লেখকের লেখনীর সার্থকতা কোথায়? এর সোজা উত্তর হলো “পাঠে”। পাঠক কে? যিনি পাঠ করেন তিনিই পাঠক। লেখকের রচনার সাথে যোগসূত্র স্থাপন করে পাঠক। পাঠকের পাঠের মাধমেই লেখকের লেখার সার্থকতা ফুটে ওঠে। কবির কবিতা, ঔপন্যাসিকের উপন্যাস, গল্পকারের গল্প, প্রবন্ধকারের প্রবন্ধ, ছড়াকারের ছড়া ইত্যাদি সব রচনাই পাঠকের পাঠের উদ্দেশ্যেই লেখা হয়। পাঠকের নানা শ্রেণি রয়েছে। নিবিষ্ট পাঠক, নির্দিষ্ট লেখকের পাঠক। রয়েছে নিয়মিত এবং অনিয়মিত পাঠক। কবিতাপ্রিয়, গল্পপ্রিয় বা উপন্যাসপ্রিয় পাঠকের শ্রেণিও রয়েছে। রয়েছে সায়েন্স ফিকশন, বিরহ, রোমান্টিক বা রহস্য গল্পের পাঠক। যে যত বড় লেখক, তিনি তত ভালো পাঠকও বটে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভালো পাঠক ছাড়া ভালো লেখকও হওয়া যায় না। একজন পাঠক আবার একজন সমালোচক এবং ব্যাখ্যাকারী। এরা সবাই পাঠক এবং সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। একজন লেখক তার লেখনীর দ্বারা যত বেশি পাঠকের কাছে পৌছাতে সমর্থ হবেন, তিনি তত জনপ্রিয় লেখক। অবশ্য “জনপ্রিয়” শব্দটির দ্বারাই পাঠকের গুরুত্ব উপলদ্ধি করা সম্ভব হয়। আজকাল বই পড়ার পাঠকের সংখ্যা দিন দিন কমে আসছে। এমনটাই ধারণা তৈরি হয়েছে। তার বিকল্প হিসেবে হাতের মোবাইল ডিভাইস রয়েছে। সেখানেই চোখ আটকে থাকে। বিপরীতে নতুন নতুন কবি, গল্পকার, ছাড়াকার আসছে লেখালেখির জগতে। তারা অনেকেই প্রচুর লিখছেন। ভালো লিখছেন। কিন্তু লেখালেখির জগতে যারা আছেন তারাই যদি কেবল পাঠক হন তাহলে পাঠক স্বল্পতা দেখা দেওয়া স্বাভাবিক। সাহিত্য বিস্তারে দরকার পাঠক, যে বই পড়ে খেতে খেতে, ঘুমানোর আগে, খেলার মাঠ চক্কর দিতে দিতে। এমন পড়ুয়া পাঠক আজ কোথায়?
অজুহাত হতে পারে সময়ের। কিন্তু যারা বই পড়তে পছন্দ করে তাদের কাছে সময়টা মুখ্য নয়, পড়াটাই আসল। প্রতিবছর বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। মেলায় বিপুল সংখ্যক নতুন বই আসে। মেলায় দর্শনার্থীর আগমন ঘটে প্রচুর। বিক্রিও হয়। কিন্তু যারা বই কিনছে তারা কি সবাই পাঠক শ্রেণিতে? কেউ অন্যকে উপহার দেয়, কেউ আবার বছরজুড়ে ঘরের সেলফে রেখে দেয়। আমাদের দরকার পাঠক। যে লেখকের বই পড়বে এবং সেই লেখার মূল্যায়ন করবে। চলচ্চিত্রে জনপ্রিয়তা মানেই যেমন দর্শকপ্রিয়তা সাহিত্যে একইরকমভাবে পাঠকপ্রিয়তা। পাঠক ছাড়া সাহিত্য বিস্তারের ফলাফল শূন্য। পাঠক হলো সাহিত্যের প্রাণস্বরূপ।
সৃষ্টিকর্ম জেগে ওঠে পাঠকের ছোঁয়ায়। কবিতায় জেগে ওঠে, আবেগে ভাসে; গল্পে নিজেকে কল্পনা করে; উপন্যাসের চরিত্রে হারিয়ে যায় পাঠক নিজে। প্রসঙ্গত প্রয়াত তুমুল জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের ছিল বিপুল পাঠকপ্রিয়তা। তিনি পাঠক তৈরি করেছিলেন। তার লেখনীর সেই শক্তি ছিল। হিমু সিরিজ পড়তে পড়তে পাঠক নিজেকে হিমু হিসেবেই কল্পনা করে নিত। কখনো মিসির আলীর ভেতর হারিয়ে ফেলতো নিজেকে। আলাদা পাঠক শ্রেণি তৈরি করতে পারা একজন লেখকের সাফল্যের জগতটা অনেক বড়। রয়েছে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পাঠক, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পাঠক, জীবনানন্দের কবিতার পাঠক আবার সবকিছু পড়তে ভালোবাসে এরকম পাঠক। একটি পাঠক শ্রেণি তৈরি, যারা বইয়ের দোকান থেকে লেখকের প্রতিটি নতুন বইয়ের খোঁজ করে কিনে নেয়, তারপর তা পড়ে ফেলে একদমে সেই লেখক যেমন সার্থক, সার্থক সেই পাঠকও।
পাঠে যে আনন্দ আছে সেই আনন্দ খুঁজে নিতে বই বেছে নেওয়ার মানুষ আজ খুবই কম। আর লেখকের কলমের সৃষ্টির উৎসাহও আসে পাঠকের কাছ থেকেই। পাঠকের উৎসাহে লেখক প্রতিনিয়ত নতুন নতুন লেখা উপহার দিতে মনপ্রাণ নিবিষ্ট করে লেখার মধ্যে। তারপর সেই লেখা লেখক আর পাঠকের মিলনস্থল হয়ে ওঠে। একজন লেখকের কাছে সবচেয়ে বড় পুরষ্কার কী? কোনো বস্তুগত পুরষ্কার বা অর্থ নয় লেখকের বড় পুরস্কার হলো– পাঠকের ভালোবাসা। একজন লেখকের নিকট পাঠকের হৃদয়ে ঠাঁই পাওয়ার চেয়ে আর কী বড় হতে পারে? পাঠকের আবেগের কথা মাথায় রেখেই লেখক তার লেখা তৈরি করেন। আর তাই পাঠক হলো সাহিত্যের প্রাণস্বরূপ।