মনজুরুল ইসলাম
১৯৮১ সালে কুড়িগ্রাম জেলার পাঁচগাছী ইউনিয়নের কদমতলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পেশা শিক্ষকতা। শিক্ষাবিষয়ক প্রবন্ধ লেখক, গল্পকার এবং অনুবাদক। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: শ্রেষ্ঠ মানুষ (প্রবন্ধগ্রন্থ), কাঠের শহর (গল্পগ্রন্থ)
মনজুরুল ইসলাম

ছাত্র-শিক্ষক: সম্পর্কের প্রান্ত-যোগ-২

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

শার্লট ব্রন্টি তাঁর ‘জেন আয়ার’ উপন্যাসটিতে সেই দায়বোধের বিষয়টিকে তার প্রকৃত জীবনবোধ থেকে উৎসারিত সত্যের মাধ্যমে আমাদের সামনে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র জেন আয়ারের গভীরে প্রবেশ করলে সেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আয়ারের শিক্ষিকা মিস টেম্পল সর্বোচ্চ প্রচেষ্টার মাধ্যমে তাকে একজন সুশিক্ষিতা হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন।

যদিও আয়ারের এই পৃথিবীতে আপন বলতে কেউই ছিল না। কিন্তু তার এই অভাবটি কখনই শিক্ষিকা টেম্পল বুঝতে দেন নি। ফলে ঋণ শোধ নয় বরং শিক্ষিত হবার পর জীবনের প্রতি পলে পলে শিক্ষিকা টেম্পলকে অত্যন্ত সযতনে আগলে রেখেছিলেন তার মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত। নিজের মাকে দু’চোখ ভরে দেখবার সুযোগ না পেলেও শিক্ষিকা টেম্পলকে মায়ের মতো করে ভালোবাসবার মাধ্যমে সেই অভাবটুকু পূরণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন ট্রাজিক চরিত্র আয়ার। শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর মাঝে যে সম্পর্কের গভীরতা কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে সেটিই ফুটে উঠেছে উপন্যাসটিতে। একই সাথে মনুষ্যত্বের যে বীজ শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষিকা মিস টেম্পল তার অন্তর্জগতে প্রবিষ্ট করতে সক্ষম হয়েছিলেন সেই শিক্ষাটিই আজীবন অনুসরণ করে আয়ার তার কণ্টকাকীর্ণ জীবনে ইতিবাচকভাবে প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ প্রেক্ষিত বিবেচনায় সমরেশ মজুমদার সৃজিত ‘সাতকাহন’ উপন্যাসটিকে যদি তীক্ষ্ণ অনুসন্ধিৎসা দ্বারা পর্যবেক্ষণ করা যায় তবে এখান থেকেও শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে স্থিত ভালোবাসার তীব্রতাকে মননের নিগূঢ় অনুভূতি দ্বারা উপলব্ধি করা সম্ভব হবে। উপন্যাসটির মুখ্য চরিত্র দীপাবলি রায় যখন কলকাতা থেকে তাঁর আদর্শ শিক্ষক সত্যসাধন স্যারকে দেখতে এসেছিল তখন কথা বলবার মতো শারীরিক সামর্থ্য ছিলো না তাঁর স্যারের। চোখ মুখ ভেঙে যাবার পাশাপাশি পুরো শরীর অত্যন্ত শীর্ণকায় হয়ে গিয়েছিল। সামান্য নড়াচড়া কিংবা কথা বললেই হাঁপিয়ে যেতেন তিনি, শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণের ক্ষেত্রে সম্মুখীন হতেন সীমাহীন বিপত্তির। তবুও দীপাবলীকে দেখবার পর শারীরিক সকল সীমাবদ্ধতাকে ভুলে গিয়ে তাকে উপদেশ দিতে আরম্ভ করেছিলেন এভাবে, ‘যখনই সময় পাবে প্রেসিডেন্সি কলেজ, ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে বেড়াতে যাবে, ওসব জায়গায় গেলে মনের পরিবর্তন আসে।’ পরবর্তী জীবনে দীপাবলী তাঁর শিক্ষকের এই অমৃত বাণীগুলিকে আবশ্যিকভাবে পালনের মাধ্যমে শুধু নিজের জীবনকেই অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে আসে নি বরং গোটা সমাজেই একটি প্রভাববিস্তারী দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে নিজেকে। ঔপন্যাসিক সমরেশ মজুমদার এখানে যে বিষয়টির ওপর পরোক্ষভাবে দৃষ্টিপাত করেছেন সেটি হলো– একজন শিক্ষক, তিনি যদি সত্যিকার অর্থেই প্রকৃত শিক্ষক হয়ে থাকেন তবে অবশ্যই তার অবচেতনাতেই তিনি একজন শিক্ষার্থীর মঙ্গলকল্পে নিয়ত চিন্তান্বিত রয়ে যান। তার সেই শিক্ষার্থীকে দেখবার পর সর্বোচ্চ প্রচেষ্টার মাধ্যমে স্বল্প সময়ের জন্যে হলেও জীবন জাগৃতিমূলক উপদেশ প্রদান করে থাকেন। এটিই স্বভাবজ এবং চিরাচরিত। একইভাবে শিক্ষার্থী যদি প্রকৃত শিক্ষকের শিক্ষাকে গ্রহণ করতে সক্ষম হন তবে ব্যক্তিগত জীবনে সফল তো হবেনই বরং তার মাধ্যমে সমাজ দেখবে আলোর চিরন্তন পদরেখা। এখান থেকে যে শিক্ষাটি আমরা লাভ করতে পারি সেটি হলো– একজন শিক্ষক, তিনি যদি প্রকৃত শিক্ষকের সকল গুণাবলি নিজের মধ্যে ধারণ করে তার শিক্ষার্থীদের প্রদান করতে সক্ষম হন তবে অবশ্যই তিনি সেই শিক্ষার্থীর মননের মর্মমূলে প্রবেশ করে তার ভেতরে স্থিত অনুভবটিকে নিজের মতো করে জয় করে নিতে পারবেন। পক্ষান্তরে, সেই শিক্ষার্থীটিও লাভ-লোকসানের হিসেব না করে শিক্ষার মাধ্যমে প্রকৃত ভালোবাসার সৃজিত বোধ দ্বারা তার শিক্ষককে আজীবন শ্রদ্ধা করতে সক্ষম হবে।

সুতরাং সন্দেহাতীতভাবেই যে বিষয়টি এখন আমাদের সামনে এসে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অকৃত্রিম বাসনা পোষণ করবে সেটি হলো– কীভাবে আমরা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মাঝে সম্পর্কের গভীরতাকে নিবিড় থেকে অধিকতর নিবিড় করে তুলতে পারি? পরিকল্পনা করে যেমন কেউ লেখক হতে পারেন না, তেমনি একইভাবে কোনো সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করাও সম্ভব নয়। এজন্য প্রথমেই যে গুণটির প্রয়োজন সেটি হলো– নিজের ভেতরে প্রোথিত প্রতিভার সঠিক পরিচর্যাকরণ। একজন মানুষ যখন নিজেকে, নিজের ভেতর স্থিত প্রতিভাটিকে লালন করতে শুরু করবেন তখন আপনা আপনি বিভিন্ন প্রতিবেশ দ্বারা তিনি প্রভাবিত হবেন। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটবে। এবং তার ভেতরে চর্চিত এবং প্রোথিত সত্য বাসনাটি তাকে সবার সঙ্গে ভালো আচরণ প্রদর্শনে বাধ্য করবে। ধীরে ধীরে যে কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির সঙ্গ অথবা আবহ প্রত্যাশা করবেন তাই-ই তিনি পেয়ে যাবেন। এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনার প্রয়োজন পড়বে না। একইভাবে একজন লেখক যখন অধ্যয়নের ওপর প্রকৃত অনুরাগ সৃষ্টি করতে সক্ষম হবেন তখন তার প্রাত্যহিক জীবনে অধ্যবসায় একটি নৈমিত্তিক কর্ম বলে বিবেচিত হবে। সময়ের পরিক্রমায় অর্জিত জ্ঞান ও বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতাকে সমন্বয় করে তিনি প্রকৃত রচনা সৃজন করতে পারবেন অনায়াসেই। এই অধ্যয়নটি থেকে প্রাপ্ত তার নিজের সুকুমার বৃত্তিগুলো সাধারণ মানুষ এবং লেখকের মতো অনুরূপ একজন শিক্ষার্থী যখন জ্ঞান অর্জনের অকৃত্রিম বাসনাকে কেন্দ্র করে শ্রেণিকক্ষে অথবা শ্রেণিকক্ষের বাইরে পাঠচক্র, বিতর্ক, খেলাধুলা ও মানবিক কর্মসহ নানামুখী সৃজনশীল কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রাকৃতিক ও নিরিবিলি পরিবেশে বিরাজিত থাকবে তখন খুব সহজেই সেই শিক্ষার্থীটি শিক্ষকের কাছাকাছি আসবার সুযোগ লাভ করবে। শুধু জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রেই নয়, শিক্ষকের প্রতি সেই শিক্ষার্থীর ভীতি কমে আসবার পাশাপাশি ব্যক্তিগত সমস্যা আলোচনায় নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত থাকবার সুযোগ পাবে। এক্ষেত্রে শিক্ষককেও বাধ্যতামূলতভাবে এমন কর্মযজ্ঞে নিজের স্বতস্ফূর্ত আগ্রহটিকে নিশ্চিত করবার মানসিকতা পোষণ করতে হবে। এমন মানসিকতা গ্রহণ না করা পর্যন্ত শিক্ষার প্রকৃত আবহ কখনোই সৃষ্টি হবে না। আর শিক্ষক যখন নিজ সন্তানের কল্যাণের মতোই তার শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করবেন তখন পরিস্থিতি হয়ে উঠবে পুরোপুরি উর্বর। শিক্ষক তখন উদারচিত্তে তার ভালোবাসার পাপড়িগুলো ছড়িয়ে দিতে শুরু করবেন কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মননভূমিতে।এবং তিনি তার তীক্ষ্ণ অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিকে প্রক্ষেপ করে যখন স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সক্ষম হবেন যে, উক্ত শিক্ষার্থী প্রকৃত অর্থেই জ্ঞান অর্জনে উৎসাহী তখন শিক্ষক ভালোবাসার বীজ বুনে শিক্ষার্থীর প্রতি এমন এক ধরনের দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করবেন যাতে করে উক্ত শিক্ষার্থীর অন্তর্জগতে এমন মানসিকতার উদয় হয়, যেন শিক্ষকের প্রতিমূর্তিস্মরণপূর্বক আপন মনে উন্নত জীবন গঠনের দিকে ধাবিত হবার উদ্দীপনা সে লাভ করবে।

রামেশ্বরম এলেমেন্টারি স্কুলে অধ্যয়নকালীন ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এবং পরমাণু বিজ্ঞানী এপিজে আবদুল কালামের বিজ্ঞান শিক্ষক শিবসুব্রামানিয়া আয়ার তাকে সবসময়ের জন্যেই একটি কথা বলতেন– ‘কালাম, আমি তোমার জীবনের উন্নতি চাই, যাতে করে বড় শহরের উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিদের সঙ্গে তুমি অবস্থান করতে পারো।’ এই একটি কথাকে বাস্তবে প্রতিষ্ঠা করবার জন্যে শিক্ষক শিবসুব্রামানিয়া আয়ার ঘণ্টার পর ঘণ্টা কালামের সঙ্গে সময় কাটাতেন, পড়াশুনার ব্যাপারে তাকে বিভিন্নভাবে উৎসাহ প্রদান করে যেতেন। তাঁর কাছ থেকে উৎসাহ প্রাপ্ত হয়ে কালাম যখন শিক্ষার প্রাথমিক পাঠ সম্পন্ন করবার পর জেলা সদর রামনাথপুরমে অবস্থিত শোয়ার্টজ হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছিল তখন ইয়াডুরাই সলোমন নামে আর একজন শিক্ষককে কাছে পেয়েছিল, যিনি শিবসুব্রামানিয়ার অভাবটি পূরণ করতে পেরেছিলেন।

শৈশবে আকাশের রহস্যময়তা ও পাখিদের উড্ডয়নে মোহাবিষ্ট হয়ে পড়তো বালক কালাম। সারসের উড্ডয়ন প্রত্যক্ষ ও শৃগালের চিৎকার শ্রবণ করে আকাশে উড্ডয়নের জন্য যেমন আকুল হয়ে পড়তো ঠিক তেমনি চিৎকারের মর্মবাণীটি উপলব্ধি করে প্রাপ্তির পূর্ণতার লক্ষ্যে প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতো। কালাম যখন তার এই প্রত্যয় শিক্ষকের কাছে ব্যক্ত করতো তখন শিক্ষক ইয়াডুরাই সলোমন কালামের আত্মশক্তি উঁচুতে তুলে ধরবার নিমিত্তে বলতেন, ‘জীবনে সফল হতে আর ভালো ফলাফল অর্জন করতে, তোমাকে অবশ্যই তিনটে প্রবল শক্তি সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে আর সেগুলোর ওপর কর্তৃত্ব করতে হবে, যে ধারণা তিনটি হলো– আকাঙ্ক্ষা, বিশ্বাস আর প্রত্যাশা।’ এবং আরো বলতেন, ‘যা ইচ্ছে করো তা হবার সামর্থ্য তোমার মধ্যে রয়েছে। মনে বিশ্বাস থাকলে, তোমার ভাগ্য তুমি পরিবর্তন করতে পারবে।’ তাঁর এই কথাগুলি শুধু উপদেশের সীমানা জুড়েই অবস্থান করে নি বরং সেই সীমা অতিক্রম করে তিনি সীমাহীন পরিশ্রম করেছিলেন কালামের প্রতিশ্রুতিশীল প্রত্যয়ের সার্থকতাটিকে নিশ্চিত করতে। শুধু তাই নয়, সেন্ট যোসেফ কলেজে রেভারেন্ড ফাদার টিএন সেকুয়েইরার মতো শিক্ষকও পেয়েছিল কালাম। রেভারেন্ড তাকে ইংরেজি সাহিত্যর ওপর বিশেষ জ্ঞান লাভে সহায়তা করেছিলেন, যে সহায়তার ওপর ভিত্তি করে কালাম লেখালেখির ওপর উৎকর্ষ অর্জন করতে পেরেছিল। ‘আমাদের নিজস্ব বিমান তৈরি করা যাক’– এম.আই.টি তামিল সংঘ কর্তৃক আয়োজিত রচনা প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়েছিল উক্ত শিরোনামে লিখে ওই শিক্ষকেরই নির্দেশনা, অনুপ্রেরণা এবং উৎসাহের ওপর ভিত্তি করে।

কিন্তু, এই অসীম প্রতিভাবান বালকটিই কলেজের পাঠ সম্পন্ন করবার পর কোথায় এবং কীভাবে ভর্তি হবে সেটি নিয়ে অনিশ্চয়তার মগ্ন প্রচ্ছন্নতায় দোলায়মান ছিলো।এম.আই.টি তে ভর্তি হবার পূর্ব মুহূর্তে রামেশ্বরম রেলস্টেশন রোডে অবস্থিত তার বড় ভাই মুস্তফা কামালের মুদির দোকানে যখন তেল, পেঁয়াজ, চাল এবং অন্যান্য দ্রব্য এবং ছোটো ভাই কাশিম মোহাম্মদের কিওসস্কে সমুদ্র শঙ্খ দিয়ে তৈরি নানা সৌখিন দ্রব্য বিক্রি করতো তখন এই বিষয়টি নিয়েই সার্বক্ষণিক চিন্তায় তাকে মগ্ন থাকতে হতো। কিন্তু, সকল সীমাবদ্ধতাকে জয় করে যখন এম.আই.টি-তে ভর্তির সুযোগ পেয়েছিল তখন আর্থিক সংকটে পড়েছিলো প্রবলভাবে। ক্রান্তিক এই মুহূর্তটিতে এগিয়ে এসেছিলেন তার বোন জোহরা, যিনি নিজের ব্যবহৃত সোনার বালা ও চেইন বন্ধক রেখে ভর্তি করিয়েছিলেন ছোটো ভাই কালামকে, যে কালামই একদিন রামেশ্বরমের প্রথম শিশু হিসেবে আকাশে উড়তে সক্ষম হয়েছিল। সক্ষম হয়েছিল পরমাণু বিজ্ঞানী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে। বিজ্ঞানী হিসেবে তার এই প্রতিষ্ঠা লাভের নেপথ্যে যে তিনজন শিক্ষক মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন সেই তিনজন শিক্ষক অধ্যাপক স্পন্ডার, কেএভি পান্ডালাই ও অধ্যাপক নরসিংহ রাও এর অসীম অনুপ্রেরণা এবং উৎসাহের প্রতি কৃতজ্ঞতাও জানিয়েছিল পরবর্তীতে অকুণ্ঠচিত্তে তারই লেখনীতে ।

উদ্ধৃত সাধারণ এক বালকের অসাধারণ হয়ে উঠবার নেপথ্যে যে নিগূঢ় বাস্তবতাটি প্রতিষ্ঠিত সেটি হলো, স্কুল থেকে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ পর্যন্ত তাঁর শিক্ষকবৃন্দের অকুণ্ঠ সহযোগিতা। পাশাপাশি এটিও আমাদের অবশ্যই স্বীকার করে নিতে হবে যে, বালক কালাম তাঁর শিক্ষকবৃন্দের কাছ থেকে উৎসাহ, অনুপ্রেরণা এবং ভালোবাসা আদায় করে নিতে সক্ষম হয়েছিল বলেই শিক্ষকবৃন্দ তার মনন-আভ্যন্তরীক পরিমণ্ডলে উন্মুখ উদগম কুঁড়িটিকে পূর্ণরূপে ফুটিয়ে তুলতে প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন। এবং তার এই সক্ষমতা সৃষ্টির পেছনে অবশ্যই তীব্র আকাঙ্ক্ষা এবং সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণে সীমাহীন পরিশ্রম করবার মানসিকতা শিক্ষা জীবনের প্রতিটি ধাপে প্রতিনিয়ত ক্রিয়াশীল ছিল। শিক্ষার্থী, সে যে প্রতিষ্ঠানেরই হোক না কেন, যদি সাফল্যের আকাঙ্ক্ষা প্রাণপূর্ণ প্রচেষ্টা তার শিক্ষকের সামনে প্রকাশ করতে পারে তবে অবশ্যই সেই শিক্ষক হয় মেধা দিয়ে নয়তো অনুপ্রেরণা প্রদান করে অথবা অন্য যে কোনো সৎ প্রচেষ্টার মাধ্যমে সেই শিক্ষার্থীটিকে তার স্বপ্ন পূরণে সহায়তার হাতটি প্রসারিত করবেন। এমনও হতে পারে একটি শ্রেণিকক্ষে সেই শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের পাঠ প্রদানের ক্ষেত্রে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন না, সেটি হতে পারে স্কুল, কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু, সেই শ্রেণিকক্ষে যদি এই ধরনের একজন শিক্ষার্থীও থেকে থাকে তবে তার একার জন্য হলেও তিনি পাঠদানে উদগ্রীব হয়ে থাকবেন। সেই নির্দিষ্ট শিক্ষার্থীর জীবনমানের উন্নয়নে সার্বক্ষণিক চিন্তায় মগ্ন থাকবেন। যখন তিনি তার পাঠটি প্রস্তুত করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দিকে যাত্রা করবেন তখন আপনা আপনি সেই শিক্ষার্থী কল্পনার ভেলায় চড়ে সেই শিক্ষকের সামনে এসে দণ্ডায়মান হবে। তার হাঁটা চলা, নিষ্পাপ মুখাবয়ব সেই শিক্ষকের তাৎক্ষণিক চিন্তাপ্রবাহে সেই শিক্ষার্থীর একটি ভবিষ্যৎ চিত্রকল্পের সৃষ্টি করবে। সৈয়দ মুজতবা আলী জার্মানির বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচ.ডি তে গবেষণাকালীন দর্শনের অধ্যাপক শ্মিট এর সান্নিধ্যে আসবার সুযোগ প্রাপ্ত হয়েছিলেন। অধ্যাপক শ্মিট শিক্ষকতা বৃত্তিতে ব্যুৎপত্তির এতটাই শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিলেন যে, বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর প্রয়োজনীয়তা তাঁর বয়সের সাথে পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পেয়েছিল। নিজে থেকেই পরবর্তী টার্ম থেকে অব্যাহতি পাবার জন্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেকটরদের অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু টানা বাইশটি বৎসর অনুরোধ অব্যাহত রাখলেও সেই অনুরোধের একটিও গৃহীত হয়নি। যে বিষয়টি আশ্চর্যের সেটি হলো, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে রেক্টর পদে অধিষ্ঠিত সবাই ছিলেন তাঁর স্নেহস্নাত শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীদের সামনে তাদের ওপর অবলীলায় তাঁর ক্রোধান্বিত মনোভাবটি প্রকাশ করে আক্ষেপের সাথে বলতেন– ‘কত বার করে অনুরোধ করলাম যে, এবারের মতো অন্তত আমাকে রেহাই দাও।’

ক্লাসে এমনভাবে তিনি পড়াতেন যা অনুকরণ করা যে কারো পক্ষেই ছিল অসম্ভব। কোন বইয়ের, কত নম্বর পাতায়, কত সালের, কী তথ্য সন্নিবেশিত রয়েছে তা কোনো প্রকারের নোট না দেখে অবলীলায় ব্যাখ্যা করে যেতেন তিনি। জার্মান ভাষার ওপর যথাযথ ব্যুৎপত্তি অর্জন করতে না পারায় প্রাথমিক পর্যায়ে তাঁর ক্লাসগুলো অনুধাবন করতে সৈয়দ মুজতবা আলীকে প্রচণ্ড বেগ পেতে হয়েছিল। ভাষার এই দুর্বলতার কারণে তিনি সাহস করে যে কোনো প্রশ্ন করতে ইতস্তত বোধ করতেন এই ভেবে যে– পরে না আবার কোনো সমস্যায় পড়ে যান। কিন্তু ‘আমি একশজনকে পড়াবো না একজনকে পড়াবো, কাকে পড়াবো আর কাকে পড়াবো না, সেটি স্থির করি একমাত্র আমি।’–অধ্যাপক শ্মিট এর এই কথাগুলো তাঁর অন্তর্করণে এমনভাবে রেখাপাত করেছিল যা তাঁর পরবর্তী জীবনে তাঁর অভাবকে প্রকট করে তুলেছিল। পরিণত বয়সে এমন আন্তরিকতাপূর্ণ মনোভাব প্রদর্শনের নেপথ্যে যেটি স্পষ্টভাবেই অনুভবিত সেটি হলো-শিক্ষক শ্মিট এর সাথে মুজতবা আলীর সম্পর্কের অন্তরঙ্গ গভীরতা। ক্লাস শেষে অথবা ভিন্ন কোনো সময়ে স্যারের সাহচর্য লাভে মুজতবা আলী চেষ্টা করে গিয়েছিলেন জ্ঞান অর্জনের। তাই এটি বলবার বিন্দুমাত্র অবকাশ থাকে না যে-কোনো একজন শিক্ষার্থী যদি তার প্রীতিপূর্ণ ব্যবহার প্রদর্শনের মাধ্যমে কোনো শিক্ষকের হৃদয়পটে দাগ কাটতে সক্ষম হয় তবে অবশ্যই যত সমস্যাই সেই শিক্ষকের যাপিত জীবনজুড়ে বিদ্যমান থাকুক না কেন, ওই শিক্ষার্থীর জন্যে হলেও তিনি তার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টাটুকু প্রয়োগ করবেন। পাশাপাশি এই ধরনের শিক্ষক অনান্য শিক্ষার্থীদেরকেও উৎসাহ প্রদান করে যাবেন অসীম অনন্তকে স্পর্শ করবার এবং সবসময়ের জন্যে আন্তরিক থাকবেন সেই প্রচেষ্টার সঙ্গী হবার। কিন্তু শিক্ষার্থীদের মধ্যে যদি সেই প্রবল বাসনার উদয় না হয় তবে কোনোভাবেই তাকে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হয়ে উঠবে না।


This is an original content which is written by a DORPON author. Copying and publishing any part of the content is strictly prohibited.

প্রথম পর্ব দ্বিতীয় পর্ব তৃতীয় পর্ব

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu