মোস্তাফিজ ফরায়েজী
সস্পাদক, দর্পণ ম্যাগাজিন
মোস্তাফিজ ফরায়েজী

ছয় শব্দের গল্প লেখার নিয়মাবলী

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

বিশ্বখ্যাত কথাসাহিত্যিক উইলিয়াম ফকনার একবার বলেছিলেন, “একজন ঔপন্যাসিক হচ্ছেন একজন ব্যর্থ গল্পকার আর একজন গল্পকার হচ্ছেন একজন ব্যর্থ কবি।” ছয় শব্দের গল্প ইংরেজি কথাসাহিত্যের একটি বিশেষ বিতর্কিত ধারা, যা বহু পাঠক দ্বারা সমাদৃত আবার অনেক কথাসাহিত্যিক দ্বারা সমালোচিত। এই ধারাটির প্রবক্তা প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। তার সবচেয়ে জনপ্রিয় ছয় শব্দের গল্পটি হচ্ছে→ Fore Sale: baby shoes, never worn, এছাড়া তিনি আরও কিছু ছয় শব্দের গল্প লিখেছেন। বাংলা সাহিত্যে ছয় শব্দের গল্পের চর্চা হয়নি বললেই চলে৷ কোনো প্রধান লেখক যেমনি এটিকে এড়িয়ে গেছেন, তেমনি অপ্রধান লেখকেরাও এই বিষয়ে তেমন আগ্রহ দেখাননি। এককথায় কবিতায় জাপানিজ হাইকু নিয়ে যতটা মাতামাতি দেখা যায়, তেমনটা বাংলা অণুগল্প (সাধারণ অণুগল্প, সীমাবদ্ধ শব্দ/লাইন-বিশিষ্ট গল্প) নিয়ে দেখি না৷ কিন্তু কেন? সেই প্রশ্নের উত্তর অনেকেরই জানা নেই। তবে সম্ভবত নির্দিষ্ট সংখ্যা এবং লাইনবিশিষ্ট গল্প লিখতে আমাদের লেখকদের প্রধান সমস্যা হয়ে দেখা দেয় এর গঠনশৈলী নিয়ে। ছয় শব্দের গল্প আমাদের শব্দসংখ্যাগত সীমাবদ্ধতার মাধ্যমে এক কঠিন পরীক্ষায় ফেলে দেয়। তাই এই ধারার গল্প লিখতে একজন লেখককে হতে হয় অধিক সচেতন।


একটি ছয় শব্দের গল্পে কী কী থাকা উচিৎ:


১) কাহিনিসূত্র

ছয় শব্দের গল্পে অন্য গল্পের মতো প্রারম্ভ, মধ্য এবং শেষ থাকতেই হবে এমন নয়। কিন্তু অবশ্যই একটি কাহিনিসূত্র, দ্বন্দ্ব এবং পরিণতি থাকতে হবে যা পাঠককে কল্পজগতে ভ্রমণ করাতে পারবে। সময় এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আবার একথাও মাথায় রাখতে হবে, সেই গল্পের কোনো মূল্য নেই, যে গল্প পড়ে পাঠক লেখকের কল্পনার দৃশ্যপট বুঝতে পারে না। অর্থাৎ আপনি এমন ছয়টি শব্দ লিখলেন যার কাহিনিসূত্র শুধু আপনিই বুঝলেন কিন্তু পাঠক বুঝতে পারল না, তাহলে সেটি ছয় শব্দের গল্প হবে না। কেননা ছয় শব্দের গল্প পাঠককে বহুমাত্রিক কাহিনীর সন্ধান দেবে।

★ গল্প হয়েছে

→ স্নাইপার দৃশ্যমান, স্নাইপার উদ্ধত, গোলা নিক্ষিপ্ত।
→ “আসো।” “আমার মৃত শরীরের উপর।” “পারবে?”

★ গল্প হয়নি

→ একটি ভগ্ন হৃদয় আরোগ্য লাভ করলো।
→ ভাঙা অর্থ যা মেরামত করা যাবে।

২) ক্রিয়াপদ

একজন গল্পকারের মতে ছয় শব্দের গল্পে ক্রিয়া সবসময় “এ্যাকশন” নির্দেশ করে। গল্পে যেহেতু এ্যাকশন থাকতে হয়, সেই কারণে ছয় শব্দের গল্পে অবশ্যই এক বা একাধিক ক্রিয়াপদের ব্যবহার করতে হবে।

তবে ক্রিয়াপদ বাদেও ছয় শব্দের গল্প লেখা যাবে– যদি বর্ণনার মাঝে এমন কিছু থাকে যেটা দ্বারা মনে হয় কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে, তাহলে সেটিকে গল্প বলা যাবে। আবার পরোক্ষভাবে সংলাপের মাধ্যমেও “এ্যাকশন” বোঝানো যাবে।

★ “ক্রিয়াপদ”-যুক্ত গল্প

→ দালান থেকে লাফ দিলাম। বেলকনিতে পড়লাম।

★ ক্রিয়াপদ ছাড়া সার্থক ছয় শব্দের গল্প

→ সুন্দরী মেয়ে। সুদর্শন ছেলে। সত্বর গোরস্থানে।
→ একটা চিঠি, বিশটি ট্যাবলেট, শুভ…রাত্রি…

৩) পরিবর্তন বা অগ্রগতি

ছয় শব্দের গল্পে পরিবর্তন বা পরিণতি এমনভাবে উপস্থাপন করতে হবে যেটা উহ্যভাবে একটি প্রারম্ভ দেবে এবং যার একটি সম্ভাব্য পরিণতি থাকবে।

★ পরিবর্তন সম্বলিত গল্প

→ গতকাল আমি আগুন জ্বেলেছি। আজকে, ছাই।

★ পরিবর্তন ব্যতীত

→ সবসময় সবকিছু একদম একই রকম থাকে।

৪) অনুভূতি বা আবেগ

ছয় শব্দের তাত্ত্বিক গল্পগুলো যখন কোনো ভাব প্রকাশ করে তখন অনুভূতি বা আবেগের ব্যবহার করা হয়। এটা লেখা খুব সহজ তাই আবেগমিশ্রিত গল্পগুলোকে অবশ্যই উচ্চ শিল্পমানসম্পন্ন হতে হবে।

★ “আবেগ বা অনুভূতি”-বিশিষ্ট গল্প

→ ওখানে স্বর্গ তোমার সাথে সুখেই আছে।
→ ভাঙা ডানার ছটফটানি। সংগ্রামী, মুমূর্ষু… স্তব্ধ।

★ আবেগহীন গল্প

→ আমরা দেখা করলাম, তারপর চা খেলাম।
→ তারপর পৃথিবীটা চিরদিনের জন্য ধ্বংস হলো।

৫) কাঠামো

গল্পটিতে এমন একটা কাঠামো পাঠককে দিতে হবে যেটার উপর ভিত্তি করে পাঠক নানা চরিত্র, নানা কাহিনী, নানা দ্বন্দ্বের কথা কল্পনা করতে পারবে।

এটার মানে এমন নয় যে গল্পটিতে সব চরিত্রের নাম বলে দিতে হবে, কিন্তু অবশ্যই গল্পটিতে এমন অবয়ব দিতে হবে যেটা পাঠককে বহুমাত্রিকভাবে ভাবাবে।

★ কাঠামো সম্বলিত গল্প

→ “একটা বই কী মারণাস্ত্র হয়? আলবাত!”
→ তার ছদ্মবেশ খুলে রাখলাম। স্মারক হিসেবে।

★ কাঠামো ছাড়া

→ জীবনকে ঘৃণা করি তাই লাফ দিলাম।
→ রসাত্মক উক্তি কিছুই প্রমাণ করে না।

৬) পাঠককে অন্তর্ভূক্তি:
একটা গল্প পাঠ করে পাঠক সবসময় জানতে চাই কী ঘটেছে এবং সামনে কী ঘটবে। পাঠককে সেই দৃশ্যপট কল্পনা করাতে গিয়ে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে কিছু বললে সেটা পাঠককে স্পর্শ করে।

★ পাঠকের ভুক্তি

→ প্রতিদিন তোমার কবর আমাকে পরিহাস করে।
→ আমাদের ধারণা, সূর্যালোক দেখতে পারছি না।

★ পাঠককে যুক্ত না করে

→ শনিবারের দিন আমি চা পান করি।


ছয় শব্দের গল্পে যা একদম থাকা উচিৎ নয়:


★ উক্তির মতো কিছু
★ কোনো কিছুর উদ্দেশ্যহীন পরোক্ষ উল্লেখ
★ কোনো চলচ্চিত্র, গ্রন্থের অংশবিশেষ
★ বাগধারা

“কিন্তু জীবন চলতে থাকে” – এই লাইনটি কখনো গল্প হতে পারে না। কোনো গল্প কিংবা উপন্যাসের উৎকৃষ্ট সমাপ্তিসূচক লাইন এটি হতে পারে, কিন্তু লাইনটি গল্পটি কী সম্পর্কে তা বলে না।।

★ কোনো কিছুর নকল হওয়া উচিৎ নয়। একদম নতুন কিছু হলে সেটা সবচেয়ে ভালো।

★ কিছু শব্দ বা যতিচিহ্নের এপাশ-ওপাশ করিয়ে কিছু একটা দাঁড় করানো।

★ উপরে যে সব নিয়মাবলী বর্ণিত আছে তার বিপরীত কিছু করা।


প্রশ্ন-উত্তর:


১) ছয় শব্দের গল্পে কতটি লাইন থাকবে?
উত্তর: (০-৬) ছয় শব্দের গল্প হতে পারে একটি অসম্পূর্ণ লাইন থেকে শুরু করে ছয়টি সম্পূর্ণ লাইন পর্যন্ত।

২) ছয় শব্দের গল্প কী আসলেই গল্প?
উত্তর: অনেকে ছয় শব্দের গল্পকে “ছয় শব্দের স্মৃতিকথা” বা “ছয় শব্দের প্রবাদ” বলে থাকেন। তবে ছয় শব্দের গল্পকে আধুনিক ও উত্তরাধুনিক যুগের অনেক লেখক নির্দ্বিধায় গল্প হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং কিছু প্রসিদ্ধ লেখক ছয় শব্দের গল্প লিখে গেছেন। যার মধ্যে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, রেবেকা মিলার, রুডি রাকার, এ্যাভলিন ওয়াহ, ব্রুস স্টার্লিং, ডেভিড ব্রিন, স্টিফেন ব্যাক্সটার উল্লেখযোগ্য।

(প্রবন্ধে উল্লেখিত ছয় শব্দের গল্পগুলো ইংরেজি সাহিত্যের “ছয় শব্দের গল্প” থেকে অনূদিত, ভিন্ন ভিন্ন লেখক কর্তৃক রচিত।)


 

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu