‘দত্ত ভার্সেস দত্ত’ নামের এই ছবিটি মুক্তি পেয়েছিলো ২০১২ সালে। চিত্রনাট্য, সংলাপ এবং পরিচালনা অঞ্জন দত্তের। বীরেন দত্ত নামের চরিত্রটিতে অভিনয় করেছেন নিজে। অন্যান্য মূখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন রণদীপ বোস (রণো চরিত্রে), শঙ্কর চক্রবর্তী (ঘেন্টি কাকুর চরিত্রে), সোমক ঘোষ (দই’র চরিত্রে), রীতা কৈরাল (রীতা চরিত্রে), রুপা গাঙ্গুলী (রুপা চরিত্রে), সৃজিত মুখার্জী (টনি মুখার্জী’র চরিত্রে), পার্ণো মিত্র (নন্দিতার চরিত্রে)। বিভিন্ন সময়ের দৃশ্যে আরও ছিলেন অর্পিতা পাল, কৌশিক সেন, বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী, মানসী সিনহা, দেবরঞ্জন নাগ সহ আরও অনেকে। ১২৪ মিনিটের এই সিনেমায় থিম সঙসহ ৫ টি গানের কম্পোজিশান করেছেন নীল দত্ত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও কৃতজ্ঞতা জানানো হয়েছে।
আমার আগে যারা এই ছবি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করেছেন তারা এটিকে ‘সেমি বায়োগ্রাফিক ফিল্ম’ বলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছেন। তবে আমি এটিকে ‘জীবনমুখী চলচ্চিত্র’ বলবো। হতে পারে এটাতে অঞ্জন দত্ত’র ছায়া পড়েছে, কিন্তু অঞ্জন দত্ত চলে আসেননি অঞ্জন দত্ত হয়ে। সত্তরের দশকের সমাজ নিয়ে ছবি বানানো হলে তখনকার কলকাতার উত্তাল শ্রেণি শত্রু খতমের নেশায় কাঁধে শান্তিনিকেতনি ব্যাগ ঝুলিয়ে ছুটে চলা যুবকদের দেখা পাওয়া যাবে। এটা মানতে হবে তখনকার কলকাতায় একটা পরিবর্তন আসছিলো। আস্তে ধীরে নয়, খুব দ্রুত-অনেকটা উন্মত্ত চিতার মতো। কাজেই এদিক ওদিক ছড়াছড়ি কম হয়নি। বাংলাদেশ সেই সময়টায় নেহায়েৎ স্বাধীকার আন্দোলন আর রক্ত দিতে ব্যস্ত ছিলো, নয়তো নকশালবাড়িয়া আন্দোলন ছত্তিশগড় পৌঁছানোর আগে রাজশাহী বা চুয়াডাঙ্গা হয়ে বাংলাদেশে ঢুকে যেতো।
এই ছবিতে উঠে এসেছে সেই দশকে কলকাতায় ঢুকে পড়া বিট কালচারাল মুভমেন্ট, গ্রামের মেঠো পথ টেনে এনে শহরের রাজপথে মেশানোর স্বপ্ন। উঠে এসেছেন গোফার, উঠে এসেছেন ক্রুফো। একইভাবে উঠে এসেছেন বাদল সরকার বা মৃণাল সেনরাও। উঠে এসেছে ন্যুভেনবার্গের চলচ্চিত্র পাড়ার হঠাৎ বৈপ্লবিক বদলে যাওয়া। এসবের পাশে দিয়ে অঞ্জন দত্ত খুব সাবধানে দেখিয়েছেন একটি যৌথ পরিবারের গল্প। যে পরিবারের কর্তাস্থানীয়রা বাড়ির নিচতলায় দড়ি টেনে কাপড় শুকানো নিয়ে হুল্লোড় বাঁধিয়ে বসে, কিন্তু বাড়ির মেয়ের ইজ্জতের প্রশ্ন আসলে নিজেদের মাঝে অভিভাবকত্ব জাগিয়ে তোলে। যে পরিবারের কর্তা সন্ধ্যা নামলে পেটমোটা স্নায়ু উত্তেজক পানীয়র বোতল নিয়ে তাসের আসর বসিয়ে দেন, সাথে জুয়া। কিন্তু ভৃত্যর বেতনটা চুকানোর সময় সব হিসাব উলটে যায়। দেখিয়েছেন সমাজের কিছু পাশ কাটানোর অযোগ্য সম্পর্ক, যেমনটা ঘেন্টি কাকু আর দিদির। যেমনটা ঘেন্টি কাকু আর রণোর মার। অথবা বীরেণ দত্ত আর তার ভিন্টেজ গাড়ি। অঞ্জন দত্ত দেখিয়েছেন সেই সব বাবাদের, যাদের ভেতরে পিতৃত্ব থাকে-দায়িত্ব থাকে। আরও থাকে পুরুষত্ব। কাজেই তাদের জীবনে আগমন ঘটে দ্বিতীয় কোনো নারীর, সমাজ যে সম্পর্কটাকে বলে থাকে ‘পরকীয়া’। অঞ্জন দত্ত শুনিয়েছেন সেসব সিফন শাড়ি পড়া রুনু মাসিদের গল্প। যেসব মহিলারা নিজেদের আর দাবার ঘুঁটি ভাবেন না, একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষই ভাবেন। নিজের সব ছবির মতো এই ছবিতেও অঞ্জন দত্ত দেখিয়েছেন ঘুণে ধরা সমাজের নৈয়ায়িকদের অপ্রয়োজন দৌড়াদৌড়ি, অন্ধের মতো কিন্তু স্বার্থপর ছুটে চলা। দেখিয়েছেন অলিতে গলিতে দেয়ালে মারা একেকটা চিকা, তখনকার উত্তাল কলকাতা আর তার যুবক-যুবতীদের শ্রেণি সংগ্রামের মাধ্যমে একটি নতুন সমাজ গড়ার স্বপ্নকে বয়ে নিয়ে চলা। একই সাথে এগিয়েছে সিনেমার গল্প। এগিয়ে গিয়েছে দিদি আর নকশাল নেতা (কৌশিক সেন), ভেঙে দিয়েছে মেকি ‘সামাজিক শিষ্ঠাচার’। রণদীপের বান্ধবী ডায়ানা এসেছে গল্পে নিজ বৈশিষ্ট্য নিয়ে, চলেও গিয়েছে নিয়ম ভাঙার তাড়নায় না পড়ে।
ছবির সবগুলো চরিত্রেই সবাই খুব প্রাঞ্জল আর সাবলীল অভিনয় করেছেন। অল্প সময়ের জন্যে পর্দায় এলেও রণদীপের দাদু (দীপঙ্কর দে) বা কাকা (শুভাশিস মুখোপাধ্যায়) ছবিটাতে এক আনকোরা ধরণের অনিন্দ্যতা যোগ করেছেন। একবারের জন্যও মনে হয়নি শ্যুটিং এর সময় ডিরেক্টর’স চেয়ার থেকে কারোর অ্যাকশন, রোল ইন বা কাট বলার মতো কিছু ঘটেছে। মনে হয়েছে সবাই নিজের মতো নিজের গল্পটা বলে গিয়েছেন একটা ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে। একদম নিজের গল্প। ২০১২ সালে মুক্তি পাওয়া এই ছবির ক্যামেরা পজিশনিং, সঙ্গীত, মেকআপ, পোষাক বাছাই বা সম্পাদনা সবই দৃষ্টিনন্দন। গল্পে ফুটে ওঠা বাবা ছেলের মতানৈক্য আর ছুটতে ছুটতে হঠাৎ গতি পাওয়া শহর কলকাতা-সবকিছু সাবলীল ও স্বাভাবিক।
সেরা চরিত্র: বীরেণ দত্ত (অভিনয়ে অঞ্জন দত্ত)।
সেরা ব্যাপ্তি: ২৬ মিনিট থেকে ২৯ মিনিট ৩০ সেকেন্ড।
সেরা পার্শ্বচরিত্র: টনি মুখার্জী (সৃজিত মুখার্জী)।
ভালো লাগা গান: তবু যদি তুমি (রুপঙ্কর বাগচী)।
পুনশ্চ: ১
‘দত্ত ভার্সেস দত্ত’ দেখার পর অনেকে বলেছেন এটা মূলত অঞ্জন দত্তের জীবনের সেলুলয়েডীয় প্রতিরূপ। ছবিটা চলার সময় আমারও বারকয়েক মাথায় এসেছে বিষয়টা। ছবির অন্যতম চরিত্র রণোর শৈশব কেটেছে দার্জিলিং-এ, সেন্ট পলস স্কুলে। অঞ্জন দত্তের ক্ষেত্রেও তাই। নিয়ম ভাঙার তাড়নাটা রণো যেনো শুধু ‘অভিনয়’-ই করেছে, সামনে থেকে পরিচালনা দিয়েছেন এই তাড়নার মূল মালিক। হতে পারে সব টানাপোড়েনের গল্পের ফাঁকে ফাঁকে বা পুরোটা জুড়েই অঞ্জন দত্ত দেখিয়েছেন তার শৈশব, বাড়ি, কলহপ্রিয় পরিবার বা নাড়ির টান থেকে, প্রিয় শহর কলকাতা। শেষটা বাদে বাকি সবটুকুই খুব সাবধানে, সঙ্গোপনে।
পুনশ্চ: ২
সৃজিত মুখার্জী সিনে পরিচালক হিসেবে বেশি পরিচিত হলেও তাঁর আরও একটা পরিচিতি আছে, সেটা হলো অভিনেতা। নিজের পরিচালিত প্রতিটি ছবিতেই কোনো না কোনো একটা চরিত্রে দেখা যায় তাঁকে। তবে এ ছবিটা দেখার পর মনে হয়েছে, এখানে তিনি সবচেয়ে ভালো অভিনয়টা করেছেন। দর্শকরা হয়তো এক মূহুর্তের জন্য ভুলেই গিয়েছিলো পরিচালক সৃজিত মুখার্জীকে, তাদের চোখে শুধুই ভেসে বেড়িয়েছেন ন্যুডেনবার্গের বিল্পবে আন্দোলিত কলকাতার ঘিঞ্জি গলির কোনো একটা বাড়িতে বসে নতুন নতুন গান ফেঁদে সমাজ বদলানোর স্বপ্ন দেখা টনি মুখার্জী।