‘যখন পুলিস ছিলাম’ ধীরাজ ভট্টাচার্যের আত্মজীবনীমূলক সামাজিক উপন্যাস। ধীরাজ একাধারে ছিলেন পঞ্চাশ দশকের উজ্জ্বল উপমহাদেশীয় চলচ্চিত্র অভিনেতা, সুসাহিত্যিক ও পুলিশ কর্মকর্তা। ১৯৩০ সালে লাহোরের ইউনিক পাবলিকেশন্স থেকে ধীরাজের এই আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় যা আজও বেশ পাঠকপ্রিয় এবং সময়ের ঐতিহাসিক দলিল।
প্রাসঙ্গিক লেখক পরিচিতি :
মূল বইটি সম্পর্কে আলোচনার আগে ধীরাজ ভট্টাচার্যের একটু পরিচিতি দেয়া যাক। ধীরাজ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯০৫ সালে, যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার পাঁজিয়া গ্রামে। তাঁর পিতা ললিতমোহন ভট্টাচার্য ছিলেন একজন ব্রাহ্মণ ও স্কুল শিক্ষক। নিজ গ্রাম পাঁজিয়ার স্কুলে শৈশবশিক্ষা শেষে কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিশন থেকে ১৯২৩ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেন তিনি। এরপর আশুতোষ কলেজে পড়ার সময় সিনেমার প্রতি প্রবল অনুরাগ জন্মে তাঁর যা তাঁকে কলেজ শেষ করতে দেয় নি। কিন্তু চলচ্চিত্রের প্রতি এই অনুরাগ তাঁর পরিবার নাকচ করে দেন। ফলে চলচ্চিত্রে ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন পেছনে ঠেলে বাবার আদেশে তাঁকে ভর্তি হতে হয় কলকাতা পুলিশের ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চে। এরপর ঘটনাক্রমে কলকাতা, বার্মা, চট্রগ্রাম এবং সবশেষে কক্সবাজারের টেকনাফে বদলি করা হয় তাঁকে। আত্মজীবনী ”যখন পুলিস ছিলাম’-এ মূলত তাঁর কর্মকালের নানা বৈচিত্র্যময়, লোমহর্ষক ও হৃদয়বিদারক ঘটনার উপস্থাপন করেছেন তিনি।
ধীরাজ ভট্টাচার্য প্রথম জীবনে পারিবারিক বাধায় চলচ্চিত্রে ক্যারিয়ার গড়তে ব্যর্থ হলেও পরবর্তীতে বেশ সফলভাবেই এ জগতে বিরাজ করেন। ১৯২৪ সালে চলচ্চিত্র পরিচালক জ্যোতিষ বন্দোপাধ্যায়ের হাত ধরে এক নির্বাক চলচ্চিত্রের মাধ্যমে অভিনয় জগতে যাত্রা শুরু হয় তাঁর। ধীরাজ অভিনীত অন্যান্য নির্বাক চলচ্চিত্রের মধ্যে সতীলক্ষ্ণী, গিরিবাল, কাল পরিণয়, মৃণালিনী এবং নৌকাডুবি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। সবাক যুগে ধীরাজের প্রথম চলচ্চিত্র ছিল ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’। এছাড়া তাঁর অন্যান্য সবাক চলচ্চিত্রের মধ্যে যমুনা পুলিন, দক্ষযক্ষ, বসনত্মসেনা, নরনারায়ণ, কৃষ্ণসুদামা ইত্যাদির নাম করা যায়। মরণের পরে, হানাবাড়ী, রাত একটা, ডাকিনলার চর তাঁর দর্শকনন্দিত চলচ্চিত্রগুলোর তালিকায় প্রথমের দিকে থাকবে।
সাহিত্য জগতেও ধীরাজের আগ্রহ ছিল অপার। ‘যখন পুলিস ছিলাম’ ছাড়াও নিজ অভিনয় জগতের নানা ঘটনা নিয়ে লিখেছেন আরেক আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘যখন নায়ক ছিলাম’। তাঁর অন্যান্য প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে মন নিয়ে খেলা, সাজানো বাগান, মহুয়া মিলন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
‘যখন পুলিস ছিলাম’: পর্যবেক্ষণ ও মতামত
‘যখন পুলিস ছিলাম’ জীবনীগ্রন্থটি বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পর শোকগ্রস্থ পারিবারের সংকট এবং পারিবারিক অসহযোগিতায় চলচ্চিত্রে ক্যারিয়ার গঠনে ব্যর্থ হয়ে অনিচ্ছায় পুলিশে যোগদান করা ধীরাজ ভট্টাচার্যের জীবন আলেখ্য। পাশাপাশি তাঁর বৈচিত্র্যময় ও প্রতিকূল পেশাগত জীবন এবং বিশেষ গুরুত্ববহ ঘটনা হিসেবে টেকনাফে চাকুরিরত অবস্থায় এক মগ তরুণীর সাথে তাঁর ঐতিহাসিক প্রেম পাঠকের চোখে চিত্তাকর্ষক এক কাহিনী হিসেবে ধরা দেবে।
স্বভাবতই চলচ্চিত্রের প্রতি ধীরাজ যতটাই মনোযোগী ও আগ্রহী ছিলেন পুলিশের চাকরিতে ছিলেন ততটাই ব্যর্থ ও উদাসীন। চাকুরীর সময়টা ছিল স্বদেশী আন্দোলনের। ইংরেজ শাসনামলের বিরুদ্ধাচরণ করা বিপ্লবীদেরকে গ্রেপ্তার এবং তাদের প্রতিরোধ ব্যর্থ করে দেওয়াই ছিল তৎকালীন পুলিশের মূল দায়িত্ব। এজন্য দেশপ্রেমিক ভারতীয়দের চোখে পুলিশের চাকুরী খুব একটা সম্মানজনক ছিল না তখন। একজন দেশপ্রেমিক ধীরাজ তাই কর্তব্য পালন ও দেশপ্রেমের মাঝে পড়ে নিজ অবস্থান নিয়ে দোলাচলে দুলেছেন বহুবার। আত্মজীবনীমূলক বইটিতে কর্মরত অবস্থায় নিজের নানা ব্যর্থতা, বোকামি ও ভীরুতার উদাহরণ স্পষ্টভাবে নিজ ভাষায় উপস্থাপন করেছেন তিনি। বইটির কোথাও ধীরাজ নিজেকে ‘বীর বা সাহসী’ হিসেবে গণ্য করেননি। তবে তিনি ছিলেন বেশ মিশুক, অমায়িক ও হৃদয়বান। ভালো গান গাইতে পারতেন, আশেপাশের মানুষকে মাতিয়ে রাখতে পারতেন বন্ধুত্বের সুসম্পর্ক দ্বারা। তিনি একজন প্রেমিকও ছিলেন কি? একবার ইংরেজ পুলিশ প্রধানের স্ত্রীর সাথে তাঁর হৃদয়ঙ্গমতা নিয়ে কলকাতা পুলিশে যে ঝড় উঠেছিল তার সত্য মিথ্যা যাচাইয়ে পাঠককে বইটি পড়তে হবে।
১৯২৩-১৯২৪ সালের দিকে ধীরাজকে কলকাতা পুলিশ থেকে বিশেষ কারণে দোষী সাব্যস্ত করে; শাস্তিস্বরূপ বদলি করা হয় কক্সবাজার জেলার দুর্গম টেকনাফে । সেই বিশেষ কারণটি কী ছিল তা উপন্যাসটির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পাঠককে সেই বিশেষ কারণটি নিজ দায়িত্বে আবিষ্কারের আমন্ত্রণ জানাই। যাহোক, সে সময় চট্টগ্রাম থেকে উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে স্টিমারে টেকনাফে যেতে সময় লাগত আড়াই দিন। ধীরাজের বর্ণনায় পাঠকরা তৎকালীন কক্সবাজার-চট্টগ্রাম ও দুর্গম টেকনাফের যাতায়াত, জনজীবন ও পরিবেশের কথা বিশেষভাবে জানতে পারবেন। জানতে পারবেন, টেকনাফে বসবাসকারী ‘মগ’ অধিবাসীদের কথা, তাদের কৃষ্টি-কালচার ও জীবন যাপনের বৈচিত্র্যময় নানা কাহিনী। সমুদ্রের পানি থেকে তৈরি চোরাই লবণ বিক্রেতাদের ধরতে এক আবগারি কর্মকর্তার সহযোগী হিসেবে ধীরাজের টেকনাফ থেকে বহুদূরের মরিআলাতে চারদিনের হাঁটা পথের অভিযান পর্বটি পাঠককে রোমাঞ্চিত করার পাশাপাশি গায়ে ভয়ের শিহরণ জাগাবে। গহীন বনজঙ্গল, পর্বত, পাহাড়ী নদী পেরিয়ে মৃত্যু, সাপ, বাঘ ও বুনো হাতির আক্রমণকে রুখে দেয়া সেই অভিযানে ধীরাজের সঙ্গী ছিলেন দশ পুলিশ কনস্টেবল ও কিছু মগ আদিবাসী।
তবে টেকনাফে কর্মরত অবস্থায় ধীরাজের জীবনের মোড় পরিবর্তন করা ঘটনা ছিল স্থানীয় মগ জমিদার কন্যা, মাথিনের সাক্ষাৎ লাভ। থানার কূপ থেকে প্রতিদিন সখীবেষ্টিত হয়ে জল সংগ্রহে আসত কিশোরী মাথিন। সময়ের সাথে সাথে ধীরাজের হৃদয়ে স্থান দখল করে ফেলে সেই সুদর্শনা। দুজনের মুখের ভাষা ভিন্ন হলেও চোখের ভাষায় তারা নিজেদের কাছে টেনে নেন। এক পর্যায়ে, জাতপাত-ধর্ম-বয়স-পেশা ভুলে ধীরাজ মাথিনের সাথে বিবাহ বন্ধনের দিন-তারিখ-ক্ষণ ঠিক করে ফেলেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে বিচ্ছেদ বেদনায় পুড়তে হয় এই প্রেমীযুগলকে। কক্সবাজার জেলার শেষ সীমান্তে টেকনাফ থানার কম্পাউন্ডে অবস্থিত শত বছরের পুরনো বিশুদ্ধ পানির ‘মাথিনের কূপ’ ধীরাজ-মাথিনের সেই যুগপৎ প্রেম ও বিরহের নিদর্শন হিসেবে আজও দর্শনার্থীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে আছে।
প্রশ্নগুলির উত্তরসহ তৎকালীন পুলিশপেশা সংশ্লিষ্ট বিচিত্র ঘটনাবলী এবং কলকাতা থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত নানা অ্যাডভ্যাঞ্চারে ভরপুর বইটি পড়তে দর্শকের বেশ লাগবে। কাহিনী ও প্রেক্ষাপট প্রায় শত বছর আগের হলেও ধীরাজ ভট্টাচার্যের সাবলীল, স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থাপনায় ‘যখন পুলিস ছিলাম’-কে এক সর্বকালীন প্রেমগাঁথা তথা সামাজিক উপন্যাসের মর্যাদা দেয়া যায়।