এককালে, চীনের এক দূরবর্তী রাজ্যে বাস করতেন এক দয়ালু এবং সাহসী যুবরাজ, যার নাম ছিল রাজকুমার লুয়ান। রাজ্যের মানুষ তাকে খুব ভালোবাসত, কারণ সে ছিল অত্যন্ত সৎ এবং তার রাজ্যকে শান্তি ও সমৃদ্ধিতে পরিচালিত করত। কিন্তু তার মন ছিল বিষণ্ণ। তিনি অনেক দিন ধরে তার নিখোঁজ প্রিয়তমা রাজকুমারী ইয়ে-কে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন, যিনি হঠাৎ একদিন অদৃশ্য হয়ে যান। রাজকুমার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, যেভাবেই হোক, তিনি রাজকুমারীকে খুঁজে বের করবেন।
একদিন, রাজকুমার লুয়ান স্বপ্ন দেখলেন যে, রাজকুমারী ইয়ে একটি রহস্যময় পাখিতে রূপান্তরিত হয়েছেন। সেই পাখি নীল রঙের এবং আকাশের মত উজ্জ্বল ছিল। রাজকুমার বুঝতে পারলেন যে তার প্রিয়তমা কোনো এক যাদুকরের অভিশাপে পড়ে গেছে, এবং তাকে উদ্ধার করতে হবে।
রাজকুমার যাত্রা শুরু করলেন সেই নীল পাখিকে খুঁজে বের করার জন্য। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত তিনি অজানা পথে হাঁটতে লাগলেন। পথ চলতে চলতে তিনি নানা বিপদ, দৈত্য, এবং রহস্যময় জীবদের মুখোমুখি হলেন। কিন্তু তিনি কখনো থামলেন না, কারণ তার মনের মধ্যে ছিল একমাত্র লক্ষ্য—রাজকুমারী ইয়ে-কে মুক্ত করা।
অবশেষে, অনেক বছর পর, রাজকুমার একটি গহন বনে এসে পৌঁছালেন। সেখানে একটি বিশাল গাছের ডালে বসে ছিল এক অপূর্ব নীল পাখি। পাখিটির চোখে ছিল গভীর দুঃখের ছায়া, এবং রাজকুমার লুয়ান ঠিক তখনই বুঝতে পারলেন যে এটাই তার প্রিয়তমা রাজকুমারী ইয়ে।
রাজকুমার পাখির কাছে গেলেন এবং তাকে আদর করে বললেন, “আমি জানি তুমি কে। আমি তোমার জন্য এতদিন ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছি। আমি তোমাকে ভালোবাসি এবং মুক্ত করতে চাই।”
পাখিটি তার ডানা ঝাপটাল, আর সেই মুহূর্তে আকাশে এক জাদুকরী আলো ঝলমল করে উঠল। হঠাৎ একটি ভয়ানক কণ্ঠস্বর শোনা গেল—এটা ছিল সেই যাদুকর, যিনি ইয়ে-কে অভিশাপ দিয়েছিলেন। তিনি বললেন, “তুমি যদি ইয়ে-কে মুক্ত করতে চাও, তবে তোমাকে নিজের জীবনের মূল্য দিতে হবে।”
রাজকুমার লুয়ান এক মুহূর্তও চিন্তা না করে সম্মতি দিলেন। তিনি বললেন, “আমি সবকিছু ত্যাগ করতে রাজি আছি, যদি আমার প্রিয়তমা মুক্তি পায়।”
যাদুকর তার কথা শুনে অবাক হলেন, এবং রাজকুমারের নিঃস্বার্থ ভালোবাসায় অভিভূত হলেন। যাদুকর তখন ইয়ে-র উপর থেকে অভিশাপ তুলে নিলেন, এবং নীল পাখি ধীরে ধীরে একটি সুন্দরী রমণীতে রূপান্তরিত হলো। এটি ছিল রাজকুমারী ইয়ে। রাজকুমার তাকে দেখে খুশিতে আত্মহারা হলেন।
কিন্তু ঠিক তখনই, রাজকুমার লুয়ান ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যেতে লাগলেন। তার আত্মত্যাগের শর্ত অনুযায়ী, তিনি মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। রাজকুমারী ইয়ে কাঁদতে শুরু করলেন এবং বললেন, “আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারব না!”
যাদুকর আবারও মুগ্ধ হলেন তাদের ভালোবাসায়। তিনি বললেন, “তোমাদের ভালোবাসা এতটাই শক্তিশালী যে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি তোমাকে আর আলাদা করব না।” এরপর যাদুকর তাদের দুজনকেই নতুন জীবন দিলেন। রাজকুমার এবং রাজকুমারী একসঙ্গে ফিরে গেলেন তাদের রাজ্যে।
রাজ্যে ফিরে, রাজকুমার লুয়ান এবং রাজকুমারী ইয়ে সুখে-শান্তিতে জীবনযাপন করতে লাগলেন। তাদের ভালোবাসা, ত্যাগ এবং নিঃস্বার্থতার গল্প রাজ্যে চিরকালীন হয়ে রইল, আর নীল পাখির গল্প কিংবদন্তি হিসেবে ছড়িয়ে পড়ল প্রজন্মের পর প্রজন্ম।
এভাবেই নীল পাখির গল্প ভালোবাসা এবং আত্মত্যাগের প্রতীক হয়ে উঠে, যা আজও চীনা রূপকথায় অমর।