এলিজা খাতুন
গল্পকার, কবি ও প্রাবন্ধিক
এলিজা খাতুন

মননে ও সৃজনে সাহিত্যগ্রন্থ পাঠ অত্যাবশ্যকীয়

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

সাহিত্যগ্রন্থ দেশ ও জাতির জীবন মানসের প্রতিফলন, এটা চিরন্তন কথা। সাহিত্য-গ্রন্থে পাঠাভ্যাস নিয়ে যে কিছু কথা বলবো– তা যে অনেকের কাছে নতুন কিছু বা চমকপ্রদ কিছু হয়ে উঠবে এমনও নয়। কেউ কেউ যে এর প্রতি আগ্রহটাকে আরেকটু শাণিয়ে নিতে পারবেন, এটুকু ভরসা রেখেই লেখার প্রয়াস। অন্তত একজনও যদি বই পড়া অভ্যেসটা আবার ঝালিয়ে নিতে পারেন তাও বা কম কি! আমার আশেপাশে বা চেনাজানা অনেক ছেলেমেয়ে আছে যাদের জানার কৌতূহল আছে যথেষ্ট, অনেককেই দেখেছি– তারা জীবনকে গভীরভাবে বুঝতে চায়, জীবনের অর্থ খুঁজতে চায় নানা প্রকারে। কিন্তু পরিবার সমাজের অবিচ্ছিন্ন অংশ হয়েও তারা এক একজন বিচ্ছিন্ন দ্বীপ, তারা বুঝে উঠতে পারে না গ্রন্থ তাদের বিশ্বস্ত সঙ্গী এবং পথপ্রদর্শক হতে পারে, দুঃসময়ে দুর্ভাবনায় মুক্তির পথ হতে পারে।

পাঠ্যপুস্তকের আড়ালে জায়গা করে কবিতা, গল্প, উপন্যাসের বইগুলো গোপনে থেকেছে একটা সময়। কেননা অভিভাবকেরা শিক্ষার প্রত্যক্ষ ফল লাভের জন্য উদগ্রীব। যে শিক্ষার ফল হাতে পাওয়া যাবে না, যার কোনো আর্থিক প্রাপ্তি নেই; সে শিক্ষার সুফল সম্বন্ধে আমরা বেশিরভাগই সন্দিহান। তাই শ্রেণী পাঠ্যপুস্তককে যেমন করে আঁকড়ে ধরা হয়, তার বিপরীত রকমে পাঠ্যবই এর বাইরের বইকে দূরে ঠেলে রাখা হয়।

কিন্তু আজকের দিনে মানুষের মনকে সবল, সমৃদ্ধ করতে সাহিত্য বিষয়ক বই পড়ার বিকল্প কিছু নেই, যেসব বই আমাদের পূর্বসূরি প্রতিভাধর মানুষদের আদর্শ জীবন এবং সংগ্রামের সজীব ও বিস্ময়কর গল্প। আমাদের ভেতরে যে জীবন সংগ্রাম আছে তাকে পূর্ণতা দেবার জন্যেই ঐসব মানুষের লেখা গ্রন্থ আমাদের পড়া উচিত। যেকোনো উন্নত জাতির মধ্যে স্বল্প-সংখ্যক মানুষ আছেন– যাঁদের জ্ঞানের ব্যাপ্তি অনেক বড়, যাঁদের চারপাশে নষ্ট স্রোতের প্রবাহ থেকেও নিজেরা ভেসে যান না তাতে, যাঁরা স্বপ্ন দেখান জাতিকে সামনে এগোবার; এমন মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষের ঐতিহ্য আমাদের জাতির মধ্যে কতটুকু গড়ে উঠেছে? আমাদের দেশের পরিস্থিতিতে নতুন কিছু করার জন্য যতটুকু সামর্থ্যের প্রয়োজন তা আমাদের নিরীহদের কতটুকু আছে? তবে বিশেষ উদ্দেশ্যকে অবলম্বন করে আমরা যে অনেক দূর যেতে পারি, পারবো এমনটা বলতে পারি সাহস নিয়ে। আর কেবল বলা নয়, করতে হবে নিজ উদ্যোগে, নিজ ভালোলাগা থেকে।

আমাদের নির্জীব শিক্ষাব্যবস্থা ছেলেমেয়েদেরকে কেবল অর্থ আয়ের পথ দেখাতে পারে। আলোর পথ, সত্যের পথ, বোধের পথ খুলে দেবার জন্য সাহিত্য জানা, সাহিত্য চর্চা, সাহিত্যের রস আস্বাদনের প্রয়োজন যথেষ্ঠ। বছরে একখানা বই ক’জন কিনে থাকি? অনেকেই তো জানি কোন উপলক্ষ কিংবা উপলক্ষ ছাড়াই কাউকে উপহার দেবার ক্ষেত্রে বই’ই সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার, এটা সর্বজন সম্মত। গত কয়েক বছরে আমরা ক’জনকে দিয়েছি বই উপহার? একটা সময় ছিল উৎসবে উপহার হিসেবে বইয়ের কদর ছিল সবচেয়ে বেশি। মা-বাবারাও কোনো উৎসবে তাদের সন্তানদের বই উপহার দিতেন। এতে করে ছোটবেলা থেকেই শিশুরা পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি অন্য বই পড়ার ব্যাপারেও আগ্রহী হয়ে উঠতো। এখন তেমনটা চোখে পড়ে না। তার জায়গা দখল করে নিয়েছে বিভিন্ন মডেলের ফোন, আইপ্যাড, ল্যাপটপ সহ আরও অনেককিছু। উন্নত বিশ্বে দেখা যায়– ট্রেনে, বাসে, স্টেশনে যেখানেই সময় পাচ্ছে তারা বই পড়ছে। সেখানে বড় বড় শপিংমলে নানা ধরণের শোরুমের পাশাপাশি বইয়েরও শোরুম থাকে।

সম্প্রতি সময়ে অনেকের ড্রয়িংরুমে দেখি– ‘বুক-সেলফ্’ নামক আসবাবটি নড়বড়ে, কারও আবার পুরোনো সেলফটা আটা-ছাতুর ঘরে এককোনে ফেলে রাখা। আর অধিক জনের বুক সেলফ ধুলোর আদরে ঘুমিয়ে। বুক-সেলফটা একদিন সাজানো হয়েছিল তো বইয়ের প্রেমেই; তবে কেন ওটার এমন দুর্দশা !

আবার অনেককেই দেখেছি– বুকসেলফ এবং বইকে ড্রয়িং রুম সাজানোর কাজে ব্যবহার করে, অবশ্য বেশ মোটা বা পুরু বই সেলফকে এমনকি রুমকেই চিত্তাকর্ষক করে তোলে। বস্তুত আমার কাছেও দারুণভাবে মনে হয়– বাড়ির সব আসবাবপত্রের  মধ্যে বই’ই সবচেয়ে সুন্দর। সত্য এটাই–  যে গ্রন্থচিত্তকে সুন্দর করে তোলার কাজে ব্যবহার না হয়, তা আসবাব সমতুল্য বটে! কেবল সেলফ এর সৌন্দর্য বর্ধনে নয়, মনের কলুষতা দূর করার জন্য গ্রন্থপাঠ অপরিহার্য।

আমাদের ইচ্ছে-নিরপেক্ষভাবেই সমাজে পরিবর্তন ঘটে চলেছে। পরিবর্তনটা ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর নির্ভর করছে না। অধ্যয়ন তথা জ্ঞানের অনুশীলনের মাধ্যমে সমাজে একটা প্রভাব ফেললে- পরিবর্তনটা একটা গনতান্ত্রিক পরিণতির দিকে যায়। বই পড়ে কেউ কেউ যে রাতারাতি ঘুস খাওয়া বন্ধ করে দেবে, কেউ যে কোটে মিথ্যে সাক্ষী দেবে না, এমন টা ভেবে নেওয়া সহজ নয়। একজন পাঠক পলকেই নীতিবান না হয়ে উঠলেও রুচিমান ও ভদ্রতার পরিচয় দেবার মানসিকতা গড়ে তুলতে পারেন। আমাদের সমাজে পরশ্রিকাতরতা ও হিংসাত্মক মনোভাবের কারনেই হানাহানি দাঙ্গা বাধছে নিয়ত। এ সমস্ত কোন্দল সৃষ্ঠির পেছনে উপর মহলের স্বার্থবাদ ও তাদের পরিচালনায় কিছু বিপথে যাওয়া ছেলেমেয়ের কর্মকাণ্ড রয়েছে।

‘বিপথে যাওয়া ছেলেমেয়ে’– ঠিক এ জায়গাটিতেই আমি নাড়া দিতে চেয়েছি। আমাদের সন্তানরা একটা বয়সে নিজের ভেতরে নিজের আলাদা একটা জগৎ তৈরি করে। সে জগতে সে একা একা বিচরণ করে। তাদের কল্পনার রাজ্যের রাস্তাগুলো সব যে ভালো পথ এমনও নয়। কল্পরাজ্যে মন্দ পথও থাকে। গ্রন্থপাঠ তার মনোরাজ্যের প্রতিটি অলিগলি পরিচালনা করে। অথচ হাতে গোনা দু’চারটি পরিবার ছাড়া সব পরিবারেই গল্প/কবিতার বই (শ্রেণী পাঠ্যসূচী বহির্ভুত) পড়াকে ফালতু নেশা ধরে নেওয়া হয়।এগারো বছরের ছেলেটির হাতে শওকত ওসমান এর শিশুতোষ রচনা–‘ওটেন সাহেবের বাংলো’ কিংবা ‘মস্কুইটো ফোন’ অথবা আনিসুল হক এর ‘কিশোর সাত গোয়েন্দা’ নামক গল্পগ্রন্থ দেখে অধিকাংশ মা  বলেই থাকেন– “এসব বই পড়ে নেশা হয়ে যাচ্ছে”  তিনি যতবারই বলেন এ কথা, ততবার আমাকেও বোঝাতে হচ্ছে এই  বলে যে,– ‘বই পড়ে নেশা হচ্ছে না, বরং বই পড়ার নেশা তৈরি হচ্ছে’। আমার মতে– অন্য কিছুতে নেশা হওয়া থেকে বাঁচাতে ওকে এই নেশাতেই রাখা শ্রেয়। যদ্দুর মনে পড়ে– আমার নেশাটা লেগেছিল ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে।

আমরা সবচেয়ে বেশি দামের খেলনা কিনে দিয়ে অন্য শিশুর মায়ের কাছে বুক ফুলিয়ে  গল্প করতে  ভালোবাসি, এ থেকে শিশুটি কি শিখছে ? পিস্তল খেলা, যুদ্ধ খেলা, অর্থের বড়াই, টেক্কা দেওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। খেলনা পিস্তলটি আছড়ে ভেঙে ফেললে কি দারুণভাবে বকাঝকা করা হয় শিশুটিকে! কিংবা খেলা শেষে খুব যত্নে মুছে ঝকঝকে করে তুলে রাখা হয়। অন্যদিকে শিশুটির সামনে বা হাতের কাছে কোন বই’ই দেওয়া হয় না, বই এর পৃষ্ঠা ছিঁড়ে নষ্ট করে ফেলবে সে আশংকায়। শিশুর সাথে বই এর সম্পর্ক ফিকে হয়ে পড়ে এমনই সূক্ষ্ণ অসচেতনতায়। দৃষ্টির সীমানায় ওরা যা দেখে তা আরও বড় করে দেখানোর জন্য গ্রন্থ উপযুক্ত হাতিয়ার। গ্রন্থপাঠে আত্মার শুভ্রতা রক্ষা করা এবং চিত্তকে মিথ্যার বিরুদ্ধে স্বাধীন করে রাখা যায়। দেশের সকল মানুষ জ্ঞান লাভের জন্যই বিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছে তাদের ছেলেমেয়েদের। প্রকৃত জ্ঞানী করে তোলা হচ্ছে কি? জাতির জীবনের মেরুদণ্ড মনুষ্যত্ব ও জ্ঞান, যা অর্জনের জন্য সাহিত্য- গ্রন্থপাঠ অনিবার্য। সামাজিক নানা সমস্যা, অসঙ্গতি, দুঃখ-দুর্দশা, শ্রেণী বৈষম্য এসব সাহিত্যের মধ্য দিয়ে তুলে ধরা হয়। জীবনঘেঁষা সাহিত্য পাঠ করলে সমাজে, রাষ্ট্রে পরস্পর পরস্পরের ন্যায়-অন্যায় কার্যকলাপের পার্থক্য অনুধাবন করতে পারে। এমন কি জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনুভূতি, দর্শন বুঝতে হলে সাহিত্য বিষয়ক গ্রন্থে মনোনিবেশ বা পাঠাভ্যাস জরুরী।

পাঠাভ্যাস এবং সাহিত্যচর্চা প্রসঙ্গে বলতে গেলে গ্রন্থের কথাই এসে যায়। আমার পড়া বইসমূহের মধ্যে দু’চারটের কথা বলতে চাই–

পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের অর্থাৎ বাঙ্গালি জাতির মধ্যে কত যে লেখক-কবি জন্মগ্রহণ করে সভ্যতার আলোকবর্তিকা নিয়ে এসেছেন তার তুলনা নেই। তাঁদের লেখনির তীক্ষ্ণ ধারে আমরা মাথা তুলে দাঁড়াতে পেরেছি। মানবতার কবি, অসাম্প্রদায়িক কবি নজরুল ইসলাম, নীপিড়িতের বঞ্চিতের পক্ষে লড়াইয়ের কবি সুকান্ত, প্রতিবাদ ও দ্রোহের কবি রুদ্র মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ, সমাজ সংস্কারক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কৃষক-শ্রমিকের মাওলানা ভাসানী, তিতুমীর, নারী আন্দোলনের বেগম রোকেয়া; প্রমুখ এঁদের জানতে পারা এবং সমাজ, রাষ্ট্র, জীবনযাপন, ন্যায়-অন্যায়, মনস্তাত্ত্বিক দর্শন, অধিকার, ইতিহাশ, বিজ্ঞান ইত্যাদি সম্পর্কে সঠিকভাবে জ্ঞাত হওয়ার সঠিক উপায় গ্রন্থপাঠ। কত যে বিস্ময়কর তথ্য নীরবে বসে আছে সেলফের প্রতি সারিতে, প্রতি মলাটের আবরনে, কাগজের ভাঁজে ভাঁজে কালিমুখে, সেসব উপভোগ করা যায় গ্রন্থ পাঠেই। কত দেশ বিদেশের অজানা রহস্য লুকিয়ে আছে কয়েকটি পাতার বুকে  ক্ষুদ্র অক্ষরে, স্বল্প সংখ্যক কথামালার সুবাদে কল্পোলোকে চলে গিয়ে স্বাদ পাওয়া যায় দূর-দূরান্তের প্রকৃতির।

অন্যায়ের বিপক্ষে বিশ্বের বিপ্লবী নেতাদের কার্যক্রম জানতে গ্রন্থপাঠ এর বিকল্প নেই। কার্ল হাইনরিশ মার্ক্স, ফিদেল কাস্ত্রো, চেগুয়েভারা, লেলিন, মাংসেতুং, ক্ষুদিরাম, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, আরও অনেক বিখ্যাতজন আছেন যাঁদের এক এক করে নাম বলে শেষ হবার নয়; ওঁরা পৃষ্ঠা জুড়ে বসে আছেন দুনিয়ার মানুষগুলোর মস্তিস্কে মুক্তির মন্ত্র জ্বালিয়ে দেবার জন্য। সেসব অগ্নিমন্ত্র আছে সেলফ্ এর খাঁজে খাঁজে। বলাবাহুল্য– মার্কসবাদ নিছক কোনো তত্ত্ব নয়, এর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে সমাজ-বিপ্লবের বাস্তবভিত্তিক নির্দেশনা; যা সময়চিত ও প্রয়োজনীয়। তা জানতে গ্রন্থপাঠ ব্যতিত কোন পথ নেই।

রবীন্দ্রসমগ্র পাঠের মধ্যে যে একবার ডুবেছে ;  তার বেঁচে থাকার জীবন-দর্শন/রুচি/আনন্দ/নন্দিত-বিরহ আর অন্যকিছু থেকে নিতে হবে ; বিশেষ করে শেষের কবিতা, গোরা, চোখেরবালি’তে বিরাজমান অসাধারণ দর্শন মনস্তাত্ত্বিক বিকাশে দারুণ সহায়ক।

বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ,শরৎচন্দ্র, কাজী নজরুল এঁদের পরপরই চলে আসে আরও অনেক প্রখ্যাত সাহিত্যিকদের নাম;  যাঁদের লেখা পড়লে সামাজিক প্রেক্ষাপট বিষয়ে অবগত হওয়ার সাথে সাথে পাঠকের আত্মিক উন্নয়ন ঘটে। বাংলা কথাসাহিত্যে যে কয়েকজন লেখকের হাতে সাহিত্যজগতে নতুন এক বৈপ্লবিক ধারা সূচিত হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর রচনার মূল বিষয়বস্তু থেকে জানা যায় মধ্যবিত্ত সমাজের কৃত্তিমতা, শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, নিম্নবিত্তের টিকে থাকার যুদ্ধ, নিয়তিবাদ ইত্যাদি। উল্লেখযোগ্য রচনা– পদ্মানদীর মাঝি, প্রাগৈতিহাসিক, পুতুলনাচের ইতিকথা।

গ্রামীণ সমাজের অনাচার, নানা কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতার সার্থক চিত্র অঙ্কন করেছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। সামাজিক ও রাজনৈতিক ভন্ডামীর উপর দ্বিধাহীন কষাঘাত তাঁর রচনার অনন্য সাধারণ বৈশিষ্ট্য। ধর্মকে স্বার্থের হাতিয়ার হিসেবে বা শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের নগ্ন এবং বাস্তব চিত্র পাওয়া যায় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এর ‘লালসালু’ পড়ে।

সেন রাজাদের রাজত্বকালে দেশের সাধারণ জনগণ সামন্ত মহাসামন্তদের অত্যাচারে কত ভয়ানকভাবে পিষ্ট হয়েছিল, তাদের অত্যাচারের প্রতিবাদ করে কখনো অন্ত্যজ হিন্দুরা, কখনো বৌদ্ধ ভিক্ষুরা, সামন্ত মহাসামন্তদের অত্যাচার থেকে দেশকে বাঁচাতে কারা কিভাবে সচেষ্ট ছিল, সে সময়কালে কয়েকজন প্রাকৃতজনের জীবন-সংগ্রামের কথা জানা যায় শওকত আলীর রচনা প্রদোষে প্রাকৃতজন থেকে।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের রচনা– দুধভাতে উৎপাত, চিলেকোঠার সেপাই, খোয়াবনামা গল্পগুলো সমাজ বাস্তবতার নিপুণ চিত্রণ, ইতিহাস ও রাজনৈতিক জ্ঞান, গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও সুক্ষ্ণ কৌতুকবোধ পাঠকের চিত্তকে দেয় ব্যতিক্রমী সুষমা।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর প্রবন্ধসম্ভার পাঠ করলে মানবিক অধিকার, পরিবেশ সুরক্ষা, দুর্নীতি প্রতিরোধ ও সামাজিক ন্যায়বিচার বিষয়ক নানা জ্ঞান লাভ করা যায় এবং বাকস্বাধিনতায় দৃড়চেতা হয়ে ওঠা যায় নিশ্চিত করে বলতে পারি।

বিভিন্ন দেশি বিদেশি লেখকদের বিজ্ঞানভিত্তিক এনসাইক্লোপিডিয়া বাচ্চাদের বুদ্ধির বিকাশ ঘটিয়ে যেমন সমৃদ্ধ করে তুলতে পারে, তেমনি শিশুদের ছোট ছোট শিক্ষামূলক গল্প পড়ায় উৎসাহ দিলে তারা নৈতিক শিক্ষায় গড়ে উঠতে পারে। আমাদের বাচ্চাদের খেলাধুলার মাঠ নেই, ওদের বিনোদনের জন্য গ্রন্থ চমৎকার সঙ্গী নিঃসন্দেহে।

প্রচুর জীবনমুখী গ্রন্থ আছে স্বল্প পরিসরে যেগুলো তুলে ধরা সম্ভব হলো না, সেসব ভালো ভালো গ্রন্থ পাঠে জীবনভাবনা সুন্দর পথের গতি পাবে নিশ্চিত ; সত্যি বলতে– ঘরের মধ্যেই বিষ্ময়করভাবে ভ্রমণ করা যায় বিশ্বজগৎ!

আমার কাছে একটি ভালো বই একটি ভালো সফট্ওয়ার, সফট্ওয়ার যেমন কম্পিউটার ল্যাপটপ বা স্মার্টফোনের কাজের প্রকৃতি পাল্টে দেয়, তেমনি একটা ভালো বইও মানুষের দেখার দৃষ্টি, ভাবনার পদ্ধতি পাল্টে দেয়।

হাতে দামী স্মার্ট ফোন নেই, গর্জিয়াস জামা গায়ে নেই, ব্রান্ডের পারফিউম নেই, তাতে ক্ষতি কী? এসব থেকেই বা কী হয়? যদি ভেতরে মহত্ব না থাকে। সমাজে দলাদলি, হানাহানি, ক্রুদ্ধতা, ক্ষুব্ধতা, নৈতিকতার অভাব সৃষ্টির পেছনে যেসব কারণ– তার একটি কারণ এমনকি প্রধান কারণ বলা যায় আর্থিক উন্নয়নের উদ্দেশ্যে পড়াশুনা। যদি মানসিক উন্নয়নের লক্ষ্যে পড়া হত তবে নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ তৈরি হত পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে। পাঠহীনতা প্রকৃত অর্থে মানুষকে চিন্তাবর্জিত শরীরসর্বস্ব এক বিশেষ প্রাণীতে রুপান্তর করে ফেলছে।

এখানে কেউ যত বেশি শিক্ষিত হচ্ছে ততবেশি জ্ঞানী হচ্ছে না। শিক্ষার ব্যাপারটা পুরো ফাঁকা। জ্ঞানচর্চার উপযোগী বইয়েরও অভাব আছে বই বাজারে। মূলত এর জন্য দায়ী পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। পুঁজিবাদের সূচনায় জ্ঞানের ব্যাপারটা ছিল, কিন্তু এখন তার প্রয়োজনেই জ্ঞানচর্চাকে সংকুচিত করে ফেলেছে। কারণ তারা চায় না– মানুষ সমাজের অসঙ্গতিগুলো সম্পর্কে জানুক এবং তা নিয়ে প্রশ্ন তুলুক। জ্ঞান চর্চার সংকট-টা সামাজিক হলেও, এ অবস্থার জন্য রাষ্ট্র দায়ী। রাষ্ট্রই পরিচালিত করে সমাজ।

আজকের প্রেক্ষাপটে সামাজিক প্রশ্নগুলো– কবিতায় গল্পে, প্রবন্ধে ইত্যাদিতে– অর্থাৎ সাহিত্যে কম আসছে। এলেও খুব ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে অস্পষ্টভাবে। এই সময়ে জ্ঞান বিস্তারের কাজ বা গণতান্ত্রিক একটা ধারাকে সমাজে বিকশিত হতে সাহায্য করার কাজটা এই অস্পষ্টতা দিয়ে এগিয়ে নেয়া যাবে না। যেকোন জাতিকে শক্তিশালী করতে দেশের বা জাতীয় সাহিত্যের পুষ্টিসাধন প্রয়োজন। মানুষের সব বিপদের মীমাংসা সাহিত্যের ভিতর দিয়েই হয়ে থাকে। গ্রীক, রোমান বর্তমান ইউরোপীয় জাতি এই প্রকারেই শ্রেষ্ঠস্থান অধিকার করেছে।

বই পাঠের গুরুত্ব বোঝাতে মনীষীগণ অনেক মূল্যবান উক্তি করেছেন।

ড: মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন- “আমাকে মারতে চাইলে চাকু ছুরি কিংবা কোন পিস্তলের প্রয়োজন নেই, বরং আমাকে বইয়ের জগৎ থেকে দূরে রাখ।”

নর্মান মেলর বলেন- “আমি চাই যে, পাঠরত অবস্থায় যেন আমার মৃত্যু হয়।”

টলস্টয় বলেন- “জীবনে তিনটি জিনিস খুবই প্রয়োজন, তা হলো বই, বই এবং বই।”

পিপাসা ও ক্ষুধা নিবারণই পশুদের প্রধান কাজ। মানুষ জাতিও কেবল এ কাজে নিয়োজিত থাকলে থাকতে পারে, তাতে সভ্যতার চিহ্নের বদলে বর্বরতার নমুনাই প্রকট আকার ধারণ করে। আমাদের শিক্ষার্থীদের চেতনার উচ্চতর সমৃদ্ধির জন্য মোক্ষম সময়ে সাহিত্য-গ্রন্থ তুলে দিতে হবে তাদের হাতে। তা না হলে মুখ থুবড়ে পড়বে আমাদের আলোকিত মানুষ হবার সম্ভাবনা।

অতএব যে সাহিত্য মানুষের কল্যাণে সৃষ্টি, যে বই জীবনের প্রয়োজনে লেখা, যা পড়লে মানুষ মানবীয় গুনাবলী অর্জন করতে পারে তেমন গ্রন্থ পাঠেই ব্যক্তির মানসিক সমস্যা এবং সামাজিক বিপর্যয় রোধ করা সম্ভব, তাই এমন গ্রন্থ প্রত্যেক পরিবারে প্রত্যেক শিশুকে এমনকি অন্যান্য সদস্যদের পাঠের তাগিদ দিতে হবে তাদের নিজেদের সমৃদ্ধি ও আত্মশুদ্ধিতে; কেননা–  সুস্থ্য জীবন যাপনে মননে ও সৃজনে সাহিত্যগ্রন্থ পাঠের বিকল্প নেই একথা জোর দিয়েই বলা যাবে।

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu