আনোয়ার কামাল
জন্ম ২ জানুয়ারি ১৯৬৩ পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলায়। কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, ফিচার ও কলাম লেখেন। সম্পাদনা করেন "এবং মানুষ" লিটলম্যাগ। উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত গ্রন্থ: জাদুবাস্তবতা ও অন্যান্য (২০১৭), নৈঃশব্দের রাত্রিদিন (২০১৫)
আনোয়ার কামাল

বাঙালির আত্মপরিচয় ও অন্যান্য : একটি অনন্য উপস্থাপনা

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

বাঙালির আত্মপরিচয় বহুকালের দ্বন্দ্ব-সংঘাত-সংগ্রাম-বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে প্রাচ্য-প্রতীচ্যের মিলনে এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মাধ্যমে স্বাধীন সত্তায় পরিপূর্ণতা নিয়ে এসেছে। যাঁদের কৃতকর্ম-উদ্দীপনায়, আন্দোলন-সংগ্রামে ও বৈচিত্র্যের জাগরণে বাঙলার সমাজকে, বাঙালির চেতনাকে অগ্রসর করে স্বাধীনরূপে প্রাণের স্পন্দন দিয়েছে, তাঁদের জীবন ভাবনা উপস্থাপিত হয়েছে বাঙালির আত্মপরিচয় ও অন্যান্য প্রবন্ধগ্রন্থে। কালের ইতিহাসে সুনির্দিষ্ট হয়ে আছে সেই পথ-প্রাচীন যুগ থেকে মধ্যযুগ, মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগ, আধুনিক যুগ থেকে বিজয়ের সুচনালগ্ন, যুগ থেকে যুগান্তর। তারই এক ধারাবাহিক চিত্র যেন প্রস্ফুটিত হয়েছে আলোচ্য প্রবন্ধগ্রন্থে। বাঙালি জাতির যুগ যুগের নানা চড়াই-উৎরাই, ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত পথ পরিক্রমা, স্বাধীন একটি রাষ্ট্রে বাঙালি স্বকীয়তা নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো যে কালপরিক্রমা, তারই নির্যাসটুকু চুম্বকাগারে তুলে ধরা হয়েছে– ‘বাঙালির আত্মপরিচয় ও অন্যান্য’ প্রবন্ধগ্রন্থে।


বাঙালির পথের আলোর দীপ্তি নিয়ে শ্রী চৈতন্যদেব থেকে রাজা রামমোহন রায়-ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর; বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই দীপ্তি বিশ্বে ছড়িয়ে দিলেন। বাংলা সাহিত্য, বাংলার মানুষ, বাঙালি সম্প্রদায়-এ যেন পরিচিত এক অমিত সম্ভাবনা। আর সেই সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে সংগ্রামের অগ্নিশিখা নিয়ে এলেন বিপ্লব ও সাম্যের কবি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তারই ধারাবাহিকতায় পরিসমাপ্তি টানলেন বাঙালি জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনিই পূর্ণতা এনে দিলেন বাঙালির আত্মপরিচয়ের দিক দর্শন। এ সবই তুলে ধরা হয়েছে কবি, প্রাবন্ধিক ও ‘সুন্দরম’ পত্রিকার সম্পাদক কামরুল ইসলামের ‘বাঙালির আত্মপরিচয় ও অন্যান্য’ প্রবন্ধগ্রন্থে। প্রাবন্ধিক কামরুল ইসলাম একজন বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ হওয়ায় তার লেখায় রাজনীতির স্বচ্ছ একটি আমেজ তার পাঠকরা সবসময়ই পেয়ে থাকে, আর এ প্রবন্ধেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি।

গ্রন্থটির শুরুতেই প্রবন্ধকার নিবেদনে বলেছেন, ‘বিশ্বজগতের প্রকাশের কোন কৃপণতা নেই, সর্বত্রই যেন– প্রাচুর্যে, ঐশ্বর্যে, সৌন্দর্যে বহুমাত্রিক উপস্থাপনা। জগতের অনন্ত সত্য কালে-কালে বৈচিত্র্যে আবির্ভূত হয়, সেই প্রকাশের আনন্দই ঐশ্বর্য লাভ ঘটে। বহুকালের পরিক্রমায় বাঙালির অফুরন্ত বেদনার অশ্রুধারা নবজাগরণের অপূর্ব বিকাশে পরিবর্তনের দ্বান্দ্বিকতায় সমাজ ও সভ্যতার রূপান্তরে মৃত্যুঞ্জয়ী শক্তি সংগ্রাম ও সৌন্দর্যের তরঙ্গলীলায় জ্যোতির্ময় গৌরব নিয়ে আসে।’ প্রকৃতই তাই আমরা তার এ প্রবন্ধগ্রন্থটি পাঠ করলে তার একটি সরল সাবলীল উপস্থাপনা আমাদের ভিন্ন জগতে প্রবেশে উপনীত করে।

প্রবন্ধগ্রন্থটিতে মোট নয়টি দীর্ঘ প্রবন্ধ তুলে ধরা হয়েছে। যার ক্রমঃ অনুসারে আমরা দেখতে পাই ‘বাঙালির আত্মপরিচয় : প্রসঙ্গ বিবেচনা’, বাঙালি সমাজ ও আত্মপরিচয়, ‘রামমোহন রায়: উনিশ শতকের আধুনিক বাঙালি’, ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর: রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় আধুনিক মানুষ’, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: বাঙালির বিশ্বসাধক’, ‘কাজী নজরুল ইসলাম: বাঙালির বিদ্রোহী সত্তা’, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: বাঙালির স্বাধীন আত্মপরিচয়ের স্থপতি’, ‘জীবনানন্দ দাশের সর্বশেষ উপন্যাস ও অন্যান্য’ এবং ‘বাংলাদেশের নাট্যচর্চায় গ্রাম থিয়েটার’, এসব নিয়েই ডালি সাজানো হয়েছে ‘বাঙালির  আত্মপরিচয় ও অন্যান্য’ প্রবন্ধগ্রন্থ।

বাঙালির আত্মপরিচয় প্রবন্ধে, সহস্র বছরের পরিক্রমায় বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা এরই মাধ্যমে তার যে প্রকৃত আত্মপরিচয় তা অনুরণিত হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন বৌদ্ধ সহজিয়া সম্প্রদায়ের সাধন-ভজন গীত থেকে শুরু করে গৌতম বুদ্ধের জন্মের পূর্বেও বাংলায় হিন্দু জাতি বসবাস করতো। বাঙালির ইতিহাসে ভারতে প্রাচীনকাল থেকেই বহু মিশ্রণে-সংঘাতে-সংশ্লেষে-সমন্বয়ে অগ্রসর হয়েছে। আদিকালে আর্য-অনার্যের বিরোধ, বৌদ্ধধর্মের প্রভাব এবং পরবর্তীকালে মুসলমানের আগমন ভারতের রাজনৈতিক সাংস্কৃতিতে নতুন ধারার সৃষ্টি করে। মুসলমানরা ভারতবর্ষে সুদীর্ঘকাল রাষ্ট্র পরিচালনা করে। প্রায় সাড়ে পাঁচশত বছর মুসলমানদের ব্যাপক প্রভাব-প্রতিপত্তি সর্বত্র ছিল। এই প্রবন্ধে ইবনে বতুতার শাসনামলের বিবরণ, চৈতন্যদেবের প্রভাব, ভাবজগতের সাথে জীবজগতের অপূর্ব সমন্বয়, ভারতে ইসলামী সুফীদের প্রভাব, স্রষ্টাপ্রেমে ভক্ত শ্রী চৈতন্য হিন্দুধর্মের ভেদাভেদের বিরুদ্ধে ভাবদ্রোহ সৃষ্টি করেন। প্রথাগতের সাথে বিরোধ এবং মানবের প্রেমধর্মকে প্রধান উপজীব্য করে তাঁর যে ভাব-আন্দোলন মধ্যযুগে তা ব্যাপক প্রভাব পড়ে। চৈতন্যদেবের ভাবধর্মের মূলমন্ত্র ছিল  ধর্মের সাথে জীবসেবার সংযোগ অর্থাৎ ‘জীবের দয়া, নামে রুচি’।

প্রবন্ধগ্রন্থে মধ্যযুগের শ্রীচৈতন্যদেব, উনিশ শতকের নবজাগরণ সৃষ্টিকারী রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা স্থপতি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি সন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁদের বিচিত্র জীবনের বৈচিত্রময় বিষয়াদি নিয়ে ‘বাঙালির আত্মপরিচয় ও অন্যান্য’ গ্রন্থটি সন্নিবেশিত হয়েছে।

অনন্য সুন্দর দালিলিক উপস্থাপনায় ঋদ্ধ এই প্রবন্ধগ্রন্থটি স্বারস্বত থেকে বৈশাখ ১৪২১, এপ্রিল ২০১৪ প্রকাশ করা হয়েছে। প্রচ্ছদ করেছেন চারু পিন্টু। মূল্য রাখা হয়েছে তিনশত পঞ্চাশ টাকা মাত্র।


বাঙালির আত্মপরিচয় ও অন্যান্য

লেখক : কামরুল ইসলাম

প্রচ্ছদ : চারু পিন্টু


 

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu