জাকির হোসেন
জন্ম ২৭ জুন ১৯৯৩ সালে চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর ঝর্ণাপাড়ায়। গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলায়। প্রকাশিত গ্রন্থ: পোলাও পাতা ও অন্যান্য (গল্পগ্রন্থ)
জাকির হোসেন

ছোটগল্প কিংবা কিসসার আলাপ

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

এবং নাসরিন সাথী। নাসরিন নামের সকল লেখিকারাই তুখোড় মেধাবী ও দরদী সাহিত্যিনুরাগী হন। তাসলিমা নাসরিনকে নিয়ে যেমনতর বিতর্ক থাকুক না কেন– উনার লেখনী শক্তি নিয়ে এহেন সমালোচকরাও দ্বিধা রাখেন না।আবার নাসরিন জাহানের সাহিত্যে ডুবে আছে অগণিত মুগ্ধ পাঠক।

বলছিলাম নাসরিন সাথীর কথা। তাঁর রচিত গল্পগ্রন্থ ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’ এর কথা। বইমেলা ২০১৮ গল্পগ্রন্থটি প্রকাশ করেছে দাঁড়িকমা প্রকাশনী। প্রথম পলকে বইটি দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। প্রচ্ছদটি আমাকে আকর্ষিত করেছে জাদু দেখানোর আগে জাদুর জিনিসপাতি দেখানোর মতন।আবার সত্যি কথা এই জাদু দেখানোর আগে জিনিসপাতি দেখাতে গিয়ে যদি ত্রুটি ধরা পড়ে,তবে স্বদিচ্ছা স্বাভাবিকভাবে মন খারাপের দরোজায় টোকা দেয়। বইয়ে প্রচ্ছদকারের নাম না থাকাই মর্মাহত হয়েছি কিংবা প্রচ্ছদটি যদি কোথাও থেকে নেয়া হয়ে থাকে তবে সংগৃহীত লিখে দেয়া বাঞ্ছনীয় ছিল। আর এর দায় কোনোভাবে প্রকাশক এড়াতে পারেন না।লেখিকার বিষয়টি নিয়ে সচেতনতার প্রয়োজন ছিল। কারণ শিল্পীর জন্য শিল্পী। গল্পকার একজন শিল্পী, প্রচ্ছদকার একজন শিল্পী, কবি একজন শিল্পী, ক্যামেরাম্যান একজন শিল্পী। এভাবেই আমাদের সৃষ্টিশীল শিল্পজগৎ।

মূলত সাহিত্য পাঠে আমার প্রিয় পাঠ্যাভ্যাস হল বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের সাক্ষাৎকার পড়া। এরপরে উপন্যাস ও ছোটগল্প যুগ্মভাবে স্থান দখল করে আছে। প্রবন্ধ তৃতীয়তে। আর কবিতাকে কোনো স্থান দিইনি। তবে এই ভেবে আমি তৃপ্ত যে কবিতা আমার পছন্দের সব কয়টি স্থান ইজারা নিয়ে রেখেছে ! যাকে সরানোর মতো কোনো সম্বল নেই। যার দেনা চুকিয়ে দেয়ার মতো কোনো শক্তি আমার নেই।

ছোটগল্প আমার কাছে খালের উপর সাঁকোর মতো ঠেকে।এইখানি পথ অথচ পার হতে কতো বিতিকিচ্চা। এই বুঝি পড়ে গেলাম! এই বুঝি সাঁকো ভেঙ্গে গেল! তারপর পার হয়ে পাড়ে এসে উঠলে কী তৃষাতৃপ্ত উচ্ছ্বাস!

কথাসাহিত্যিকরা সমাজ সংস্কারে সরাসরি ভূমিকা রাখতে পারেন। উপন্যাসে যেখানে একটা সমাজের কথকতা উঠে আসে ঠিক সেখানেই ছোটগল্পে ঘটনাগুলোকে ছোট করে বলা হয় অথচ ছোট করে বলা কথাগুলোর সারমর্ম আদৌতে ছোট নয় বরং গভীর ও তুমু্ল তাৎপর্যপূর্ণ।

নাসরিন সাথীর লেখনী ভাষা একান্তই নিজের। প্রত্যেক সাহিত্যিকেরই নিজের ভাষা থাকে কিন্তু বেশিরভাগ লেখকের নিজস্ব ঢং থাকে না। সেই ঢংয়ের দিক থেকে তিনি স্বতন্ত্র ও স্ববলয়বান।

লেখিকা যখন দেনমোহর গল্পে নীলার মাধ্যমে শান্তাকে দেনমোহরের সবক দেন। প্রকৃতপক্ষে তখনই তাঁর মুন্সিয়ানার পরিচয় মিলে। একজন মেয়েকে বোঝাতে একজন মেয়েই যথেষ্ট। দেনমোহর গল্পেও ঠিক তেমনটি ঘটেছে। আবার কামিয়াবি গল্পে ঘটেছে ঠিক উল্টোটা। গল্পটিতে বুঝিয়ে শুনিয়ে একজন আরেকজনকে অন্ধ বিশ্বাসে বিশ্বস্ত হতে সাহস দেন। অবণী, জামিল, শেহবাজ ও রুমালি বাবা এই চারটি চরিত্রকে কল্পনা করতে গিয়ে আমি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লাল সালুর মধ্যে ডুব দিয়ে ফেলি। কেননা ধর্মান্ধতা বা কুসংস্কারকে পড়ার সময় লাল সালুর কথা মনে পড়ে যায়।

“একটি টিয়া যেন আরো দুটি প্রাণীকে মুক্তির আনন্দ দিয়ে গেল” এমন সাবলীল বাক্য ছোটগল্পকে পরিপূর্ণতা দেয়। টিয়া গল্পের একেবারে শেষে লাইনটি পড়ার পর ছোটগল্পের সার্থকতা খুঁজে পেলাম। সেরা বিস্ময় গল্পে আমার প্রিয় বিষয়টি যথাযথ স্থান খুঁজে পায়। লেখিকা কিংবা গল্পকার গল্পটিতে সমাজ সংস্কারে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছেন বলে মনে করি। আশঙ্কা গল্পে লেখিকা যথেষ্ট শালীনতা বজায় রেখেছেন। ঠিক এই গল্পটিই যদি অন্য কেউ লিখতেন কিংবা লেখিকা যদি শালীনতা না মানতেন তবে গল্পটিকে আমরা উন্মুক্ত পেতাম। আর এই জন্যে ধন্যবাদ দেয়া যেতে পারে কারণ তিনি শালীনতার মধ্যে গল্পটির মূলভাব পাঠককে ধরাতে পেরেছেন। মরীচিকা গল্পটি পাঠক মনে দারুণ দাগ কেটে যায়। প্রবাসীদের যাপিত জীবনের কথকতা উঠে এসেছে গল্পটিতে। বিচ্ছেদ–বিচ্ছেদ–বিচ্ছেদ। সুখ থেকে বিচ্ছেদ, স্বপ্ন থেকে বিচ্ছেদ, সংসার থেকে বিচ্ছেদ। শেষতক প্রেম থেকে বিচ্ছেদের গল্প মরীচিকা। এই গল্পটিতে আশঙ্কা গল্পের মতোই লেখিকা শালীনতা বজায় রেখেছেন। এক কথায় পাঠককে এইটিন প্লাস শব্দ দুটি পড়ার সুযোগ দেননি।রাইহানা গল্পটিতে গল্পকারের চিন্তাগত ঘাটতি ছিল বলে মনে করি। গল্পটিকে আরো কৌতূহলী করা যেতো। সন্তানকে কেবল শাসন করলে হয় না ভালোবাসায় মোড়াতে হয় সুশাসনের লেবাসে। রাইহানা পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে একজন গর্বিত মায়ের মতো তিনি বলতে চেয়েছেন সন্তান কীভাবে মানুষ করতে হয় কিংবা বোঝাতে চেয়েছেন কঠোরতায় কাল!

গাছের ছায়ায় বসে বহুদিন কাটিয়েছি
কোনোদিন ধন্যবাদ দিইনি বৃক্ষকে,
এখন একটা কোনো প্রতিনিধি বৃক্ষ চাই
যাঁর কাছে সব কৃতজ্ঞতা সমীপেষু করা যায়।
(ছায়ার জন্য,সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়)

তবে কি সুনীলের কবিতার মতন ছায়া সুনিবিড়ের অদিতি একটি প্রতিনিধি বৃক্ষ খুঁজছিলেন?
.
পরাজিত বিজয় গল্পের ভাবনাটা বেশ ভারী। ভারী এই জন্যই বলা কারণ মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখতে হলে সাহস ও ভার নেয়ার মানসিকতা থাকতে হয়। পরাজিত বিজয় গল্পে লেখিকার ভার নেয়ার মানসিকতা ছিল তবে তিনি কিছু ভার পাঠককে দিতে পারতেন।
.
অর্থাৎ পাঠককে গল্পের মাঝে মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযোদ্ধার বিজয় অর্জনের বহু বছর পরের যে করুণ দশা সেই সম্পর্কে আরো বয়ান করতে পারতেন। বলে রাখা প্রয়োজন, এখন পাঠক কম কিন্তু যারা আছে তারা পড়তে চায়। সুতরাং পঠিয়সী পাঠকদের পড়ানোর দায়িত্ব একান্তই লেখকের নিজের।

তুমি আমারে মিত্তা কতা কিল্লাই কইছো– বাংলা সাহিত্য বোধ করি বিশ্ব সাহিত্যের প্রেমের শুরু এমন মায়াময় মিথ্যায়।গল্পগ্রন্থের মায়া গল্পটির মূল গল্প শুরু হয়েছে কাজের মেয়ে সোনিয়ার মিথ্যা বলার মাধ্যমে। মেঘনা পাড়ের আর্তনাদ আমার দৃষ্টিতে সার্থক গল্প হওয়ার কাছাকাছি। সার্থক গল্পের উপযুক্ত উপাদান লেখিকা গল্পটিতে ব্যবহার করতে পেরেছেন।

গল্পগ্রন্থের শিরোনাম করা গল্পটির গুণগত গরিমা লক্ষ্য করা যায়। আমরা জানি, গরিমা গড়ে উঠে রচনাকারীর শব্দ বুনন ও গল্পের ঘটনানুযায়ী। লেখিকা এই জায়গায় এসে সমালোচনার উর্ধ্বে। ডিটেক্টিভ গল্পে প্রচুর রোমাঞ্চ প্রয়োজন হয়। প্রয়োজন হয় শিহরণ জাগানিয়া কথামালার। একটি আত্মহননের নেপথ্যে গল্পটিতে এসব উপাদানের অভাববোধ করেছি। ইনবক্স গল্পের জোর ভালো ছিল। গ্রন্থের ছাইচাপা ভালোবাসা গল্পটি পাঠক এড়িয়ে যেতে পারেন না। নস্টালজিক প্রেমের গল্প হিসেবে ছাইচাপা ভালোবাসা শিরোনামটি পাঠককে নজরবন্দি করে। তবে সব কিছুকে ছাপিয়ে গেছে ২৫ শে জুন। শেষ হইয়াও হইলো না শেষ গল্পগ্রন্থের সবচে’ সুন্দর গল্প ২৫ শে জুন।

মোদ্দাকথা প্রথম বই হিসেবে লেখিকা কম যান না। গল্পকার হিসেবে দৌড় আছে ভালো। কেবল থামার শৈল্পিক গতি রেখে অবিরাম ছুটে চললেই আমরা দ্রুত সেরাটা পাবো বলে আশা রাখি।

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu