সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার এবং আমরা

এবছর নোবেল কমিটি কথা দিয়েছিল সাহিত্যে নোবেল দেবার ক্ষেত্রে তারা ‘ইউরোপ’ থেকে বেরিয়ে আসবে। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি, তারা ইউরোপকে আরও আলিঙ্গন করেছে, ইউরোপকে জোড়া পুরস্কার দিয়েছে। যৌন নিপীড়নের জের ধরে একথা নিশ্চিত করেই বলা যাচ্ছিল– ২০১৮ ও ২০১৯-এর সাহিত্যে যাদের নোবেল দেওয়া হবে সেখানে একজন অন্তত নারী লেখকের স্থান থাকবে। তবে এ নিয়েও উঠছে প্রশ্ন, উপযুক্ত কাউকে কি নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে, ওলগা তোকারজুক কি উপযুক্ত? অনেক সমালোচকই মনে করেন পোলিশ লেখিকা ওলগা তোকারজুক নোবেল পাওয়ার মতো শক্তিশালী নন। আর অস্ট্রীয় লেখক পিটার হ্যাণ্ডকির বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তাতে করে নোবেল কমিটি আবারও চরম বিতর্কে পড়েছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গুরুতর, বস্তনিয়ায় মুসলিম গণহত্যার সময় সার্বিয়দের সাথে তার দহরম মহরম সম্পর্ক ছিল, এমনকি যুগোস্লোভ যুদ্ধের মূল যুদ্ধাপরাধী স্লোবোডান মিলোসেভিকের সাথে তার দারুণ ব্যক্তিগত সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। একারণে অনেকে তাকে বলে থাকে ‘মতাদর্শের দানব’।

এছাড়া আরও একটি বিষয় বারবার চলে আসছে, কয়েকবছর আগে এই পিটার হ্যান্ডকিই বলেছিলেন, ‘নোবেল কমিটি ভুল লোকদের নির্বাচন করে। এটার কোনো দরকার নেই। নোবেল পুরস্কারে প্রাপ্তি বলতে বোঝায় শুধু চার-পাঁচ পাতাজুড়ে পত্রিকায় খবর।’ এখন সমালোচকেরা বলছেন, ‘পিটার হ্যান্ডকিকে নোবেল দেওয়ার মাধ্যমে পিটার হ্যান্ডকির কথাই সত্য প্রমাণিত হলো।’

হ্যান্ডকি অবশ্য নোবেল পুরস্কার পাবার পর তার কথা ১৮০ ডিগ্রি কোণে ঘুরিয়ে নিয়েছেন, বলেছেন, ‘নোবেল কমিটি তাদের ভুল সংশোধন করেছে। আশা করি এখন থেকে নোবেল কমিটি তাদের এই ধারাটি বজায় রাখবে।’ ৭৬ বছর বয়স্ক এক ব্যক্তির এই বয়সে এমন প্রাপ্তি অনেক কিছু, তার হয়তো এখন সাহিত্যকে দেবার মতো উপাদান কমই আছে, তাই এই প্রাপ্তিকে আলিঙ্গন করা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির অংশ। এমনকি নোবেল প্রাপ্তির পর তার অনুভূতির কথা জিজ্ঞাসা করলে তিনি উল্লসিত হয়ে বলেছেন, ‘একজন লেখক জন্ম থেকেই দোষী। আজকের দিনে নিজেকে আর দোষী মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে আমি মুক্ত।’

এতসব কথা বলার একটাই কারণ, নোবেল পুরস্কার নিয়ে আমাদের বাংলাদেশি লেখকদের চিন্তাধারা কেমন সেই বিষয়েটা বিশ্লেষণ। প্রায় ১২০ বছর ধরে প্রতিবছর নোবেল পুরস্কার ঘোষিত হয় (ব্যতিক্রম ছাড়া), একজন করে লেখককে দেওয়া হয় সাহিত্যে নোবেল, আমরা বাংলাদেশি লেখকরা প্রতিবছর অপেক্ষায় থাকি কে নোবেল পাচ্ছে, পুরস্কার দেওয়া হলে তাদের গুণকীর্তন করি, তাদের সাক্ষাৎকার-সাহিত্যকর্ম অনুবাদের প্রতিযোগিতা বাধাই– কিন্তু একবারও ভাবি না আমাদের দেশে একটা সাহিত্যে নোবেল আসা উচিৎ। অনেকে আবার ভেবে বসে থাকেন, নোবেল পাওয়ার উপযুক্ত একজনই বাংলা সাহিত্যে ছিলেন, তিনি হলেন ভারতীয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ভারতীয় বলছি, এই কারণে যে, রবীন্দ্রনাথকে আমরা যতই জাতিগত ও ভাষাগত বিচারে আমাদের ভাবার চেষ্টা করি না কেন, এর মাঝে একটা মার্জিন রয়েই গেছে– রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় লেখক, বাংলাদেশী নন– দেশভিত্তিক নোবেলের তালিকার দিকে নজর দিলে আপনারা সেটা জানতে পারবেন।

সাহিত্যে নোবেলকে আমাদের কাছে এখন অবধি অধরাই মনে হয়। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের সময় আসলে একটি কথা খুব শোনা যায়, সেটা হচ্ছে ভালো লবিস্ট গ্রুপ ধরে মিলিয়ন ডলার খরচ না করলে নাকি সাহিত্যে নোবেল মেলে না। এদেশের দু’চারজন লেখক নাকি লবি-টবিও ইদানীং করে বেড়ায় বলে শোনা যায়। তবু কাজের কাজ হচ্ছে না।

নোবেল পুরস্কার যে কয়টি বিষয়ভিত্তিক ক্যাটাগরিতে দেওয়া হয়ে থাকে এগুলোর মধ্যে বোধ করি ‘সাহিত্য’ বিষয়টা নিয়ে এদেশের সবচেয়ে বেশি লোক কাজ করে। তবে, মাঝে মাঝে এই প্রশ্নও দেখা দেয়, এদেশের লেখকদের বেশিরভাগের লেখার মান যথেষ্ট নয়! সাধারণ অনেক পাঠকেরাও এমন একটা ভাবধারা পোষণ করেন। কিন্তু বিশ্বসাহিত্যের যেকোনো ভাষার সাহিত্যের সাথে তুলনা করলে বাংলা ভাষার সাহিত্যের অবস্থান খাটো করে দেখার কোনো উপায় নেই, এমনকি বর্তমান সময়ে যারা লেখালিখি করেন তাদের অনেকেই উঁচু মানের সাহিত্য লিখে যাচ্ছেন– তারপরও বাংলা সাহিত্য বিশ্বসাহিত্যে কেন ব্র্যান্ড ভ্যালু পাচ্ছে না? বিশ্বসাহিত্যে শক্তিশালী অবস্থান সৃষ্টি করতে হলে আমাদের তরুণ প্রজন্মের লেখকদের এখন থেকে সতর্ক হওয়া উচিৎ এবং নির্দিষ্ট পরিকল্পনামাফিক কাজ করা উচিৎ। তা না হলে বিশ্ব পরিমণ্ডলে আমাদের চিন্তাধারা বিস্তৃত করা সম্ভব হবে না। ক্রিকেট যেমন বাংলাদেশের ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিত, তেমনি বাংলা সাহিত্যেরও সুযোগ রয়েছে বিশ্ববাজারে তার অবস্থান তৈরি করার। এই বিষয়টিকে নিয়ে কখনো কেউ সিরিয়াসলি ভেবেছে কিনা আমার জানা নেই, তবে আমার প্রশ্ন, এখনও কি সেই ভাবনা ভাবার সময় আসেনি?

আমাদের সাহিত্য যে বিশ্ব দরবারে নিগৃহীত এর দায় লেখকদের আছে, বাংলা একাডেমির আছে, আছে সাহিত্য বিষয়ক সংগঠনগুলোর। দেশের লেখকদের আর্থিক অবস্থাও একটা বড় কারণ।

বিশ্বমঞ্চে আমাদের সাহিত্যকর্ম উপস্থাপনের জন্য সবার প্রথমে প্রয়োজন একজোট ভালো অনুবাদকের যারা বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করতে পারেন। একথা ভাবার কোনো উপায় নেই যে, ১৮ কোটির মানুষের দেশে ইংরেজিতে দক্ষ লোক একদমই নেই। অনুসন্ধান করলেই আপনারা পেয়ে যাবেন, তবে তাদেরকে যদি ২০০-৩০০ পাতার বই হাতে ধরিয়ে দিয়ে অনুবাদ করতে বলেন– তারা কেন করবে? উপযুক্ত পারিশ্রমিক না দিলে তারা এই কষ্টসাধ্য কাজ করবে না, একথা মেনে নিতে হবে। একথা মানছি অনেক দেশে এমন অনুবাদক আছেন যারা স্বেচ্ছায় অনেকের বই অনুবাদ করে থাকেন। তবে আমাদের বিষয়টা আলাদা, এদেশে সাহিত্যের অনুবাদক(বাংলা থেকে ইংরেজি) কম– এর একমাত্র কারণ আমরা এসব করার প্রয়োজনীয়তা কেউ কখনো অনুভব করি না। প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলে পথও বের করা এতদিনে সম্ভব হতো। এতদিনে বাংলা একাডেমির উচিৎ ছিল বাংলাদেশি লেখকদের বিখ্যাত বইগুলোর ইংরেজি অনুবাদের ব্যবস্থা করে তা বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করে বাংলা সাহিত্যের কথা বিশ্ববাসীকে জানানো।

একথা সত্য, অনুবাদ করার বিষয়টার গুরুত্ব অনেকে অনুভব করে থাকেন। তবে, এর পরের ধাপের কথা চিন্তা করে অনেকে কাউকে দিয়ে অনুবাদ করিয়ে নিতে সাহস পান না। অর্থাৎ প্রকাশক তারা কোথায় পাবেন? প্রকাশক পেতে হলে আপনাকে বিভিন্ন প্রকাশনীর কাছে আপনার পান্ডুলিপি পাঠাতে হবে, আপনি এখন ইমেইলযোগে অনেক প্রকাশনীতে আপনার লেখা পাঠাতে পারবেন। আপনি যদি প্রকাশকের সাথে যোগাযোগ করতে ব্যর্থও হন তার পরেও আপনারা আপনাদের অনুবাদ করা বই পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে পারবেন ‘সেল্ফ পাব্লিশিং’-এর মাধ্যমে। এরকম অনেক প্লাটফর্ম বর্তমানে রয়েছে, এর মধ্যে আমাজনের ক্রিয়েটস্পেস, স্ম্যাশওয়ার্ডস অন্যতম। এখানে বই প্রকাশ করলে আপনার বইটির ই-বুক ভার্সন কিংবা প্রিন্ট ভার্সন যে কেউ আমাজনের কাছ থেকে ক্রয় করতে পারবে– লভ্যাংশের ৭০% আপনি রয়েলিটি হিসেবে পাবেন, এছাড়া আপনার বইটি বিশ্বের বিভিন্ন অনলাইন লাইব্রেরিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে যাবে। এভাবে সেল্ফ পাবলিশিং-এর মাধ্যমে বই প্রকাশ করে এসময়ে অনেকে অর্থশালী ও নামকরা লেখকে পরিণত হয়েছে।

এসব আলোচনার মাধ্যমে একটা কথা বোঝাবার চেষ্টা করছি, আপনারা কী বিষয়টা অনুধাবন করতে পেরেছেন? সেটা হচ্ছে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার সবসময়ই কিছু না কিছু বিতর্কের সৃষ্টি করেছে, আর নোবেল কমিটি তাদের ইউরোসেন্ট্রিক ট্রমা থেকে বের হবে বলেও মনে হয় না, বের হলেও সাম্প্রতিক সময়ে জাপানের হারুকি মুরাকামিকে স্পর্শ করতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার কথা চিন্তা করলে প্রথমে তারা ভারতের কথা চিন্তা করবে, পুচকে বাংলাদেশের কথা তারা চিন্তা করবে বলে মনে হয় না। বাংলা সাহিত্যের কথা তো তারা চিন্তাই করবে না, কেননা এই সাহিত্যের বর্তমান অবস্থান কেমন সে সম্পর্কে তাদের বিশেষ কোনো ধারণা নেই বললেই চলে। তাই আমাদেরকে বিশ্বসাহিত্যে নিজেদের অবস্থান তৈরি করার দিকে মনোযোগ দিতে হবে।

আর একটা কথা, লেখকের ওসব পুরস্কার-টুরস্কার নিয়ে চিন্তা করা মানায় না। লেখকের কাজ লিখে যাওয়া এবং পাঠকের কাছে তা পৌঁছে দেওয়া। বৈশ্বিক পাঠকের কাছে লেখা পৌঁছে দেবার চেষ্টা করাও তার একটা কাজ হয়ে উঠতে পারে– যদি বিষয়টাকে তারা সেভাবে নেয়। আর এই কাজটি করতে সমর্থ হলে বলাও যায় না, একদিন হয়তো নোবেল কমিটি আপনাকে হঠাৎ করেই লবিং করা বাদেই নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করতে পারে। তখন অবশ্য আপনি মুক্ত অবস্থায় থাকবেন এমন সম্ভাবনা শতভাগ নেই, হয়তো তখন আপনি থাকবেন জেলখানায় বন্দি অথবা পরদেশে নির্বাসিত।


This is an original content which is written by a DORPON author. Copying and publishing any part of the content is strictly prohibited.

বি. দ্র. দর্পণে প্রকাশিত সকল লেখার স্বত্ব দর্পণ ম্যাগাজিন কর্তৃক সংরক্ষিত। দর্পণ থেকে কোনো লেখার অংশ অন্যত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে দর্পণের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক।

একই ধরনের লেখা

দর্পণে লিখুন

গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, মুভি পর্যালোচনা, বই আলোচনা, ভ্রমণ অথবা দর্পণের যে কোনো বিভাগে

লেখা পাঠানোর ইমেইল

editor@dorpon.com.bd
নিয়মাবলী জানতে ক্লিক করুন
ADVERTISEMENT
মাসওয়ারি
কবিতা

অঘ্রান প্রান্তরে

‘জানি আমি তোমার দু’চোখ আজ আমাকে খোঁজে না আর পৃথিবীর’ পরে- বলে চুপে থামলাম, কেবলি অশত্থ পাতা পড়ে আছে ঘাসের

সিনেমা

শাং­-চি এন্ড দ্যা লেজেন্ড অব টেন রিংকস: ভালো­-মন্দের লড়াই

এমন অনেক চলচ্চিত্র রয়েছে যা ভালো­-খারাপ, ফেরেশতা-­শয়তান এবং আরও অনেক দ্বন্দ্ব নিয়ে এসেছে। কিন্তু কিছু সিনেমার অনন্য গল্প এবং অনন্য

কবিতা

এইখানে এক শহর আছে

মৌমিতা তাসরিন প্রত্যয়ের তিনটি কবিতা: ‘এইখানে এক শহর আছে’, ‘বৈশাখী’, ‘আপোস’ এইখানে এক শহর আছে এই শহরের প্রতিটা সরু গোলির

হাসির গল্প

হেনতেন

অল্প বয়সেই আজিজের বাপ-মা মরে গেল। বুড়ো নানা আজিজকে এনে তাঁহার বাড়িতে রাখলেন। কিন্তু তার মতো দুষ্ট ছেলেকে সামাল দিবেন