ব্ল্যাক হোল, মহাবিশ্বের এমন এক বিস্ময়কর সৃষ্টি যা সবকিছুই নিজের মধ্যে টেনে নিয়ে যায়, এমনকি আলোও এর গ্রাস থেকে মুক্তি পায় না। বিজ্ঞানের ইতিহাসে এটি অন্যতম চমকপ্রদ এবং রহস্যময় এক জগৎ। কিন্তু কীভাবে এই ব্ল্যাক হোল তৈরি হয়? কীভাবে এটি কাজ করে? আর কেনই বা এত আকর্ষণীয়? এই প্রশ্নগুলির উত্তর জানার আগে ব্ল্যাক হোলের প্রাথমিক ধারণা বুঝতে হবে।
ব্ল্যাক হোল মূলত খুব বড় কোনো নক্ষত্রের মৃত্যু থেকে জন্ম নেয়। নক্ষত্রগুলো তাদের জীবনের শেষ পর্যায়ে পৌঁছালে ভেঙে পড়ে। যখন তারা তাদের অভ্যন্তরের সমস্ত জ্বালানি ফুরিয়ে ফেলে, তখন একটি বিশাল আকৃতির বিস্ফোরণ ঘটে, যা সুপারনোভা নামে পরিচিত। এই বিস্ফোরণের পর যদি নক্ষত্রটির ভর খুব বেশি হয়, তবে সেটি সঙ্কুচিত হয়ে অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটি বিন্দুতে পরিণত হয়। একে সিঙ্গুলারিটি বলে। এই সিঙ্গুলারিটি এতটাই ঘন এবং এর মহাকর্ষীয় শক্তি এত বেশি যে কোনো কিছুই, এমনকি আলোকরশ্মিও এর আকর্ষণ থেকে মুক্তি পায় না।
ব্ল্যাক হোলের চারপাশে এক ধরনের সীমারেখা থাকে, যাকে ইভেন্ট হরাইজন বলা হয়। এটি হলো ব্ল্যাক হোলের সেই সীমানা, যেখান থেকে কোনো কিছু বের হয়ে আসতে পারে না। ইভেন্ট হরাইজনের বাইরে থেকে কিছু দেখার সুযোগ থাকে, তবে একবার কেউ এই সীমারেখা পার করলে তার আর ফিরে আসার উপায় থাকে না। মহাকর্ষীয় বল এতটাই শক্তিশালী যে আলোকও এর প্রভাব থেকে পালাতে পারে না। এ কারণেই আমরা ব্ল্যাক হোলকে সরাসরি দেখতে পারি না, কারণ কোনো আলোই আমাদের চোখে পৌঁছায় না।
ব্ল্যাক হোলের ভেতরের জগৎ সম্পূর্ণভাবে আমাদের উপলব্ধির বাইরে। ভেতরে কী ঘটছে তা বোঝা বা পরিমাপ করা বিজ্ঞানীদের জন্য এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সাধারণভাবে, আমরা ধারণা করতে পারি যে ব্ল্যাক হোলের কেন্দ্রে সবকিছু সিঙ্গুলারিটির দিকে ধাবিত হয় এবং সেখানে মহাকর্ষ শক্তি এতটাই বিশাল যে স্থান এবং কাল বিকৃত হয়ে যায়। কিছু বিজ্ঞানী ধারণা করেন যে ব্ল্যাক হোলের মাধ্যমে একটি নতুন মহাবিশ্বের জন্ম হতে পারে। এটি একটি 'ওয়ার্মহোল' এর ধারণার সাথে সম্পর্কিত, যেখানে ব্ল্যাক হোলের একটি দিক থেকে আরেকটি মহাবিশ্বে প্রবেশ করা সম্ভব হতে পারে। যদিও এই ধারণা এখনো কল্পবিজ্ঞানের পর্যায়ে রয়েছে, তবুও এটি গবেষকদের মাঝে ব্যাপক কৌতূহল জাগিয়েছে।
স্টিফেন হকিং, বিখ্যাত তাত্ত্বিক পদার্থবিদ, ব্ল্যাক হোল সম্পর্কে একটি অপ্রত্যাশিত তথ্য আবিষ্কার করেন। তিনি বলেন, ব্ল্যাক হোল আসলে স্থায়ী নয়। এটি ধীরে ধীরে তার ভর হারায় এবং একসময় সম্পূর্ণরূপে বিলীন হয়ে যায়। এই প্রক্রিয়াটিকে হকিং রেডিয়েশন বলা হয়। হকিং রেডিয়েশন হলো এমন এক প্রক্রিয়া যেখানে ব্ল্যাক হোলের ইভেন্ট হরাইজনের ঠিক বাইরে থেকে কণা এবং বিকিরণ বেরিয়ে আসে। একদিন হয়তো ব্ল্যাক হোল নিজেই সম্পূর্ণরূপে শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু এর জন্য সময়ের পরিমাপ হবে লক্ষ কোটি বছর।
ব্ল্যাক হোল নিয়ে গবেষণার নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে ২০১৯ সালে তোলা প্রথম ব্ল্যাক হোলের ছবি। ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ (EHT) এর মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা এই ছবিটি ধারণ করতে সক্ষম হন। এটি ছিল M87 গ্যালাক্সির কেন্দ্রে অবস্থিত একটি বিশালাকার ব্ল্যাক হোলের ছবি, যার ভর সূর্যের চেয়েও ৬.৫ বিলিয়ন গুণ বেশি। এই অর্জন আমাদের ব্ল্যাক হোল সম্পর্কে আরও গভীর ধারণা পেতে সাহায্য করেছে এবং মহাকাশবিজ্ঞানের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।
ব্ল্যাক হোল একদিকে যেমন মহাকাশের গহ্বর, তেমনি এটি হতে পারে মহাবিশ্বের গোপন রহস্যের চাবিকাঠি। এটি কেবল ভৌত বিজ্ঞানীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু নয়, বরং সাধারণ মানুষের মাঝেও কৌতূহল জাগায়। ব্ল্যাক হোলের মতো একটি রহস্যময় বস্তু আমাদেরকে মহাবিশ্ব সম্পর্কে নতুন করে চিন্তা করতে বাধ্য করে। আমরা যতই চেষ্টা করি না কেন, এই রহস্যের শেষ কোথায়, তা এখনো আমাদের অজানা। তবে একদিন হয়তো আমরা ব্ল্যাক হোলের প্রকৃত স্বরূপ সম্পর্কে জানতে পারব এবং এর ভেতরের লুকায়িত তথ্যগুলো উন্মোচন করতে সক্ষম হব।
ব্ল্যাক হোলের এ রহস্যময় আকর্ষণই আমাদের মহাবিশ্বকে জানতে ও বুঝতে আরও গভীরে প্রবেশ করার অনুপ্রেরণা জোগায়।