সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শক্তিশালী গল্পকার শিমুল মাহমুদ ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশ করেছেন তার সংকলিত গল্পগ্রন্থ গল্পসংগ্রহ। নালন্দা প্রকাশ থেকে প্রকাশিত এই সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তার পূর্বপ্রকাশিত চারটি গল্পগ্রন্থের নির্বাচিত গল্প। গল্পগ্রন্থগুলো হলো— ইলশেখড়ি ও অন্যান্য গল্প, মিথ মমি অথবা অনিবার্য মানব, হয়তো আমরা সকলে অপরাধী এবং মনোবিকলন গল্প। সংকলনে মোট ২৯টি ছোটগল্প স্থান পেয়েছে, যা লেখকের বৈচিত্র্যময় গল্পভুবনের এক অনবদ্য রূপ প্রকাশ করে।
গল্পের গদ্য
শিমুল মাহমুদের গদ্য বরাবরই স্বতন্ত্র এবং ব্যতিক্রমী। তিনি শব্দের ব্যঞ্জনায় এক অনন্য স্বাদ সৃষ্টি করেন। তার গদ্যশৈলী গভীর এবং সংবেদনশীল, যেখানে প্রতিটি বাক্যে উপমা ও রূপকের সুনিপুণ ব্যবহার দেখা যায়। ভাষার সাবলীলতা পাঠকের পড়ার অভিজ্ঞতাকে আরও উপভোগ্য করে তোলে।
নিরীক্ষাধর্মীতা
শিমুল মাহমুদের গল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য তার গদ্যে নিরীক্ষাধর্মী প্রবণতা। প্রচলিত গদ্যের কাঠামো ভেঙে তিনি নতুন নতুন ভাষার ব্যবহার করেন। কখনো বাক্যের গঠনকে অপ্রথাগতভাবে সাজিয়ে পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করেন, আবার কখনো শব্দের পুনরাবৃত্তি, ছন্দময়তা ও আঞ্চলিক উপাদান সংযোজন করে এক নতুন আঙ্গিক তৈরি করেন। তার নিরীক্ষামূলক গদ্য কেবল ভাষাগত নয়, বরং আখ্যানের গঠনেও বৈচিত্র্য আনে।
গল্পের বিন্যাসে কখনো সচেতনভাবে অসংলগ্নতা তৈরি করেন, কখনোবা চেতনাপ্রবাহের কৌশল প্রয়োগ করে মনস্তাত্ত্বিক গভীরতা আনেন। পাঠক যখন তার গল্প পড়তে শুরু করেন, তখন সাধারণ গদ্যের সীমা পেরিয়ে এক নতুন ধরণের পাঠ-অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন। এই নিরীক্ষা তার গল্পগুলোর অনন্যতা বাড়িয়ে দেয়।
লেখক মনে করেন, মানুষের অন্তর্জগতকে সূক্ষ্ণ ও স্বচ্ছভাবে দেখার কৌশল সরলরৈখিক গল্পে সম্ভব নয়। এই কারণেই তিনি পরীক্ষামূলক আঙ্গিকে গল্প নির্মাণ করেন। তার গল্পে কখনো পরাবাস্তবতা, কখনো মনস্তাত্ত্বিক গভীরতা, কখনোবা নন-লিনিয়ার আখ্যানধারা দেখা যায়। এতে করে পাঠক শুধু গল্পের বাহ্যিক বয়ানেই আবদ্ধ থাকেন না, বরং প্রতিটি স্তরের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ব্যঞ্জনাও আবিষ্কার করতে পারেন।
জাদুবাস্তবতা
শিমুল মাহমুদের গল্পে জাদুবাস্তবতার আধিপত্য স্পষ্ট। তার লেখনীতে বাস্তবতা, কল্পনা ও মিথ একসঙ্গে মিশে এক নতুন গল্পজগত তৈরি করে। জাদুবাস্তবতার ঘোরে তিনি পাঠকদের এমন এক দুনিয়ায় নিয়ে যান, যেখানে সময়, চরিত্র ও বাস্তবতার গণ্ডি ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হয়ে যায়। তার গল্পে কল্পনাশক্তির এক বিস্ময়কর প্রকাশ লক্ষ করা যায়, যা তাকে অন্য সমসাময়িক গল্পকারদের থেকে আলাদা করে।
মিথ
লেখকের গল্পে মিথ এবং বাস্তবতার সংমিশ্রণ একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। গল্পগুলোর প্রেক্ষাপট, চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ এবং আখ্যানের বাঁকবদল পাঠকদের এক ধরনের ধাঁধায় ফেলে দেয়। কখনো তা অতীতের কোনো মিথের সঙ্গে মিলে যায়, কখনোবা বর্তমান বাস্তবতার কঠোর রূপরেখার সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।
বিষয়বস্তু
গল্পগুলোর বিষয়বস্তু নানা মাত্রিক। কখনো তা ব্যক্তির মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে প্রবেশ করে, কখনো সমাজ, ইতিহাস ও রাজনৈতিক বাস্তবতার সমালোচনা করে। কিছু গল্পে অস্তিত্ববাদী চিন্তার প্রভাব দেখা যায়, আবার কিছু গল্পে মানবজীবনের রহস্যময় দিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে। লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ এবং গভীর, যা পাঠককে ভাবতে বাধ্য করে।
দার্শনিকতা
শিমুল মাহমুদের গল্পে দার্শনিক ভাবনার সুস্পষ্ট প্রভাব লক্ষণীয়। তার গল্পে বাস্তবতা, অস্তিত্ববাদ এবং মানবজীবনের গভীরতর প্রশ্নগুলো উঠে আসে। অস্তিত্বের সংকট, পরিচয়ের অনিশ্চয়তা, নৈতিক দ্বিধা এবং সমাজের সৃজিত সীমারেখা তার গল্পে গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক উপাদান হিসেবে কাজ করে।
তার লেখনীতে কখনো নীতিবাদী প্রশ্ন উঠে আসে, কখনোবা চরিত্রগুলোর আত্মদ্বন্দ্বের মাধ্যমে দর্শনের গভীরে প্রবেশ করা হয়। অস্তিত্ববাদী সংকট, উদ্দেশ্যহীন জীবনযাত্রা এবং সময়ের সঙ্গে মানুষের অবিরাম সংঘাত তার গল্পের মূল অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে।
তিনি বোর্হেস দ্বারা অনুপ্রাণিত। বোর্হেসের গল্পগুলো পাঠ করলে দেখা যায় সেখানে রয়েছে ঘনবদ্ধ রচনাবৈশিষ্ট্য। এক মাত্রার বাক্যের মধ্যে বোর্হেস ঠেসে দিয়েছেন বহুমাত্রিক অর্থমাত্রা ও ইঙ্গিত। শিমুল মাহমুদের গল্পেও এই প্রবণতা লক্ষ করা যায়। তার লেখা পড়তে গিয়ে পাঠক বুঝতে পারেন, গল্পটি শুধু যা বলা হয়েছে তা-ই নয়, বরং তার প্রতিটি বাক্যের অন্তর্নিহিত অর্থও বহুমাত্রিক।
সাহিত্যমূল্য
শিমুল মাহমুদের এই সংকলন বাংলা ছোটগল্পের বিবর্তনে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। বাংলা সাহিত্যের প্রচলিত ধারা থেকে কিছুটা ভিন্ন পথে হেঁটে তিনি গল্পের কাঠামো ও আখ্যানের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। তার গল্পে মানবচরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ যেমন দার্শনিকতা বহন করে, তেমনি কল্পনা ও জাদুবাস্তবতার মিশেলে তৈরি হয় এক গভীর শিল্পমান౼ যা আমাদের চিরন্তন সংশয়বাদী মনকে আরও আগ্রহী করে তোলে।
পাঠঅভিজ্ঞতা
এই সংকলনের প্রতিটি গল্প পাঠকের চিন্তাভাবনাকে নতুন করে গঠন করতে সহায়ক। যারা প্রচলিত গল্পের বাইরে নতুন স্বাদের সন্ধানে আছেন, তাদের জন্য এটি এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা হতে পারে।
লেখকের গল্প পড়লে বোঝা যায়, তিনি একজন দক্ষ কারিগর, যিনি গল্পের প্রতিটি স্তরে পাঠককে টেনে নিয়ে যান। কখনো রহস্যময় এক জগতে, কখনোবা বাস্তবতার কঠিন কাঠামোর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেন। তার গল্পগুলোতে ভাষার নতুন নতুন পরীক্ষার দেখা মেলে, যেখানে শব্দগুলো কখনো ঘনীভূত, কখনোবা স্বচ্ছ ও বহমান।
পরিশেষে,
গল্পসংগ্রহ শুধু একটি সংকলন নয়, এটি শিমুল মাহমুদের গল্পভুবনের এক সংক্ষিপ্ত অথচ বিস্তৃত চিত্র। তার ভাষা, গল্পের বিন্যাস, জাদুবাস্তবতা, মিথের ব্যবহার এবং বাস্তবতার সঙ্গে সংলগ্নতা পাঠককে এক অনন্য অভিজ্ঞতা দেয়। যারা বাংলা সাহিত্যে গল্পের নতুন ধারা ও ব্যতিক্রমী বর্ণনাশৈলী উপভোগ করতে চান, তাদের জন্য গল্পসংগ্রহ অবশ্যপাঠ্য একটি বই। এছাড়া, যারা বাংলা সাহিত্যের সমসাময়িক চিত্র দেখতে চান, তাদের জন্যও এটি এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।
শিমুল মাহমুদের এই সংকলন প্রমাণ করে, বাংলা ছোটগল্পের শক্তি এখনো অটুট, এবং নতুন ভাষা, কল্পনা ও বাস্তবতার সমন্বয়ে বাংলা গল্পচর্চা নতুন দিগন্তের দিকে এগিয়ে চলেছে।
জাদুবাস্তবতা, মিথের ব্যবহার এবং বাস্তবতার সঙ্গে সংলগ্নতা পাঠককে এক অনন্য অভিজ্ঞতা দেয়। যারা বাংলা সাহিত্যে গল্পের নতুন ধারা ও ব্যতিক্রমী বর্ণনাশৈলী উপভোগ করতে চান౼ তাদের জন্য গল্পসংগ্রহ অবশ্যপাঠ্য একটি বই।