বইয়ের নাম: বগি নাম্বার-জ
লেখক: লুৎফর হাসান
কু ঝিকঝিক শব্দ তুলে আসে যায় একের পর এক রেলগাড়ি। লোকেরা ওঠে-নামে, কত কথা কয়, সরবে কিংবা নীরবে। এরই ভেতরে জমা হয় জীবনের নানা গান-সুর-ছন্দ।
একটা বগির পেটের ভেতর বেড়ে ওঠে সময়ের বিন্দু বিন্দু ক্লেদ, সুখ-দুঃখ আর সুখের গোপন অসুখ। ‘বগি নাম্বার-জ’ এমনই একটি উপাখ্যান। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী গায়ক-লেখক লুৎফর হাসানের লেখা উপন্যাস।
শিক্ষাঙ্গনের আঙিনা আর তার পরিপার্শ্ব জুড়ে লেপ্টে থাকা নানামুখী গল্পের বিবৃতি এই উপন্যাস। বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনের বন্ধুতা, প্রেম, পাওয়া-না পাওয়া, নীরব অনুভব, রাজনীতি, সুন্দরতা, নোংরামি, আগুন-পানি সব এক করে অন্যরকম প্রাণবন্ত কাহিনির অবতারণা করেছেন লেখক লুৎফর।
জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে কতোটা পরিপূরক একে অন্যের তা বড়ো নিপুণতায় ফুটে ওঠেছে ‘বগি নাম্বার-জ’-তে:
‘নির্ভরতা আসলে এরকমই। যখন যা আঁকড়ে ধরে মানুষ, গন্তব্যে না পৌঁছে ছাড়তে চায় না কেউই।’
‘পথ আদতে এক পৃথিবী মায়ার উসকানি। পথের সঙ্গীরা মায়ার বন্ধনে পরস্পরে পরস্পরের নিকটাত্মীয়ই।’
‘এখানে সম্পর্কগুলো সমুদ্রের মতো। বহু পথ পেরিয়ে নদীরা যেভাবেই আসুক, সমুদ্রে এসে যখন মিলে যায় তখন ভেতরে কোনও পার্থক্য থাকে না।’
তুমুল সাহস নিয়ে থাকা মানুষের বেলায়ও অন্যের সঙ্গ জীবনে কতোটা দেদীপ্যমান অনুষঙ্গ তার বয়ান রয়েছে লেখকের কিছু কিছু চরিত্র রূপায়নে। এ কারণেই হয়তো অতোটা সাহসী হওয়া সত্ত্বেও নীলিমের মতো মেয়ের এক সময় মনে হয়– ‘নিঃসঙ্গতা অনেক বড়ো অসুখ।’
লুৎফর হাসান নিরেট বাস্তবতার ছবি আঁকার পাশাপাশি চিত্রকল্প নির্মাণেও বেশ সিদ্ধহস্ত। তাই এমন বর্ণনার দেখা মেলে তার ‘বগি নাম্বার-জ’-তে :
‘ভরপেট খেয়ে আরামে শুয়ে থাকা বুড়ো অজগরের মত খেতে কালো পিচঢালা রাস্তাটা এখন ঘন অন্ধকারে ঢেকে আছে। রাত প্রায় সাড়ে দশ।’
আবার কিছু একান্ত দর্শনকেও খুঁজে পাওয়া যায়:
‘কিছু মানুষ থাকে পৃথিবীতে, যারা নিজেরাই নিজেদের সম্মুখের সময় ও পরিস্থিতি লিখে ফেলতে জানে। যারা ভয় পায় না অন্য কোনওকিছুর। তারা জানে হুট করে যে কেউ মরে যেতেই পারে। সেই মৃত্যুটা মাথা নামিয়ে নয়, নিজের মত হলে কে পায় তারে? এই খ্যাপাটে মানুষেরা খুব ভালো করে জানে, মাথা উচু করে বেঁচে থাকার চেয়ে মাথা উচু করে মরে যাওয়াটাও কম কিছু নয়।’
এদেশের শিক্ষার্থীদের দোদুল্যমান ভবিষ্যতের পানে অভিভাবক মহলের চাতক চোখে চেয়ে থাকার চিত্র পাওয়া যায় এমনভাবে:
‘তর চারকি পাইতে আর কয় বছর পরন নাগব?’
ভালোবাসা কিংবা অভিমানের স্বরূপ খুঁজতে গিয়ে লেখক বলেছেন:
‘অভিমান এক আশ্চর্য রকম অসুখের নাম। প্রশান্তি নির্ভর এক অসুখ। এরকম অসুখ চেয়ে চেয়ে নিতে জানতে হয়। এরকম অসুখে পড়তে হলে ভাগ্য লাগে। সকলেই এই অসুখের ভুক্তভোগী হতে জানে না, কেউ কেউ জানে। অভিমানের অসুখটা মূলত মাতৃঘেঁষা জ্বরের মত।’
‘অভিমান মূলত ভালোবাসার মাঝখানে শুয়ে থাকা এক এক সুখের অসুখ।’
আবার জীবনকে লেখক দেখেছেন এরূপ চোখে:
‘সব ইচ্ছে পূরণ না-হবার নামই জীবন।’
শিক্ষাপ্রাঙ্গণের গল্প মূল উপজীব্য হলেও ‘বগি নাম্বার-জ’-তে সঙ্গত কারণেই প্রতিভাত হয়েছে সমকালীন দ্বন্দ্ব, রাজনীতি, ‘আছে’ থেকে মানুষের ‘নেই’ হয়ে যাওয়া, সমাজ, রাষ্ট্র; আরো কতো কী!
সুখপাঠ্য এ বইটি কি শুধুই যাপিত জীবনের গল্প আর কতোগুলো তারুণ্যদীপ্ত চরিত্রের সমাহার? মোটেই নয়। প্রসঙ্গত এতে উঠে এসেছে সময়ের নানা রূপ-রস-গন্ধ, সেই সাথে নির্মোহ ইতিহাস। ইতিহাসের বিষয় বর্ণনায় বইটির কলেবর বৃদ্ধি পেলেও কিছু কিছু তথ্যবহুল অংশের কারণে বইটি অনুসন্ধানী পাঠকের কাছে একটি reference book হয়ে ওঠা স্বাভাবিক।
সব কথার শেষ কথা, ‘বগি নাম্বার-জ’ নিবিষ্ট পাঠক মনের জন্যে আরামদায়ক । ভালো লাগার অন্যরকম পরশে প্রাণিত করার এক দারুণ উপাদান।