নিজস্ব গদ্যরীতি বা স্টাইল প্রত্যেক লেখকের জন্য কতটুকু প্রয়োজনীয়, তার ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা আমার নেই। তবে একজন লেখক তার সত্ত্বাকে প্রমাণ কিংবা আগ্রহী পাঠকদের জানাতে চাইলে লেখার ভেতরে এক ধরনের নিজস্বতার ছাপ রেখে যাওয়ার বিকল্প কিছু নেই।
মারমার কাটকাট কিংবা দুধর্ষ স্পাই মিশনে বের না হয়ে একেবারে সাধারণ জীবনযাপনের মধ্য দিয়েও যে থ্রিলারের অন্যরকম আবহ তৈরি করা যায়, লেখক তার উপরোক্ত বইয়ে সেটার সুবিস্তীর্ণ প্রমাণ কিংবা দৃশ্যধারণের মাঝ দিয়েই বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন।
গ্রন্থ থেকে–
‘ভ্যানগগটা আবার কে?’
‘আমার কুকুর।’
‘আপনার আবার কুকুর এলো কোত্থেকে? আর এলেই বা তার নাম ভ্যানগগ কেন হবে? আপনি কি সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মতো কথাবার্তা বলতে পারেন না?’
‘পারি তো। বলব? কাল রাতে একটা কুকুরকে রাস্তায় পেয়ে খাবার খাইয়েছিলাম। এরপর থেকেই কুকুরটা আমার পোষা হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। ওর নাম দিয়েছি টমি।’
‘একটু আগে না বললেন, ভ্যানগগ?’
‘ওটা তো অস্বাভাবিক নাম, চেঞ্জ করে স্বাভাবিক নাম দিলাম।’
আফরিন হাসলো, ‘থাক, আপনি যেমন আছেন, তেমনই থাকুন। দুনিয়াতে আপনার মতো এবনরমাল মানুষেরও দরকার আছে।’ (পৃষ্ঠা নং : ৬৬)
পাঠকের রুচি কিংবা বোধের দিকে তাকিয়ে লেখক ‘এই খাইছেরে’ টাইপ যে সুন্দর শব্দসঙ্গমে ভাসিয়েছেন সবাইকে তাতে পাঠক খাবারে চাটনি (!) মতো টক জাতীয় কিছু একটা পেয়ে পড়ার গতি কিংবা আগ্রহ অনেকাংশে বাড়িয়ে নিতে পারে। সফল লেখকগণের টেকনিক্যালি থিওরি নিজের ভেতরে কতভাবে যে পুষে রাখেন, খোদা জানে!
আফরিন ঘোর লাগা মেয়ে। ঠিক ততোটায় বিপরীতমুখো একজন গৃহশিক্ষক অভ্র। গল্পের মূল চরিত্র এই অভ্রকে নিয়ে। উপমা আর উদাহরণের এক পৃথিবীসম যোগ্যতা নিয়ে জন্মেছে যেই অভ্র। আফরিনকে বোকা বানানো কিংবা অল্পতেই খুশি করানোতে সিদ্ধহস্ত বলতে মানা নেই এই অভ্রের।
জুলফিকার চৌধুরি। অতিরিক্ত রোদে পুড়ে কান্ডজ্ঞানহীন কাজ অথবা অনিয়মিক কিছুকে নিজের অস্তিত্ব থেকে বাদ দিয়ে মেদহীন একজন সুপুরুষ। সুক্ষ্ম অথচ কত অল্প বাক্যে তার এমন পরিচয় তুলে ধরেছেন লেখক! ভেতরে ভেতরে বয়ে বেড়াচ্ছেন নিজের ছয়দিন বয়সে অদ্ভুতভাবে চলে যাওয়া সন্তানের ব্যথা। জখম আর ব্যথাতুর সবকিছু নিয়েও সবার সামনে কেমন ভারমুক্ত ভাব নিয়ে চলাফেরা করা; এসবের প্রতিটা ক্ষেত্রকে একেবারে শস্যে পরিপূর্ণ করে দেওয়ার মতো লেখকের বর্ণণাভঙ্গি নজর দেওয়ার মতো।
গ্রাম। গ্রামের আনকোরা রাস্তাঘাট আর অল্পতে ভক্ত হওয়া শব্দমূর্খ মানুষদের জীবনাচরণ এগুলো তো প্রতিটা লেখকের সজ্ঞানে উপস্থিতি বিদ্যমান থাকেই। এর ভেতর যারা ভিন্ন কিছুর অপেক্ষায় অপেক্ষমাণ থাকে, তাদের পিপাসা মেটাবে ‘অভ্রত্ব’। আর থ্রিলারের কাহিনী উদঘাটনে সাময়িক সব লেখককে হার মানাতে পারবে বলে ধারণা।
সবশেষে, লেখকের বেশ কয়েকটি বইয়ের ভেতর এটা আমার প্রথম পড়া কোনো উপন্যাসগ্রন্থ ছিলো এটি। ছোটগল্পে তার জাদু-কারিশমা দেখেছি অনেক আগেই। তবে লেখকের পূর্বের বই না পড়ে অভ্রত্ব পড়লে পাঠক অনেক কিছু মিস করবেন। ধারাবাহিতা বজায় রেখে এগোনোতেই হয়ত এমন কিছুর প্রয়াস!
প্রথমত, শান্ত হাসিখুশি অথচ অদ্ভুতপূর্ণ চরিত্রে অভ্রের শুরুর সময়, অথবা মিষ্টি আফরিনের প্রাণোচ্ছল সময়ের পূর্বাবস্থা আর মায়াময় নীল চুরি পরিহিতা আরশির অশান্ত নিরানন্দ সময়কে; প্রথমে একটু খটকা খটকা লাগলেও শেষতক পৌঁছে সব আলোর ঝলক একবারে সামনে আছড়ে পড়বে।