জসীমউদ্দিন

টুনটুনির বুদ্ধি

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

টুনটুনি আর টুনটুনা একসঙ্গে তো আছে। সেদিন টুনটুনি টুনটুনাকে বলল, “দেখ টুনটুনা! আমার যে বড় পিঠা খেতে ইচ্ছা করছে।”

টুনটুনা বলে, “পিঠা তৈরি করতে চাল লাগে, ঢেঁকি লাগে। হাঁড়ি লাগে, পাতিল লাগে, কাঠ লাগে আরও কত কি লাগে। এসব আমরা কোথায় পাব?”

টুনটুনি তখন বলল, “চল, আমরা গেরস্তের বাড়ি হতে আগে চাল কুঁড়িয়ে আনি। তারপর বাকি সব জিনিসের কথা চিন্তা করব।”

টুনটুনি আর টুনটুনা ফুরুৎ ফুরুৎ করে উড়ে এ বাড়ি যায় ও বাড়ি যায়। ছেলেরা এখানে ওখানে কত চাল ছড়িয়ে ফেলে। সেই চাউল ওরা কুঁড়িয়ে নিয়ে আসে।

তখন টুনটুনা বলল, “চালের তো জোগাড় হল। এবার চাল ভাঙিয়া গুঁড়া করব কেমন করে?”

টুনটুনা তখন করল কি?

গিয়ে দেখে, গেরস্তের বউ ও-ঘর হতে ঢেঁকিঘরে যাচ্ছে! সে উঠানে একঘটি পানি ঢেলে দিয়ে তার পথ পিছল করে দিয়ে আসল। গেরস্তের বউ সেই পথ দিয়ে যেতে আছাড় খেয়ে পড়ল।

টুনটুনা এই অবসরে টেকি ঘরে গিয়ে ঢেঁকির ললাটে চাল ভরে ধাপুর ধোপর পার। অল্পক্ষণের মধ্যে চাল গুড়া করে তারা বাসায় ফিরল।

কিন্তু পিঠা বানাইতে তো খাপরার দরকার। খাপরা তারা কোথায় পাবে?

এক কুমার, হাঁড়ি-পাতিল মাথায় করে বাজারে যাচ্ছিল।

টুনটুনি করল কি?

তার পথের সামনে এক বদনা পানি ঢালিয়া সেই পথ পিছল করে দিয়ে আসল। কুমার সেই পথ দিয়ে যাচ্ছে অমনি ধপাস করে আছাড় খেয়ে পড়ে গেল। মাথার হাঁড়ি-পাতিল এর ঝাঁকা এক পাশে পড়ে গেল। মনের ইচ্ছামতো টুনটুনি সেখান হতে খাপরা কুঁড়িয়ে আনল।

পিঠা বানানোর গুঁড়া হল, খাপরা হল; কিন্তু কাঠ পাবে কোথায়?

টুনটুনি আর টুনটুনা এ জঙ্গল ছেড়ে ও জঙ্গল পার হয়ে যায়। জনমানুষের সাড়া মেলে না, এমন এক বিজাবন জঙ্গলে গিয়ে উপস্থিত হল। সেখানে গিয়ে তারা দেখে গাছের উপর কত মরা ডাল শুকিয়ে খড়ি হয়ে আছে।

এ ডাল ভাঙে মড়র মড়র, ও ডাল ভাঙে কড়র কড়র, সে ডাল ভাঙে চড়র চড়র।

এমন সময় এক সিংহ, “হালুম মালুম খেলুম” বলে ডাক ছাড়ে, “এই বনে লাকড়ি ভাঙে কারা?”

ভয়ে টুনটুনি জড় সড়।

কাঁপতে কাঁপতে টুনটুনা পড় পড়।

সিংহ আবার গর্জন করে বলে, “এই বনে লাকড়ি ভাঙে কারা?”

টুনটুনি আর টুনটুনা অনেক সাহস করে বলে—

“আমি টুনটুনি মামা!

আমি টুনটুনা মামা!

তোমাকে দাওয়াত করতে এসেছি।

আজ আমাদের বাড়িতে চিতই পিঠা করব কিনা,

তাই তোমাকে বিকালে আমাদের বাড়ি যেতে হবে।”

একগাল হাসিয়া সিংহমামা বলে, “বেশ ভাগনে! বেশ। বেশ ভাগনী! বেশ! তোমাদের দাওয়াত কি না রেখে পারা যায়? আমি ঠিক সময়ে গিয়ে হাজির হব।”

সাহস পেয়ে টুনটুনি বলে, “তা মামা! আমরা তো খুব ছোট, কয়টা লাকড়ি আর ঠোটে করে নিয়ে যেতে পারব!”

সিংহ আর একটু হাসিয়া বলল, “তবে দাঁড়া, আমি পিঠে করে তোদের লাকড়ি দিয়ে আসতেছি।”

এদিকে থাবা মারিয়া, ওদিকে থাবা মারিয়া মড় মড় করে অনেক লাকড়ি ভেঙ্গে সিংহ পিঠে বোঝাই করল। টুনটুনি আর টুনটুনা আগে আগে পথ দেখিয়ে এগিয়ে চলল। টুনটুনিদের বাসার সামনে এসে দুড়ুম করে পিঠের বোঝা নামিয়ে সিংহ চলে গেল। যাওয়ার সময় বলে গেল, “আজ ঠিক বিকাল হলে আমি পিঠা খেতে আসব।”

টুনটুনি আর টুনটুনা পিঠা বানায়। একখানা বানায় টুনটুনি খায়, আর একখানা বানায় টুনটুনা খায়। খেতে খেতে খেতে তারা সকল পিঠা খেয়ে ফেলল।

তখন টুনটুনি বলে, “দেখ টুনটুনা! সব পিঠা তো আমরাই খেয়ে ফেললাম। এদিকে সিংহ মামা আসলে কি খেতে দিব?”

দুইজনে মিলে অনেক ভেবে চিন্তে তাহারা করল কি? মাঠ হতে শুকনা গোবর এনে এক প্রকাণ্ড ভুরী বানালো। তার উপরে একখানা পিঠা সাজিয়ে সমস্ত গোবর ঢেকে ফেলল। তারপর দুইজনে চালের হাঁড়ির মাঝে লুকিয়ে সিংহমামার আসার অপেক্ষা করতে লাগল। সিংহ এসে পিঠার ভুরী দেখে বড়ই খুশি। পিঠার ভুরীর চারদিকে সে ঘোরে, একখানা পিঠা তুলে মুখে দেয় আর নাচিয়া নাচিয়া গান গায়—

“টুনটুনিরে পাইতাম,

ঘাড়ে করে নাচতাম।”

এইভাবে খেতে খেতে উপরের পিঠা সব ফুরিয়ে গেল। তারপর একখানা গোবরের পিঠা মুখে দিয়ে ওয়াক ওয়াক করে ফেলে দিল। তখন সিংহ মহাশয় তর্জন গর্জন করে উঠল,

“টুনটুনিরে পাইতাম,

ঘাড় মটকায়ে খাইতাম।

টুনটুনারে পাইতাম,

ঘাড় মটকায়ে খাইতাম।”

চাউলের হাঁড়ির মধ্যে থাকিয়া টুনটুনা বলে, “টুনটুনিরে। আমার বড়ই হাঁচি পেয়েছে।”

টুনটুনি বলে, “টুনটুনা সর্বনাশ করলি! হাঁচি দিলেই সিংহ টের পাবে। আর টের পেলে আমাদের কি আর আস্ত রাখবে!”

এমন সময় সিংহ গর্জন করে বলতেছে,

“টুনটুনারে পাইতাম,

ঘাড় মটকায়ে খাইতাম।

টুনটুনিরে পাইতাম,

ঘাড় মটকায়ে খাইতাম।”

কিন্তু টুনটুনা বলে, “টুনটুনিরে! আমি যে আর থাকতে পারতেছি না। আমার এমন হাঁচি পেয়েছে।”

টুনটুনি তার বুকে মাথায় পাখা ঘষে, পিঠে লেজে ঠোট ঘষে, “টুনটুনারে! আর একটু ধৈর্য ধরে থাক।”

কিন্তু বললে কি হবে! আকাশ ফাটিয়ে টুনটুনা হাঁচি দিল, “হাচ্চো।”

সেই শব্দের জোরে চাউলের হাঁড়ি ভেঙ্গে ফট্টাস, আর ভয়ে লেজ গুটিয়ে সিংহ মামা দে চম্পট।

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu