সুরাইয়া জাহান

পাঠ পরিক্রমায় জন্মভিটে

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

কথাসাহিত্যিক ম্যারিনা নাসরীনের গল্পগ্রন্থ ‘জন্মভিটে’। দশটি গল্প রয়েছে বইটিতে। একেকটা গল্প পড়তে পড়তে নানান অনুভূতির জন্ম হয়েছে বুকের ভেতর। প্রথম গল্প ‘বরফের পাহাড়’। একজন অতীব সুন্দরী মায়ের গর্ভে জন্ম নেয়া অসুন্দর কিংবা বলা চলে সাদামাটা এক মেয়ের আত্মকথন। কলেজ শিক্ষক বাবার টানাপোড়েনের সংসারে অনেকগুলো ছেলেমেয়ের নিত্য সুখ-দুঃখ, কলহ-খুনসুটি নিখুতভাবে ফুটে উঠেছে ‘বরফের পাহাড়’ গল্পে। পড়তে পড়তে পাঠক একটা সময় বুকের গভীরে তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করবে যখন শিক্ষক বাবার হাতে বেদম মার খেয়ে আত্মহত্যা করে রুমানা নামের পরীর মতন রূপসী মেয়েটি। এটা যেন কোনোমতেই কাম্য হতে পারে না। পাঠকের খুব কষ্ট হবে রুমানার মৃত্যু মেনে নিতে। মানুষের মন জগতের বৈচিত্র্যময় দিকগুলো দারুণভাবে পরিলক্ষিত হয় ‘বরফের পাহাড়’ গল্পে।

‘আগন্তুক’ একটা পরাবাস্তব গল্প। বাস্তব আর পরাবাস্তবের ফারাক পাঠক বুঝতে পারবে গল্পের শেষে। অতীত আর বর্তমান সময়ের বাম রাজনীতির সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভুল-ত্রুটি নাড়া দিয়ে যায় গল্পের নায়কের হৃদয়ে। রাজনীতির গোলকধাঁধায় নায়ক চলে যান অতীতে। তাইতো লেখকের উপলব্ধিটাই যেন কমরেড শাফায়াতের কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হয় এভাবে– ‘বনেদি বামের অস্তিত্ব খুব কম সময়ের জন্য ছিল এদেশে। যারা ছিল, শালারা চীন সোভিয়েত জিগির তুলে আলাদা হলো, আর নিজের আখের গোছাল। দেশের মাটি মানুষের কথা ভেবে রাজনীতি করেছে ক’জন?’

‘যে জীবনের সাথে হয় নাকো দেখা’– বর্তমান পুঁজিবাদের ঘূর্ণাবর্তে সাহিত্যচর্চা যেন উত্তাল স্রোতের বিপরীতে বৈঠা বাওয়ার মতন কাজ। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র একজন কবি। স্বভাবে বাউণ্ডুলে আর ছন্নছাড়া। শৈশবে বাবা মায়ের বিচ্ছেদ, বিমাতার কাছ থেকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নিগৃহীত হতে হতে মানুষটা ক্রমেই একা হয়ে যায়। নিজের চারপাশে তৈরি করে অদৃশ্য খাঁচা। অনেক মানুষের মধ্যে থেকেও সাঈফ যেন অন্য গ্রহ থেকে আসা আগন্তুক। নিজের মায়ের উপর বিশ্বাস নষ্ট হয়ে গোটা নারী জাতিকেই ঘৃণা করতে শেখে সাঈফ। তার কাছে জীবন মানেই ছলনা আর অবিশ্বাস।

এতকিছুর পরেও জীবন মানেই অপেক্ষা। কার জন্য অপেক্ষা, কিসের জন্য অপেক্ষা– এই ধাঁধার উত্তর খুঁজতে খুঁজতে জীবন পার করে ফেলি আমরা। ট্রেন লাইনের পাশে বসে যেন নিরন্তর অপেক্ষায় থাকি পরবর্তী ট্রেনের। আসলে সেই অপেক্ষা অনন্ত জীবনের, যেমনটি লেখক বোঝাতে চেয়েছেন ‘একটি আপাত সমাপ্ত গল্প’ এর মধ্য দিয়ে।

বিশেষ করে ‘বলিরেখা’ আর ‘জন্মভিটে’ গল্প দুটির কথা না বললেই নয়। জন্মের পর মায়ের সাথে সন্তানের নাড়ির সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে বটে। কিন্তু সম্পর্কের ভিত যেন গভীর থেকে গভীরতর হয় অদৃশ্য এক শেকড়ের মধ্য দিয়ে। যে শেকড় ছিন্ন করবার ক্ষমতা কারোই থাকেনা। সাময়িক সময়ের জন্য সেই সম্পর্কে চিড় ধরে, ফাঁটল দেখা যায়, তারপরও একটা সময় হৃদয়ের গভীরে আমরা ঠিকই শেকড়ের টান অনুভব করি। এ যেন বিধাতার অপূর্ব এক কারিশমা।

সহজ সাবলীল ভঙ্গিতে গল্প বলেন ম্যারিনা নাসরীন। এ যেন আমার গল্প, আপনার গল্প, পাশের বাড়ির চঞ্চলা মেয়েটির গল্প, আত্মভোলা কোনো কবির গল্প। এক গল্পের ভিতর হাজার গল্পের ছায়া। ছায়ার পাশে ছায়া হেঁটে চলে অজানা গন্তব্যে। তাইতো লেখকের ভাষায়, ছায়াগুলো হেলেদুলে সামনের দিকে এগোচ্ছে। রাস্তায় কোনো জনমানবের চিহ্ন নেই। ডাইভারসনে লাগানো গাছগুলো ঝিরিঝিরে বাতাসে হালকা নড়ছে। সুনসান রাতে একটা শব্দই ধীরে ধীরে প্রকট থেকে প্রকটতর হয় ঘড়ঘড়…ঘড়ঘড়… ঘড়ঘড়। এমনই সব দৃশ্যকল্প রয়েছে পুরো গল্পগ্রন্থে।

বইয়ের নাম– জন্মভিটে
লেখক– ম্যারিনা নাসরীন
ক্যাটাগরি– গল্পগ্রন্থ
প্রচ্ছদ– ধ্রুব এষ


 

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu