সৌমিত্র চৌধুরী
ড. সৌমিত্র কুমার চৌধুরী ক্যানসার বিজ্ঞানি ও লেখক। বর্তমানে এমেরিটাস মেডিক্যাল সায়েন্টিস্ট (ICMR); চিত্তরঞ্জন জাতীয় কর্কট রোগ গবেষণা সংস্থায় কর্মরত। অধ্যাপনা ও দীর্ঘ আড়াই দশক কর্কট রোগ সংক্রান্ত গবেষণার পাশাপাশি বাংলা ভাষায় অসংখ্য গল্প কবিতা প্রবন্ধ ভ্রমণ আখ্যান এবং কয়েকটি উপন্যাস লিখেছেন। বহু বিদেশী গল্প ও কবিতা বাংলায় অনুবাদ করেছেন।
সৌমিত্র চৌধুরী

অর্ধেক দিনেই

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

অর্ধেক দিনেই


লেখক: নাগিব মাহফুজ

অনুবাদক: সৌমিত্র চৌধুরী 


বাবার ডান হাত ধরে পাশাপাশি হাঁটছিলাম। মাঝে মাঝে বাবার লম্বা পায়ের সাথে তাল মেলাতে দৌড়াতে হচ্ছিল। আমার ছোট পায়ে কালো জুতো। গায়ে নোতুন জামা কাপড়। সবুজ রঙের স্কুল পোশাক। মাথায় লাল ফেজ টুপি। আমার নোতুন পোশাকের আনন্দ ফিকে হয়ে যাবার মত অবস্থা। কারণ কোনো অনুষ্ঠানে যাবার দিন ছিল না ওটা। ছিল সেই বিশেষ দিন। আমাকে স্কুলে ঢুকিয়ে দেবার স্মরণীয় মুহূর্ত।

বাড়ির জানলা দিয়ে মা আমাদের এগিয়ে যাওয়া দেখছেন। বার বার আমি মায়ের দিকে তাকাচ্ছি যেন আমাকে স্কুল যাওয়া থেকে উদ্ধার করেন। আমরা একটা রাস্তায় এসে পড়লাম। পাশেই বাগান। রাস্তার দু’ধারে বড় ক্ষেতে শস্য ফলে আছে। নাশপাতি আর হেনা আর কিছু খেজুর গাছ দেখলাম।

‘আমাকে স্কুলে নিয়ে যাচ্ছ কেন?’ বাবার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়লাম। বললাম, ‘বাবা, তোমাকে আর কখনও বিরক্ত করবো না।’

‘তোমাকে কোনো শাস্তি দিচ্ছি না।’ বাবা হাসতে হাসতে বললেন, ‘শাস্তি দিতে কাউকে স্কুলে পাঠানো হয় না। স্কুল একটা কারখানা বুঝলে! বাচ্চাদের শিখিয়ে পড়িয়ে ওখানে বড় করা হয়। ওদের কাজের যোগ্য লোক বানানো হয়। তুমি দাদাদের মতো, তোমার বাবার মতো হতে চাও না?’

বাবার কথা মেনে নিতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল বাড়ি ঘর আর নিজের লোক থেকে আমাকে টেনে হিঁচড়ে বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। রাস্তার শেষ মাথায় বিশাল রুক্ষ এক প্রাসাদের মধ্যে বন্দী করে রাখলে আমার কোনো লাভই হবে না।

স্কুলের গেটে পৌঁছে ভিতরটা দেখতে পেলাম। বিশাল উঠান। অনেক ছেলে মেয়ে গিজগিজ করছে।

‘নিজেই এগিয়ে যাও।’ বাবা বললেন। ‘হাসি মুখে ওদের পাশে গিয়ে দাঁড়াও। অন্যেরা যেন ভালো বলে তোমাকে।’

আমি যেতে চাইছিলাম না। বাবার হাত শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিন্তু বাবা ধীরে ধীরে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলেন। বললেন, ‘মানুষ হও। আজ থেকে তোমার জীবন শুরু হোল। স্কুল ছুটি হোলে বাইরে এসে আমাকে দেখতে পাবে।’

কয়েক পা সামনে এগিয়ে আমি একটু থামলাম। তারপর পিছন ফিরে কাউকে দেখতে পেলাম না। সামনে মুখ ফেরালাম। সব মুখ গুলোই আমার অচেনা। ওরাও কেউ আমাকে চেনে না। মনে হোল আমি যেন পথ হারিয়ে এখানে এসে পড়েছি। কিন্তু লক্ষ করলাম কৌতূহলী চোখ গুলো আমাকে ঘিরে ফেলেছে। একটি ছেলে আমার কাছে এগিয়ে এসে বলল, ‘কে নিয়ে এল তোমাকে?’

‘আমার বাবা’। আমি ফিসফিস করে বললাম।

‘ওঃ’, ছেলেটি খুব সহজ ভাবে বলল, ‘আমার বাবা তো মরে গেছে’।

কী বলা উচিৎ আমি জানি না। দেখলাম স্কুলের গেট বন্ধ হয়ে গেল। একটা দুঃখ দুঃখ ভাব নেমে এল চারদিকে। কয়েকজন ছেলে-মেয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠল। স্কুলের ঘণ্টা বাজল। এক ভদ্রমহিলা এগিয়ে এলেন। তাঁর পেছনে কয়েকজন ভদ্রলোক। লোকগুলো শ্রেনী  অনুযায়ী আমাদের আলাদা করে দিল।

আমাদের নিয়ে তৈরি হোল জটিল এক আল্পনা। স্কুলের মাঠের তিন দিক ঘিরে উঁচু উঁচু বাড়ি। বহু তল বাড়ির প্রত্যেক তলা থেকে বেড়িয়ে আসা কাঠের ব্যালকনি থেকে আমাদের উপর নজর রাখা হচ্ছে।

সেই ভদ্রমহিলা উঁচু গলায় বললেন, ‘আজ থেকে এটাই তোমাদের বাড়ি। এখানেও তোমাদের বাবা-মা আছেন। জ্ঞান আর ধর্মের জন্য যা যা ভালো জিনিষ দরকার, সব এখানে পেয়ে যাবে। চোখের জল মুছে নাও। হাসি মুখে জীবনকে মোকাবিলা কর।’

আমরা তাঁর কথা মেনে নিলাম। মেনে নেওয়ার মধ্যে এক ধরনের স্বস্তি অনুভব করলাম। এক প্রাণ আরেক প্রাণের সান্নিধ্যে আসছে। প্রথম থেকেই আমি এখানকার ছেলেদের বন্ধু করে নিলাম। মেয়েদের ভালোবেসে ফেললাম। মনে হোল, আমি আগে যা ভেবেছি সবই ভুল। আগে ভাবতেই পারিনি যে স্কুলে এত কিছু পাবো। অনেক ধরনের খেলা আমরা একসাথে খেললাম। সাঁতার কাঁটা, ঘোড়া উল্টানো আর বল নিয়ে খেলা। সঙ্গীত কক্ষে আমরা প্রথম গান গাইলাম। ভাষা সম্পর্কে প্রথম ক্লাশ করলাম। গ্লোবের মধ্যে পৃথিবীর চেহারা দেখলাম। ওটা ঘুরালেই বিভিন্ন দেশ মহাদেশ দেখতে পাওয়া যায়। আমরা সংখ্যা শিখতে আরম্ভ করলাম। বিশ্বের স্রষ্টা কী ভাবে দুনিয়াটা তৈরি করলেন সেই গল্পও আমাদের পড়ে শোনানো হোল। এই জন্ম ও পরজন্মের কথা জানানো হোল আমাদের। বেশ ভালো খাবার দাবার খেয়ে কিছুক্ষণ ঘুমালাম আমরা। জেগে উঠে বন্ধুদের সাথে আরও কিছু পড়াশোনা খেলা আর ভাব ভালোবাসার মধ্যে সময় কাটালাম।

চলার পথ ধীরে ধীরে পরিস্কার হয়ে উঠছিল।পথ যে পুরোটাই সুন্দর ছিল তা নয়। মাঝে মাঝে মেঘ ঘনিয়েছিল। ধুলোর ঝড় উঠেছে পথে। আচমকা দুর্ঘটনা ঘটেছিল বহু। শিখেছিলাম সাবধান হতে হবে। আর জেনেছিলাম চলার পথে ধৈর্য একান্ত দরকার। জীবন মানে শুধু খেলা আর মজা নয়। বন্ধুদের পরস্পরের মধ্যে রেষারেষি হত, সেই থেকে মারামারিও। ফলে মনের মধ্যে বাড়ত দুঃখ আর ঘৃণা। স্কুলের ভদ্রমহিলা মাঝে মাঝে হাসি মুখ নিয়ে তাকাতেন। আবার তাঁর চোখ রাঙ্গানি আর বকা ঝকাও খেতে হত। মাঝে মাঝে শারীরিক নির্যাতন করতেন তিনি।

এর মধ্যে মনের যা পরিবর্তন ঘটবার ঘটে গেছে। নিজেদের বড় আপন যে বাড়ি সেখানে যাবার কথাও কেউ তুলতো না। আমাদের সামনে শুধু লড়াই। ধৈর্য নিয়ে চেষ্টা করে যাওয়া। তার মধ্যে যারা যোগ্য তারা সুযোগের সদ্ব্যবহার করে সাফল্যের মুখ দেখল। অনেক দুঃখের মধ্যেও সুখ আর সাফল্য জুটল তাদের কপালে।

ঘণ্টা বাজল। ছুটি। সেই সঙ্গে দিনের সমাপ্তি। ছেলেরা চিৎকার করতে করতে গেটের দিকে ছুট লাগাল। স্কুলের বন্ধ দরজা আবার খুলে গেল। বন্ধু-বান্ধবীদের বিদায় জানিয়ে আমিও খোলা দরজা দিয়ে বেড়িয়ে এলাম। চারদিকে তাকালাম। কিন্তু বাবাকে কোথাও দেখতে পেলাম না। বাবার তো স্কুল গেটের বাইরে উপেক্ষা করবার কথা। আমি খানিক দূরে সরে এসে বাবার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইলাম। দীর্ঘ অপেক্ষার পর যখন বাবাকে দেখতে পেলাম না, আমি একা একা রাস্তা চিনে বাড়ি চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম।

কয়েক কদম এগোনোর পর পথ চলতি এক মধ্যবয়সী লোক নজরে এল। মনে পড়ল আমার পরিচিত উনি। আমার দিকে এগিয়ে এসে করমর্দন করলেন। তারপর বললেন, ‘অনেক দিন পরে তোমাকে দেখছি। কেমন আছ?’

আমিও মাথা নাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি কেমন আছেন?’

‘এই যেমন দেখছো! আল্লা মেহেরবান।’ উনি বললেন, ‘তেমন ভালো নেই বুঝলে!’

উনি আরেকবার আমার সাথে হাত মিলিয়ে বিদায় নিলেন। তারপর আমি হাঁটতে লাগলাম। একটু পরে একদম অবাক হয়ে গেলাম। হায় আল্লা! কোথায় গেল সেই বাগানের ধার ঘেঁষে তৈরি সুন্দর রাস্তা? কেমন করে হঠাৎ উধাও হয়ে গেল! এত এত গাড়ি কোথা থেকে এল! রাস্তায় এত লোক। এই বিপুল জনস্রোত! পথের পাশে এত আবর্জনা কবে জমে উঠল? সেই ফাঁকা মাঠটাই বা কোথায় গেল? বড় বড় ইমারত উঠে গেছে পথের দু-পাশে। অসংখ্য বাচ্চা ছেলে রাস্তায়। বিকট শব্দে বাতাস ভরে উঠেছে। রাস্তা জুড়ে হরেক বাজিগর খেলা দেখাচ্ছে। ঝুড়ির ভিতর থেকে সাপ বের করে আনছে। বড় একটা গানের দল নোতুন সার্কাস শুরু হবে, তার বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। জোকার আর ভার উত্তোলনকারী যুবকেরা তাদের সামনে দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। কেন্দ্রীয় সুরক্ষা বলের সৈনিকদের নিয়ে অনেক গুলো ট্রাক রাজকীয় ভঙ্গীতে এগিয়ে গেল।

দমকলের সাইরেন বাজছে তীক্ষ্ণ স্বরে। বোঝা গেল না কেমন করে রাস্তার প্রচণ্ড ভিড় ঠেলে দমকলটি অকুস্থলে আগুন নেভাতে পৌঁছাবে। জোর ঝগড়া লেগেছে যাত্রীর সাথে ট্যাক্সি ড্রাইভারের। যাত্রী মানুষটির স্ত্রী সাহায্যের জন্য চিৎকার জুড়ে দিয়েছে। কিন্তু তার ডাকে সাড়া দিচ্ছে না কেউ। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। হতবুদ্ধি অবস্থা। হায় আল্লা! মাথা ঘুরছে আমার। পাগল পাগল লাগছে। হঠাৎ একদিনে এত সব পরিবর্তন! সকাল থেকে সন্ধ্যে এর মধ্যে সব বদলে গেল? বাড়িতে গিয়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করলে হয়ত উত্তর পাবো। কিন্তু হায়রে! কোথায় আমার বাড়ি? চারদিকে গিজগিজ করছে মানুষ আর অসংখ্য বহুতল। আমি দ্রুত পৌঁছে গেলাম বাগান আর আবু খোদার (কায়রোর রাস্তা) ক্রসিঙে। রাস্তায় সাঁই সাঁই গাড়ি ছুটছে। রাস্তার ওপারে যাবো কী করে? বাড়ি পৌঁছাতে আবু খোদা তো পার হতেই হবে। দ্রুত ধাবমান গাড়িগুলোর মধ্য দিয়ে রাস্তা পেরনো তো অসম্ভব। দমকল এগোচ্ছে শামুকের গতিতে। দ্রুত এগোবার জন্য জোরে জোরে ঘণ্টি বাজাচ্ছে। নিজেকে বললাম, দমকলের দেরী হচ্ছে হোক। আগুন যত খুশী পুড়িয়ে যাক। সব কিছু খাক হয়ে যাক।

আমি খুবই বিরক্ত হয়ে উঠেছি। কখন বাড়ি পৌঁছাবো? রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি অনেকক্ষণ। রাস্তার কোণার ধোবিআলার দোকানের এক ছেলে আমার কাছে এসে দাঁড়াল। ও উৎফুল্ল ভঙ্গিতে আমাকে বলল, ‘দাদু, চল তোমাকে রাস্তাটা পার করিয়ে দিই।’


***সমাপ্ত***


[লেখক পরিচিতিঃ নাগিব মাহফুজ (Naguib Mahfouz) ভিন্ন উচ্চারণে নাজিব মাহফুজ (১১.১২.১৯১১-৩০.০৮.২০০৬) নোবেল পুরষ্কারে সম্মানিত মিশরের বিখ্যাত লেখক। আরব দুনিয়ায় তিনিই প্রথম নোবেল পুরষ্কার পান। অসংখ্য ছোট গল্প (৩৫০) লিখেছেন তিনি এবং উপন্যাসও লিখেছেন বহু (৩৪)। নাটক লিখেছেন অনেক। লিখেছেন বহু চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য। তাঁর অনেক উপন্যাস মিসর তথা বিভিন্ন দেশে চলচিত্রায়িত হয়েছে। নাগিব মাহফুজ ১৭ বছর বয়স থেকে লেখালেখি শুরু করেন। প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয় ১৯৩৯ সালে। পরবর্তী উপন্যাস ‘কায়েরা ট্রিলজি’, (১৯৫৫ থেকে ১৯৫৭ সালের মধ্যে প্রকাশিত) আরব সাহিত্যকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। উপন্যাসে তুলে ধরেন ইংরেজ শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার সময়কালে তাঁর দেশের অবস্থার কথা। ঐতিহাসিক শহর  মিশরের গরীব ও মধ্যবিত্তের জীবনধারা নিপুণ ভাবে লিখেছেন তিনি। ‘কায়রো ট্রিলজি’ উপন্যাসটির স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি  সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান (১৯৮৮)। নাগিবের উপন্যাসের প্রায় অর্ধেকেরও বেশীর চলচ্চিত্রায়ন হয়েছে। বর্তমান গল্পটি, হাফ এ ডে (Half a day) দেশ বিদেশে খুবই জনপ্রিয়।]


 

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu