কাহিনি সংক্ষেপ : যখন চাঁদের বুক থেকে রক্ত ঝরে পড়ে, সেই রক্তিম চন্দ্রগ্রহণের অশুভ নিশীথে গ্রামের জলাভূমি থেকে উত্থিত হয় এক ভয়াল দানব, আলেয়া– একটি সুপ্রাচীন গ্রামীণ কিংবদন্তী। কিন্তু একবিংশ শতাব্দিতে এসে এই কিংবদন্তীই বুঝি ফিরে এলো! গ্রাম থেকে একের পর এক উধাও হয়ে যাচ্ছে মানুষ। খবর পেয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করতে ছুটে এলো তরুণ সাংবাদিক শাহরুখ রাদিব খান। দৃশ্যপট দেখে তার বুকের ভেতর জেগে উঠল একটি পুরাতন কূপ– এমনই এক ঘটনায় শৈশবে হারিয়েছিল প্রিয় বন্ধুকে! বহুদিনের চাপা পড়া সেই বিবর্ণ স্মৃতি ফের জেগে উঠল মনে; এই দানবের সাথে অনেক বোঝাপড়া বাকি আছে তার! আবেগের আতিশয্যে খালি হাতেই দানবটার মুখোমুখি হয়ে গেল বেচারা!
…শেষপর্যন্ত কী ঘটেছিল তার কপালে?
পর্যালোচনা : বাল্যবেলার বিজ্ঞান বইয়ে লিখিত ছিল, আলেয়া একটি গ্রামীণ কুসংস্কার। পুরাতন হাজামাজা পুকুরে রাতের বেলায় বাতাসের সংস্পর্শে দপ করে জ্বলে ওঠে মিথেন গ্যাস। গ্রামের মানুষ বলে, জ্বলে উঠেছে ভুতের আলো– আলেয়া। বাস্তবিকই বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে আলেয়া কুসংস্কার, তবে সাহিত্যের তাতে কিছুই আসে যায় না। এই কুসংস্কারকে উপজীব্য করে ড্যামকেয়ার ভঙ্গিমায় ড্যাশিং এক ফ্যান্টাসি নভেলা লিখে ফেলেছেন বাংলা হাই ফ্যান্টাসির আদি দিকপাল আশরাফুল সুমন। সাহিত্য একটি আর্ট এবং কুসংস্কার নিঙড়ে সাহিত্য বের করে আনাটা একজন বড় আর্টিস্টের পক্ষেই সম্ভব ৷ লেখকের চাই গল্প, তা সত্য হলে ভালো, না হলে যেন আরও ভালো। বিজ্ঞানকে থোড়াই কেয়ার করে, সাহিত্যের সাথে বিজ্ঞানের আবহমান বিরোধে আরেকটু ঘি ঢালার প্রয়াস নিয়ে, গ্রামীণ কুসংস্কারের গায়ে রঙ চড়িয়ে লেখক এমন একটি মুখরোচক গল্প ফেঁদেছেন যা পড়ার পর মনে হয় আলেয়া বিজ্ঞান না হয়ে কুসংস্কার হলেই ভালো হত, পচা মিথেনের প্রজ্জ্বলন অপেক্ষা ভয়াল দানব হলেই ভালো জমত! এখানেই একজন লেখকের কুশীলতা, পাঠকের মনের নিয়ন্ত্রণ বুঝে নিতে পারাটাই তাঁর সর্বৈব সার্থকতা। শুনতে পাই, তিনি নাকি একের পর এক গ্রামীণ মিথোজগুলোকে প্রশ্রয় দিয়ে সিরিজ লিখে যাবেন! সেক্ষেত্রে তথাকথিত গ্রামীণ ‘কুসংস্কার’গুলোকে শিল্পিত আঁচড়ে এভাবে বাঁচিয়ে রাখার এই মহান উদ্যোগকে স্বাগত জানাই।
ঘরানার বিচারে আলেয়া একটি প্রাইমারি ওয়ার্ল্ড ফ্যান্টাসি উপন্যাসিকা। এর সেটিংস আমাদের চিরচেনা পৃথিবী, এমনকি প্লট ও চরিত্রগুলোও পৃথিবীয়। একমাত্র অ্যান্টাগনিস্ট আলেয়া অচেনা জগতের প্রতিভূ হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে ফ্যান্টাসি গল্পের স্বাদ জোগাতে। আরেক বিচারে একে বলা যেতে পারে থ্রিলারীয় ম্যাজিকাল রিয়েলিজম– যেহেতু আমাদের চিরচেনা জগতের ভেতরেই সংঘটিত হয়েছে যাবতীয় অতিপ্রাকৃত ঘটনাগুলো, ম্যাজিক ও রিয়েলিটি একাকার হয়েছে অবিচ্ছেদ্য সঙ্গমে। আবার যেহেতু শেষ পর্যন্ত এই ভয়াল দানবের সুনির্দিষ্ট পরিচয় বের করা যায়নি, সে কোন কসমস থেকে বেরিয়ে আসে তার ঠিকুজি মেলে না, অথচ অজ্ঞাত এক কসমিক ভয়, গা ছমছমানুভূতি, এই বুঝি এলো-ছোঁ মেরে নিল মনোশাঙ্কা পাঠকের মনে সার্বক্ষণিক বিরাজ করে, কাজেই এটাকে মৃদুভাবে লাভক্রফটিয়ান হররঘেঁষা বললেও আপত্তি ওঠার কথা নয়। এক কথায়, আলেয়ার মতোই রহস্যময় ‘আলেয়া’ উপন্যাসের ঘরানা।
সাহিত্যের নয়টি রসের মধ্যে এই উপন্যাসিকায় হাস্য রস ও ভয়ানক রস দুটির সংমিশ্রণ ঘটেছে ৷ সমগ্র লেখায় কখনো হাস্য রস দখলে নিয়েছে, কখনো ভয়াল রস। কাহিনীর শেষভাবে এসে একচেটিয়াভাবে ভয়াল রস দখল বুঝে নিলেও বইটি পড়ার পর হাস্যরসের রেশটুকু রয়ে যায় মাথার ভেতরে। এমনকি অ্যান্টাগনিস্ট আলেয়াকেও পরিণতিতে এসে কিঞ্চিত কৌতুকপ্রদ বোধ হয়। প্রোটাগনিস্টের হিরোয়িক চরিত্রেও মক-হিরোইজমের আস্বাদ মেলে। এবং কী দুর্বিশ্বাস্য, অ্যান্টাগনিস্ট-প্রোটাগনিস্ট উভয়কেই পাঠক ভালোবেসে ফেলে! পাঠকের অনুভূতি নিয়ে এই ধরণের বিরল এক্সপেরিমেন্ট সাম্প্রতিককালে দেখিনি।
আশরাফুল সুমনের লেখনশৈলী নিয়ে নতুন করে কিছু কহতব্য নেই। তাঁর ভাষা অলঙ্কারসমৃদ্ধ, তথাপি অলঙ্কার-ভার-ন্যুব্জ্য নয়। এই বইয়ে তাঁর সেই ঔজ্জ্বল্য যেন আরো খানিকটা বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও বইয়ের শেষদিকে কিছু খন্ডিত বাক্যের বহুল ব্যবহারের কারণে তা কিঞ্চিত ধৈর্যচ্যুতির আশঙ্কামুক্ত নয়। চরিত্র সৃজনে আশরাফুল সুমন দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। প্রতিটি চরিত্র ধরণে-গড়নে আলাদা। তবে সবগুলোই হিউমারাস, পাঠককে কাহিনীর সাথে সেঁটে রাখে। প্রধান চরিত্র রাদিবের প্রেমিকা আসমী যদিও দৃশ্যপটে আসেনি, কিন্তু তাকে পাওয়ার চ্যালেঞ্জ রাজিবের আলেয়াকে পরাভূত করার পার্সোনাল স্টেককে বেগবান করেছে। কিন্তু একই কারণে গল্পের একটি অন্যতম গুরুত্বপুর্ণ চরিত্র শাহরীন রিতুর ভূমিকা দুর্বল হয়ে পড়েছে, অথচ সে-ই হতে পারত রাদিবের পার্সোনাল স্টেকদাত্রী। এই সুন্দরীর চোখে হিরো হওয়ার বাসনাও রাদিবকে তাড়িত করতে পারত। সে তো কোনো সন্তু পুরুষ নয়– আসমী না রিতু- এই ইনার কনফ্লিক্টে তাকে জড়িয়ে দিয়ে পাঠককে আরো রোমাঞ্চিত করার সুযোগ কেন যে ছেড়ে দিলেন লেখক তা বোধগম্য নয়। পুরুষপ্রবরদের যে প্রেমাস্পদ থাকা সত্ত্বেও অন্য নারীর প্রতি দুর্বল হতে বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হয় না এই চিরসত্যটি লেখক কার ভয়ে চেপে গেলেন তা অজানাই রইল!
উপন্যাসটিতে তিন-তিনটি আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ হয়েছে, একটি বা দুইটিতে সীমাবদ্ধ হলে আরো মসৃণ হত! গ্রামের ছেলেমেয়েদের রাদিব খানের কাছে গ্রাম্য ভাষায় অটোগ্রাফ চাওয়াটা বেমানান ঠেকে। তাদের তো একসাথে সেলফি-ফটোগ্রাফ তুলতে চাওয়ার কথা। আর অটোগ্রাফ চাইতে যারা জানে তারা নিজেদের মধ্যে যে ভাষাতেই কথা বলুক না কেন, একজন সেলিব্রিটির সাথে প্রমিত ভাষাতেই কথা বলবে।
বইয়ে অসংখ্য উচ্চভাবসম্পন্ন বাক্য ছিল যেগুলো লেখকের ক্রমবর্ধিষ্ণু ম্যাচুরিটিকে প্রকাশ করে। উপরন্তু বইয়ের শেষদিকে ফ্যান্টাসির সাথে বিভিন্ন সায়েন্টিফিক তথ্যের চমৎকার মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন লেখক। বিজ্ঞানের সাথে বিরোধ দিয়ে সূচনা করে পুনরায় বিজ্ঞানের সাথে সখ্যতা বইটিকে অনন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছে। বইয়ের আকৃতিটা ব্যতিক্রমী ছিল, অন্যান্য বইয়ের চেয়ে ঈষৎ ছোট হওয়ায় দেখতে নান্দনিক সুন্দর!
আলেয়া আশরাফুল সুমনের সামর্থ্যের ইঙ্গিতবাহী। বইটির ঈর্ষণীয় পাঠকপ্রিয়তা দর্শনীয় হওয়াটা সময়ের ব্যাপার মাত্র।
একনজরে বইটি
বইয়ের নাম : আলেয়া
লেখক : আশরাফুল সুমন
প্রকাশক : বইপিডিয়া
প্রথম প্রকাশ : ২০১৯
ঘরানা : ফ্যান্টাসি
প্রচ্ছদ : জুলিয়ান
পৃষ্ঠা : ১৫৮
মুদ্রিত মূল্য : ২৫০ টাকা
প্রকাশনী: অন্যধারা