচিত পালাগান। ধর্ম নির্বিশেষে সকল শ্রেণির মানুষ গভীর রাত অবধি পালাকারদের উপস্থাপনায় পরিবেশিত চন্দ্রাবতী পালা শোনেন। তাঁর রচিত মলুয়া ও রামায়ণ এখনও ময়মনসিংহের গ্রামাঞ্চলের মেয়েরা বিবাহোপলক্ষে রাতব্যাপী পরিবেশন করেন।

ড. দীনেশচন্দ্র সেন ১৯৩২ সালে চন্দ্রাবতীর রামায়ণ প্রকাশ করেন। লৌকিক, মানবিক ও কিছু মৌলিক উপাদান সংযোগের ফলে এই রামায়ণ কাব্যটি বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছে। দীনেশচন্দ্রের মতে, মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর মেঘনাদবধ কাব্যের সীতা-সরমার কথোপকথনের অংশটি ‘চন্দ্রাবতীর রামায়ণ’ থেকে গ্রহণ করেছিলেন।[৫] মৈমনসিংহ-গীতিকায় তিনটি পালাগান চন্দ্রাবতী সংশ্লিষ্ট। মলুয়া, দস্যু কেনারাম আর চন্দ্রাবতী। এর মধ্যে প্রথম দুটি তাঁর রচনা। তবে মলুয়াতে কোনো কবির নাম নেই। গোড়ায় চন্দ্রাবতীর একটা বন্দনা রয়েছে। যে কারণে কোনো কোনো গবেষক মনে করেন যে গোটা পালাটিই চন্দ্রাবতীর রচনা। কিন্তু দীনেশচন্দ্র সেন এ বিষয়ে ভিন্ন মত পোষণ করেন। তাঁর মতে এই পালাটি চন্দ্রাবতীর লেখা নয়। তবে এই পালার কবি হিসেবে আর কারো দাবী না থাকায় এটিকে চন্দ্রাবতীর লেখা পালা হিসেবেই বহুল প্রচলিত হয়েছে। চন্দ্রাবতী পালাটি লিখেছেন নয়ানচাঁদ ঘোষ। এই পালাতেই চন্দ্রাবতীর জীবনের করুণ ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়েছে। এই পালাটিই বর্তমানে বাংলা সাহিত্যের চন্দ্রাবতীর জীবনীর তথ্যভিত্তিক লিখিত প্রামান্য দলিল।

তথ্যসূত্র:
১. হিমেল বরকত, “চন্দ্রবতী”, দৈনিক বণিকবার্তা, ৩১ জুলাই ২০১৬, ঢাকা, বাংলাদেশ
২. http://bn.banglapedia.org/index.php?title= P›`ªveZx
৩. লায়লা আফরোজ, “কবি চন্দ্রাবতী, ইতিহাসে উপেক্ষিত এক নিঃসঙ্গ দ্রাবিড়া” এইদেশ.কম, ০৯ ডিসেম্বর, ২০১৩, ঢাকা, বাংলাদেশ।
৪. সেলিনা হোসেন ও নুরুল ইসলাম সম্পাদিত; “বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান”, পৃষ্ঠা ১৫৭, ফেব্রুয়ারী, ১৯৯৭, ঢাকা,
৫. “কিশোরগঞ্জ জেলার ঐতিহাসিক ও দর্শণীয় স্থান”। ১৭ অক্টোবর ২০১৬, কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসন।
৬. বাংলার পুরনারী, দীনেশচন্দ্র সেন, অরুণা প্রকাশন সংস্করণ: ২০১১, কলকাতা, ইন্ডিয়া।

বি. দ্র. দর্পণে প্রকাশিত সকল লেখার স্বত্ব দর্পণ ম্যাগাজিন কর্তৃক সংরক্ষিত। দর্পণ থেকে কোনো লেখার অংশ অন্যত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে দর্পণের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক।

একই ধরনের লেখা

দর্পণে লিখুন

গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, মুভি পর্যালোচনা, বই আলোচনা, ভ্রমণ অথবা দর্পণের যে কোনো বিভাগে

লেখা পাঠানোর ইমেইল

editor@dorpon.com.bd
নিয়মাবলী জানতে ক্লিক করুন
ADVERTISEMENT
মাসওয়ারি
গল্প

কিছু নতুন

বাবাকে বেশি নকশামারা কথা বলার সুযোগ না দিয়েই রিঙ্কি সাফ জানিয়ে দিল সে টিনটিনা, দুবলা এবং বেকুবমার্কা এই ছেলেটাকেই বিয়ে

কবিতা

আত্মহনন না মৃত্যুদণ্ড?

কান্ত রায়ের কবিতা আত্মহনন না মৃত্যুদণ্ড? সেনোরিটার সাথে অনুষঙ্গের অপরাধে– এ মর্ত আমাকে মৃত্যু না হওয়া অবধি ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রাখার

অনেক আকাশ

গানের সুরের মতো বিকালের দিকের বাতাসে পৃথিবীর পথ ছেড়ে — সন্ধ্যার মেঘের রঙ খুঁজে হৃদয় ভাসিয়া যায় — সেখানে সে