মনজুরুল ইসলাম
১৯৮১ সালে কুড়িগ্রাম জেলার পাঁচগাছী ইউনিয়নের কদমতলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পেশা শিক্ষকতা। শিক্ষাবিষয়ক প্রবন্ধ লেখক, গল্পকার এবং অনুবাদক। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: শ্রেষ্ঠ মানুষ (প্রবন্ধগ্রন্থ), কাঠের শহর (গল্পগ্রন্থ)
মনজুরুল ইসলাম

ছাত্র-শিক্ষক: সম্পর্কের প্রান্ত-যোগ-৩

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

প্রাসঙ্গিকভাবেই যে বিষয়ের আলোচনা প্রয়োজনীয়তা দাবি করে সেটি হলো– শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই যে উত্তম সম্পর্কের বন্ধন, সেই বন্ধনটি নিশ্চিত করবার ক্ষেত্রে শিক্ষকবৃন্দের কোন কোন বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়া যুক্তিসংগত?

প্রথমত– শিক্ষার্থীদের ওপর কর্তৃত্বসুলভ মানসিকতা পরিহার, দ্বিতীয়ত-শিক্ষা গ্রহণের প্রকৃত প্রয়োজনীয়তার জানালাটি রুদ্ধ না করা। যেই মুহূর্তে শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষকের মধ্যে কর্তৃত্বসুলভ মানসিকতা প্রত্যক্ষ করবে ঠিক সেই মুহূর্ত থেকেই তারা সেই শিক্ষকের কাছ থেকে দূরে সরে আসবে এবং তাদের অবচেতনাতেই শিক্ষকের সম্পর্কে একটি বিপজ্জনক ধারণা সৃষ্টি হবার আশঙ্কা তৈরি হবে। তখন এই ধরনের শিক্ষকের পক্ষে শিক্ষার্থীদের মনোজগতে প্রভাব বিস্তার করে শিক্ষার প্রকৃত নির্যাসটুকু প্রোথিত করা সীমাহীনভাবে কষ্টকর বলে প্রমাণিত হবে। আবার শিক্ষক যদি শিক্ষার্থীদের সামনে শিক্ষা গ্রহণের প্রকৃত প্রেক্ষিতটিকে বর্ণনা করতে সক্ষম হন তবে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা শিক্ষা গ্রহণের বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে তাদের মননে স্থান দেবে এবং সেভাবেই নিজেদের প্রস্তুত করবে। অর্থাৎ যেটি বলা প্রয়োজন সেটি হলো– যোগ্য শিক্ষক এবং জ্ঞান পিপাসু শিক্ষার্থী এই দুইয়ের যথাযথ সমন্বয়ে শিক্ষা যেমন সার্বিক উৎকর্ষ লাভ করবে তেমনি ব্যর্থ হবে যদি এটির অভাব দৃশ্যমান হয়। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদেরও কিছু বিষয়ের ওপর মনোনিবেশ প্রদান শিক্ষার উৎকর্ষ নিশ্চিত করবার নিমিত্তেই প্রয়োজনীয়।

শ্রেণিকক্ষে অথবা শ্রেণিকক্ষের বাইরে শিক্ষার্থীর কাছে শিক্ষকের কোনো এক মুহূর্তের অপছন্দনীয় আচরণ এবং মন্তব্যের ওপর ভিত্তি করে কোনো শিক্ষকের ওপর সার্বিকভাবে নেতিবাচক ধারণা পোষণ কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। একেক মৌসুমে একটি বৃক্ষের বৈশিষ্ট্য একেক রকম হওয়ার কারণে বৃক্ষটির পুরো বৈশিষ্ট্য যেমন একটি বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে মূল্যায়ন করা যায় না, তেমনি একজন শিক্ষকের কাছ থেকে নির্দিষ্ট সময়ের একটি কষ্টকর মুহূর্তের ওপর ভিত্তি করে তার পূর্ণাঙ্গ দক্ষতা অথবা যোগ্যতা সম্পর্কে মূল্যায়ন করা উচিত নয়। একটি বিষয়ে সকলেই অবগত যে, শিক্ষকের ব্যক্তিগত জীবন এবং শিক্ষকতা জীবনের মধ্যে ব্যবধান থাকতে পারে, যা খুবই স্বাভাবিক। শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনের নিমিত্তেই শ্রেণিকক্ষে এবং শ্রেণিকক্ষের বাইরে নানামুখী আচরণ পরিলক্ষিত হতে পারে। কিন্তু ব্যক্তি হিসেবে শ্রদ্ধেয় শিক্ষকবৃন্দের মহানুভবতাকে অনুসন্ধিৎসার মাধ্যমে সেই অনুভবের প্রকৃত চিত্রকল্পটিকে আবিষ্কার করাই একজন শিক্ষার্থীর বড় ধরনের কৃতিত্ব। তবে শিক্ষার্থীর মানোন্নয়নের জন্য ক্লান্তিহীন পরিশ্রম করে একজন সাধারণ মানের শিক্ষার্থীকে অসাধারণ মানের হিসেবে গড়ে তুলবার পরেও যখন সেই শিক্ষার্থী শিক্ষাগুরুর সাথে দূরত্ব বজায় রেখে চলে, তখন শিক্ষকের হৃদয়জুড়ে যে কষ্টকর অনুভূতির উদ্রেক ঘটে তা উপলব্ধি করা সম্ভব শুধুমাত্র একজন শিক্ষকের পক্ষেই। এই প্রেক্ষিত বিবেচনায় অপ্রত্যাশিত একটি প্রশ্ন সবসময়ের জন্যেই অন্তর্মনে এক ধরনের অস্থিরতার সৃষ্টি করে থাকে। জীবন গঠনের পূর্বে একজন শিক্ষকের অবস্থান যদি তার পিতামাতার কাছাকাছি অথবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বে হয় তবে জীবন গঠনের পর সেই অবস্থান শিক্ষার্থী কর্তৃক কতটুকু অটুট রয়ে যায়? এমতাবস্থায় শিক্ষক শিক্ষার্থীর মধ্যে সম্পর্কের সেতুকে শক্তিশালী করবার ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারেন অভিভাবকবৃন্দ। অভিভাবকবৃন্দ যদি তাদের সন্তানদের শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই শিক্ষকবৃন্দের ওপর আজীবন শ্রদ্ধা প্রদর্শনের শিক্ষাটি প্রদান করতে সক্ষমহন তবে বিশাল ইতিবাচক পরিবর্তনের সম্ভাবনা সৃষ্টি হতে পারে– এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই।

শিক্ষার্থীদের যে বিষয়টি মনে রাখা প্রয়োজন সেটি হলো– শিক্ষকবৃন্দ কখনোই শিক্ষার্থীদের কাছে কোনো বিনিময় প্রত্যাশা করেন না। শত সমস্যায় জর্জরিত থাকলেও একজন প্রকৃত শিক্ষক ব্যক্তিসত্তাকে বিসর্জন দেন না, অতীতে দেননি এবং ভবিষ্যতেও দেবেন না। এবং দেবার বিষয়টি কখনোই তার হৃদয়ের জাগৃতিতে অবস্থান গ্রহণ করতে পারে না। একজন প্রকৃত শিক্ষকের সম্পদের প্রতুলতা নেই কিন্তু আত্মসম্মানের প্রাচুর্য রয়েছে। শিক্ষকবৃন্দ তাদের অর্জিত আত্মসম্ভ্রমবোধকে পুঁজি করে বীরদর্পে নতুন স্বপ্ন লালন করে সামনের দিকে এগিয়ে চলেন। একজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে প্রাপ্ত কষ্টকে ভুলে গিয়ে পুনরায় নতুন একজন সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবার নির্মোহ আকর্ষণে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আর এখানেই তো এই পেশার স্বাতন্ত্র্য।

তাই সমাজকে শিক্ষকের প্রাপ্য আত্মসম্মানটুকু বজায় রাখতে অঙ্গীকারাবদ্ধ হতে হবে। নইলে তা জাতির জন্য বড় দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। প্রাসঙ্গিকভাবেই বাংলা সাহিত্যের ধ্রুপদী প্রাবন্ধিক অধ্যাপক হুমায়ুন কবীরের শিক্ষা সংক্রান্ত চেতনার স্ফুরণ সংযোজন করবার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি। ‘শিক্ষা একান্তভাবে ব্যক্তিনির্ভর, শিক্ষকের ব্যক্তিত্বের স্পর্শ যদি ছাত্রের মনে না লাগে, তবে শিক্ষার কাঠামো খাড়া করা যেতে পারে, কিন্তু শিক্ষার প্রাণপ্রতিষ্ঠা হবে না’–  হুমায়ুন কবীরের এই উদ্ধৃতির সঙ্গে যে বিষয়টি আপনা আপনি উপলব্ধ হয়ে ওঠে সেটি হলো– শিক্ষায় যদি প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব না হয় তাহলে সেই ভঙ্গুর শিক্ষাকাঠামো খুব বেশিদিন সেই রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা অর্জনে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে না। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র যদি অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধও হয়ে থাকে তবুও সেই ভঙ্গুর শিক্ষা কাঠামো সেই রাষ্ট্রকে অপ্রত্যাশিত কোনো বিপদ থেকে উত্তরিত করতে সক্ষম হবে না। যেহেতু শিক্ষার এই প্রাণ প্রতিষ্ঠার ভিত্তিমূলই হচ্ছে শিক্ষার্থী, যাদের অন্তর্জগতে শিক্ষার প্রকৃত আলো উদ্ভাসনের কাজটি করবেন একজন শিক্ষক সেহেতু শিক্ষকের মাধ্যমে যখন এটি করা সম্ভব হবে তখন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সেই শিক্ষার্থীরা অর্জিত আলোক বার্তাটিকে পৌঁছে দিতে সক্ষম হবে এবং রাষ্ট্রও একটি স্থায়ী ভিতের ওপর দাঁড়াতে পারবে। কিন্তু রাষ্ট্রের গর্ভে যদি ব্যক্তিত্ববান শিক্ষকের প্রাচুর্য না থাকে তাহলে কখনোই, কোনোভাবেই সম্ভব নয় সেই রাষ্ট্রে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের প্রাণকে জাগিয়ে তোলা। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন শিক্ষকের পক্ষেই সম্ভব একজন শিক্ষার্থীকে প্রকৃত মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। পক্ষান্তরে ব্যক্তিত্বহীন শিক্ষকের পক্ষেই কেবল সম্ভব সন্তানতুল্য কোমলমতি শিক্ষার্থীদের চরিত্র হননের মতো অপকর্ম সম্পন্ন করা, নম্বরের ভয় প্রদর্শন করে জিম্মি করে রাখা, প্রকৃত পাঠদানের প্রতিশ্রুতি প্রদান করে সেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা, শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করে অনৈতিকভাবে অর্থ উপার্জনে নিজেকে ব্যস্ত রাখা। প্রকৃত পক্ষে এমন ব্যক্তিত্বহীন শিক্ষকের সংখ্যা যতই বৃদ্ধি পাবে সামাজিক অস্থিরতা ততই বৃদ্ধি পাবে। শিক্ষকদের সম্মান প্রদর্শনের বিষয়টিও এক সময়ে হয়ে দাঁড়াবে প্রশ্নবিদ্ধ।

‘অতীতে শ্রেণীকক্ষগুলো কাঁচা হলেও শিক্ষকরা ছিলেন পাকা, আর বর্তমানে শ্রেণীকক্ষগুলো পাকা হলেও শিক্ষকরা কাঁচা’– এই ধারণাটি যেন ভবিষ্যতে স্থিত হতে না পারে সেদিকে লক্ষ না রেখে এখন আর কোনো উপায় নেই। যেকোনো মূল্যে ব্যক্তিত্ববান শিক্ষক সৃজন করতে হবে। অতীতে শিক্ষকবৃন্দ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ছিলেন বলেই তাদের প্রতি শিক্ষার্থীদের শ্রদ্ধা ছিল চোখে পড়বার মতো একটি বিষয়। শিক্ষকের সাথে শিক্ষার্থীদের মনের যোগ সাধিত হতো অনায়াসেই। শিক্ষকের সমস্ত শিক্ষা শিক্ষার্থীরা গভীরভাবে বিশ্বাস করত। শিক্ষার্থীদের সাথে আত্মিক সম্পর্ক স্থাপনের পাশাপাশি তাদের হৃদয়ের অন্তর্নিহিত প্রতিভার উন্মোচন করাও শিক্ষকের কর্তব্যবোধের প্রথম শর্ত হিসেবে অগ্রগণ্য ছিল। হয়ত এ কারণেই একজন প্রকৃত শিক্ষক খুব সহজেই শিক্ষার্থীর ওপর অধিকার সৃষ্টি করে তাদের ভুলগুলো ধরিয়ে দিতে পারতেন এবং শিক্ষার্থীরাও তা উদারচিত্তে গ্রহণ করত। পাশাপাশি শিক্ষকবৃন্দ সহজেই সক্ষম হতে পারতেন শিক্ষার্থীদের প্রকৃত চাহিদা অনুধাবনে।

কিন্তু আজ শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের সম্পর্কের মাঝে যে দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছে তার নেপথ্যে কী কারণ অন্তর্নিহিত রয়েছে সেটি অন্বেষণ করা সবার অবশ্য কর্তব্য বলে বিবেচিত হচ্ছে। এবং সে অনুযায়ী সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করবার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। শিক্ষকবৃন্দের শৈক্ষিক ও মানসিক উন্নয়নের নিমিত্তে তুলনামূলক শিক্ষাব্যবস্থা অধ্যয়ন, দেশে-বিদেশে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ গ্রহণ, দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ এবং সহ-শিক্ষা কার্যক্রমের গতিশীলতা আনয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়েরই অংশগ্রহণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করবার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা যেমন কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না তেমনি শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের আন্তরিকতাপূর্ণ প্রচেষ্টা ও দায়বোধের কোনো বিকল্প থাকতে পারে না। যেহেতু দিনে দিনে এটি স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে– সামাজিক স্থিতিশীলতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে এই সম্পর্কের উন্নয়ন অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে। তাছাড়া জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে আমাদের জাতীয় শিক্ষার গড় মানসিকতাকে সেই পর্যায়ে উন্নীত করতে হবে যেখানে সকল শিক্ষকই একজন শিক্ষার্থীর নৈতিক, মানবিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নের জন্য মমতা, আবেগ ও উৎকণ্ঠা অনুভব করতে পারেন। ‘পিতা গড়ে শুধু শরীর মোরা গড়ি মন, তাই শিক্ষক বড় কিবা পিতা বড় বলিবে সে কোন জন?’ কবি গোলাম মোস্তফার এই অমর পংক্তিটির যথার্থ বাস্তবায়ন একজন শিক্ষক কর্তৃক সম্পাদন সম্পন্ন হলে কেবল তখনই শিক্ষকবৃন্দ শিক্ষার্থীদের জন্য উদ্ধৃত আবেগটিকে নিজেদের মননে ধারণ করতে সক্ষম হবেন। এবং তখন আপনাআপনি শিক্ষার্থীদের জীবনবোধ সেই স্তরে উন্নীত হবে যেখানে সত্যিকার অর্থেই তারা তাদের শিক্ষকদের অভিভাবক কিংবা কোন কোন ক্ষেত্রে অভিভাবকের ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়ার প্রয়াস পাবে।

সার্বিক দিক বিবেচনায় এ প্রেক্ষিতে দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল এর শিক্ষা সম্পর্কিত একটি ভাবনা নিশ্চিতভাবেই সমাধানের পথ প্রদর্শন করতে পারে। তিনি বলেন, ‘যে শিক্ষক কেবল শৃঙ্খলা রীতি ও দক্ষতাকে বড় করে দেখেন কিন্তু জ্ঞান রাখেন কম এবং ছেলেদের প্রতি মমত্ববোধ করেন না, তার পক্ষে শিক্ষক হিসেবে সফল হওয়া সম্ভব হয় না, ছাত্ররা এদের দ্বারা কম উপকৃত হয়।’ এখন স্বাভাবিকভাবেই এই ধরনের শিক্ষক যখন তাদের সম্মোহনী গুণ অথবা ব্যক্তিত্ব দারা শিক্ষার্থীদের কাছে নিজেদের জনপ্রিয় করে তুলতে ব্যর্থ হবেন তখন তারা হয়ত প্রশাসক হয়ে সেই আরাধ্য অনুভবটিকে আপনার করে নেবার চেষ্টা করবেন, পাশাপাশি নিজেদের জ্ঞানী হিসেবে উপস্থাপনের ব্যর্থ চেষ্টা করবেন গোটা সমাজের সামনে। মূলত সমস্যার শেকড়টি স্থাপিত হবে এখানেই। ফলস্বরূপ স্নেহপূর্ব পরিবেশের পরিবর্তে শাসনের বৃত্ত দ্বারা আবৃত পরিবেশের সৃষ্টি হবে সেই সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং জ্ঞানভিত্তিক সমাজ সৃষ্টিতে সৃষ্টি হবে বিশেষ প্রতিবন্ধকতা। সঙ্গত কারণেই শিক্ষার্থীদের পক্ষে পড়াশুনা প্রত্যয়টিকে যেমন উপভোগ্যে হিসেবে ভাবতে পারা সম্ভব হবে না তেমনি সমাজ ব্যর্থ হবে কাঙ্ক্ষিত জ্ঞানভিত্তিক পরিবেশ পেতে। একটি কথা সবসময়ের জন্যই বিবেচনায় রাখা উচিত– শাসনের মাধ্যমে ভালো ফলাফল তৈরী করা যেতে পারে কিন্তু কখনোই জাতিকে প্রকৃত মানুষ উপহার দেয়া যায় না। তাই প্রশাসক হিসেবে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাতে মানবতাবাদী প্রাজ্ঞ শিক্ষক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করবার সুযোগ পায় সেটি নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকেই। সন্দেহাতীতভাবেই এই ধরনের প্রজ্ঞাবান প্রতিষ্ঠান প্রধান তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিকে সাজাতে পারবেন জ্ঞানের পাপড়ি দিয়ে। এ প্রেক্ষিতটিকে সার্থক করতে শিক্ষার্থী কর্তৃক শিক্ষক মূল্যায়নের একটি প্রক্রিয়াকে সচল রেখে সেই প্রত্যাশিত পরিবেশটিকে অধিকতর গ্রহণযোগ্য করে গড়ে তোলা যেতে পারে। এটি সচলমান রাখলে হয়ত শিক্ষকবৃন্দের মনোজগতে একটি বিশাল পরিবর্তন লক্ষ করা যাবে। এবং তারাও নিজেদের নেতিবাচক দিকগুলির প্রতি দৃষ্টি রেখে সংশোধনের চেষ্টা করবেন। কেবল তখনই শিক্ষার্থীরাও তাদের শিক্ষকদের প্রতি প্রবল আস্থা অর্জন করতে শুরু করবে। চূড়ান্ত অর্থে এরই মাধ্যমে কেবল একজন শিক্ষার্থী তার শিক্ষকের কাছাকাছি আসবার সাহস লাভ করবে। সেক্ষেত্রে শিক্ষার্থীটি যদি সব থেকে ভীতু এবং দুবর্লও হয়ে থাকে। কারণ পরিবেশই শিক্ষার্থীদের বাধ্য করবে উদীয়মান সূর্যের মতো নিজের ভেতর অন্তরিত অন্ধকারকে দূর করবার। ব্যত্যয় ঘটলে একজন শিক্ষক যেমন কখনোই সুশিক্ষক হয়ে জাতির কল্যাণে অবদান রাখতে পারবেন না তেমনি সেই ধরনের শিক্ষার্থী সৃষ্টি করবে সীমানাহীন প্রতিবন্ধকতা। আর ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ককে স্বর্গীয় পর্যায়ে উন্নীত করা হবে দূর ভবিষ্যতের জন্য সুদূর পরাহত।


তথ্যসূত্র:
১। সৈয়দ মুজতবা আলী, পঞ্চতন্ত্র, অগ্রহায়ণ, ১৪১৯ বঙ্গাব্দ, স্টুডেন্ট ওয়েজ, তৃতীয় সংস্করণ।। বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০। দর্শনাতীত, পৃষ্ঠা নং ১৫৭।
২। শার্লট ব্রন্টি, জেন আয়ার, রূপান্তর-কাজী শাহনূর হোসেন, ১৯৯৬, প্রজাপতি সংস্করণ, সেগুনবাগিচা, ঢাকা-১০০০।
৩। এ পি জে আবদুল কালাম, উইংস অব ফায়ার, অনুবাদ- প্রমিত হোসেন, দ্বিতীয় সংস্করণ ডিসেম্বর ২০০৮।। অন্যধারা।। বাংলাবাজার, ঢাকা।। পৃষ্ঠা নং-১৯, ২১, ২৩, ২৫, ২৬, ২৯, ।
৪। হুমায়ুন কবীর, শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী, সম্পাদনা মুহম্মদ সাইফুল ইসলাম, দ্বিতীয় মুদ্রণ: ফেব্রুয়ারি ২০১৩, কথাপ্রকাশ বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০, পৃষ্ঠা নং-১৫০
৫। সমরেশ মজুমদার, সাতকাহন, আনন্দ পাবলিশার্স, কোলকাতা, পৃষ্ঠা নং- ২০১।
৬। ড. বার্ট্রা- রাসেল, শিক্ষা ও সমাজকাঠামো, স্বকীয় ব্যক্তিতা ও নাগরিকতার মধ্যে সমন্বয়, অনুবাদ আরশাদ আজিজ, ফেব্রুয়ারি, ২০০৭, অবসর, ঢাকা-১১০০, পৃষ্ঠা-১২০।
৭. Taare Zameen Par, Directed by Aamir khan, Written by Amole Gupte, 21, December, 2007.
৮। মাইকেল এইচ হার্ট, হেলেন কেলার, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০০ মনীষীর জীবনী, সুলেখা প্রকাশনী, ঢাকা, পৃষ্ঠা নং ১৩২-১৩৪।
৯। জেন আয়ার, শার্লট ব্রন্টি, ফ্রেন্ডস পাবলিকেশন্স, ২০০৬, ঢাকা।

This is an original content which is written by a DORPON author. Copying and publishing any part of the content is strictly prohibited.

প্রথম পর্ব দ্বিতীয় পর্ব তৃতীয় পর্ব

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu