তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরে দাঁড়িয়ে থাকা দৈত্যাকৃতির হাজিয়া সোফিয়া সত্যিকার অর্থেই স্থাপত্যকলার এক বিস্ময়। আনুমানিক ১৫০০ বছর আগে এটি খ্রিস্টান ব্যাসিলিকা হিসেবে তৈরি করা হয়। ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ার কিংবা এথেন্সের পার্থিননের মতো এই স্থাপনাটিও শহরটিকে একটি সার্বজনীন রূপ দিয়েছে। এছাড়াও স্থাপত্যকলা, ধর্মীয়, বিশ্ব রাজনীতির এক অনন্য নিদর্শন হাজিয়া সোফিয়া।
শত-শত বছর ধরে রাজনীতির পালাবদলের সাক্ষী এই স্থাপনা খ্রিস্টান এবং মুসলমানরা নিজেদের কাজে ব্যবহার করেছিল। এর ইতিহাস থেকেই এটা পরিষ্কার হয়ে যায়, শত বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধারণ করে আছে ইস্তাম্বুল শহরটি।
হাজিয়া সোফিয়া (তার্কিস উচ্চারণ, Ayasofya-আয়া সোফিয়া) তৈরি করা হয়েছিল অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের উপাসনালয় হিসেবে। যদিও সময়ে-সময়ে ক্ষমতার পালাবদলে মুসলিমরা মসজিদ এবং অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয় হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে। তাই বহু সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় আচার-আচরণের নীরব সাক্ষী এটি। সর্বপ্রথম ৩৬০ খ্রিস্টাব্দে বাইজানটাইন সম্রাট কনস্টানটিয়াস হাজিয়া সোফিয়া তৈরি করার অনুমোদন দেন। সেই সময়ে ইস্তাম্বুলের নাম ছিল কনস্টান্টিনোপল। কনস্টানটিয়াস এর পিতা প্রথম কনস্টানটিন এর নামানুসারে এই শহরের নামকরণ করা হয়েছিল, যিনি ছিলেন বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের প্রথম সম্রাট।
একেবারে শুরুর দিকে হাজিয়া সোফিয়ার ছাদ ছিল কাঠের তৈরি। সেই সময় বাইজানটাইন সম্রাট ছিলেন আর্কেডিওস, পারিবারিক কলহের জেরে শহর উত্তাল হয়ে উঠে এবং যার বলি হয় হাজিয়া সোফিয়া। আনুমানিক ৪০৪ খ্রিস্টাব্দে এই স্থাপনায় আগুন লাগিয়ে দেওয়া হলে সেটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
পরবর্তীতে সম্রাট দ্বিতীয় থিওডোসিওস হাজিয়া সোফিয়াকে পুনরায় নির্মাণ করেন। এই পর্বে এসে স্থাপনাটির ডিজাইনেও পরিবর্তন আসে। মূল ফটকে স্মারকচিহ্ন সংযুক্ত করা এবং ছাদ হিসেবে আগের মতো কাঠ ব্যবহার করা হয়। এরপর প্রায় এক শতাব্দী কেটে যায়। এই সময়ে হাজিয়া সোফিয়াকে ঘিরে কোনো ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড সংগঠিত হয়নি। সম্রাট প্রথম যাস্টিনিয়ান এর শাসনামলে শহরজুড়ে আবার বড় ধরণের দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। তিনি ৫২৭-৫৬৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাসনকাজ পরিচালনা করেন। নিকা বিদ্রোহের কবলে পড়ে শতবর্ষী হাজিয়া সোফিয়া আবার আগুনে পুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আগুন লাগার ফলে মূল কাঠামোটি ভেঙে পড়ে এবং অন্যান্য অংশও ভিত্তি হারিয়ে নড়বড়ে হয়ে যায়।
সম্রাট যাস্টিনিয়ান সংস্কার কাজ হাতে নিলেও সেটা সংস্কার অযোগ্য হয়ে পড়ে। যার কারণে যাস্টিনিয়ান ৫৩২ সালে এটাকে একেবারে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে ফেলার নির্দেশ দেন। তারপর সেই জায়গাতেই নতুন করে হাজিয়া সোফিয়াকে নির্মাণ করার জন্য বিখ্যাত স্থপতি ইসিডরোস এবং এ্যান্থেমিওস-কে নিয়োগ দেন। তারা দায়িত্ব পাওয়ার পর ৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে নতুন স্থাপনাটির নির্মাণ কাজ শেষ করেন। বর্তমানে আমরা যে হাজিয়া সোফিয়াকে দেখি সেটা তৈরি করেন এই দুই বিখ্যাত স্থপতি। নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর ৫৩৭ খ্রিস্টাব্দের ২৭ ডিসেম্বর আবার ধর্মীয় অনুষ্ঠানের কার্যক্রম উদ্বোধন করা হয়। অনুষ্ঠানে সম্রাট যাস্টিনিয়ান এই পবিত্র স্থাপনাটি পুনর্নির্মাণের সুযোগ পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবান হিসেবে উপস্থাপন করেন।
হাজিয়া সোফিয়া যখন সর্বপ্রথম নির্মাণ করা হয়েছিল তখন থেকে তৃতীয় নির্মাণ হয়ে আজ অবধি বিশ্ববাসীর বিস্ময়ের কারণ। অর্থোডক্স ব্যাসিলিকার ঐতিহ্যের সঙ্গে মিল রেখেই প্রতিবার এটাকে ডিজাইন করা হয়েছে। ছাদের উপর বিশালাকার গম্বুজগুলো এটাকে আরও আকর্ষণীয় হিসেবে তুলে ধরেছে সবার সামনে। গম্বুজগুলোর নিচে থাকা খিলানগুলো ডানাযুক্ত পবিত্র দেবদূতেরা সামলে ধরে আছেন। তাদের একত্রে হেক্সাটেরিগন নামে অভিহিত করা হয়। তাদের দেহ অসংখ্য দামি মোজাইক দ্বারা আবৃত করে রাখা হয়েছে। মেঝে এবং সিলিং-এ যে মার্বেল পাথরগুলো ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো আনাতোলিয়া এবং সিরিয়া থেকে বানিয়ে আনা হয়। তাছাড়া দেয়ালে যে ইটগুলো ব্যবহৃত হয়েছিল সেগুলো আনা হয় উত্তর আফ্রিকা থেকে। মেঝেতে মার্বেলের স্ল্যাবগুলো এমননভাবে সাজানো হয়েছে যে, দেখে মনে হবে তরঙ্গায়িত জল বয়ে চলেছে। হাজিয়া সোফিয়া’য় ব্যবহৃত ১০৪ টি কলাম নিয়ে আসা হয় ইফিসের আর্টেমিস মন্দির এবং মিশর থেকে। পুরো স্থাপনাটির দৈর্ঘ্য ২৬৯ ফিট এবং প্রস্থ ২৪০ ফিট, যদিও গম্বুজ সংযুক্ত অংশগুলো ১৮০ ফিট লম্বা। প্রধান গম্বুজের সোনালি বর্ণের কারণে এটাকে ‘স্বর্ণের গম্বুজ’ নামে ডাকা হয়। বিশালাকার গম্বুজ থেকে ৪০ টি রিব চারদিকে ডানা মেলে দিয়েছে, যেগুলো আবার খিলানযুক্ত জানালার উপরের অংশে গিয়ে শেষ হয়েছে। দিনে যখন সূর্যের আলো জানালা ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করে, তখন সেটা এক রহস্যময় পরিবেশ তৈরি করে। আলোর এই খেলা তৈরি হওয়ার পেছনে মেঝের মার্বেল পাথর আর জানালার কাচের কারসাজি তৈরি করা হয়েছে। এই আলোর ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ তৈরি করতে একে ‘স্পিরিচুয়াল লাইট’ বলে পরিচিত করিয়ে দেওয়া হয়।
গ্রিক অর্থোডক্স ছিল বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের প্রধান ধর্ম। তাই হাজিয়া সোফিয়াও সারাবিশ্বে এই ধর্মাবলম্বীদের কেন্দ্রীয় মিলনমেলায় পরিণত হয়। বাইজানটাইন সম্রাটদেরও অভিষেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো হাজিয়া সোফিয়াতে। এই রীতি প্রায় ৯০০ বছর পর্যন্ত অবিচ্ছিন্ন অবস্থায় পালন করা হতে থাকে। কিন্তু ক্রুসেড সংগঠিত হলে কনস্টানটিনোপোল বাইজানটাইনদের হাতছাড়া হয়ে যায়। ত্রয়োদশ শতকের পুরো সময়জুড়ে হাজিয়া সোফিয়া বেশ কয়েকবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে বাইজানটাইনরা শহর দখল করে নিলে হাজিয়া সোফিয়াতে সংস্কার কাজ চালায়। এর পরবর্তী ২০০ বছরের মাথায় কনস্টানটিনোপোল আবার তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। এবার অটোমানরা শহরের দায়িত্ব নিজেদের করে নেয় এবং শহরের নামকরণ করে ইস্তাম্বুল।
অটোমানরা যেহেতু ইসলামকে নিজেদের প্রধান ধর্ম হিসেবে মেনে আসছে, তাই তারা হাজিয়া সোফিয়াকে সম্পূর্ণ নতুন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে শুরু করে। তারা এটাকে মসজিদে রূপান্তরিত করে এবং এখানকার খ্রিস্টীয় নিদর্শনগুলো মোজাইক দিয়ে ঢেকে ফেলা হয়। সেখানে দখল করে নেয় ইসলামি ঐতিহ্যের নানা আল্পনা। কাবার দিকে নির্দিষ্ট করে একটি মিহরাবও স্থাপন করা হয়, যেটা সিজদাহ’র দিক নির্দেশ করে। সুলতান সুলেইমান পরবর্তীতে মিহরাবের দুই পাশে দু’টি ব্রোঞ্জের বাতি বসান, এবং সুলতান তৃতীয় মুরাদ বারগামা থেকে আনা মার্বেল কিউব বসান এখানে। প্রায় একই সময়ে স্থাপনার মূল অংশে চারটি মিনার নির্মাণ করা হয়। এটা আজান দেওয়া এবং ভূমিকম্পের হাত থেকে হাজিয়া সোফিয়াকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য তৈরি করা হয়। সুলতান আবদেলমেসিডের শাসনামলেও ভেতরগত বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়।
এভাবেই এমন একটি স্থাপত্যকর্ম শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ধর্মীয় ব্যাপারগুলোর প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত হয়ে আসছে। নানা উত্থানপতন এর সাক্ষী হয়ে হাজিয়া সোফিয়া এখনও বিশ্বের মানুষের কাছে সমান আকর্ষণীয়। বিশেষ করে খ্রিস্টান অর্থোডক্স থেকে অটোমানদের দ্বারা মসজিদ হিসেবে ব্যবহারকে অনেকেই এখনো বিতর্কের বিষয় বানিয়ে রেখেছেন। অটোমানদের গত হওয়ার প্রায় ১০০ বছর পর ১৯৩৫ সালে আতার্তুক সরকার হাজিয়া সোফিয়াকে জাদুঘরে পরিণত করেন। ফলে নানা ধর্ম আর সংস্কৃতির পরিচয় বহন করা এই স্থাপনায় সারা বিশ্ব থেকে প্রচুর দর্শনার্থী এখানে ঘুরতে আসেন। তাদের পায়ের প্রতিটি পদক্ষেপে ইস্তাম্বুল নিজের গল্প বলে যায়। আর হাজিয়া সোফিয়া যেন মুচকি হেসে বলে, সত্যিকার গল্প শুনলে এদিকে এসো। তারপর গল্প জমে যায়, সহস্রাব্দের ব্যবধানে বেড়ে উঠা দুই প্রজন্মের মাঝে।