সাংবিধানিক দৃষ্টিতে দুর্বল বা দলিত শ্রেণীর অন্তর্গত হল তপশিলি জাতি-উপজাতি এবং অন্যান্য পিছিয়ে পড়া শ্রেণী। এর মধ্যে সমাজের সাহায্য না পাওয়া শ্রেণীগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে এম.ডি.দেশাই, জি.পার্থসারথী, জি.ডি.রাজারাও, বি.এস.চৌহান এবং যোগেশ অটল প্রমুখ অর্থনীতিবিদ এবং সমাজতত্ত্ববিদগণ দুর্বল বা দলিত শ্রেণীর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে আর্থিক-সামাজিক মানদণ্ডকে নির্বাচন করেন। এই অর্থনীতিবিদ এবং সমাজতাত্ত্বিকদের মতানুসারে দুর্বল শ্রেণী বলতে নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ব্যক্তিগণ এর কথা বলা হয়েছে এগুলি হল–
(১) সেইসব ব্যক্তি যারা নিজেদের জীবনের ন্যূনতম চাহিদাকে পূরণ করতে পারে না। খাদ্যবস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসার সুবিধা পেতেও অসমর্থ। এবং যাদের এই দারিদ্র্য সীমা (Poverty Line) এর অনেক নীচে।
(২) সে ব্যক্তি যার মুখ্যত দৈনিক মজুরির ওপর আশ্রিত এবং সেটিও অনিয়মিত ও ঋতু পরিবর্তনের ওপর নির্ভরশীল।
(৩) সেইসব ব্যক্তি যারা উৎপাদনে সক্রিয় সহযোগিতা করে কিন্তু তবুও তাদের দৈনন্দিন ভরণ-পোষণ হয়না। তারা নিজেদের দৈনিক চাহিদা গুলিকেও পূরণ করার জন্য ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
(৪) সেইসব ব্যক্তি যাদের কাছে এমন টাকাও থাকে না যা দিয়ে কাঁচামাল ও অন্যান্য উৎপাদিত দ্রব্য কিনতে পারে।
(৫) এরা হলেন প্রান্তিক কৃষক যারা জলসেচ ইত্যাদি সুবিধা থেকেও বঞ্চিত।[১]
উপর্যুক্ত সকল মানদণ্ডের উপর ভিত্তি করে দুর্বল বা দলিত শ্রেণী বলতে সেইসব শ্রেণীর কথা উল্লেখ করা যায় যারা সামাজিক-আর্থিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এরা শোষিত এবং পিছিয়ে পড়া শ্রেণী। সমাজতাত্ত্বিক হাটন এর মতে সেইসব লেখকদের অস্পৃশ্য বা দলিত বলে মনে করা হয়েছে যারা (ক) উচ্চমর্যাদা সম্পন্ন ব্রাহ্মণদের সেবা করার অযোগ্য, (খ) সবর্ণ হিন্দুদের সেবাকারী নাপিত, দর্জির সেবা পাওয়ার অযোগ্য, (গ) হিন্দু মন্দিরে প্রবেশের অযোগ্য, (ঘ) সার্বজনীন সুবিধা লাভ করার অযোগ্য, (ঙ) ঘৃণিত পেশা থেকে পৃথক হওয়ার অযোগ্য।[২]
এই ‛তপশিলি জাতি’ শব্দের প্রয়োগ সর্বপ্রথম ১৯৩৫ সালে সাইমন কমিশন দ্বারা করা হয়েছে। এই শব্দের প্রয়োগ অস্পৃশ্য লোকদের জন্য করা হয়েছে। এই অস্পৃশ্য বা দলিতদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন সময়ে পৃথক পৃথক নামে অভিহিত করা হয়েছে। যেমন আম্বেদকরের মতে আদিকালে ভারতে এদের ‛ভগ্ন-পুরুষ’ (Broken Men) বলা হত। ১৯৩১ সালের জনগণনা অনুসারে এদের বাইরে জাতি (Exterior Caste) বলে সম্বোধিত করা হয়েছে। আবার মহাত্মা গান্ধী এদের হরিজন নামে অভিহিত করেছেন। এবং ব্রিটিশ যুগে এসেই অস্পৃশ্য দেরকে দলিত শ্রেণী (Depressed Class) বলে ডাকা হত। এইভাবে দলিতদেরকে অস্পৃশ্য, বাইরের জাতি, হরিজন এবং তপশিলি জাতি-উপজাতি নামে সম্বোধিত করা হয়ে থাকে।
পশ্চিমবঙ্গে বহু দলিত সম্প্রদায় রয়েছে। এইসব দলিত সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি অন্যতম সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠী হল–সাঁওতাল সম্প্রদায়। আবার আমাদের মনে প্রশ্ন আসতে পারে যে সাঁওতাল সম্প্রদায় বলতে আসলে কাদেরকে বোঝানো হয় বা সাঁওতাল সম্প্রদায় আসলে কারা? এই প্রশ্নের উত্তরে বলা হয় যে, পশ্চিমবঙ্গের আদিবাসী গোষ্ঠীর মধ্যে সাঁওতালরাই হল সংখ্যাগরিষ্ঠ। প্রায় সব জেলাতেই এদের বসবাস লক্ষণীয়। তবে মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম ও মালদহ জেলায় এরা পুরুষানুক্রমে বসবাস করছে। সাঁওতালরা সর্বত্রই নিজেদেরকে হড় বলে পরিচয় দিয়ে থাকে।[৩]
এই হড় কথার অর্থ হল মানুষ। ১৯৮১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে সাঁওতালদের জনসংখ্যা হল ১৬,৬৬,৬১০; তার মধ্যে পুরুষ হল ৮,৪২,৬৫৮ ও স্ত্রী লোকের সংখ্যা ৮,২৩,৯৫২।[৪] আদমশুমারির তথ্য অনুযায়ী দেখা যায় যে, মেদিনীপুর জেলার সাঁওতাল বসতি সবচেয়ে ঘন আর হাওড়া জেলার সবচেয়ে কম। সাঁওতালরা আবার ১২টি গৌত্রে বিভক্ত। যেমন–(১) হাঁসদা, (২) কিস্কু, (৩) মুরমু, (৪) মান্ডি, (৫) হেমব্রম, (৬) সরেন, (৭) বাস্কে, (৮) বেসরা, (৯) চঁড়ে, (১০) পাঁউরিয়া, (১১) টুডু, (১২) বেদেয়া।[৫] আর এই গৌত্রগুলি আবার কতগুলি উপগৌত্রে বিভক্ত। উপগৌত্রকে সাঁওতালিতে ‛খুঁট বলা হয়। সাঁওতালরা মূলত কৃষিকাজ ও বনজ সম্পদ সংগ্রহ করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। সাঁওতালদের পোশাক-পরিচ্ছদও অতিসাধারন। আগেকার দিনে পুরুষেরা গামছা কিংবা পাঁচ-ছয় হাতের তাঁতে বোনা মোটা কাপড় পরত। মেয়েরাও দু’টুকরো মোটা শাড়ি ব্যবহার করত, এটাকে তারা ‛পাড়হাঁড় বা ‛পাড়হাও বলে।[৬]
যদিও বর্তমান সময়ে আধুনিক যুগে ছেলেরা নানান ধরণের প্যান্ট, শার্ট, গেঞ্জি এবং মেয়েরা নানা রঙের ছাপা শাড়ি, আধুনিক ড্রেস পরছে।
আমি এই সাঁওতাল উপজাতিদের বিবাহ ব্যবস্থার উপর একটি ক্ষেত্র সমীক্ষা সম্পূর্ণ করেছি। আমার ক্ষেত্রসমীক্ষার জায়গাটি হল পুরুলিয়া জেলার রঘুনাথপুর ১ ব্লকের সাঁকা গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত বারমেসিয়া গ্রাম। আমি এই ক্ষেত্রসমীক্ষাটি সম্পূর্ণ করতে যেসমস্ত পদ্ধতি অবলম্বন করেছি তা হল– প্রশ্নমালা পদ্ধতি, টেলিফোন সার্ভে পদ্ধতি, কেস স্টাডি পদ্ধতি। আমি দুটি বিষয়ের বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে সাঁওতালদের বিবাহ ব্যবস্থাকে আলোচনা করব– (১) সাঁওতালদের বিবাহ ব্যবস্থার আদি রীতি-নীতি, (২) বর্তমান সময়ে সাঁওতালদের বিবাহ ব্যবস্থার রীতি-নীতি সহ বিবাহ ব্যবস্থার পরিবর্তন। তার আগে আমাদেরকে জানতে হবে সাঁওতাল বিবাহ প্রথা কাকে বলে? সাঁওতাল বিবাহ প্রথা বলতে সাঁওতাল উপজাতির মধ্যে প্রচলিত বিবাহ রীতি-নীতিকে বোঝানো হয়। এই বিবাহের অধিকাংশ রীতি-নীতি উপজাতিগত বৈশিষ্ট্য সমন্বিত হলেও বিবাহে গায়ে হলুদ, আইবুড়োভাত খাওয়ানো, সিঁদুরদান প্রভৃতি অনুষ্ঠানগুলি বাঙ্গালী হিন্দু বিবাহ রীতির অনুপ্রবেশের নির্দেশক।
সাঁওতালদের বিবাহ ব্যবস্থার আদি রীতি-নীতি:
আদিবাসী সাঁওতালদের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক বন্ধন হল বিবাহ। সাঁওতালরা বিয়েকে বলে ‛বাপলা’। সাঁওতালদের একই গৌত্রে বিবাহ নিষিদ্ধ। সাঁওতাল সমাজে বিয়ের কথাবার্তা পাকা হয় মেয়ের বাড়িতে। এইসময় শালপাতার বাটি ব্যবহার করা হয়। বাটিতে তখন কয়েকটি ধাতুর মুদ্রা রাখা হয় বিয়ের আলোচনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই বাটিটি জগমাঁঝির কাছেই থাকে। সাঁওতালদের সমাজে বাল্যবিবাহের প্রথা নেই। ছেলে-মেয়েরা উপযুক্ত হলে পিতামাতাই পাত্র-পাত্রী মনোনীত করেন। স্বগৌত্রে এদের বিবাহ সম্বন্ধ হয় না। সাঁওতালদের সমাজে দেবরবরণ ও শালীবরণ প্রচলিত রয়েছে কিন্তু বড় ভাই কখনও ছোট ভাইয়ের বিধবা স্ত্রীকে বিবাহ করতে পারবে না। সাঁওতালদের সমাজে কনেপণ (Bride Price) দেওয়ার রীতি রয়েছে। যদিও এই পণ খুবই সামান্য। এই পণের পরিমান ৩ টাকা বা ৭ টাকা হয়ে থাকে। আবার কোথাও কোথাও ১৬ টাকা দেওয়ার রীতিও আছে। সাঁওতালী ভাষায় ঘটকে বলা হয় ‛রায়বার।
সাঁওতালদের মূলত সাত ধরণের বিবাহ রয়েছে। এগুলি হল:
(১) কিরিঞ্চ বীহু বাপলা:
এই বিবাহে দেখা যায় যে, স্বাভাবিক ভাবে বিবাহ যোগ্য পাত্র-পাত্রী অনুসন্ধান করে আপোসে কথাবার্তা চালিয়ে এ বিবাহ হয়। এ বিবাহকে ‛দুয়ার বাপলাও বলা হয়। ছেলে বিয়ের উপযুক্ত হলে ছেলের বাবা আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের মেয়ে খোঁজার ভার দেয়। যে কেউ এ কাজ করতে পারে, সেই ওদের ‛রায়বার বা ঘটক। বিয়ের সম্বন্ধ ঠিক হওয়ার পর থেকে বিবাহনুষ্ঠান শেষ না হওয়া পর্যন্ত রায়বারকে অনেকখানি দায়িত্ব পালন করতে হয়।
(২) টুঙকি দিপিল বাপলা:
যারা আর্থিক দিক দিয়ে খুব গরীব তারা এধরণের বিবাহ করে থাকে। এ বিবাহে ঢাক-ঢোল ব্যবহার করে না, আর বিবাহের অনুষ্ঠানও কনে বাড়িতে হয় না। এই বিবাহের ক্ষেত্রে দেখা যায়, কনের সঙ্গে দু’তিনজন বরের বাড়িতে আসে এবং বিবাহের অনুষ্ঠান বরের বাড়িতে হয়।
(৩) অর আদের বাপলা:
এই বিবাহকে বলা হয় রাক্ষস বিবাহ। কোনো ছেলে যদি কোনো মেয়েকে পছন্দ করে বিবাহ করতে রাজী হয় আর যদি মেয়ে রাজী না হয়, তখন ছেলেটি বন্ধু-বান্ধবদের সহায়তায় মেয়েটিকে জোর করে বাড়িতে নিয়ে যায়, এরকম বিবাহকে বলা হয় অর আদের বাপলা বা রাক্ষস বিবাহ।
(৪) ঞিরবল বাপলা:
এই বিবাহ ছেলে ও মেয়ের মধ্যে ভাব ভালোবাসার মাধ্যমে হয়ে থাকে। কিন্তু যদি ভালোবাসার পর ছেলে বা তার বাড়ির অভিভাবকরা রাজি না হয় তখন মেয়েটি তাদের গ্রামের জগমাঁঝিকে জানায় এবং সে ছেলের বাড়িতে জোরপূর্বক চলে আসে। যদি সে ছেলের বাড়ির নির্যাতন মেনে কিছুদিন সংসার করতে পারে তাহলে তাকে বাড়ির বউ হিসেবে মেনে নিতে হয়।
(৫) ইতুৎ সিঁদুর বাপলা:
এ বিবাহ হল একধরনের জোরজবস্থি মূলক বিবাহ। এ বিবাহে দেখা যায়, ছেলে ও মেয়ের মধ্যে ভাব-ভালোবাসা হওয়ার পর যদি মেয়ের অভিভাবকরা বিবাহে আপত্তি করে, তখন ছেলে একদিন সুযোগ বুঝে জোর করে মেয়েটির সিঁথিতে সিঁদুর লাগিয়ে দেয়। সাঁওতাল সমাজে কোনো মেয়ের সিঁথিতে কোনো ছেলে যদি একবার সিঁদুর বা ধুলো লাগিয়ে দেয়, তাহলে সমাজের বিধান অনুযায়ী মেয়েটিকে সেই ছেলেটির স্ত্রী বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
(৬) সাঙ্গা:
বিধবা বা স্বামী পরিত্যক্তা মেয়ের সঙ্গে বিবাহ হলে সেই বিবাহকে বলা হয় ‛সাঙ্গা। এই বিবাহে কন্যাপণ কম লাগে। এই বিবাহে কোনো ভোজ দিতে হয় না। কেবলমাত্র দু’চারজনকে হাঁড়িয়া খাওয়াতে হয়।
(৭) কিরিঞ্চ জাঁওয়ার বাপলা:
‛কিরিঞ্চ জাঁওয়ার হচ্ছে বরপণ দিয়ে জামাই ক্রয় করা। যদি কোনো অনূঢ়া কন্যা কোনো কারণে অন্তঃসত্ত্বা হয় এবং দোষী ব্যক্তির নাম প্রকাশ করতে রাজি না হয়, তাহলে তার জন্য একটি পাত্র সংগ্রহের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। কারণ ভাবী সন্তানকে মর্যাদা ও গৌত্র পেতে হবে। যদি অর্থের জোরে পাত্র জুটে যায় এবং সে যদি মেয়ের ভার নিতে রাজী হয়, তখন তাদের বিবাহ দিয়ে দেওয়া হয়। আর কোনো পাত্র না পাওয়া গেলে ভাবী সন্তান জগমাঁঝির পাত্র ও কূল পায়।
সাঁওতালদের বিয়ের সময় কনের পনের সঙ্গে গরু-বাছুর ও একটি পিতলের বাটি দেওয়ার রেওয়াজ আছে। সাঁওতাল সম্প্রদায়ে বিয়ের জন্য যখন পাত্রী দেখা হয় তখন যদি কনে পছন্দ না হয় তাহলে তাদের বাড়িতে যারা কনে দেখতে এসেছে তারা জলস্পর্শ করে না এবং সঙ্গে সঙ্গে ফিরে আসে। এদের মধ্যে আবার ‛গিরতল প্রথা দেখা যায়। অর্থাৎ বিবাহের দিন ধার্য হলে সেই দিন থেকে গেরো সুতোতে করে কিছু গিঁট বেঁধে দেওয়া হয়। এই গিঁটের সংখ্যা হল বিয়ের দিন সংখ্যা যতদিন বাকি থাকবে ততগুলি হয়ে থাকে। এই গিঁট দেওয়া পাঁচটি গেরো সুতো, বাটা হলুদ, দূর্বা ঘাস এবং আতপচাল শালপাতার পাঁচটি বাটিতে করে রেখে ঘটকের হাত দিয়ে বরের বাড়িতে পাঠানো হয়। বরের বাড়ির পাশাপাশি কনের মা-ও প্রতিদিন স্নান করে এসে এক একটি করে গিঁট খুলতে থাকে। এই গিঁটের মাধ্যমেই বোঝা যায় যে বিয়ে আর কত দিন বাকি আছে। সাঁওতালদের যিনি বিয়ে দিয়ে থাকেন তার নাম হল ‛নায়েকে। বিয়ের সময় আত্মীয়-স্বজনদেরও নিমন্ত্রণ করা হয়– শালপাতার মধ্যে এরকম গেরো সুতো পাঠানোর মধ্যে দিয়ে। বিবাহের পূর্বে যখন বিবাহ মণ্ডপ তৈরি করার ব্যবস্থা হয়, এ উদ্দেশ্যে বাড়ির পূর্বপুরুষদের নামে হাঁড়িয়া উৎসর্গ করা হয়। এইসময় জাহের-এরা, মঁড়েকো এবং মারাঙ বুরুর উদ্দেশ্যে তিনটি মুরগি উৎসর্গ করা হয়। যাতে শুভকাজ নির্বিঘ্নে সমাধান হয়ে যায়।[৭]
বিবাহ মণ্ডপ তৈরি হয়ে গেলে মাঝখানে একটি গর্ত খোঁড়া হয় এবং তিন টুকরো কাঁচা হলুদ, কয়েকটা আতপচাল, দূর্বাঘাস আমপাতায় মুড়ে সুতো দিয়ে বেঁধে সেই গর্তে রেখে দেওয়া হয়। একটি মহুয়া ডাল সেখানে পোঁতা হয়।সাঁওতালদের গায়ে হলুদ সাতবার হয়ে থাকে। সাঁওতালরা বিয়ের দিন একই নিয়মে বর ও কনেকে তেল হলুদ মাখিয়ে স্নান করানো হয়। তেল হলুদ মাখানোর সময় এদের সাঁওতালি ভাষায় একটি গান গাওয়া হয়–
“সুনুম সাসাং অজঃ মড়ে দিন পাহিল মন
দং বুন এনেচ আং ঝামর ঝামর।
সুনুম সাসাং পে অজঃ কেদিঞ্চ।
ভিতির বলন পে মানা কেদিঞ্চ।
ডুলৌ পাড়ন রিঞ্চ ফাঁসি গজুঃ।” [৮]
স্নানের পর বর কনের হাতে আম পাতায় বাঁধা একটি পোঁটলা বেঁধে দেওয়া হয়। পোঁটলায় থাকে কমপক্ষে তিনটি দুর্বাঘাস, নখে খুঁটে সাতটি আতপ চাউল এবং তিন টুকরো কাঁচা হলুদ। তারপর বরপক্ষ কনের বাড়িতে যাত্রা শুরু করে। এইসময় কনের বাড়িতে বরকে নিয়ে নানারূপ কৌতূহলদীপ্ত গান গাওয়া হয়–
“নাইন নুতুম দো বাবা বার ঘরে মা ছাওয়া-এপে
গুরিচ মন্দরে খুনতি বিদমে,
নাইন নুতুম করিয়াদ কো
হোর রে গে দরম কোপে
নাইন রেঁ জুরি দো নাতো রে গে।” [৯]
বর কনের বাড়িতে যাত্রা শুরু করিবার পূর্বে আরও একটি বিষয় লক্ষ করা যায়। তা হল বরের মা ছেলেকে কোলে বসিয়ে গুড়-জল খাওয়ান। বাবা ছেলেকে একটি রুপোর টাকা দেন, ছেলে সে টাকাটি মুখে নিয়ে মায়ের হাতে তুলে দেয়। তারপর বর এবার সবাইকে প্রণাম করে যাত্রা শুরু করে। এইসময় বরযাত্রীরা চাল-ডাল, তেল-নুন, মশালাপাতি সব সঙ্গে করে নিয়ে নেন। রায়বার বরযাত্রীর সঙ্গেই থাকেন। এদের বিয়ের সময় যুদ্ধের মতো করে ‛নাটুয়া নাচ হতো। এছাড়াও বিয়ের সময় সারাদিন ধরে মাদল বাজিয়ে নাচ-গান হতো। এই নাচকে বলা হয় ‛দং নাচ। সাঁওতালদের বিবাহে বরকে গুড় ও জল দিয়ে বরণ করার রীতি রয়েছে। সাঁওতালদের বিয়ের সময় মহুয়া বা শালগাছ পুঁতে দেওয়া হতো চারিদিক করে। তারপর সেই মহুয়া গাছের মণ্ডপের মাঝখানে একটি প্রদীপ জ্বালানো হতো। তারপর বর ও কনে বিবাহ মণ্ডপে সাতবার বা তিনবার বৃত্তাকারে ঘুরবার পর বর কনের সিঁথিতে সিঁদুর দিতো। এই সিঁদুর দান হতো তিনবার মাটিতে ফেলে ও তিনবার কপালে পরে। এদের কোনো শুভদৃষ্টি ও লগ্ন নেই। কনেকে বিয়ের মণ্ডপে নিয়ে আসত ভাসুর ঢামায় করে বসিয়ে। সিঁদুর দান সম্পূর্ণ হয়ে গেলে সবাই মিলে ‛হরিবোল সিঁদুরদান বলে উঠত। [১০]
বিয়ের দিন কনের বাড়িতে নাচ গান ও খাওয়া-দাওয়া হয়। এরপর শুভমুহূর্তে মা বাবা মেয়েকে বিদায় দেয়। বিদায়ের পূর্বে গ্রামের মাঁঝি ছেলের কাছে একধরনের মন্ত্র পাঠ করেন–
“মা বাবা, তেহেঞ্চ দ কাস্মার টটকলে তলাৎমেয়া; সেন্দররারে কার-কারেম চালাকআ, জাঙ দ জনমে আর জেল জেল দ অগুইমে। রুয়াক’রে, হাসোক’রে, সুকরে, দুকরে জুরীজতা বাড়ে তাঁহে ককবিন। তেহেঞ্চ দ বাবা জাঙ হঁ জাঙ, তরচ্ হঁ তরচ্ এম কিরিঞ্চকেদা।” [১১]
ঠিক একইভাবে গ্রামের মাঁঝি মেয়ের কাছে আবার একধরণের মন্ত্রপাঠ করেন–
“মা মাই, তেহেঞ্চ খনাক্” দাক্’ ঘাট পুখরি ঘাটরে সেদায় গাতে-থুতি আলম উইহারা, তেহেঞ্চ-দ ছাতা দারেলে তিঙ্গোয়াকমেয়া। জাঙ হঁ জাঙ, তরচ্ হঁ তরচ্, বাড়য়া বুলুং লেকালে তুলৌকেৎমেয়া। রুয়াকরে, হাঝোক’রে, সুকরে, দুকরে জরীজতা বাড়ে তাঁহেককবিন।” [১২]
সাঁওতাল সমাজে কনে বিদায়ের আগে বরপক্ষের কিছু লোক এবং কনে পক্ষের কিছু লোক সহ কনের বাবা মিষ্টি ও জল হাতে নেয়। এসময় তাদের সঙ্গে থাকে গ্রাম্য মোড়ল। তারা সবাই নবদম্পতির সুখময় জীবনের জন্য মারাংবুড়োর কাছে প্রার্থনা করে। তারপরই শুরু হয় কোনে বিদায়ের অনুষ্ঠান। এসময় সাঁওতালরা বিদায়ের গান ধরে–
“আতো গাতি কুড়ি কোড়া
মায়া জালাং ছাড়া ফিঁদেই
ইনদ ভেদ কান বোঙ্গা দেউড়ে
ঈং রেনাং মায়া জালা মিনা
আনাং মেন খান
কাদাম বাতে চাপা দিন পে
ত্রিয়ে ডুচিয়ে তে গেদু জিন পে
দেউড়ে চিতাং কুলি শহর নূর।” [১৩]
নতুন বউ তার বরের বাড়ি আসার পর সেইদিনই গ্রামের মাঁঝি, নায়কে, পারানিক ও বরের আত্মীয়-স্বজন সবাইকে পা ধুয়ে প্রণাম করে তারপর ভাসুরের পা ধুয়ে দেয়। এরপর ভাসুর নতুন বৌয়ের ডান হাতের কনুইতে জল ঢেলে দেন আর নতুন বৌও ভাসুরের ডান হাতের কনুইতে জল ঢেলে দেয়। এরপর থেকে তারা উভয়কে যোগ্য সম্মান দেয়। বিয়ের পর সাঁওতালদের বাসর যাপনের রীতি রয়েছে। জঙ্গলের আলো-আঁধারীর মধ্যে এদের বাস খুপরি জাতীয় ঘরের মধ্যেই এরা বাসর সাজায়। লতা, পাতা, বন্যফুল দিয়ে বাসর সাজানো হতো। এছাড়াও সাঁওতালদের ‛বালাতাহাড়া রীতিও লক্ষ করা যায়। যেখানে দেখা যায় বিয়ের একবছর পর বেয়ান-বেয়ানি বা অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে দেখা হতো তার আগে দেখা করা যেতো না। আর সাঁওতালদের ঘটক বা রায়বারকে বিয়ের সময় জুতো ও ছাতা দেওয়া হতো। এবং গরুর গাড়িতে করে বিয়ে হতে যেতো। এছাড়াও সাঁওতালদের মধ্যে বিধবা বিবাহ লক্ষ্য করা যায়। এক্ষেত্রে বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পর ছোট ভাই বড় ভাইয়ের বউকে বিয়ে হতে পারত, কিন্তু ছোট ভাইয়ের মৃত্যু হলে বড় ভাই ছোট ভাইয়ের স্ত্রীকে বিয়ে হতে পারত না। সাঁওতালদের বিয়েতে হাঁড়িয়াকে পবিত্র পানীয় হিসেবে মান্য করা হয়। এইভাবে নানাবিধ নিয়ম ও রীতি-নীতি লক্ষ করা যায় সাঁওতালি বিয়েতে।
সাঁওতালদের বিবাহ ব্যবস্থার বর্তমান রীতি-নীতি ও পরিবর্তন:
বর্তমান সময়টি হল বিশ্বায়নের যুগ। এই বিশ্বায়নের প্রভাব সাঁওতালদের মধ্যেও লক্ষ করা যায়। বিশ্বায়নের ফলে সাঁওতালদের বিবাহ ব্যবস্থার আদি রীতি-নীতি গুলোর ক্ষেত্রে কিছু সংখ্যক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। যদিও সাঁওতালদের বিবাহ ব্যবস্থার রীতি-নীতিতে খুব একটা পরিবর্তন সাধিত হয়নি। অতীতের মতোই সিংহভাগ নিয়ম কানুনই এখনো বিরাজমান রয়েছে। কিন্তু সমীক্ষার প্রাপ্ত তথ্যের উপর ভিত্তি করে বলা যায় যে, সাঁওতালদের বিবাহ ব্যবস্থায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এই পরিবর্তিত রীতি-নীতি গুলি হল–
১) সাঁওতালদের পূর্বে বাল্যবিবাহ প্রথা ছিল না। কিন্তু এখন বাল্যবিবাহ রোধের আইন থাকা সত্ত্বেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই বাল্যবিবাহ লক্ষ করা যাচ্ছে।
উদাহরণস্বরূপ, দক্ষিণদিনাজপুরের প্রান্তিক গ্রাম সুবর্ণপুরের তরুণী সান্ত্বনা মুর্মু এর কথা বলতে পারি। তার প্রবল অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তাকে কিশোরবেলায় বিয়ে দেওয়া হয় থাকে। ষোলো বছর বয়সেই সে দুই মেয়ের মা হয়ে যায়। যদিও তিনি এখন তার স্বপ্নকে দীর্ঘ প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাস্তবায়িত করতে পেরেছে। তিনি বাল্যবিবাহকে রোধ করার জন্য নিজের জীবন বিপন্ন করে নানান সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। [১৪]
২) সাঁওতালদের বিবাহে কনে পন হিসেবে ৩ টাকা বা ৭ টাকার সাথে পিতলের বেলা গরু-বাছুর প্রভৃতি দেওয়া হতো। কিন্তু এখন পিতলের বেলা গরু-বাছুরের বদলে নানান রকমের আধুনিক জিনিস দেওয়া হয়। কিন্তু ৩ টাকা বা ৭ টাকা কনেপন দেওয়ার রীতি-নীতি এখনও বর্তমান।
৩) এদের বিয়েতে পূর্বে যুদ্ধের মতো করে নাটুয়া নাচ হতো কিন্তু এখন তা কমে গেছে। এখন প্রায় হয়না বললেই চলে।
৪) আগে বিয়েতে সারাদিন ধরে মাদল বাজত কিন্তু এখন নানান ধরণের আধুনিক বাদ্যযন্ত্রও বাজানো হয়। এক্ষেত্রে আর্থিক সামর্থ্যের উপরও নির্ভর করতে হয়।
৫) আগে সাঁওতালদের মধ্যে সাত ধরণের বিয়ে হতো কিন্তু এখন আর তা হয়না। এক্ষেত্রে রাক্ষস বিবাহ ও জোরপূর্বক বিবাহের কথা বলা যায়।
৬) এখন বিয়েতে খাওয়ার আয়োজনও অনেকখানি আধুনিক হয়েছে, আগে কিন্তু তা ছিলনা। যদিও এক্ষেত্রে বাড়ির আর্থিক অবস্থার উপর নির্ভর করতে হয়। যার যেমন আর্থিক অবস্থা সে সেইভাবে যাওয়ার আয়োজন করে।
৭) আগে রায়বার বা ঘটককে তার পাওনা হিসেবে জুতো ও ছাতা দিতে হতো কিন্তু এখন তা পরিবর্তন হয়েছে। এখন নানা রকমের আধুনিক জিনিস দেওয়া হয় থাকে।
৮) বিবাহের সময় দিন-গোনার জন্য আগে ‛গিরতল রীতি ছিল। কিন্তু এখন তা অনেকাংশে পরিবর্তন হয়েছে। এখন তা ক্যালেন্ডার বা পাঞ্জি দেখে করা হয়ে থাকে। যদিও এই রীতি একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে যায়নি।
৯) আগে বিবাহের জন্য যখন কন্যা দেখা হতো তখন যদি তা পছন্দ না হতো তাহলে কন্যার বাড়িতে জল স্পর্শ করা হতো না। কিন্তু এখন পছন্দ হোক বা না হোক জল বা অন্যান্য খাবার গ্রহণ করা হয়।
১০) পূর্বে সাঁওতালিদের বিয়েতে জাহের-এরা, মঁড়েকো এবিং মারাং বুরুর উদ্দেশ্যে তিনটি মুরগি উৎসর্গ করা হতো। কিন্তু এখন তা পরিবর্তন হয়েছে। এই রীতিটি এখন আর সেভাবে নেই বললেই চলে।
১১) আগে বিয়ের সময় বাবা ছেলেকে একটি রুপোর টাকা দিত এবং সেটি ছেলেকে মুখে করে নিয়ে মায়ের হাতে তুলে দিতে হতো, কিন্তু এখন আর রুপোর টাকা না দিলেও চলে, যেকোনো পয়সা বা টাকা দিলে হয়ে যায়।
১২) আগে সাঁওতালদের বিয়েতে আধুনিক লাইটিং ও বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার হতো না। কিন্তু এখন এগুলির ব্যবহার হয়ে থাকে।
১৩) আগে বিয়েতে সিঁদুরের পাশাপাশি ধুলো ব্যবহার করার রীতি ছিল কিন্তু বর্তমানে ধুলো ব্যবহার আর হয় না কেবল সিঁদুরই ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
১৪) পূর্বে সাঁওতালিদের বিয়ের বাসর হতো জঙ্গলের খুপরি ঘরে আলো-আঁধারীর মধ্যে। কিন্তু এখন তা আর নেই বললেই চলে।
১৫) আগে সাঁওতালদের মধ্যে ‛বালাতাহাড়া’ প্রথা মানা হতো। এই প্রথায় বলা হয়, বিয়ের একবছর পর বর-কনের উভয় পরিবারের বেয়ান-বেয়ানি বা অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনরা দেখা করতে পারবে। তার আগে দেখা করতে পারবে না। কিন্তু এখন তা আর মানা হয় না।
এইভাবে বিশ্বায়নের যুগে এসে সাঁওতালদের বিবাহ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে নানাবিধ পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। এছাড়া সাঁওতালরা অধিকাংশই আজ ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করছেন। ফলে বদলে গেছে সাঁওতাল বিয়ের রীতি গুলো। এছাড়া যারা সনাতন ধর্মকে আগলে রেখেছেন, দারিদ্র সহ নানা কারণে তারাও টিকিয়ে রাখতে পারছেন না বিয়ের আদি আচার গুলোকে। ফলে এভাবেই লুপ্ত হচ্ছে সাঁওতাল বিয়ের আদি আচার ও রীতি গুলো। কিন্তু তা সত্ত্বেও সাঁওতালরা তাদের বিবাহের নিজস্ব স্বতন্ত্র রীতি গুলিকে এখনও অব্যাহত রেখেছে। সর্বোপরি বলা যায়, সাঁওতালদের বিবাহ ব্যবস্থার রীতিগুলি পরিবর্তন হচ্ছে ঠিকই কিন্তু তা পুরোপুরি ভাবে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। আজও সাঁওতাল বিবাহে বহু আদি রীতি-নীতি বিরাজমান রয়েছে।
সহায়ক গ্রন্থ ও তথ্যসূত্র:
ব্যক্তি ঋণ: