পিন্টু রহমান
১৩ অক্টোবর ১৯৭৫ খ্রি: চুয়াডাঙ্গার কুমারী গ্রামে জন্ম, পৈত্রিক ঘরবসতি কুষ্টিয়া জেলার বাজিতপুর গ্রামে। মাতা: জিন্নাতুন নেছা ও পিতা: বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিবর রহমান। তিনি একজন কথাসাহিত্যিক। গল্পের ছলে ভাষার আঞ্চলিকতায় চিত্রায়ণ করেন বাঙাল-জনপদের বহুমাত্রিক জীবনাচার। উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত গ্রন্থ: পাললিক ঘ্রাণ (গল্পগ্রন্থ), পূরাণভূমি (উপন্যাস), কমরেড (উপন্যাস), পরাণ পাখি (গল্পগ্রন্থ)
পিন্টু রহমান

ট্রেন টু পাকিস্থান: ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্তি ও উদ্ভুত পরিস্থিতির এক প্রামাণ্য দলিল!

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

পাকিস্থানের সীমান্তবর্তী শত্রুঘ্ন নদীর উপর নির্মিত সেতু পার হয়ে ভূতুড়ে ট্রেনটি মনো মাজরা স্টেশনে উপস্থিত হলে দ্রুত পরিস্থিতি বদলে যেতে শুরু করে। গ্রামবাসীর মনে উৎকণ্ঠা– কী আছে ওই ট্রেনে! স্টেশনে কর্তব্যরত সৈন্যদের মধ্যেও অস্থিরতা। সর্দারের মাধ্যমে কেরোসিন তেল ও জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করলে গ্রামবাসীর উত্তেজনা আরও বেশি বৃদ্ধি পায়; নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই ঘরের ছাদের উপর অপেক্ষা করতে থাকে। রাতের নির্জনতা গভীর হলে, স্টেশনের আশেপাশে আগুনের কুণ্ডলী স্পষ্ট হলে, মানুষ পোড়ার উৎকট গন্ধ ভেসে এলে বুঝতে অসুবিধা হয় না, ভূতুড়ে ট্রেনের অভ্যন্তরে লাশ ছিল! দেশভাগের আগে-পরে মনো মাজরার বাসিন্দারা সাম্প্রতিক দাঙ্গার খবর শুনেছে; এপারে পাতিয়ালা, আম্বালা, কাপুরতলায় শিখ ও হিন্দুদের হাতে মুসলমানরা আক্রান্ত হয়েছে। অন্যদিকে পাকিস্থানের রাওয়ালপিণ্ডি, মুলতান, গুজরানওয়ালা, শেখপুরায় অসংখ্য শিখ ও হিন্দু নিহত হয়েছে। কিন্তু পাকিস্থানের সীমান্তবর্তী মনো মাজরা গ্রামের পরিস্থিতি তখনো শান্ত ছিল। কিংবা দাঙ্গার ভয়াবহতা তারা আঁচ করতে পারতো না। নিজেদের ঐক্য বজায় রাখার জন্য সর্বদা তৎপর থাকতো। শিখ, মুসলমান, হিন্দু– সবাই ভাই ভাই; কারো সাথে কোনো বিরোধ ছিল না, ভক্তি-শ্রদ্ধার অভাব ছিল না। ইমাম বকশের কণ্ঠে ধ্বনিত হতো আযান, সন্ধায় শোনা যেতো উলুধ্বনি, আর ভোরের আলো ফুটে উঠলে মিত সিং প্রার্থনায় বসতো। এ চিত্র শুধু মনো মাজরা নয়; অখণ্ড ভারতবর্ষের প্রতিচ্ছবি! বিভিন্ন ভাষাভাষী ও জাতিগোষ্ঠির সমন্বয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির লীলাভূমি হিসেবে অঞ্চলটি পরিগণিত। অথচ দেশভাগের করাল থাবায় সর্বত্র আগুনের শিখা প্রজ্জ্বলিত হয়ে ওঠে।

বস্তুত: মসজিদ-মন্দির-গুরুদুয়ারা ছিল শান্তি উৎসস্থল। বহুবছর ধরে তারা একত্রিত ভাবে বসবাস করে আসছিল। একজন রামলাল খুন হলে ওই ঐক্যে চিড় ধরে। হত্যার অভিযোগে শিখ যুবক জুগ্গাত সিং গ্রেফতার হলে কারো কেনো আপত্তি থাকে না; ঘটনাটিতে সাম্প্রদায়িকতার রং না মাখিয়ে বরং ন্যায় বিচারের জন্য অপেক্ষা করে। কিন্তু ভূতুড়ে ট্রেনে পাকিস্থান থেকে থেকে প্রায় ১৫০০ জন শিখের লাশ এলে পরিস্থিতি ভিন্ন রুপ ধারণ করে। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে ওঠে। লেখক উল্লেখ করেছেন, “মনো মাজরায় হেড কনষ্টেবলের আগমনের পর গ্রামের লোকেরা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। এই বিভক্তি স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা গেল তাদের দৈনন্দিন কাজকর্মে। মুসলমানরা নিজেদের বাড়িতে বসে আলাপ-আলোচনা করতে লাগল এবং ভবিষ্যত চিন্তায় উদ্গিন্ন হয়ে পড়ল। পাতিয়ালা, আম্বালা ও কাপুরতলায় মুসলমানদের উপর শিখদের নির্যাতনের যে কথা তারা গুজব বলে উড়িয়ে দিয়েছিল, সেই কথা এখন তাদের চিন্তায় এলো। ওরা শুনেছিল, মহিলাদের কাপড় খুলে বেত মারা হয়েছে এবং বাজারের রাস্তায় তাদের ঘুরিয়ে জনবহুল বাজারে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছে। সতীত্ব রক্ষার্থে অনেক মহিলা আত্মহত্যা করেছে। ওরা শুনেছে যে, মসজিদে শূকর হত্যা করে মসজিদকে অপবিত্র করা হয়েছে, বিধর্মীরা কোরআন শরীফ ছিঁড়ে ফেলেছে। আকস্মিকভাবে মনো মাজরার সব শিখ তাদের কাছে পরিগণিত হলো অসৎ উদ্দেশ্যে আগত আগন্তূক হিসাবে। ওদের লম্বা চুল ও দাঁড়ি হিংস্রতা ও কৃপাণ মুসলিম বিদ্বেষের প্রতীক হিসাবে চিহ্নিত হলো। এই প্রথমবার ‘পাকিস্থান’ নামটি ওদের কাছে নতুন অর্থ বয়ে নিয়ে এলো– আশ্রয় লাভের এমন এক শান্তিময় স্থান– যেখানে কোন শিখ নেই।”

শুধু মুসলমান নয় অন্যান্য ধর্মের মানুষের মনে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ানো হয়েছে। ভারতীয় ইতিহাসে মুসলমান শাসনামলের উদাহরণ টেনে সর্বশেষ গুরু শিখদের সতর্ক করে দিয়েছে, “তাদের দু’জন গুরুকে হত্যা করেছে, অন্য একজনকে খুন করেছে এবং তার শিশু সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ না করার অপরাধে তাদের হাজার হাজার লোককে তলোয়ার দিয়ে নিধন করা হয়েছে। তাদের মন্দিরে গরু জবাই করে মন্দির অপবিত্র করা হয়েছে, পবিত্র গ্রন্থ ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করা হয়েছে। মহিলাদের তারা কখনও সম্মান করেনি। শিখ উদ্বাস্তুরা অভিযোগ করেছে যে, মুসলমানদের কাছে ইজ্জত বিসর্জন দেওয়ার আগে বহু মহিলা কুয়ায় ঝাঁপ দিয়েছে অথবা শরীরে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছে। যারা আত্মহত্যা করেনি, তাদের উলুঙ্গ করে রাস্তায় নামানো হয়েছে, জনসমক্ষে ধর্ষণ করা হয়েছে এবং শেষে হত্যা করা হয়েছে। ”

ঔপন্যাসিক খুশবন্ত সিং ওই সংকটময় সময়কে ধারণ করে রচনা করেছেন তার প্রথম উপন্যাস ‘ট্রেন টু পাকিস্থান’। উপন্যাসটি প্রথমে মনো মাজরা নামে প্রকাশ হয়েছিল। পরবর্তীতে ‘ট্রেন টু পাকিস্থান’ শিরোনামে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। শুধু ভারতীয় না বিশ্ব সাহিত্যে এটি একটি আলোচিত উপন্যাস। উপন্যাসিক খুশবন্ত সিং প্রসঙ্গে মনমোহন সিং বলেছেন, “সাংবাদিক, সম্পাদক, ইতিহাস রচয়িতা, যে ভাবেই হোক খুশবন্ত-এর লেখালেখি ছিল উস্কে দেওয়া গল্প কথকের মতো, যেসব লেখায় মানব পরিস্থিতিতে আলোকপাত বিষয়ে তিনি কখনোই পরান্মুখ নন। এই ব্যাপারটা তিনি অব্যর্থভাবে, অকপটভাবে চালিয়ে আসছেন গত পঞ্চাশ বছর ধরে, আর এই প্রবণতা ছিল পরিহাসময়, বাগবৈদগ্ধ্য দীপ্ত যা সমাজদর্পণকার হিসেবে তাঁর বিপুল দক্ষতার পরিচয় দিয়ে থাকে।”

তাঁর একদা সহকর্মী Bachi Karkaria বলেন, “খুশবন্ত ছিলেন ভারতবর্ষের স্বীকৃত ঔপন্যাসিক, শিখ ইতিহাস ও ধর্মের বিশেষজ্ঞ, গাছ ও পাখি বিষয়ে পণ্ডিত, তাঁর কালে সম্পাদক হিসেবে অত্যন্ত সফল।”

‘ট্রেন টু পাকিস্থান’ দেশভাগের গল্প; লাখ-লাখ মানুষের স্বপ্নভঙ্গ, ভিটেমাটি হারানোর করুণ গল্প; সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ভালবাসার জয়ের গল্প; ধর্মান্ধ পাপিষ্টদের কৃর্তকলাপের গল্প– অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত এবং নিরপেক্ষ ভাবে লেখক ওই কাহিনী বর্ণনা করেছেন। মনো মাজরা নামের ছোট্ট এক গ্রামের পটভূমিকায় চিত্রায়ন করেছেন সমগ্র ভারকবর্ষের খণ্ডচিত্র। ১৯৪৭’র দেশভাগ ছিল ইতিহাসের একটি আলোচিত এবং বিতর্কিত অধ্যায়। বহু ভাষা-ভাষী এবং ধর্ম-বর্ণের মানুষের তীর্থভূমিকে বিভক্ত করা হয়েছে দ্বি-জাতি নামক এক বিশেষ তত্ত্বের ভিত্তিতে। অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় বাংলা ও পাঞ্জাবে বিভাগ পরবর্তী জটিলতা খুব বেশি প্রকট হয়েছিল। কেননা অখণ্ড প্রদেশ দুটিকে খণ্ডিত করে ভারত ও পাকিস্থানের মধ্যে বন্টন করা হয়েছিল। বন্টনের এই নীতি আজীবন প্রশ্নবিদ্ধ থাকবে। পেণ্ডেরেল মুনের হিসেব মতো ১৮০,০০০ মানুষ নিহত হয় পাঞ্জাবে। হিন্দু মুসলমান উদ্বাস্তুর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে দশ লক্ষ। প্রফুল্ল চক্রবর্তী জানান, কেন্দ্রীয় সরকারের হিসেব মতে ১৯৪৮ জুলাই মাসের শেষে সাড়ে এগার লক্ষ মানুষ পূর্ববঙ্গ ছেড়ে এসেছে; কিন্তু উদ্বাস্তু-ভবন চলেছে অনেক অনেক কাল ধরে। অন্তত: ৭৫,০০০ নারী ধর্ষিত, লাঞ্ছিত হয়।

উপন্যাসে মনো মাজরা গ্রামটি হয়ে ওঠে বিভিষীকাময়। ছোট্ট রেল স্টেশনটি হয়ে ওঠে গুরুত্বপূর্ণ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট হুকুম চাঁদ রেস্টহাউজে স্থায়ীভাবে অবস্থান নেয়। আশেপাশের এলাকার খবরাখবর রাখে। চন্দননগর থেকে পুলিশের বিশেষ দল নিয়মিত যাতায়াত করে। গ্রামবাসীর চোখে মুখে বোবা কান্না। বুঝতে পারে না এই কান্নার শেষ কোখায়। নিজেদের মধ্যে বিভাজন ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মিত সিং ও ইমাম বকশ সহাবস্থান অটুট রাখার চেষ্টা করলেও স্বার্থান্বেষী মহলের উস্কানির কারণে তা অসম্বব হয়। প্রতিশোধ নিতে শিখ যুবকরা তৈরি হতে থাকে। তারা খুনের বদলে খুন চায়; পাকিস্থান থেকে যত লাশ আসবে তার দ্বিগুণ তারা উপহার দিতে চায়। প্রশাসনও জিম্মি দশায়! তারা নিজেরাই নিরাপত্তাহীনতা অনুভব করে। পরিস্থিতি পর্যালোচনায় গ্রামের সর্দারকে বলতে শুনি, “কোন দুর্ঘটনা ঘটলে আমরা তোমাদের নদী পার করে দিতে সাহায্য করতে পারতাম। কিন্তু দু’দিন ধরে অবিরাম বৃষ্টি হওয়ায় নদীর পানি অস্বাভিক বেড়ে গেছে। নদী পার হওয়ার জন্য দুটো উপায় হলো ট্রেন ও রাস্তার ব্রীজ। ওই দুই জায়গায় কি হচ্ছে তোমরা জান। তোমাদের নিজেদের নিরাপত্তার জন্য আমি পরামর্শ দিই, কয়েক দিনের জন্য ক্যাম্পে আশ্রয় নিতে, পরে তোমরা চলে এসো পরিস্থিতি শান্ত হলে। আমাদের ব্যাপারে তোমরা নিশ্চিত থাকতে পার। তোমরা যদি গ্রামে থাকার সিদ্ধান্ত নাও, এ সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাব। আমাদের জীবন দিয়ে তোমাদের আমরা রক্ষা করব।”

জীবন বাঁচাতে মুসলমানদের স্বরণার্থী ক্যাম্পে সরিয়ে নেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত হয় ওখান থেকেই তাদের পাকিস্থানের ট্রেনে তুলে দেওয়া হবে। মনো মাজরা ছেড়ে আসার সময় হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারনা হয়। একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করে। পরিত্যক্ত ঘরবাড়ি, ছাগল-গরু ভিটে-মাটির পানে তাকিয়ে চোখের জল সংবরণ করতে পারে না। কেউ কেউ বুক চাপড়িয়ে বিলাপ করে। আহা, জন্মমাটির সাথে তাদের আর কোনো সম্পর্কই থাকবে না! ইমাম বকশের মেয়ে নূরাণ গ্রাম ছাড়তে অস্বকৃতি জানায়। ধর্মের বিভেদ ভুলে ডাকাত জুগ্গাত সিংকে সে ভালোবেসেছে। তার পেটে জুগ্গাত সিং-এর সন্তান! কিন্তু জুগ্গাত সিং-এর মা তাকে আশ্রয় দেয় না; মনো মাজরার মাটিতে কোনো মুসলমান মেয়ের জীবন এক মূহুর্তের জন্য নিরাপদ নয়। মা তাকে আশ্বস্ত করে– ‘তোমাকে এখানে রাখা সম্ভব নয়। পুলিশের সাথে আমার নানা রকম সমস্যা আছে। সব কিছু ঠিক হলে এবং জুগ্গা ফিরে এলে সে তোমাকে ফিরিয়ে আনবে। তুমি যেখানেই থাক না সে ঠিক তোমাকে ফিরিয়ে আনবে।’

মুসলমানদের বাড়িঘর, ক্ষেত-খামার রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিলেও রক্ষা করা সম্ভবপর হয়নি; দাঙ্গাবাজ মাল্লী ও তার দলবল সবকিছু লুণ্ঠণ করে। ইতিহাসের চরম দুঃসময়ে পাঞ্জাবের শত্রুঘ্ন নদী ফুঁসে উঠেছিল। সম্ভবত এটাও এক ধরনের বিদ্রোহ! হুঁ-হুঁ করে নদীর জল বাড়তে থাকলে মনে মাজরা ও আশপাশের এলাকা জলমগ্ন হয়ে ওঠে। নদী দিয়ে অসংখ্য লাশ ভেসে আসে। ওইসব লাশ নদী ভাঙনের নয় দাঙ্গার। দাঙ্গাকারীরা পরিকল্পনা করে, যে ট্রেনে শরণার্থীরা পাকিস্থানে যাবে সেই ট্রেনে হামলা চালিয়ে সকল মুসলমানদের মেরে ফেলবে। স্টেশনের পার্শ্ববর্তী সেতুর সাথে দড়ি বাঁধা থাকবে। ফলে ছাদে বসা প্রায় চার পাঁচ’শ শরণার্থী নিচে ছিটকে পড়বে এবং তাদের ওপর তলোয়ার ও বর্শা চালাবে। ট্রেন সেতু পার হলেই জানালা দিয়ে গুলি ছুঁড়বে। ম্যাজিস্ট্রেট হুকুম চাঁদ অসহায়। হঠাৎ হুকুম চাঁদের মাথায় এক বুদ্ধি খেলে যায়। তাদের কাছে আটক থাকা ডাকাত জুগ্গাত সিংকে ছেড়ে দেয় এবং সন্ধ্যার আগে মনো মাজরা গ্রামে পৌঁছে দেয়। হুকুম চাঁদ জানত ওই ট্রেনে করে পাকিস্থানে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে জুগ্গাতের প্রেমিকা নূরাণকে। নূরাণকে বাঁচানোর জন্য জুগ্গাত কিছু একটা করবে বলে তার ধারণা ছিল। অবশ্য অনেকের ধারণা, এ সিদ্ধান্ত যতটা না অসাম্প্রদায়িক তার চেয়ে বেশি প্রেম-কাতরতা। কারণ সেও এক মুসলমান বাইজি মেয়েতে আসক্ত ছিল; যে মেয়ে ওই বিশেষ ট্রেনে পাকিস্থানে যাচ্ছিল। উপন্যাসের সমাপ্তিতে আমরা লক্ষ করি, জুগ্গাত সিং তার নিজের জীবনের বিনিময়ে ট্রেনের সমস্ত মুসলমানদের জীবন রক্ষা করে; জয় হয় সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ভালবাসার।

দীর্ঘ পরিসরের এই উপন্যাসটিতে ট্রেনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। দেবেশ রায় ‘রক্তমণির হারে’ নামে দেশভাগের গল্প সংকলনের প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “এ ধরনের গল্পে বা উপন্যাসে ট্রেনের বা পথের মেটাফর বহুদৃষ্ট হয়।” একথার স্বপক্ষে যথেষ্ঠ কারণ রয়েছে। সংকটময় পরিস্থিতিতে দেশান্তরী হওয়ার সময় ট্রেন যেমন আপাত নিরাপদ মাধ্যম, পথ তেমনি হতভাগ্য মানুষের বাঁচার মাধ্যম। কেউ লাঞ্চিত হয়, কেউ মরে, কেউ কেউ আবার ভাগ্যের জোরে গন্তব্যে পৌঁছে যায়। জুগ্গাত সিং উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় ও আলোচিত চরিত্র। ডাকাত হিসেবে পরিচিত হলেও সে সম্পূর্ণ নীতি-নৈতিকতাহীন নয়। আশেপাশে ডাকাতি করলেও নিজ গ্রাম মনো মাজরায় কোনো অঘটন ঘটাতে অরাজি। মাল্লী ও তার দলবল কতৃক রামলাল খুন হওয়ায় সে ক্ষুব্ধ; প্রতিশোধ নিতে জেলের মধ্যে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করে, অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করে। তবে ইমাম বকশের মেয়ে নূরাণের সাথে অনৈতিক সম্পর্কের কারণে জুগ্গাতের প্রতি আমাদের বিরূপ মনোভাব জন্মালেও শেষ পর্যায়ে মনে হয়েছে কাহিনীর প্রয়োজনেই উপন্যাসিক চরিত্রটিকে এভাবে উপস্থাপন করেছেন। নিজের জীবন বাজি রেখে ট্রেনের যাত্রীদের নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করে প্রকৃত অর্থেই জুগ্গাত এ উপন্যাসের নায়ক।

লেখক হিসেবে খুশবন্ত সিং খোলামেলা এবং বিতর্কিত। যৌনতা বিষয়ে তাঁর বিরুদ্ধে প্রচুর অভিযোগ। তবে আমার কাছে মনে হয়েছে যৌনতার মাধ্যমে তিনি কোনো অচেনা জগতকে স্পর্শ করতে চেয়েছেন। অনেক লাশ দেখার ফলে হুকুম চাঁদ যখন জৈবিক তাড়না অনুভব করে না; বাইজিকে যখন ফিরিয়ে দেয়; অল্পবয়সী মেয়েটিকে দেখে নিজের মেয়ের কথা মনে করে অনুতপ্ত হয়– তখন চরিত্রটি পাঠকের কাছে মানবিক হয়ে ওঠে! চরিত্রকে নিয়ন্ত্রণ করার এটা একটা কৌশল। নিঃসন্দেহে খুশবন্ত সিং একজন কুশলী নির্মাতা। দার্শনিক চেতনায় তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘মৃত্যুর তাৎক্ষণিক ভয়কে তিনি জয় করতে পারলেও মানুষের চূড়ান্ত পারিণতি যে মৃত্যু, এই ভাবনা তার মনে স্থায়ী হয়ে আছে। এই ভাবনাই তাকে করে তুলেছে দয়ালু, পরোপকারী ও সহনশীল। প্রতিকূল পরিবেশে প্রফুল্ল থাকার শিক্ষাও তিনি এই ভাবনা থেকে পেয়েছেন।’

সময়কে সম্মুখে বয়ে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যম হিসেবে তিনি ঋতুকে ব্যবহার করেছেন। চরিত্র ও কাহিনী বর্ণনার পাশাপাশি যাপিত জীবনাচারের নিঁখুত বর্ণনার মাধ্যমে ব্যঞ্জণাময় চিত্রকল্প তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। বইয়ের কাহিনী বিন্যাসে রয়েছে অসামান্য মুন্সিয়ানা। দৃষ্টিভঙ্গির তীক্ষ্ণতায় প্রতিটি মূহুর্ত জীবন্ত হয়ে উঠেছে। কোনো একটি ঘটনা আরোপিত মনে হয়নি। ইকবাল অসাম্প্রদায়িক পক্ষের প্রতিনিধি। উপন্যাসে সম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে পাঠককে যেভাবে সচেতন করে তোলার প্রয়াশ রয়েছে তা প্রশংসার দাবিদার। সার্বিক বিবেচনায় মনে হয়েছে, ‘ট্রেন টু পাকিস্থান’ শুধু উপন্যাস নয়; ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্তি ও উদ্ভুত পরিস্থিতির এক প্রামাণ্য দলিল যেনো-বা!


 

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu