মাসুদুর রহমানের স্মৃতিকথা
তখন আমি একটা কোচিংয়ে জব করি, সংগত কারণেই কোচিংয়ের নাম এবং জায়গার নাম গোপন করছি। একদিন কোচিংয়ের নির্বাহী পরিচালক আমাকে ডেকে পাঠালেন, সন্ধ্যা পিরিয়ডের দুটো ক্লাস নিয়ে পরিচালকের সাথে দেখা করলাম। তিনি আমাকে বললেন– স্যার, একটা কাজে যেতে হবে। বললাম– কিসের কাজ আর কখন? তিনি জবাবে বললেন– আজ রাতেই ছুটির পরে এক ছাত্রের বাড়িতে যেতে হবে। ছাত্রের পরিচয় জানার পর বললাম– আমিতো স্যার নতুন, তাছাড়া ওদের বাসাও চিনি না আর সেতো বেশ কয়দিন ধরে কোচিংয়েও আসে না ঘটনা কী? পরিচালক বললেন– আমিও যাবো আপনার সাথে, ছেলেটার মা আমাকে কয়েকবার ফোন করেছে, আমাকে আর আপনাকে যেতে বলেছে বিশেষভাবে। ঘটনা কিছু বুঝতে পারলাম না, তবে আশ্চর্য হলাম এই ভেবে যে, পরিচালক নিজে যাবে তাও আবার এখনই যেতে হবে, কী এমন কাজ! আর এও আন্দাজ করলাম ঘটনা হয়তো গুরুতর হতে পারে।
ছুটির পর স্যারের সাথে ঐ ছাত্রের বাড়ির উদ্দেশে বের হলাম, যেতে যেতে স্যার আমাকে নিয়ে গেলেন উপশহরের মূল এরিয়া থেকে একদম বাইরে একটা গ্রামের একদম শেষ প্রান্তে, আমি মনে মনে বললাম, এতদূর থেকেও আমাদের কোচিংয়ে স্টুডেন্ট যায়। মূল রাস্তা থেকে অনেকটা নির্জন জায়গায় বাড়িটা, সেই বাড়ির আশেপাশে তেমন কোন বাড়ি নেই, ছিমছাম তবে অগোছালো একটা বাড়ি। বাড়ির ভিতরে ঢুকতেই মাছের বাসি উৎকট গন্ধ নাকে ভেসে এলো, দেখলাম বাড়ির উঠোনে মাছ ধরার জাল আর খাড়ি পড়ে আছে, বুঝতে বাকি রইলো না এটা একটা জেলে বাড়ি। তারপর পরিচালকের ডাকে ছাত্র বেরিয়ে এলো। কুশল বিনিময় করতে করতে আমাদের একটা রুমে নিয়ে গিয়ে শক্ত একটা তক্তপোশে বসতে বলে ছাত্রটা গিয়ে তাঁর মাকে ডেকে আনলো। মধ্য বয়স্কা একটা রোগা মহিলা এলেন, দেখেই মনে হলো তখনও হয়তো কোন রোগে আক্রান্ত উনি। কুশল বিনিময়ের পর তিনি পরিচালককে বললেন– স্যার, আপনাদের ইংরেজির নতুন স্যারকে নিয়া আইছেন? স্যার আমাকে দেখিয়ে পরিচয় করিয়ে দিলেন, তিনি আমাকে দেখে আরও আবেগ তাড়িত হয়ে পড়লেন। বললেন আপনার কথাই সজীব (ছদ্মনাম) সবসময় বলে, আপনাকে দেখার খুব ইচ্ছা ছিলো আমার। আমার বিষয়ে আরও অনেক কথা বললেন যেগুলো এখানে বলা নিষ্প্রয়োজন।
ভদ্রমহিলার সাথে মোটামুটি অনেক কথাই হলো কথার এক পর্যায়ে বললেন বাপে যা করে ছেলেরও তাই করতে হবে এমন কোন কথা আছে গো স্যার? ওর বাপে না হয় জাইলা (জেলে) তাই কি ওরও জাইলা হতে হবে? ওর বাপে ওরে পড়াবো না তয় আমি পড়াবো। আমি কোচিংয়ে যেতাম অসুস্থ বলে ঘর থেকেই বের হতে পারি না, না হলে আমি নিজে গিয়ে বলে আসতাম আপনাদের, তাছাড়া সব কথাতো আর ওখানে বলা যাবে না তাই আপনাদের আসতে বলেছি। ভদ্রমহিলা আরও অনেক কথা বললেন যে কথাগুলোর সারমর্ম এটাই যে, ছেলেটার বাবা পড়াশোনা নিজেও করেনি ছেলেকেও করাবে না। তিনি মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন, ছেলেকেও একই পেশাতে নিতে চান। মায়ের কথা হলো, না! ছেলে তাঁর পড়াশোনা করে বড় চাকরি করবে সরকারী অফিসার হবে। ভদ্রমহিলা আরও অনেক কথা বললেন, এক পর্যায়ে পারিবারিক নানা টানাপোড়েনের কথা বলতে বলতে কান্নাকাটিও করলেন। এও বললেন যদি ওর বাপে টাকা পয়সা না দেয় তবে তিনি নিজেই দিবেন সেটা যেভাবেই হোক। আর আমাদের টাকা পয়সা নিয়ে চিন্তা করতে না করলেন। তিনি শেষমেশ বললেন দরকার হলে গয়না বেঁচবেন তবুও ছেলেকে পড়াবেন।
ভদ্রমহিলা আমার হাত ধরে বললেন– বাবা, আমার পোলাডারে দেইখেন। আমি বললাম আপনার ছেলের প্রতি আমাদের নজর এমনিতেই বেশি, কারণ ও সব থেকে ভালো ছাত্র পি.এস.সিতে যেমন ভালো রেজাল্ট করেছে এবার জে.এস.সিতেও ভালো রেজাল্ট করবে আমরা আশা করি। ভদ্রমহিলা চোখ মুছলেন। বললেন– আমি বাবা বড় অসুখে পড়ছি, জানি না কতদিন বাঁচমু। আমি মরলেইতো ওর বাপে ওরে আর পড়াবো না। আপনারা আমার পোলারে দেইখেন, ট্যেকা পয়সার চিন্তা করবেন না। আমি সব দিমু গত মাসের বেতন দিতে পারি নাই তাই ও কোচিংয়ে যেতে চায়না আপনেরা ওর কাছে কোন টাকা চাবেন না ও শরম পায়, এই বলে আমার হাতে কয়েকটা নোট গুজে দিলেন। আমি টাকাটা পরিচালকের হাতে তুলে দিলাম, তিনিও টাকা দেখলেন না, উঠে আসার সময় তক্তপোশের উপর রেখে দিলেন আর বললেন– ওর দায়িত্ব কোচিং-এর, ও খুব মেধাবী ছাত্র নিয়মিত যেতে বলবেন আর ওকে ডেকে আমরা পরেরদিন থেকে নিয়মিত কোচিংয়ে যাওয়ার কথা বললাম। খেয়াল করলাম ছেলেটা লজ্জায় মাথা নিচের দিকে দিয়ে চোখ মুছতেছে আর তখন ভদ্রমহিলা কিছুটা জোরেই কেঁদে উঠলেন।
তখন রাত প্রায় ১০ টা বেজে গেছে, ছাত্রটা আমাদের উঠোন পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেলো তবে তখন আর প্রথমবারের মতো মাছের গন্ধবোধ করলাম না এতক্ষণ থেকে হয়তো গন্ধটা আমার সওয়া হয়ে গিয়েছে। আমরা বের হয়ে রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। বাড়ির বাইরে থেকে ছেলেটার পড়ার শব্দ শোনা গেলো, সে জোরে জোরে পড়তেছে, The national flag is the symbol of independence…