প্রশ্ন: শিক্ষকতার পাশাপাশি লেখালিখি বিষয়টা আপনি কতটুকু উপভোগ করেন?
মেহেদী ধ্রুব: আসলে আমি শিক্ষকই হতে চেয়েছি। শিক্ষক হবো, লেখালেখি করবো, পড়াশুনা করবো এটা বলা চলে আমি আমার পরিবার থেকেই পেয়েছি– ছোটবেলায় দেখেছি আমার বড় ভাই বই পড়ে– সেখান থেকে আমার বই পড়া, তারপর শিক্ষকদের প্রতি আমার ভালো লাগা– এটা ছিল একদম শুরু থেকেই। আর শিক্ষকতার সাথে থাকলে বইয়ের পাশাপাশি থাকা যায়, ছাত্রদের পড়ানো যায়, নিজে পড়া যায়, চর্চাটা থাকে এই কারণে বিষয়টা উপভোগ্য।
প্রশ্ন: লেখালিখির ভূত আপনার মাথায় কবে থেকে চেপেছে?
মেহেদী ধ্রুব: এটা মূলত হচ্ছে… আচ্ছা ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ টানি, সেটা হচ্ছে– আমি যখন ক্লাস নাইনে পড়ি তখন আমার মা মারা যান, ক্লাস টেনে থাকতে বাবা মারা যান। আমি পরিবারে সবার ছোট ছিলাম। বড় ভাইয়েরা দেশের বাইরে, বোনদের বিয়ে হয়ে গেছে; আমি সেই মূহুর্তে একা। এমন একটা নিঃসঙ্গতা থেকেই আমার মাঝে একরকম ভাবনা কাজ করত সবসময়। ভাবনা যখন কাজ করে, তখন এটাকে প্রকাশ করার একটা মাধ্যম চাইতাম। তখন দেখা গেল আমি বই পড়ছি, সাথে সাথে কিছু লেখারও চেষ্টা করছি– আমার কষ্টগুলো, বেদনাগুলো। প্রথমে কবিতা দিয়ে শুরু তারপরে ইউনিভার্সিটিতে ওঠার পর থেকে গল্প লেখা শুরু করি।
প্রশ্ন:: আপনার প্রথম গল্পগ্রন্থ “মেঘ ও মানুষের গল্প” গ্রন্থের ভিন্ন ভিন্ন গল্পে দেখা গেছে মিথের প্রয়োগ, এটার কারণ কী?
মেহেদী ধ্রুব: আসলে আমাদের গ্রামে কিছু মিথ আছে। ছোটবেলা থেকেই আমি আমার দাদু, নানু, চাচা বা এলাকার মুরুব্বি যারা আছেন তাদের কাছে গল্প শুনতে পছন্দ করতাম। এটাকে কিচ্ছা বলে আমাদের গ্রামে। গল্পে উল্লেখিত মিথগুলো আমার নিজ কানে শোনা। আমার গল্পগুলোর মধ্যে দেখবেন, দিঘি নিয়ে একটা গল্প আছে ‘জলকূয়া’ নামে। ওই যে দিঘি, ওই দিঘিতে ছোটবেলায় ভয়ে আমরা নামতাম না। ওই দিঘি নিয়ে প্রচুর গল্প ছিল। দিঘিটা একসময় মান্দাইদের ছিল, এরপর আরেকজনের হাতে আসলো, এই যে পর্যায়ক্রমের যে বিষয়টা এটা আমার দেখা। এখনো দিঘিটা আছে। আমার একসময় মনে হয়েছে এটা নিয়ে একটা গল্প হতে পারে। ‘রূপকথার পরের কথা’ নামে দেখবেন একটি গল্প আছে, এতে দেখবেন পুঁথি তসর, পুঁথি তসর হচ্ছে আমার দাদার বন্ধু। আমরা ঊনাকে দাদা বলতাম, ঊনি মুক্তিযুদ্ধের সময় পুঁথি বানাতেন বলে শুনেছি। ঊনি যখন মারা গেলেন, খুব সুন্দর একটা জায়গাতে ঊনাকে কবর দেওয়া হয়, খুব দামী জমিতে। পরে দেখা গেছে এমন একটা জায়গাটাতে কেন মাটি দেওয়া হলো, সেটা নিয়ে মানুষে এখন আফসোস করে। বলে, এমন একটা দামী জায়গায় মাটি দেওয়া হয়েছে কেন! এসব কিছুই হচ্ছে আমার দেখা।
প্রশ্ন: দেখা গেছে আপনি এই মিথগুলো রূপকতার মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন আপনার গল্পে, এই রূপকতার সঙ্গে আপনার পাঠকেরা সম্পূর্ণভাবে কানেক্ট হতে পারবে বলে কী আপনার মনে হয়?
মেহেদী ধ্রুব: অনেক গল্পে দেখা গেছে আমি যেটা বলতে চাচ্ছি বা বোঝাতে চাচ্ছি সেটা সংখ্যা দিয়ে বা অন্যকিছু দিয়ে বলেছি। অনেকসময় হয়তো পাঠকরা কানেক্ট হতে পারবেন না কিন্তু এটা না পারলেও একটা গল্প পড়ার পরে পাঠকের যে অনুভূতি– একটা গল্প পড়লাম, এই টেস্টটা অন্ততপক্ষে পাঠক পাবেন। ওই ম্যাসেজটা যদি কেউ ধরতে নাও পারেন, তবু গল্পের যে রস– সেটা থেকে মনে হয় পাঠকরা বঞ্চিত হবেন না।
প্রশ্ন: “মেঘ ও মানুষের গল্প” আপনার প্রথম গল্পগ্রন্থ বা প্রথম গ্রন্থ, এটা প্রকাশিত হবার পেছনের গল্পটা কী?
মেহেদী ধ্রুব: শুরু থেকেই বলি। ২০০৯ থেকে মূলত সিরিয়াসলি আমার গল্প লেখা শুরু। ২০১১-তে রাজশাহী থেকে প্রকাশিত চিহ্ন-তে আমার একটি গল্প আসে। এর আগেও লেখা হয়েছে তবে কোনো পত্রিকাতে আসেনি। এরপর থেকে নিয়মিতভাবেই আমার গল্প বিভিন্ন মাধ্যমে আসছে। প্রথম প্রকাশিত গল্পটার নাম ছিল “স্বপ্রতিভ”। এটা এখনো গ্রন্থভুক্ত হয়নি। ২০১৪-১৫ সালের দিকে আমার বেশকিছু গল্প হয়ে গেছে, ৭-৮ টার মতো গল্প, আমার স্যারসহ অনেকে বললেন, তুমি ভালোই লিখছো, তোমার সম্ভাবনা আছে, তুমি একটা গ্রন্থ বের করো। কিন্তু আমার কাছে তখন মনে হত, আমি যে বই বের করবো এতে আমি নতুন কী দিতে পারছি বা আমি কি কোনো স্টাইল তৈরি করতে পেরেছি বা মনে হত, আমি আমার নিজের পথ তখনো তৈরি করতে পারিনি। আমার কাছে মনে হয়েছে, আমার আরও সময় নেওয়া দরকার। সেকারণে আমি সময় নিয়েছি। এখন আমার কাছে মনে হয়েছে, আমার গল্পের একটি প্যাটার্ন আছে, আমি আমার পথ খুঁজে পেয়েছি।
প্রশ্ন: দেখা যাচ্ছে আপনি ২০০৯ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত ৭-৮ টার মতো গল্প লিখেছিলেন, আপনি তাহলে দ্রুত সময়ের ভিতর আপনার একটি গল্প শেষ করেন না, আপনি ধীরগতিতে লিখে থাকেন, তো আপনার একটা গল্প লিখতে মুটামুটি কত সময় লাগে?
মেহেদী ধ্রুব: এমন গল্প আছে যেটা দেখা যাচ্ছে লিখতে আমার ছয় মাস সময় লেগে গেছে। উদাহরণ হিসেবে যদি জলকূয়া গল্পের কথা বলি, সাড়ে ছয় হাজার শব্দের একটা গল্প, সেই গল্পটা লিখতে আমার ছয়মাস সময় লেগেছে।
প্রশ্ন: একটা গল্প আপনার মাঝে কীভাবে আসে? হঠাৎ করে আসে নাকি পরিকল্পিতভাবে একটা গল্প লেখেন?
মেহেদী ধ্রুব: আমি জীবনে চলছি ফিরছি বা আমি গ্রামে গিয়েছি বা কোথাও গিয়েছি– সেখানে একটা জিনিস দেখলাম, ছোট্ট একটা জিনিস দেখলাম; তখন আমার কাছে মনে হয় এটাকে কীভাবে গল্পে নিয়ে আসা যায়। এটা নিয়ে ভাবি, অনেকদিন এই চিন্তাটা মাথার মধ্যে থাকে৷ গল্পটা আমি জানি, চরিত্রটা আমি জানি, কিন্তু এটাকে আমি নির্মাণ করবো কীভাবে, কীভাবে নিয়ে আসবো, কী করবো, এটা নিয়ে আমি ভাবি। তারপর পরিকল্পনা করে করে একসময় লেখা শুরু করি।
প্রশ্ন: আপনার গল্পের গদ্যের দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, আপনি সফলভাবে দীর্ঘবাক্যের ব্যবহার করেছেন, এটা রপ্ত করতে আপনাকে কী দীর্ঘ অনুশীলন করা লেগেছে?
মেহেদী ধ্রুব: অনুশীলন বলতে ওই অর্থে না, গদ্যটা আমার মনের ভাব থেকেই আসে। আবার অনেকসময় দেখা যায়, একটা বাক্যে একটার পর একটা কথা চলে আসে, তাই বাক্যগুলো দীর্ঘ হয়।
প্রশ্ন: আপনি যেহেতু কথাসাহিত্য চর্চা করেন, তাহলে একটা কথা চলেই আসে, সেটা হচ্ছে, আপনার প্রিয় কথাসাহিত্যিক কে?
মেহেদী ধ্রুব: আমার প্রিয় কথাসাহিত্যিক, ওইরকম অর্থে যদি আমি বাংলাদেশের লেখকদের কথা বলি তাহলে এককভাবে বলা যাবে না, প্রথম জায়গাতে আমি কয়েকজনকে রাখবো তার মধ্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এবং শহীদুল জহির। তার আগে যদি চিন্তা করি তাহলে অবশ্যই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারপর বিভূতিভূষণ এদেরগুলো ভালো লাগে।
প্রশ্ন: এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রিয় কে?
মেহেদী ধ্রুব: বাংলাদেশ পিরিয়ডে শহীদুল জহির এবং ’৪৭-এর আগের কথা বললে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।
প্রশ্ন: আপনার গল্পে দীর্ঘবাক্য রচনার ক্ষেত্রে শহীদুল জহিরের কী কোনো প্রভাব আছে?
মেহেদী ধ্রুব: প্রভাব সচেতনভাবে নেই।
প্রশ্ন: আপনার কী মনে হয় আপনি তাকে অতিক্রম করে যেতে পারবেন?
মেহেদী ধ্রুব: শহীদুল জহিরের গল্পে যে জাদু বাস্তবতার বিষয়টা আছে, সেখানে তিনি দেখা যাচ্ছে একটা গল্পে একটা গল্প বলছেন এবং চরিত্রের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বা নানান ঘটনা দেখাচ্ছেন। কিন্তু আমার গল্পে, একটা গল্পের ভেতরে একটা গল্প না, ধরেন একটা গল্পের মধ্যে চারটা পাঁচটা গল্প আছে এবং সবগুলো বিচ্ছিন্ন গল্প এবং সবগুলো গল্প মানুষের গল্প, আমার শোনা গল্প। এই গল্পগুলো দেখা যাচ্ছে অন্য কোনো এলাকায় অন্যভাবে আছে। ওই বিচ্ছিন্ন গল্পগুলোকে একসাথে জোড়া দিয়ে কিছু একটা বলা– সংখ্যা, প্রতীক এবং রূপকতার মাধ্যমে বলা; এটা কিন্তু শহীদুল জহিরে নেই।
প্রশ্ন: আপনি সংখ্যার কথা বলছেন, আপনি ৪৭, ৭০ এবং ৭১, ৪৬ সংখ্যা দিয়ে ইন্দিরা গল্পে কিছু একটা ইঙ্গিত করতে চেয়েছেন, বিষয়টা আসলে কী?
মেহেদী ধ্রুব: ইন্দিরা গল্পে আমি দেখিয়েছি যে ওই ইন্দিরাটি একটা অভিশপ্ত ইন্দিরা। সেখানে আমি দেখিয়েছি সাতচল্লিশের সময় বা দেশভাগের সময় যারা পালিয়ে যেতে চেয়েছিল তাদেরকে ওই ইন্দিরাতে ফেলা হয়েছিল, কিছু একাত্তর সালে ফেলা হয়েছে। তারপর একটা সময় মানুষেরা মনে করেছে, এটা একটা অভিশপ্ত ইন্দিরা, তাই ওটা বন্ধ করে দিয়েছে। বন্ধ করে দেবার পরে ওই ইন্দিরাকে ঘিরে গ্রামে মিথের প্রচলন হয়। এখান থেকেই আমার গল্পটা মূলত এসেছে।
প্রশ্ন: আপনি একজন তরুণ কথাসাহিত্যিক, একজন তরুণ কথাসাহিত্যিক হিসেবে আপনাকে যে প্রশ্নটা করবো, সেটা হচ্ছে বর্তমানে বাংলাদেশের তরুণ কথাসাহিত্যিকদের প্রধান সমস্যা কী?
মেহেদী ধ্রুব: আমার মনে হয়, পড়ার বিষয়ে আমাদের স্বল্পতা রয়েছে। বর্তমানে ফেসবুক আমাদের অনেক সময় নিয়ে নিয়েছে এটা একটা বিষয়, আবার আমরা তরুণেরা অনেকে আমাদের কথাসাহিত্যের বেসিক পাঠ না সম্পন্ন করেই লেখালিখি করে থাকি, যেমন একজনের হয়তো মানিক, রবীন্দ্র, বঙ্কিম, শরৎচন্দ্র কিংবা বিভূতিভূষণ পড়া নেই কিন্তু তিনি লেখালেখি করে যাচ্ছেন।
প্রশ্ন: আপনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা ফেসবুকের কথা বললেন, তো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার একটা কথাসাহিত্যিকের জন্য কতটুকু প্রয়োজনীয়, এটা কী লেখকসত্তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে?
মেহেদী ধ্রুব: এটা আসলে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তবে এটা যদি একজন লেখক নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ব্যবহার করে তাহলে সেটা ভালো। যেমন একজন লেখক তার গল্প, কবিতা ফেসবুকে শেয়ার করছে, সেটা অনেক পাঠকের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে, পাঠক সেটা পড়ছে, এটা ভালো। কিন্তু ওই যে খবর পড়া, চ্যাটিং বা কয়টা লাইক পড়লো, কয়টা শেয়ার হলো, কে কী কমেন্ট করলো এটা দেখার জন্য বারবার ছুটে আসা এগুলো কিন্তু আমাদের সময়টাকে নষ্ট করছে। দেখা যাচ্ছে, এটার কারণে আমাদের পড়াশুনা বা লেখালিখির মনোযোগে ব্যাপক ব্যাঘাত ঘটে। তাই সামাজিক যোগাযোগ ব্যবহারের ক্ষেত্রে যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ থাকা প্রয়োজন বলে মনে করি।
প্রশ্ন: আমরা যদি বাংলা কথাসাহিত্যের যুগবিভাগের দিকে যায়, তাহলে আমাদের বর্তমান সময়ের কথাসাহিত্যকে আমরা কোন যুগের বলতে পারি? আধুনিক যুগের নাকি উত্তরাধুনিক যুগের? অথবা গল্পের কথা যদি ধরি, আমাদের গল্পগুলো কী উত্তরাধুনিক যুগের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে আসতে পেরেছে বলে আপনি মনে করেন?
মেহেদী ধ্রুব: এখন বলা হচ্ছে যে আমরা উত্তরাধুনিক যুগে এসেছি, নতুন নতুন জিনিস আসছে, আবার ফর্ম নিয়ে অনেকে ভাঙাচোরা করার বিষয় চিন্তা করছে। সেক্ষেত্রে বলা চলে কেউ কেউ সফল। আবার দেখা যাচ্ছে অনেকে সেই পুরনো ধারার গল্প লিখে চলেছেন, সেই গতানুগতিক কাহিনী, নতুনত্ব বলে কিছু নেই। এক্ষেত্রে আমি বলবো, কেউ কেউ চেষ্টা করছেন, কেউ কেউ সফল।
প্রশ্ন: এসময় গল্পের গদ্য নিয়ে অনেককে ভাঙাচোরা করতে দেখা যায়, গল্পে কী গদ্যটাই মূল?
মেহেদী ধ্রুব: গল্পে গদ্যটা মূল নয়, গদ্য-কাহিনী সবকিছু মিলিয়েই আসলে একটা গল্প।
প্রশ্ন: অনেকে এখন এক্সপেরিমেন্টাল গল্প লেখেন, অনেক সময় দেখা যায় গল্পের গদ্যের ঝঙ্কারের কারণে গল্পটাকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে৷ এ বিষয়ে আপনার মত কী?
মেহেদী ধ্রুব: আমি এটার পক্ষে না৷ আমি যেটার পক্ষে আমি যে অঞ্চলের মানুষ সেই অঞ্চল নিয়ে আমি ভালো গল্প লিখতে পারবো। আমি যদি এখন ঢাকা শহরে এসে ঢাকাকেন্দ্রিক গল্প লিখতে যাই, আমার গল্প কিন্তু ঢাকা শহরে যে বড় হয়েছে তার গল্পের চেয়ে ভালো হবে না। আমার যেখানে জন্ম হয়েছে সেখানকার অভিজ্ঞতায় সেই গল্পগুলোকে আমি যখন তুলে ধরবো, তখন কিন্তু একটা পারফেক্ট গল্প হবে। এবং গল্পের মধ্যে গল্প থাকতে হবে এটা আমি মনে করি। একটা পাঠক একটা গল্প মনে করেন পড়তে গেল, এখন দেখা গেছে সেই গল্পের মধ্যে শুধু ভাষা বা ভাষার কারুকার্য কিংবা অনেকক্ষণ পড়ার পর মনে হলো, কী হলো!– এটার পক্ষে আমি না। এটা আমার ভালো লাগে না। আমি চাই যে শেষপর্যন্ত পাঠক পড়বে, পাঠক বুঝবে– হ্যা, এমন একটা ঘটনা ঘটেছিল এবং পাঠকের বিষয়টা মনে থাকবে। সেই গল্পটা হয়তো আগে থেকে প্রচলিত, কিন্তু সেটা আমি কীভাবে উপস্থাপনা করছি সেটা আবার গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন: একটা পাঠক লেখকের কাছে কী চায় আর একটা লেখক পাঠকের কাছে কী চায়?
মেহেদী ধ্রুব: এটা সহজ হিসাব, লেখক চায় পাঠক তার লেখা পড়ুক; আর পাঠক চান লেখক কোনো নতুন চমক বা নতুন কিছু তাদেরকে দিক।
প্রশ্ন: একজন লেখক কী শুধু পাঠকের জন্যই লেখেন তাহলে?
মেহেদী ধ্রুব: লেখক কখনোই পাঠকের জন্য লেখেন না। প্রথমে তিনি নিজের জন্য লেখা শুরু করেন। একটা পর্যায়ে যখন তিনি দেখেন তার একটু খ্যাতি হয়েছে বা অনেক মানুষ তাকে চিনছে বা শ্রদ্ধা করছে তখন তার মধ্যে একটা লোভ চলে আসে। তখন হয়তো তিনি লেখার মধ্যে পাঠকের কথা চিন্তা করে কিছু বিষয় লিখে থাকেন– এটা প্রকৃতপক্ষে একজন লেখকের জন্য ক্ষতিকর।
প্রশ্ন: একজন গল্পকারের প্রতিদ্বন্দ্বী কি একজন গল্পকার হতে পারেন কখনো?
মেহেদী ধ্রুব: হ্যা, হতে পারে৷ মনে করেন, দু-তিনজন লেখককে একই বিষয় নিয়ে গল্প লিখতে দেওয়া হলো। প্রত্যেক গল্পকার চিন্তা করবেন আমি যাতে ওর চেয়ে নতুন কিছু দিতে পারি। একটা মানসিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা কিন্তু অনেকের মধ্যে থাকে। তবে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতাটি কিন্তু মারামারি কাটাকাটি নয়।
প্রশ্ন: প্রতিদ্বন্দ্বিতাটি কি গল্পকারের সাথে গল্পকারের নাকি গল্পের সাথে গল্পের?
মেহেদী ধ্রুব: মূলত গল্পের সাথে গল্পেরই। আমি ওই গল্প আর গল্পকারকে এক করেই দেখছি।
প্রশ্ন: আপনি দীর্ঘ ১০ বছর ধরে গল্প লিখছেন, এখন পর্যন্ত আপনার গল্পের সবচেয়ে দুর্বল দিক কোনটা মনে হয় আপনার কাছে? অথবা কোন দিকটা আপনি আরও ভালো করতে পারতেন বলে মনে করেন?
মেহেদী ধ্রুব: আসলে আমি আমার গল্প লিখে কখনোই সম্পূর্ণ তৃপ্ত নই, সবসময় একটা ভয় থাকে, কেমন হয়েছে! আরও যে দিকগুলো ভালো করা উচিৎ বলে মনে হয়– ভাষার দিক থেকে আরও স্মুথ করা যায় কিনা, যতি চিহ্নগুলো– কোথায় থামবো কোথায় থামবো না, এ বিষয়গুলো নিয়ে আরও কাজ করা যেতে পারে। তবে শেষপর্যন্ত কিন্তু পাঠকই সবকিছু।
প্রশ্ন: আপনার প্রথম গল্পগ্রন্থ দীর্ঘ ১০ বছর পর প্রকাশিত হচ্ছে, আপনার পরবর্তী গ্রন্থ কতদিন পরে আসতে পারে, আপনার কী কোনো পরিকল্পনা আছে?
মেহেদী ধ্রুব: আমার পরিকল্পনা আগে থেকেই আছে, আমার প্রথম বই প্রকাশের পর পাঠকের প্রতিক্রিয়া কী সেটা দেখা এবং সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেবো। আমার কিন্তু এখনো অগ্রন্থিত ১১-১২টি গল্প আছে, যেগুলো দিয়ে হয়তো এবারই আরও একটি বই করা যেতো, কিন্তু সেটা আমি করছি না। আগে আমার প্রথম বইটি পাঠকেরা কীভাবে নেয়, আমি সেটা দেখবো। কারণ একজন লেখক যে গল্পটা লেখেন, সে গল্পটি লেখক জানেন– আমি আমার গল্পটি জানি, আমি আমার গল্পটি সবচেয়ে ভালো বুঝি, আমার গল্পের প্রথম পাঠক আমি, আমার চোখের সামনে সবকিছু ভাসে; কিন্তু পাঠক কিন্তু জানেন না, এখন তার চোখে আমি ছবিটা আঁকতে পারছি কিনা– সেটা কিন্তু আমি এখনো জানি না। সেটা পাঠক জানেন, পাঠক যদি পড়ে বলেন, হ্যা, আপনি এই ছবিটা আঁকতে পারছেন– সেক্ষেত্রে কিন্তু আমার আত্মবিশ্বাসটা চলে আসবে, তখন হয়তো আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে সামনে বছরেই আরেকটা বই করতে পারি।
প্রশ্ন: আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় দেবার জন্য, আপনার প্রথম গল্পগ্রন্থ “মেঘ ও মানুষের গল্প”-এর জন্য শুভকামনা।
মেহেদী ধ্রুব: আপনাদের জন্যও শুভকামনা।