মো. ওসমান গণি শুভ

বাস্তবঘনিষ্ট সামাজিক উপন্যাস: কালচক্র

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

বারোমাস উৎসব-পুজো-পার্বণে মোড়া ঠাকুরবাড়ির সবটুকু সুখ কেড়ে নিয়ে সরস্বতী দেবীর মতো দেখতে মহুয়া পিসি হেমন্তের ঠিক শেষ বিকেলে লিচু গাছের ডালে নিজের শাড়ি পেঁচিয়ে আত্মহুতি দিয়ে সবাইকে কালচক্রের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত করলেন। ঠাকুরবাড়ির চন্দ্রলেখার প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া মুসলিম ঘরের সন্তান পলাশ মহুয়া পিসিকে সর্বপ্রথম দেখেছিল লিচু গাছের ডালে পুতুলের মতো ঝুলে থাকতে। আসলে সে এসেছিল প্রিয় মানুষটার মুখটি দেখতে কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস সে দেখল আরেক প্রিয়জন মহুয়া পিসির ঝুলন্ত লাশ! বুকের ভিতরটা একদম দুমড়ে-মুচড়ে গিয়েছিল পলাশের মহুয়া পিসির জন্য । এই রকম দৃশ্যের জন্য হয়তো কোনোরকম প্রস্তুুুত ছিল না কিশোর পলাশ।

আশালতা দেবীর গগনবিদারী চিৎকারে কেঁপে ওঠে যেন ভবানীপুরের আকাশ-বাতাস। পিতৃ-মাতৃহারা মহুয়াকে নিজের সন্তানের মতো করে মানুষ করেছেন আশালতা দেবী। সবাই না জানলেও আশালতা দেবী কিন্তু জানতেন মহুয়ার পেটে বাচ্চা আছে এবং ঐ বাচ্চার প্রকৃত বাবা পরেশ না, পরেশের আপন দাদা নরেশ।

কালচক্র উপন্যাসের দুটি চরিত্র জগলু এবং হায়দারের সাথে আমি মানিক বন্দোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসের কুবের এবং গণেশের সাদৃশ্য খুঁজে পাই এবং আমজাদ প্রেসিডেন্টের সাথে সাদৃশ্য খুঁজে পাই ঐ একই উপন্যাসের হোসেন মিয়ার। তেল চুরির ব্যবসায় নিয়োজিত থাকায় এই দুইজনের মধ্যে সম্পর্কও বেশ ঘনিষ্ঠ। জগলুর চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট হায়দার মাঝি ছয় মাস হয়েছে নতুন বিয়ে করেছে। তাইতো গভীর রাতে বউকে ছেড়ে কাজে আসতে দেরি হয় হায়দারের।

ভৈরবের বুকের অদ্ভুত রাতও দুইজন মাঝির হৃদয় স্পর্শ করে। উজ্জ্বল রাতের আকাশে নদীতে পড়া রূপালি প্রতিবিম্ব, নদী পাড়ের বিস্তীর্ণ জনপদ,ছাড়া ছাড়া দোকানপাট, বসতবাড়ি, গরান,সুন্দরী আর বাঁশের খুঁটি দিয়ে তৈরি দোতলা ঘর, বিশালাকৃতির দালানকোঠা, পাটকলের চিমনি, জেটিতে দাঁড়িয়ে থাকা পাটবোঝায় নৌকা, বড় বড় তেলের ডিপো সবকিছুর বড় মায়াময় দৃশ্য তাদের হৃদয় আন্দোলিত করে।

জাহাজ থেকে চোরাই পথে বাজার দরের অর্ধেকে তেল কেনা যায়। তাইতো তারা এম. ভি লতিফা থেকে তেল কিনে স্থানীয় এলাকায় চড়া দামে বিক্রি করে লাভের টাকায় কোনোরকম সংসার চালায়। লাভের একটি বড় অংশ চলে যায় আমজাদ প্রেসিডেন্টের পকেটে কারণ তিনি অর্থ বিনিয়োগ করেন চোরাই পথে তেল কেনার জন্য।

“লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু” প্রচলিত প্রবাদটি হয়তো পাকিস্তান আমলে এইট পাশ, পঁয়ষট্টি বছর বয়সী সদালাপী নাজিমউদ্দিনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এলাকার মুরুব্বি এই নাজিম চাচা একসময় নয়নতারা মিলের সর্দার ছিলেন। বেশ কয়েক বছর হলো অবসরে আছেন। জীবনের উপার্জিত অর্থ দিয়ে তিনি একটা পাকা বাড়ি বানাবেন, একটি ডিপ টিউবওয়েল বসাবেন উঠোনে, বউকে একজোড়া কানের দুল বানিয়ে দেবেন আর বাকি অর্থ ব্যাংকে রেখে দিবেন এমনটাই প্রত্যাশা করেছিলেন। কিন্তু একসময় তার অধীনে নয়নতারা মিলে কাজ করা বুদ্ধিমান ছেলে শমসের কোটি টাকার রাডারের লোভ দেখিয়ে সমস্ত উপার্জিত অর্থ হাতিয়ে নেয়।তাইতো একদিন মকবুলের দোকানে চা খেতে খেতে জালিয়াতির অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া শমসের ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের ছবি সংবাদপত্রে দেখে স্ট্রোক করে মাটিতে মৃতের মতো লুটিয়ে পড়েন নাজিমউদ্দিন।

কালচক্র উপন্যাসের দুইটি চরিত্র পলাশ এবং চন্দ্রলেখা ছিল দুইটি ভিন্ন ধর্মের কিশোর-কিশোরী।তবুও তাদের মধ্যে ধর্ম-বর্ণ ছাপিয়ে প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। প্রায়ই তারা শম্পার মাধ্যমে চিঠি চালাচালি করতো এবং নির্জন প্রকৃতির মাঝে লুকিয়ে দেখা করতো। প্রেমের শেষ পরিণতি যেন ভালো হয় এজন্য তারা পরিকল্পনা করেছিল গ্রাম ছেড়ে ঢাকা শহরের ভালো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার যাতে পরবর্তীতে তারা তাদের সম্পর্কের স্থায়ী রূপ দিতে পারে। কিন্তু চন্দ্রলেখার পরিবার মহুয়া পিসির ঘটনাকে কেন্দ্র করে হঠাৎ জমিজিরাত বিক্রি করে রাতের আঁধারে পালিয়ে যাওয়ার ফলে তা আর সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি।

করাতকলে কাজ করা যুবক হারুন এবং মাতাল বিষ্ণুর যুবতী স্ত্রীর মধ্যে একটা পরকীয়া প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল এই উপন্যাসে। মিষ্টি ছিল একজন উদার, আধুনিক এবং স্বাধীনচেতা দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন মহিলা। রাস্তায় চলার পথে বহু পুরুষের চোখে ব্যবচ্ছেদ ঘটে মিষ্টির সুন্দর শরীরের। কিন্তু তাতে মিষ্টির কিছু আসে-যায় না। কেউ যদি তার শরীর দেখে আনন্দ পায় তাহলে পাক না। এতে দোষের কিছু সে দেখে না। গ্রামের সবার সাথে হেসে হেসে কথা বললেও “বৌদি”-খ্যাত মিষ্টি কাউকে প্রশ্রয় দেয়নি শুধু বয়সে পাঁচ বছরের ছোট হারুনকে ছাড়া। হারুনের মাঝে নিজের অজানা ভালোবাসা খুঁজে পেয়েছিল মিষ্টি আর তাইতো ঠাকুরবাড়ির ঘাটে হেসে হেসে কথা বলতো হারুনের সাথে। মাতাল স্বামীর অত্যাচার নির্যাতন থেকে বাঁচতে একসময় সে মনে মনে পরিকল্পনা করেছিল হারুনের হাত ধরে পালিয়ে যাবে কিন্তু শেষ পর্যন্ত হারুনের দেখা না পাওয়ায় তা আর সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। এম.ভি লতিফার ফুটো হয়ে যাওয়ার ফলে ছড়িয়ে পড়া তেল বিক্রি করে প্রচুর টাকা হাতে আসায় হারুন তার একান্ত আপন ভাবা মিষ্টি বৌদির জন্য কিনে এনেছিল একটি সিঁদুরে লাল শাড়ি, দোকানির সহায়তায় শাড়ির রঙে মিলিয়ে দুটো লিপস্টিক, একপাতা টিপ, একজোড়া কানের দুল আর দুই ডজন চুড়ি। আর এইগুলো গ্রহণ করতে প্রথমে ইতস্ততাবোধ করলেও ক্ষণকাল পরে সেগুলো গ্রহণ করে মিষ্টি এবং আয়নার সামনে ট্রায়াল দিয়ে দেখেছিল কেমন দেখায় তাকে। একদিন সখ করে সব জিনিসগুলো পরেছিল মিষ্টি কিন্তু সেদিন যে এমন ভয়ানক অবস্থা সৃষ্টি হবে হবে সেটা সে কোনোদিন উপলব্ধি করতেও পারেনি। ভাবতে পারেনি তার মাতাল স্বামী এতটা নীচ হতে পারে। টাকার কাছে বিক্রি হয়ে নিজের বিবেক বিসর্জন দিয়ে বিষ্ণু নিজের বৌয়ের ঘরে তুলে দেয় এলাকার চেয়ারম্যান সিরাজ মোল্লাকে। কিন্তু মিষ্টি হঠাৎ-ই স্বামীর কিনে দেওয়া আয়নার ভাঙা টুকরা দিয়ে ইজ্জত বাঁচাতে তার স্বামীর বুকে চালিয়ে দেয়। ঘটনা বেগতিক দেখে সিরাজ মোল্লা লা হাওলা ওলা কুয়াতা ইল্লাবিল্লাহ পড়ে ভেগে যায়।

মদ্যমাতাল বিষ্ণু তার সুন্দরী যুবতী স্ত্রী মিষ্টি থাকা সত্ত্বেও তার ভিতরে ঠিক আসল সুখ খুঁজে পেত না। আর তাইতো বিষ্ণু সুখ খুঁজতে আল্লাহর পথে চলা ধর্মপ্রাণ মুসলমান রইজউদ্দিনের স্ত্রী রাহেলার সাথে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে। কলোনির পথে চলতে গিয়ে একদিন মিষ্টি ধরে ফেলেছিল তার স্বামীর এই অবৈধ সম্পর্ক, শুনেছিল নারী কন্ঠে ফিসফিসানো কিছু গোপন কথা, কিছু গোপন আওয়াজ। তারপর মুখে শাড়ি গুঁজে চলে এসেছিল আপন ঘরে।

ছোট ছেলে বকরের চিকিৎসার জন্য যখন টাকার যোগান দিতে পারছিল না জগলু তখন আমজাদ প্রেসিডেন্ট টাকার যোগান দেন। তখন জগলু তার মালিক আমজাদ প্রেসিডেন্টকে ফেরেশতারূপী মনুষ্য মনে করেছিল কিন্তু সেই ফেরেশতারূপী মনুষ্যকে যখন একদিন তার স্ত্রীর সাথে ঘরে দেখেছিল তখন সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল। সেই মুহূর্তে আমজাদ প্রেসিডেন্ট জগলুকে ঘরের মজা থেকে বঞ্চিত না থাকার জন্য উপদেশ দিয়েছিল এবং বেশি বেশি সময় ঘরে ব্যয় করতে বলেছিল।

কালচক্র উপন্যাসে মন্টু চরিত্রটি অত্যন্ত রহস্যময় এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ। বছর দশেক আগে হঠাৎ নিখোঁজ হয়েছিল মন্টু। সবার ধারণা ছিল সে হয়তো মারা গেছে। কিন্তু মৃত্যুর যাবতীয় সংশয়কে তুড়ি মেরে সে একদিন ফিরে এলো। তার উধাও হওয়ার কাহিনী নিয়ে সে বিভিন্ন মনগড়া কাহিনী ফাঁদছিল কিন্তু বাস্তবতা ছিল এই যে, সে একজন দুধর্ষ ডাকাতে রূপান্তরিত হয়েছিল এবং ডাকাতি করতে গিয়েই বোমার আঘাতে তার একহাত কাটা পড়ে।

শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচনে হাফেজকে নিজের প্যানেলে সাংগঠনিক সম্পাদক পদে লড়ার স্বপ্ন দেখিয়ে ছাইদুল,কাঞ্চন আর মনিরের সাথে হাত মিলিয়ে সাধারণ শ্রমিকের প্রিয় হয়ে ওঠা রাজুকে শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচন থেকে চিরতরে সরানোর পরিকল্পনা করেছিলেন আমজাদ প্রেসিডেন্ট। পরিকল্পনা সফল না হলেও নোংরা রাজনীতির মারপ্যাঁচে তার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরিকল্পনা ঠিকই সফল হয়েছিল। মাঝে বলির পাঠা হয়ে নয়নতারা মিলের সাধারণ শ্রমিক সোলায়মান তার চোখ দুটি হারিয়েছিল।

শৈশবের স্মৃতি, কৈশরের উদ্দীপনা, লুটোপুটি, স্মৃতিকাতরতা সবকিছু সুন্দরভাবে উঠে এসেছে কালচক্র উপন্যাসে। রাকিব, সোহেল, পলাশ এবং চন্দ্রলেখা যেন আমাদের সবার সুন্দর শৈশবকে উপস্থাপন করে। তাদের হঠাৎ বিদায় উপন্যাসকে আরো হৃদয়বিদারক করে তোলে।

সর্বোপরি, মৃত এক শিল্প অঞ্চল এবং এর অধীনস্থ মানুষদের আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখ, ভাঙা-গড়া আর বৈচিত্র্যময় জীবনবোধ নিয়ে লেখা উপন্যাস কালচক্র এর চক্র আবর্তন বাস্তবে আমাদের মানব সমাজের প্রতিটি ঘটনায় লুকিয়ে আছে। উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রকে লেখক খুব সুন্দরভবে ফুটিয়ে তুলেছেন। উপন্যাসটি খুলনার আঞ্চলিক ভাষায় রচিত হলেও সেখানে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষা সামান্য সংযোজিত হয়েছে, যেটা বর্জন করলে উপন্যাসটি আরো সুন্দর রূপ পেত। মুদ্রণজনিত কারণে উপন্যাসের কিছু কিছু শব্দের বানান ভুল থাকলেও আব্দুল্লাহ আল ইমরানের কালচক্র উপন্যাসটি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নতুন সংযোজন এবং পাঠক মহলে এটি যথেষ্ট প্রশংসার দাবি রাখে।

বই সম্পর্কিত তথ্য:

বইয়ের নাম→ কালচক্র।
লেখক→ আব্দুল্লাহ আল ইমরান।
প্রচ্ছদ→ সানজিদা পারভীন তিন্নি।
মুদ্রিত মূল্য→ ৩০০ টাকা।
পৃষ্ঠা → ২০০
প্রকাশনায়→ অন্বেষা প্রকাশন।

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu