জাতিসংঘের কাজে নিয়োজিত থাকাকালে ২০১০ সালে আমার সাইপ্রাসে যাবার সৌভাগ্য হয়। একবার নয়, কয়েকবার। প্রত্যেকবারই কমপক্ষে সাতদিন অবস্থান। জাতিসংঘের গাড়ি থাকার কারণে ঘোরাফেরা করতে কোনো অসুবিধা হয়নি। এ কারণে সাইপ্রাসের ছ’টি জেলার প্রায় প্রতিটি উল্লেখযোগ্য স্থানেই যাওয়া সম্ভব হয়েছে।
সাইপ্রাস ভূমধ্যসাগরের বুকে একটি ছোট দ্বীপ রাষ্ট্র। অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন, শোভাময় এবং অরণ্য পর্বতবেষ্টিত এক সুদৃশ্য নন্দনকানন। এটি দক্ষিণ পূর্ব ইউরোপের সর্বশেষ সীমায় অবস্থিত। দেশটি তুরস্কের ৭০ কি.মি. দক্ষিণে, সিরিয়া উপকূলের ১০০ কি.মি. পশ্চিমে এবং গ্রীসের ২৭০ কি.মি. দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। আয়তন ৯২৫১ বর্গ কি.মি. । বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ১৪ লক্ষ। বারবার দেশটিতে ঘুরে বেড়ানোতে জানা গেছে এর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তের দৈর্ঘ্য ২২৫ কি.মি. এবং প্রস্থ ৯৪ কি.মি.। মাথাপিছু আয় ৩১,২৫০ ইউএস ডলার (২০১৮)। স্বাস্থ্যসম্মত আবহাওয়া এবং চমৎকার নৈসর্গিক দৃশ্যাবলির কারণে এখানে সারা বছর পর্যটকের ভিড় লেগেই থাকে। দেশটির সর্বত্র সবুজ শ্যামলিমা। পথে-ঘাটে রাস্তার দু’পাশে প্রায়শ আগাছার ন্যায় আঙুরলতা গাছ ছড়িয়ে আছে। চাষকৃত আঙুর বাগানসহ রয়েছে প্রচুর রসনারোচক ফল— স্ট্রবেরি, তীন, চেরি, মাল্টা, কমলা, আপেল কিংবা অলিভ। ছোট এই দ্বীপবাসী সকল মানুষের চোখে-মুখে দেখেছি সন্তোষের আভা, শান্তির সুস্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ। এছাড়া সেখানে রয়েছে অসংখ্য প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য এবং সেদেশের মানুষের প্রথাগত আতিথেয়তা। সাইপ্রাসের যেখানে গেছি সেখানেই পেয়েছি বাংলাদেশি যুবক ছেলেদের। এ কারণে কোনো দর্শনীয় স্থান দেখতে গেলে বাঙালি ছেলেদের সঙ্গে নিয়ে গেছি। রাষ্ট্রভাষা ইংরেজি হবার কারণে এখানকার সবাই এ ভাষায় সাবলীল কথা বলতে পারে।
সাইপ্রাসে তেমন কোনো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই। রাজধানী নিকোশিয়ায় একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও সেখানে শিক্ষার গুণগত মান আশাব্যঞ্জক নয়। আর সারাদেশে রয়েছে ৬ টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ প্রতিদিন আমাদের দেশের অধিকাংশ দৈনিক নিউজ পেপারে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়— উচ্চশিক্ষার্থে সাইপ্রাস গমন করুন। দ্বীপ দেশটিতে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলোর মধ্যে বিদেশী শিক্ষার্থীরা সাধারণত হোটেল ম্যানেজমেন্ট, হোটেল মেইনটেন্যান্স, এয়ার হোস্টেস ইত্যাদি বিষয়ের ওপর ডিপ্লোমা সম্পন্ন করে থাকে।
একদিন নিকোশিয়া থেকে লিমাসল যেতে খালিদ নামের একজন প্রবাসী বাঙালি ছেলে আমার সহযাত্রী হয়।
সে জানায়, ‘আমি মিলোনিয়াম ইয়ারে এখানে এসেছি। আমার এসএসসি এবং এইচএসসি দুটোতেই স্টার মার্কস ছিল। কিন্তু এখানে পড়াশুনার জন্য উচ্চশিক্ষার জায়গা নেই। যেহেতু ৬ লক্ষ টাকা খরচ করে এসেছি ফিরে যাই কীভাবে! এজন্য হোটেল ম্যানেজমেন্টের ওপর শিক্ষা গ্রহণ করছি। ১০ বছরেও ইচ্ছে করে পাশ করিনি। পাশ করলেই দেশ থেকে বের করে দেবে। যদিও প্রতিমাসে কলেজে ৩০০ ইউরো দিতে হয়।’
জানতে চাইলাম, ‘এত টাকা জোগাড় কর কীভাবে?’
সে জানায়, ‘দিন-রাত পার্টটাইম কাজ করে আমি এখন কমপক্ষে ২০০০ ইউরো আয় করতে পারি। সবমিলে খরচ হয় ৬ থেকে ৭ শ ইউরো। অবশিষ্ট ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের মাধ্যমে দেশে পাঠাই।’
খালিদের মতো অধিকাংশ ছেলেরা এখানে ভাল আছে। বাঙালি শিক্ষিত স্টুডেন্টগণ দ্রুত ইংরেজি শেখার ফলে হোটেলে কাজ করতে তাদের কোনো সমস্যা হয় না। ছোট দেশটিতে রয়েছে প্রায় দুই হাজার আবাসিক হোটেল এবং শতশত নাইট ক্লাব।
পথ প্রদর্শনের জন্যে খালিদকে সঙ্গে নিয়ে চলতে থাকলে এক জায়গায় পৌঁছুলে সে জানায়, নিকটেই ʻকোরিও হোম’— মনোরম দর্শনীয় স্থান। মাঝে কিছু সময়ের জন্য যাত্রা বিরতি করে দেখতে যাই কোরিও হোম দূর্গ। প্রাচীন রাজন্যবর্গ ও সামন্ত প্রভূদের মনোরঞ্জনের জন্য অনুষ্ঠিত প্রাণপণ যুদ্ধের মল্লভূতি। এতে অংশগ্রহণ করত কঠোরভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ক্রীতদাসগণ ও সিংহ। একইদিন কোরিও হোম পরিদর্শনে এসেছিল তুরস্কের একটি স্কুলের শিক্ষার্থীগণ। তাদের সাথেও আমরা কুশল বিনিময় করি। পুরনো দিনের বড় বড় পাথরের চাঁই দিয়ে তৈরি করা হয়েছে দুর্গটি এবং মল্লযুদ্ধ উপভোগের জন্য আসনগুলি। Basically Kourio Home means where the kings of ancient used to enjoy brutal fighting of Gladiators and lion in this castle. কোরিও হোম দর্শন শেষে খালিদকে নিয়ে যাই লিমাসল বন্দরে। লিমাসল বিশ্বের অন্যতম সেরা আন্তর্জাতিক সমুদ্র বন্দর। এই বন্দরে রয়েছে বেশ ক’টি মেরিনা, সি-বিচ, জাহাজ মেরামত কারখানা। এছাড়াও সেখানে রয়েছে সুরম্য অট্টালিকায় আধুনিকতার ছোঁয়াসহ প্রাচীনকালে ব্যবহৃত আসবাবপত্র এবং শিল্পকর্মের দোকান। রয়েছে বিস্তর আবাসিক হোটেল এবং নাইট ক্লাব।
২০১১ সালের প্রথমদিকে আবার সাইপ্রাসে যাই। এবার নিকোশিয়ায় না থেকে অবস্থান গ্রহণ করি লিমাসলে। এখানেও প্রবাসী বাঙালি ছাত্র প্রচুর। প্রতিদিনই তাদের সাথে পরিচয় হয়, কথা হয়। কারো কারো সাথে একত্রে ঘুরে বেড়াই । একদিন গালিবের সঙ্গে পরিচয় হয়, সাথে তার শ্বেতাঙ্গিনী স্ত্রী রাশা। রাশা লিথুয়ানিয়ার অধিবাসী। বুলগেরিয়া, বেলারুশ এবং বাল্টিক সাগর তীরবর্তী দেশ এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়ার ছেলেমেয়েরা এখানে এসেছে নামমাত্র পড়াশুনা এবং জীবিকার প্রয়োজনে। আর এসেছে প্রাচ্যের কিছু ছেলেমেয়েসহ শিক্ষার্থী হিসেবে বাঙালি ছেলেরা। বাংলাদেশ থেকে আগত কমপক্ষে ৫% ছেলেরা বাল্টিক অঞ্চলীয় মেয়েদের সাথে বৈবাহিকসূত্রে জড়িয়ে পড়ে। ইউরোপীয় মেয়েদের বিয়ে করতে পারলে পরবর্তীতে ওয়েস্টার্ন কান্ট্রিতে যেতে কিংবা সেখানে কাজ পেতে কোনো বাধা থাকে না। উল্লেখ্য যে, কোনো বাঙালি স্টুডেন্ট ইচ্ছে করলে সহজেই প্রাচ্যের মেয়েদের বিয়ে করতে পারে।
গালিব এবং তার স্ত্রী রাশাকে সঙ্গে নিয়ে এবার যাই লারকানা জেলার লারকানা সল্টে। যেখানে রয়েছে ঐতিহাসিক সমাধি শিলা। সুমহান ইসলামের পবিত্র নিদর্শন। মহানবী (সঃ) এর একজন অন্যতম মহিলা সাহাবী হজরত উম্মে হারাম (রাঃ) এর মাজার শরীফ। এখানে মাজার শরীফে নেই কোনো খাদেম, দানবাক্স কিংবা আগরবাতি-মোমবাতি বাণ্যিজের অবাধ প্রসার। হজরত উম্মে হারামকে মহানবী (সঃ) খালা বলে সন্বোধন করতেন । হজরত ওসমান (রাঃ) এর খেলাফতকালে সিরিয়ার শাসনকর্তা হজরত আমির মুয়ারিয়া খলিফার অনুমতিক্রমে একটি শক্তিশালী নৌ বহরের সাহায্যে সাইপ্রাস আক্রমণ করেন। ৬৪৯ সালের সেই অভিযানে নৌ সেনাপতি আবদুল্লাহ বিন কায়েসের নেতৃত্বে সাইপ্রাস অধিকৃত হয়। মুসলিম নৌ বহরের নৌ সেনাদলে স্বামীর সাথে হজরত উম্মে হারামও ছিলেন। দখলকৃত সাইপ্রাসের লারকানার সন্নিকটে ঘোড়ার পিঠের ওপর থেকে পড়ে এই মহীয়সী রমণী শহীদ হন । নৌ যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী মহিলাদের মাঝে তিনিই সর্বপ্রথম শাহাদাৎ বরণ করেন। পরবর্তীতে লারকানা সল্টে তাকে সমাহিত করা হয়। সমুদ্রের সন্নিকটে তার পবিত্র সমাধিসৌধ । মাজারসহ তৎসংলগ্ন মসজিদটির নির্মাণশৈলী নান্দনিক সৌন্দর্যে ভরপুর। অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন পারিপর্শ্বিকতায় মনোরম পরিবেশে। সেখানে গেলে দেহ-মনে অনাবিল প্রশান্তি নেমে আসে। প্রতিদিন শতশত পর্যটক এই সমাধিফলক পরিদর্শনে আসে। সেদিন গালিব এবং তার বিদেশি স্ত্রীসহ আমরা মাজার জেয়ারত করি।
পরদিন আবার গালিব দম্পতিকে নিয়ে বের হই। যাই লব্ধপ্রতিষ্ঠ, বিখ্যাত ওয়াইন ভিলেজে। হাজার হাজার বছর ধরে এই গ্রামের লোকেরা ওয়াইন তৈরি করে বাজারজাত করে। ওয়াইন ভিলেজের নাম ওমোডস। এই ওমোডসের প্রতিটি পরিবারই যারপরনেই অতিথিপরায়ণ। আমরা যেখানেই গেছি সেখানেই আপ্যায়িত হয়েছি। কেউ সেখানে গেলে নানা প্রকরণের লাইট রিফ্রেশমেন্ট দিয়ে সমাদর করে। এই মনোমুগ্ধকর গ্রাম এবং এর প্রতিটি পরিবারের ঐতিহ্যগত আতিথেয়তায় আমরা মুগ্ধ হয়েছি।
ওমোডস ভিজিটের পর ফেরার পথে একই দিন ফামাগুস্তা গেইটের নিকট পোডাকাট্রোতে দৃষ্টিনন্দন লিবার্টি মনুমেন্ট দেখার সুযোগ হয়। স্বাধীনতা/মুক্তি স্মৃতিস্তম্ভ ১৯৭৩ সালে নির্মিত হয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সচেতন জনতা বিদ্রোহ করলে ইংরেজ সরকার তাদেরকে গণহারে কারাগারে শাস্তির ব্যবস্থা করে। ব্রিটিশ শাসন অবসানের পরিসমাপ্তিতে ১৯৫৯ সালে স্বাধীনতাকামীদের কয়েদখানা থেকে মুক্তি দেয়া হয়। বন্দিশালা থেকে মুক্তির স্মৃতি রক্ষার্থেই চিত্তাকর্ষক স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়।
ভূমধ্যসাগরের টিপ (তিলক) সাইপ্রাস দ্বীপ। এখানে রয়েছে— নিকোশিয়া, লিমাসল, লারকানা, পাফোস, কেরিনিয়া এবং ফামাগুস্তা নামে ছ’টি জেলা। আর সব জেলাতেই রয়েছে প্রচুর ঐতিহাসিক অতীত নিদর্শন, অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং আধুনিক স্থাপত্যের ছোঁয়া। একবার সাইপ্রাস ভ্রমণ করলে আপনার বারবার যেতে ইচ্ছে করবে। সেদেশের আকর্ষণীয় নৈসর্গিক লাবণ্য, নিরুপদ্রব চলাফেরা, মানুষের অবাধ কর্মচাঞ্চল্য এবং সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব আপনাকে নিরন্তর আকর্ষণ করবে।