নুরেমবার্গ ট্রায়াল বা নুরেমবার্গ বিচার (Nuremberg Trials) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। এই বিচারগুলিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার জার্মান নাৎসি বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং গণহত্যার অভিযোগে মামলা করা হয়েছিল। এই বিচারগুলি মানবতার প্রতি সন্মান ও আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের এক মাইলফলক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে, ১৯৪৫ সালের মে মাসে জার্মানির পরাজয় নিশ্চিত হওয়ার পর মিত্রবাহিনীরা সিদ্ধান্ত নেয় যে নাৎসি বাহিনীর নেতাদের আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় বিচারের সম্মুখীন করা হবে। যদিও যুদ্ধের সময় অসংখ্য যুদ্ধাপরাধ সংগঠিত হয়েছিল, এই বিচারগুলির উদ্দেশ্য ছিল শুধু যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা নয় বরং ভবিষ্যতের জন্য একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করা।
বিচার অনুষ্ঠিত হয় জার্মানির নুরেমবার্গ শহরে, যা নাৎসি দলের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রস্থল ছিল। মূলত চারটি প্রধান দেশ – যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন এই বিচার পরিচালনা করে। প্রথম এবং সবচেয়ে বিখ্যাত বিচারটি অনুষ্ঠিত হয় ১৯ নভেম্বর ১৯৪৫ থেকে ১ অক্টোবর ১৯৪৬ পর্যন্ত, যেখানে ২৪ জন নাৎসি নেতার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছিল।
নুরেমবার্গ ট্রায়ালে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে চারটি প্রধান অভিযোগ আনা হয়েছিল:
এই বিচারগুলিতে অভিযুক্তদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু ব্যক্তি ছিলেন:
অনেক অভিযুক্ত অপরাধ অস্বীকার করলেও, বেশিরভাগ অভিযুক্তদের মৃত্যুদণ্ড অথবা কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
নুরেমবার্গ ট্রায়াল কেবলমাত্র সেই সময়ের যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি প্রদান করেই শেষ হয়নি; বরং এটি মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইন প্রণয়নে এক যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেছে। এই বিচারগুলির মাধ্যমে প্রথমবারের মতো একটি আন্তর্জাতিক আদালত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করেছে। এর ফলে:
নুরেমবার্গ ট্রায়াল বিশ্বকে দেখিয়েছে যে কোনও ব্যক্তিই, তার পদ বা ক্ষমতার অবস্থান যাই হোক না কেন, আন্তর্জাতিক আইনের ঊর্ধ্বে নয়। মানবাধিকার লঙ্ঘন করলে বিচার ও শাস্তি অনিবার্য। আজও, এই বিচারগুলি মানবাধিকার সংরক্ষণে, যুদ্ধাপরাধ মোকাবিলায় এবং বিশ্বজুড়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রেরণা হিসেবে কাজ করে চলেছে।
নুরেমবার্গ ট্রায়াল ছিল যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মানবজাতির এক অগ্রগামী পদক্ষেপ। এটি প্রমাণ করেছে যে, ক্ষমতা বা কর্তৃত্বের অপব্যবহারের মাধ্যমে অপরাধ করে গেলে তার শাস্তি অনিবার্য। এই বিচারগুলির মাধ্যমে আজকের আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার সুরক্ষার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে, যা ভবিষ্যতের জন্যও একটি উদাহরণ হিসেবে রয়ে গেছে।