প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনুস হলেন একজন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ যিনি সারা বিশ্বে মাইক্রোক্রেডিট এবং সামাজিক ব্যবসার ধারণার প্রবর্তক হিসেবে পরিচিত। তার “থ্রি জিরো থিয়োরি” বর্তমান বিশ্বের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে একটি দারিদ্র্যমুক্ত, বেকারত্বমুক্ত এবং পরিবেশবান্ধব সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখায়। এই তত্ত্ব আমাদের সামনে একটি টেকসই এবং সমৃদ্ধ বিশ্বের সম্ভাবনা নিয়ে আসে, যেখানে সকলের জন্য সমান সুযোগ থাকবে।
থ্রি জিরো থিয়োরি তিনটি মূল লক্ষ্য নিয়ে গঠিত, যা হল জিরো পভার্টি (Zero Poverty), জিরো আনএমপ্লয়মেন্ট (Zero Unemployment), এবং জিরো নেট কার্বন এমিশন (Zero Net Carbon Emission)। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, এই তিনটি সমস্যা দূর করতে পারলেই আমরা একটি সমৃদ্ধ এবং টেকসই সমাজে উন্নীত হতে পারব।
প্রফেসর ইউনুসের বিশ্বাস, পৃথিবীর কোনো মানুষকে দারিদ্র্যের মাঝে রেখে সমৃদ্ধি সম্ভব নয়। দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য তিনি সামাজিক ব্যবসা এবং মাইক্রোক্রেডিটের মাধ্যমে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা বৃদ্ধির প্রস্তাব দেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক এবং অন্যান্য সামাজিক ব্যবসাগুলো দারিদ্র্য বিমোচনে অবদান রেখে যাচ্ছে। প্রতিটি মানুষের উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষমতা রয়েছে এবং এই ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়েই দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব।
মাইক্রোক্রেডিট সুবিধা: অল্প সুদের ঋণ প্রদান করে, বিশেষত নারীদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বৃদ্ধি করে।
সামাজিক ব্যবসার প্রসার: দারিদ্র্য দূরীকরণে ব্যবসাগুলোকে সাধারণ লাভের জন্য নয়, বরং মানুষের উন্নয়নের জন্য ব্যবহার করা।
একটি বেকারত্বমুক্ত সমাজ গঠনের জন্য ড. ইউনুস “সোশ্যাল বিজনেস” ধারণার প্রচলন করেছেন। তার মতে, প্রত্যেকের মধ্যেই উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষমতা আছে এবং উপযুক্ত সমর্থন পেলে মানুষ নিজের কর্মসংস্থান নিজেরাই সৃষ্টি করতে পারে। তাই, তিনি উৎসাহ দেন সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে। এর ফলে সমাজে একজন ব্যক্তি শুধু কর্মসংস্থান তৈরি করবে না, বরং সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে।
উদ্যোক্তা হিসেবে মানুষের ক্ষমতায়ন: তরুণ সমাজকে উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরি করা, যাতে তারা নিজেদের চাকরির জন্য অপেক্ষা না করে বরং নিজেরা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে।
বেকারদের জন্য সামাজিক ব্যবসার সুযোগ: সামাজিক ব্যবসাগুলোর মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে।
থ্রি জিরো থিয়োরির অন্যতম স্তম্ভ হল কার্বন নির্গমন শূন্যে নামিয়ে আনা, যা বর্তমানে বিশ্বের পরিবেশের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকিগুলোর একটি। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রফেসর ইউনুস টেকসই শক্তি, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি, এবং নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়ানোর ওপর জোর দেন। তিনি বিশ্বাস করেন, আমাদের সকলের দায়িত্ব হলো পৃথিবীকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য স্থানে রূপান্তর করা।
পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তির ব্যবহার: সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি ইত্যাদির মাধ্যমে পরিবেশ সংরক্ষণ করা।
পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তি: কার্বন নির্গমন কমানোর জন্য পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করা।
থ্রি জিরো থিয়োরি আমাদেরকে একটি ন্যায্য, টেকসই এবং দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ গঠনের জন্য অনুপ্রাণিত করে। এই ধারণা বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা একটি উন্নত বিশ্বের দিকে এগিয়ে যেতে পারি, যেখানে মানুষ দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং পরিবেশগত বিপর্যয় থেকে মুক্ত থাকবে। ড. ইউনুসের তত্ত্বে প্রস্তাবিত সামাজিক ব্যবসা মডেলটি ইতিমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সফলভাবে গৃহীত হয়েছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনুসের থ্রি জিরো থিয়োরি শুধুমাত্র একটি তত্ত্ব নয়, এটি বর্তমান সমাজে একটি বিপ্লবী পরিবর্তনের ডাক। দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং পরিবেশ দূষণ থেকে মুক্ত একটি বিশ্ব গড়ে তোলার স্বপ্ন বাস্তবায়নে এই তত্ত্বের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রফেসর ইউনুস আমাদের দেখিয়েছেন কিভাবে সামাজিক উদ্যোগগুলো পৃথিবীকে আরও সুন্দর এবং টেকসই করতে পারে। এই তত্ত্বের বাস্তবায়ন সম্ভব হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি শান্তিপূর্ণ, সবুজ এবং বৈষম্যহীন পৃথিবীতে বেড়ে উঠবে।