দর্পণ ডেস্ক
একটি পূর্ণাঙ্গ ম্যাগাজিন। শিক্ষা, সাহিত্য ও গবেষণামূলক ম্যাগাজিন দর্পণ। ২০১৯ সালে ব্যতিক্রমধর্মী ম্যাগাজিন দর্পণ তার যাত্রা শুরু করে। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে দর্পণ "গল্পবাজ" ম্যাগাজিন আত্তীকরণ করে।
দর্পণ ডেস্ক

দীলতাজ রহমানের ‘তারান্নুম’ : প্রাতিস্বিক অনুভবে – ড. চিরঞ্জিৎ রায়

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

পলাশী বাসস্ট্যান্ড থেকে খানিকটা হাঁটা পথ– ফুলবাগান মোড়। হেঁটে হেঁটে পৌঁছানো গেলেও আমাকে যেতে হয় বাসে। কারণ ফুলবাগান আমার গন্তব্য নয়। নিত্যযাত্রী আমি। তাই রোববার ও ছুটির দিন বাদ দিয়ে প্রায় প্রতিদিনই ফুলবাগান মোড় পেরিয়ে আমাকে পৌঁছাতে হয় কর্মভূমি দাদপুরে। অবশ্য আসার সময় অধিকাংশ দিন ট্রেনেই ফিরি, না হলে বাসে চেপে ক্লান্ত দেহে প্রায় সুষুপ্তিমগ্ন অবস্থায় বাড়ি ফেরা। এই নিত্য যাতায়াতের মধ্যে ফুলবাগান মোড়টা যেন কিছুক্ষণের জন্য আমার অন্তরকে দখল করে থাকে-এক বিশেষ অনুভূতি আমাকে মগ্ন করে রাখে। প্রতিবারই ফুলবাগান মোড় ঢুকতেই উত্তর অভিমুখে বাম দিক করে একটি দেওয়ালে আমার চোখ পড়ে যায়, যাতে লেখা আছে-‘তারান্নুমস’। এই শব্দটুকু কীসের বিজ্ঞাপন তা ঠাওড় করে ওঠার কোনো উপায় দেখি না। কারণ অনেক দিনের প্রায় জরাজীর্ণ দেওয়ালে অস্পষ্ট ওই লেখাটি তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখলেও তার আগে-পরে বা ওপর-নিচে কোনো শব্দবন্ধ না থাকায় আমার ইন্দ্রিয় বহু চেষ্টাতেও সেই রহস্য উন্মোচন করতে পারে না। অবশ্য না পারলেও তার অপার মোহময়তা নিয়ে শব্দটি স্মৃতির অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করে-যেমন ‘কাল জল ঢালিতে সই কালা পড়ে মনে’; ঠিক তেমনি শব্দটি দেখলেই আমার মনে পড়ে যায় ‘তারান্নুম’ গল্পগ্রন্থটির কথা।

মাসখানেক আগে ফেসবুকের দেওয়ালে একটি পোস্ট লক্ষ করি। একটি বইয়ের প্রচ্ছদ। বইটি একটি গল্পগ্রন্থ। নাম ‘তারান্নুম’। যিনি লেখিকা তিনি পূর্ববঙ্গের– মানে আমার পিতৃভূমির, আমার অদেখা স্বপ্নরাজ্যের। তাঁর নামটির সঙ্গে আমার পরিচয় তারও বেশ কয়েক মাস আগেই হবে বোধ হয়। দীলতাজ রহমান তাঁর নাম। সত্যি কথা বলতে, পোস্টটি দেখার পর বইটি সম্পর্কে আমার তেমন একটা আগ্রহ তৈরি হয়নি। এরকম বই তো আজকাল কতই বেরুচ্ছে! ক’জনের পক্ষেই বা তার খোঁজখবর রাখা সম্ভব! কাজেই ‘অভ্যাসবশত’ পোস্টটিতে লাইক দিয়ে আমি অন্য পোস্টগুলি দেখতে থাকি, আর ‘তারান্নুম’ আমার স্মৃতিপথ থেকে একটু একটু করে সরে যেতে থাকে। এক সময় বোধ হয় তা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়! এর কিছুদিন পর ফুলবাগান মোড়ের একটি দেওয়ালে ‘তারান্নুমস’ লেখা একটি বিজ্ঞাপন দেখে আমি হঠাৎ স্তব্ধবাক্ হয়ে যাই। আমার সহকর্মীর সাথে লঘু চালের কথাবার্তাগুলি থামিয়ে মগ্নচিত্তে ‘স’ -কে ঠেলতে ঠেলতে বার করে দিই। আর তখনই স্মৃতিপথে উদিত হয় ‘তারান্নুম’- যাকে আমি দূরে সরিয়ে দিয়েছিলাম একদিন। আমার অন্তরটা যেন একটা পাপবোধে জীর্ণ হতে লাগলো বা কী যে একটা বোধে আমি আচ্ছন্ন হলাম, তা আমি বলে বোঝাতে পারবো না! আমার সত্তায় যেন একটা অকৃত্রিম টান অনুভব করলাম-এ কীসের টান! আমি ব্যস্তসমস্ত হয়ে বইটির খোঁজ করতে লাগলাম। কিন্তু বইটি যে এখানে, মানে পশ্চিমবঙ্গে সহজে পাওয়া যাবে না, এ আমার মাথায় ছিল না। তারপর হঠাৎই একদিন সকাল ৭টা ৫৪ মিনিটে লেখিকাকে ম্যাসেঞ্জারে টেক্সট করলাম-‘আপনার তারান্নুম বইটি কি কলকাতায় পাওয়া যাবে, না হলে বইটি পাওয়ার অন্য কোন উপায় আছে’। ৮টা ৩২-এ উত্তর এল ‘স্বরূপ মণ্ডলের কাছে আছো [আছে] বোধহয়’। আমি একটু অসহায় বোধ করলাম। কলকাতার মতো এরকম জনবহুল জায়গায় স্বরূপ মণ্ডল-কে কীভাবে খুঁজে পাবো। তাঁর ওপর স্বরূপ মণ্ডলের কোনো নির্দিষ্ট পরিচয়ের উল্লেখ নেই। কিন্তু আমি পরের লাইনটা দেখেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম-‘নাহলে ইমেইন[ইমেইল] নাম্বার দাও পিডিএফ করাই’। আমি আমার ইমেইল আইডি সাথে সাথে টেক্সট করে দিলাম। সঙ্গে ফোন-নাম্বারটিও। তখন সকাল ৯টা ১০। সঙ্গে সঙ্গে মেসেজ এলো ‘আচ্ছা। আমি তো অস্ট্রেলিয়া। এখান থেকে দেশে যোগাযোগ করে দেবো। যোগাযোগের ভেতর আছি অবশ্য’।  ৩টে ২৫। একটি মেসেজ এল-‘দুজন পাঠিয়েছে দেখো’! আমার মেইল খুলে দেখি ইনবক্সে দুটি মেসেজ ঢুকছে। একটি মতিউর রহমানের। আরেকটি শাফিক(?) হাসানের। মেসেজ দুটি খুলেই দেখলাম, আমি ক’দিন যাবৎ যাকে খুঁজে চলেছি–একদিন যাকে অবহেলা করে আজ আমি অনুতপ্ত-আমার সেই ‘তারান্নুম’। আমি যেন এক ঘোরের মধ্যে রয়েছি! কিছুক্ষণের মধ্যে সেখান থেকে কিঞ্চিত মুক্ত হলাম।

‘তারান্নুম’ গল্পগ্রন্থের প্রথম গল্প, যা আমি দেখতে পাচ্ছি, তা হল ‘তারান্নুম’। দেখতে পাচ্ছি বলছি এই কারণেই যে, পিডিএফ-এর প্রথম পৃষ্ঠাটা বইয়ের এগারো পৃষ্ঠা থেকে শুরু হচ্ছে। আগের পৃষ্ঠাগুলি অনুপস্থিত। কাজেই ‘তারান্নুম’ গল্প দিয়েই আমার ‘তারান্নুম’ গল্পগ্রন্থ পাঠের শুরু। গল্পের কথক যেন প্রথমেই আমাকে, মানে পাঠককে এই চার-দেওয়ালের গণ্ডি থেকে মুক্তি দিতে চাইছেন, সুদূর অস্ট্রেলিয়ায় নিয়ে গিয়ে। সেখানে বহু চরিত্রের সমাবেশ– পরী, রোকেয়া, করিমননেসা, জাহরা, আশিক, ডাক্তার আহমেদ শরীফ শুভ, ইফা, মাহফুজ, ফারহানা, এনামুল মিয়াজি, নওমি এবং আরো অনেকে ও সর্বোপরি তারান্নুম। এরা কমবেশি প্রত্যেকেই উজ্জ্বলরূপে ধরা দেয়। অবশ্য কথক তাঁর কথকতার গুণে তাদেরকে ধরিয়ে দেন। এদের প্রত্যেকের সঙ্গে যেমন কথকের সম্পর্ক আন্তরিক, তেমনি আমি, মানে পাঠকও এদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠেছি। করিমননেসা যখন তার ছোট্ট বোন পরিকে বুকে আগলে রেখে তাঁর দেহভার সহ্য করেও তার নানি অর্থাৎ কথকের কবিতাপাঠ শুনছিল, তখন সেই দৃশ্য আমাকে মমত্ববোধের একটি পেলব আস্তরণে ছেয়ে ফেলল। তারান্নুমের সঙ্গে কিছুটা পরে পরিচয় হল ‘সপ্তর্ষি মণ্ডলের অরুন্ধতীর মতন’। রৌদ্র যেমন বালুচর ছুঁয়ে থাকে’ সেইভাবেই কথক ‘ধরিত্রীর মতো আশীর্বাদ আলোতে’ ঘিরে রাখে তারান্নুমকে। কথকের সঙ্গে তারান্নুমের সম্পর্ক অন্তরের গভীরতর স্তর থেকে উৎসারিত। এ সম্পর্ক বিশ্বজনীন মাতৃত্বের সম্পর্ক যার স্নেহপাত্র দানের কোনো সীমাবদ্ধতা বা ভেদ-বিচার নেই। তারান্নুমের প্রতি অন্তরের গভীরের গোপনলালিত মাতৃস্নেহ কথকের এক অপার্থিব আনন্দে রোমাঞ্চিত করে-‘সেই যে সে আমার ‘বাবা’ ডাকে একবার অশ্রুতে ভেসেছে। আর আমি তা যখন জেনেছি, সেই থেকে আমি যেন একটি ঝিনুক হয়ে গেছি, বুকে মুক্তোর মতো করে তাকে ধারণ করে রাখতে। না-ই বা জানলো তা আমার মুক্তাসার-হৃদয় মেয়েটি’।

গল্পের ভেতরে যত প্রবেশ করছি ততই অনির্বচনীয় এক আবেশে আচ্ছন্ন হচ্ছি। বহু চরিত্রের আনাগোনায় আমার একাকীত্ব যেন দূর হয়ে যাচ্ছে। খানিক বিচ্ছিন্নভাবে হলেও চরিত্রগুলি কথকের সঙ্গে আমার অন্তরাত্মাকেও ছুঁয়ে যাচ্ছে। কথক যেন মানুষকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন-মানব রতনের সন্ধান পেতে চাইছেন। তাঁর এই সন্ধান যেমন তাঁর স্বদেশ থেকে শুরু হয়েছে তেমনি পরবাসে এসেও থেমে যায়নি। বরং আরো আকুলতা নিয়ে তা মিশে যেতে চাইছে বহুধারাময় জীবন স্রােতে। যেখানে আনন্দ আছে-দুঃখ আছে-তার পরেও জীবনের একটা মানে আছে। বিদেশে থাকলেও কথক দেশের কথা ভুলতে পারছেন না। পাঠকের সঙ্গে তাঁর আন্তঃক্রিয়ায় উঠে আসছে দেশের নানা প্রসঙ্গ। শেকড়ের টান বড়োই আমোঘ! তাই তো অতীতচারী মন বার বার ফিরে পেতে চাই অতীতের সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশার স্মৃতিগুলিকে। এই মর্ত্যপ্রীতি বা স্বদেশপ্রীতি আমার, মানে পাঠকের অন্তরকে ছুঁয়ে যায়।

এ গল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এক স্নিগ্ধ আবেশে কথক পাঠককে আচ্ছন্ন করে রাখে। অস্ট্রেলিয়ায় প্রবাসী-বাঙালিদের সীমিত পরিসরে নিজস্ব সাহিত্য-সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার অদম্য প্রচেষ্টা ও কথকের সঙ্গে তাঁদের আন্তঃসম্পর্কের বন্ধন পাঠকের হৃদয়কেও বেঁধে ফেলে। সবকিছু ছাপিয়ে মাতৃত্ববোধ, অস্তিত্ববোধ মনকে হালকা আবরণে স্পর্শ করে যায়। ঘোর নেশা লাগে!

কিন্তু গবেষক আমি। নিজেই এই ঘোর থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করি। আমার গবেষক-সত্তা নিরপেক্ষতার সাপেক্ষতায় উদ্যত হয়ে ওঠে। গবেষকের ধর্মই চুলচেরা বিশ্লেষণ করা। আতস-কাঁচ ফেলে পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুধাবন করে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো। তাই আমি ‘তারান্নুম’-কে নিয়ে, বলা ভালো, কাটা ছেঁড়া করতে চলেছি। আমার কষ্ট হচ্ছে! তবুও আমার সন্ধানী ছিদ্রান্বেষী মন দেখতে পাচ্ছে শব্দশরীরের মধ্যে তারান্নুম যেন খানিক অল্প পরিসরেই তার ছায়া বিছিয়েছে। যার নামে এই গল্প, তার আরো উপস্থিতি কাম্য ছিল। কখনো কখনো ঘটনার পারম্পার্য রক্ষিত হয়নি। বহু চরিত্রের ভিড়ে কোনো বিশেষ চরিত্র প্রভূত ‘শক্তি’ নিয়ে উপস্থিত হতে পারেনি। এ কী হচ্ছে! আমি কি আস্তে আস্তে আবার ‘তারান্নুম’-এ মিশে যাচ্ছি! এই তো পরী, রোকেয়া, করিমননেসা, তারান্নুম! এই তো ডাক্তার শুভ, আসিফ, ইফা, ফারহানা! এই তো অস্ট্রেলিয়ার মালগ্র্যাভ হল! এই তো আমি!

‘তারান্নুম’ আমার সমগ্র হৃদয়ের অনেকটাই অধিকার করে নিয়েছে-বোধ করি এর স্রষ্টাও। ‘তারান্নুম’ শেষ করে যখন পরের গল্পগুলো পড়তে শুরু করেছি, তখন এক অদ্ভুত অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়েছি। ফিরে ফিরে যেন সেই ‘তারান্নুম’-ই আমার সমগ্র চৈতন্যকে বিভোর করে রেখেছে-আমাকে কোন বাঁধনে যে বেঁধে ফেলেছে, তা হয়তো আমি নিজেও জানি না!

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu