হলিউডে টম হ্যাংকসের মতো প্রতিভাবান অভিনেতা খুব কমই আছেন। বিভিন্ন ধরনের চরিত্রে সফলভাবে অভিনয় করে তিনি বরাবর দর্শকদের মন জয় করে নিয়েছেন। তার অভিনীত ‘সেভিং প্রাইভেট রায়ান’ কিংবা ‘ফরেস্ট গাম্প’ চলচ্চিত্রের কথা কেউ কী ভুলতে পারবে!
এই লকডাউনে অ্যাপল টিভি+ এর নতুন মুভি ‘গ্রেহাউন্ড’– সিনেমাটি মুক্তির অনেক আগ থেকে দেখার ইচ্ছে ছিল। শেষমেশ দেখলাম। ভালো লাগলো বেশ। না দেখা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত আরেকটু জ্বলে উঠলো। মনে পড়ে গেল ‘ডাস বুট’ চলচ্চিত্রের কথা। মনে পড়ে গেল জার্মানির বিখ্যাত ইউ-বোট এবং ব্রিটিশ ডেস্ট্রয়ারের ইঁদুর-বিড়াল খেলার কথা।
জার্মান বিখ্যাত মুভি ‘ডাস বুট'(১৯৮১)-এর কথা মনে পড়ার আরও বিস্তর কারণ রয়েছে। যারা ‘ডাস বুট’ ও ‘গ্রেহাউন্ড’ দুটোই দেখেছেন তারা বুঝবেন বিষয়টা। আমার কাছে ‘ডাস বুট’ হচ্ছে একটা মহাকাব্য যা ইউ-বোটে অবস্থানরত জার্মান ক্যাপ্টেন-নাবিকদের জীবনের উপলব্ধি প্রকাশিত হয়েছে। ‘ডাস বুট’ নিখুঁত এক চলচ্চিত্র, সেখানে আমরা বুঝতে পেরেছি সমুদ্রের নীচের ডুবোজাহাজের ইতিবৃত্ত। অন্যদিকে ‘গ্রেহাউন্ড’ আমাদের বুঝিয়েছে ইউ-বোটের খপ্পরে পড়ে কতটা অসহায় হয়ে পড়তে পারে সমুদ্রের উপরের জাহাজ কিংবা ব্রিটিশ ডেস্ট্রয়ার। ‘ডাস বুট’ আর ‘গ্রেহাউন্ড’-এর মধ্যে মূল তফাৎ চলচ্চিত্রের চিত্রায়ণে। ‘ডাস বুট’ যেখানে শান্ত, গম্ভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ; সেখানে ‘গ্রেহাউন্ড’ যেন একটা ঝড়, অশান্ত– ঠিক আটলান্টিকের ঢেউয়ের মতো।
গ্রেহাউন্ড সিনেমাটি পরিচালনা করেছেন অ্যারন স্নাইডার। আমার মতে, তিনি সিনেমাটিকে ভালোই সামলেছেন। স্ক্রিপ্ট লিখেছেন মূখ্য অভিনেতা টম হ্যাংকস নিজেই। কাহিনি নিয়ে বেশি কিছু বলার নেই। পার্ল হারবারে আক্রমণের পর ১৯৪২ সাল থেকে আমেরিকা কর্তৃক মিত্রবাহিনীকে বিপুল পরিমাণ সাহায্য পাঠানো হয়ে থাকে সমুদ্রপথে। কিন্তু পুরো সমুদ্রপথে যুদ্ধবিমানের মাধ্যমে জাহাজের সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব হয় না। কেননা আটলান্টিকের মধ্যবর্তী স্থানে জার্মান ইউ-বোটের কারণে সেই সময় তৈরী হয় এক সামুদ্রিক যুদ্ধক্ষেত্রের– যেটাকে বিশ্বযুদ্ধের সময় বলা হতো ‘ব্লাক পিট’। এই ব্লাক পিট অতিক্রম করার সময় মালবাহী জাহাজ ও সৈন্যবাহী জাহাজকে সুরক্ষা দিতে ‘গ্রেহাউন্ড’-এর মতো কিছু যুদ্ধজাহাজ আমেরিকা তাদের জাহাজ বহরের সাথে পাঠাতো। ‘গ্রেহাউন্ড’ সিনেমাটি আসলে এই ব্লাক পিট অতিক্রমের সময় একেকটি জাহাজের সংগ্রাম কাহিনি।
চলচ্চিত্রে টম হ্যাংকস গ্রেহাউন্ডের ক্যাপ্টেন আর্নেস্টের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। প্রথমবারের মতো আর্নেস্ট গ্রেহাউন্ড নামক যুদ্ধজাহাজের ক্যাপ্টেন হিসেবে অতিক্রম করতে যাচ্ছে ব্লাক পিট, পিছনে ফেলে এসেছে প্রেমিকার সাথে পুনর্মিলনের আকুতি– এই প্রেক্ষাপটে তৈরি হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধনির্ভর এই সিনেমাটি। পুরো সিনেমাটি উত্তেজনায় ভরপুর। উত্তেজনা থেকে যেন রেহায় নেই। ইউ-বোট এক মূহুর্ত বিরাম দেয়নি আর্নেস্টকে কিংবা দর্শকদের। ইউ-বোটের খপ্পর থেকে বাঁচতে ক্ষণে ক্ষণে আর্নেস্টকে নিতে হয়েছে কঠিন সিদ্ধান্ত। নির্ঘুম দিনাতিপাতে অনেকটা ক্লান্ত হয়ে পড়লেও আর্নেস্ট তার দায়িত্ব পালন থেকে কখনো বিরাম নেননি। দীর্ঘ ৫০ ঘন্টার যাত্রার এই জটিল যুদ্ধ আসলে আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সমুদ্রে আসলে কী চলেছে!
তবে পুরো চলচ্চিত্রজুড়ে আবেগের একটা ঘাটতি লক্ষ করা যায়। আর্নেস্টের প্রেমিকা ইভির জন্য এক ধরনের আবেগ সৃষ্টির প্রাণান্ত চেষ্টা হলেও সেটা অনর্থক মনে হয়– যদিও জীবনের অনেক ঘটনা অনেকের কাছে অনর্থক মনে হলেও সেটা বাস্তবতাও হতে পারে। আবার জার্মান ইউ-বোটের নাবিকদের মৃতদের প্রতি আর্নেস্টের আবেগী দৃষ্টিভঙ্গি সুস্পষ্টভাবে দর্শকদের হৃদয়ে গেঁথে থাকবে না। ‘ডাস বুট’-এসকল দিক দিয়ে পরিপূরক। তাছাড়া সাউন্ড ইফেক্টের ক্ষেত্রেও ‘গ্রেহাউন্ড’ মাস্টারক্লাস কাজ দেখাতে পারেনি। ‘ডাস বুট’ থেকে ধার করা থ্রিলার সাউন্ড ইফেক্টের অনুপযুক্ত ব্যবহার চলচ্চিত্রটির অ্যাকশন দৃশ্যগুলোকে কিছুটা হলেও দুর্বল করে দিয়েছে।
তারপরও বলতে হবে, ‘গ্রেহাউন্ড’ সিনেমাটি সফল। কেননা সমুদ্রের মাঝে একটা যুদ্ধজাহাজের মধ্যে প্রায় পুরো সিনেমাটিকে ফুটিয়ে তোলা সহজসাধ্য কাজ নয় মোটেই। তাছাড়া টম হ্যাংকসের দারুণ অভিনয় দর্শকদের পুরোটা সময় স্ক্রিনে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখবে বলে আশা করি।