প্রাসঙ্গিকভাবেই দুটো বিষয়ের ব্যাখ্যা প্রদান অনিবার্যতার দাবি করে। প্রথমত মূল্যবোধ কী, দ্বিতীয়ত কারিগর বলতে কী বোঝায়। মূল্যবোধ শব্দটির প্রকৃত তাৎপর্য উপলব্ধি করবার ক্ষেত্রে লন্ডনের বিখ্যাত লেখক ক্লাইভ বেল প্রদত্ত একটি উক্তির শরণাগত হওয়া যেতে পারে। তিনি বলেছেন– “ছ’শ সাত‘শ টাকা মাইনে পান অথচ দু-একখানা বই কিনে পড়া অপব্যয় মনে করেন, এমন লোক দেখেছি যথেষ্ট, আর পঞ্চাশ টাকা মাইনে পেয়েও দু-একখানা বই না কিনে পারেন না, এমন লোকও চোখে পড়েছে।” উদ্ধৃত উক্তি থেকে নিশ্চিত মন্তব্যে উপনীত হওয়া যায় যে, পরবর্তী মানুষগুলোই উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন যে, জীবনে বেঁচে থাকার প্রকৃত স্বাদ কোথায় অন্তরিত। এবং তিনি আরো বলেছেন, “এই প্রকৃতির মানুষগুলো যখন সমাজে অবজ্ঞাত না হয়ে শ্রদ্ধার আসন লাভ করেন, তখনই সমাজ বর্বরতার সীমা ডিঙিয়ে সভ্যতার দিকে এগিয়ে যায়- কেননা তখনই তা মূল্যবোধের পরিচয় দেয়” অর্থাৎ মানুষ তার প্রাত্যহিক জীবনটিকে উৎকৃষ্টভাবে পরিচালিত করবার ক্ষেত্রে যে উপকরণগুলো গ্রহণ করে, তাই-ই সমাজ কর্তৃক মূল্যবোধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে কেবল তখনই, যখন সেই উপকরণগুলো সভ্যতার উন্নয়নে সরাসরি ইতিবাচক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মানুষের কাছে যখন মনে হবে, একটি দামি পোশাক ক্রয়ের পরিবর্তে একটি সাধারণ মানের পোশাক পরিধান করে সেই উদ্বৃত্ত অর্থ দিয়ে বই ক্রয় কিংবা সরাসরি সমাজের কল্যাণে আসে এমন কোনো কাজে ব্যয় করা শ্রেয়তর, ঠিক তখনই বুঝতে হবে তার মননে মূল্যবোধের বীজটি অঙ্কুরিত হয়েছে। আর এই মূল্যবোধ যখন কোনো রাষ্ট্র অথবা সমাজে বসবাসরত প্রতিটি মননে ক্রিয়াশীল হবে, তখন কোনো দ্বিধা ছাড়াই সেই সমাজ অথবা রাষ্ট্রটি উৎকর্ষের শীর্ষ চূড়ায় অবস্থান করতে সক্ষম হয়ে উঠবে– যা সকল রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই প্রত্যাশিত। সঙ্গত কারণেই এই ধরনের মনন সৃষ্টির নেপথ্যে কারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করবেন, সেই প্রসঙ্গটিও আপনা আপনি এসে যায়। অবশ্যম্ভাবীরূপে শিক্ষকতা পেশায় যারা নিজেদের নিবেদিত রেখেছেন তাদের ক্ষেত্রে এই দায়িত্বটি বর্তায়। এই শিক্ষকবৃন্দ যখন সমাজের প্রতিটি মননে মূল্যবোধের বীজটিকে বুনন করতে সক্ষম হবেন, ঠিক তখনই যে কাক্সিক্ষত সামাজিক আবহ প্রত্যাশা করা হবে সেই আবহটি সৃষ্টি হবে খুব সহজেই। পাশাপাশি শিক্ষকবৃন্দই যে এই কাঙ্ক্ষিত সমাজ নির্মাণের প্রকৃত কারিগর, সেই ধারণাটিও পুনঃপ্রতিষ্ঠা পাবে।
শিক্ষা প্রদানের প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে, বিশাল এই বিশ্বচরাচর এবং বিশ্বচরাচরে স্থিত বহুমুখী জীবনবোধের সাথে শিক্ষার্থীদের পরিচয় ঘটিয়ে দেয়া। এক্ষেত্রে শিক্ষকবৃন্দ তাদের অর্জিত জ্ঞানকে শিক্ষার্থীদের মাঝে সম্প্রসারণ করবার মাধ্যমে সেই সুযোগটি পালন করতে সর্বোচ্চ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবেন– এটিই নিঃসন্দেহ। যখন শিক্ষার্থীরা বহুমুখী জীবন এবং জীবনাচরণের সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করবার ক্ষেত্রে ইতিবাচকতার দিকে ধাবিত হবে তখন থেকেই তাদের মূল্যবোধের দীক্ষায় দীক্ষিত হবার যাত্রাটি শুরু হবে। উদ্ধৃত সুযোগটি সৃষ্টি ব্যতীত আর কোন ধরনের গুণাবলী অর্জনের মাধ্যমে একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের অন্তর্জগতে মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সক্ষম হয়ে উঠতে পারেন, সেই বিষয়টিও বিশেষভাবে গুরুত্বের দাবি রাখে। একটি বিষয়কে স্বীকার করা সবার ক্ষেত্রেই প্রাসঙ্গিক হবে যে, যখন কোনো শিক্ষক এমনকি সাধারণ ব্যক্তি, সমাজের মঙ্গলকল্পে কোন ইতিবাচক দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করবেন, তখন সেই শিক্ষক অথবা ব্যক্তিটির অন্তর্বোধজুড়ে প্রথমত সেই ইতিবাচকতার গুণগুলি ক্রিয়াশীল হয়ে উঠবে। আর সেই ধরনের অনুভূতি ক্রিয়াশীল না হলে সেই শিক্ষক অথবা ব্যক্তির পক্ষে কখনই সম্ভব হয়ে উঠবে না, সেই ধরনের ইতিবাচক দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করা। স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার্থীর মননে উচ্চমাত্রার মূল্যবোধ সৃষ্টি কোনো সমাজের সর্বোচ্চ কর্ম বলে বিবেচিত হয়। কারণ উচ্চমাত্রার মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষরাই সমাজকে উৎকর্ষের শীর্ষে অধিষ্ঠিত করতে পারে। স্ক্যান্ডিনোভিয়ান আওতাভুক্ত দেশগুলোতে দুর্নীতির মাত্রা একেবারেই নিম্নে অবস্থান করবার নেপথ্যে যে মূল বিষয়টি অন্তস্থিত সেটি হলো– মূল্যবোধের উৎকর্ষ। জাতি হিসেবে তারা নিজেদের অনেক উচ্চ অবস্থানে অধিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন শুধু তাদের এই মূল্যবোধ নামীয় গুণের ওপর ভিত্তি করে। সুতরাং একজন শিক্ষক, যিনি শিক্ষার্থীর মননে মূল্যবোধ সৃষ্টির কাজটিতে সারাজীবন নিজেকে বিরাজিত রাখবেন, তার মননে যে গুণগুলি ক্রিয়াশীল হওয়া প্রয়োজন সেই গুণগুলোর সতত উপস্থিতিই কেবল তাকে, পক্ষান্তরে তার জাতিকে সেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছবার ক্ষেত্রে সহায়তা করবে। সেক্ষেত্রে প্রথমত একজন শিক্ষককে শিক্ষকতার মতো মহান ব্রততে আত্মনিয়োগ করবার পূর্বে স্থির চিত্তে যে বিশ্বাসে বিশ্বাসিত হওয়া অনিবার্য হয়ে উঠবে, সেটি হলো– তার মনন সত্যিকার অর্থেই মূল্যবোধের বীজ বুননের জন্যে প্রস্তুত রয়েছে কিনা?
শিক্ষকতা পেশাতেই একজন প্রকৃত শিক্ষকের পড়াশুনার বৃত্তে বৃত্তায়িত থাকবার বিষয়টি বাধ্যতামূলক হয়ে ওঠে তার সমগ্র জীবনজুড়ে। সেক্ষেত্রে কোন শিক্ষক যদি অতৃপ্ত মানসে এই পেশায় প্রবেশ করেন তবে তার পক্ষে এটি কখনোই সম্ভব হয়ে উঠবে না যে, অধ্যয়নের মতো আনন্দদায়ক কর্মটিতে সারাজীবনের জন্যে নিজেকে ব্যাপৃত রাখবার। সুতরাং, শিক্ষক নির্বাচনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে এমন ধরনের শিক্ষক নিয়োগ করবার দিকে মনোযোগী হওয়া বাঞ্ছনীয়, যাদের মনন অভ্যন্তরে সত্যিকার অর্থেই জ্ঞানের প্রদীপ্ত প্রভা প্রজ্বলনের ইচ্ছেটুকু সকর্মক রয়েছে। এটি কারোরই অজানা নয় যে, মুকুলবিহীন কোনো বৃক্ষের পক্ষে কখনই সম্ভব হয়ে উঠবে না সাধারণ মানুষকে তার নিজের প্রতি আকৃষ্ট করা। যেহেতু সেই মুকুলে ফলের অংকুর উদগমিত হবার কোনো সম্ভাবনাই থাকবে না। এক্ষেত্রে যদিও সেই বৃক্ষটির প্রাচুর্যপূর্ণ কোনো স্বকীয়তা থাকবে না তবুও বৃক্ষটি বৃক্ষ হিসেবেই বিবেচিত হবে সবার কাছে। একইভাবে একজন শিক্ষক যখন নিয়মিত অধ্যয়নে নিমগ্ন থাকবার নিমিত্তে কাঙ্ক্ষিত সুযোগ এবং পরিবেশ কোনটিই সৃষ্টি করতে সক্ষম হবেন না তখন কোনো শিক্ষার্থীকেই তার নিজের প্রতি আকৃষ্ট করা সম্ভব হয়ে উঠবে না। এমনকি তার ব্যক্তিগত জীবনের প্রতিটি পর্বে সৃষ্টি হতে পারে অপ্রত্যাশিত সমস্যার। একই সাথে যেহেতু তিনি কখনোই তার পেশার প্রতি সন্তুষ্ট থাকতে পারবেন না সেহেতু তার অন্তর্মনে শিক্ষা প্রদানের অনুকূল আবহ বিবেচনায় প্রকৃত আবেগ সৃষ্টি হয়ে উঠবে না। একজন শিক্ষক তিনি যে পর্যায়েই শিক্ষকতা করুন না কেন, তার ভেতর আবেগের প্রাচুর্য থাকবার বিষয়টিও অনিবার্য হয়ে উঠবে শিক্ষা প্রদানের প্রকৃততা নিশ্চিতির ক্ষেত্রে। যেহেতু তিনি যাদের সঙ্গে কাজ করবেন সেই সব শিক্ষার্থীদের বয়সটিই থাকবে আবেগের আতিশায্যে পরিপূর্ণ। কারণে অকারণে নানামুখী প্রশ্ন প্রক্ষিপ্ত করবার মাধ্যমে তারা তাদের শিক্ষকবৃন্দকে ব্যস্ত করে তুলতে পারে, যা ঘটা খুবই স্বাভাবিক। এমনকি বর্তমান বাস্তবতায় শিক্ষার্থীরা যদি যে কোন বিষয়ের শিক্ষকের কাছ থেকেই প্রযুক্তির মৌলিক বিষয় সম্পর্কে জানবার ক্ষেত্রে আগ্রহী হয়, সেটিও অস্বাভাবিক বলে বিবেচিত হবে না। এক্ষেত্রে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের এই অনুসন্ধিৎসু মননগুলোকে স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হয়ে উঠবে তখনই, যখন সেই শিক্ষক তার মননটিকে অধ্যয়ন এবং আধুনিক প্রযুক্তির ওপর ন্যূনতম মৌলিক জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে নিজেকে আদর্শিক মাত্রায় উন্নীত রাখতে সক্ষম হবেন।
একজন শিক্ষক যখন নিজে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানামুখী জানালাগুলো উন্মুক্ত করবার মাধ্যমে সেই জানালাগুলোর মধ্যে থেকে প্রবাহিত অমূল্য নির্যাসগুলো নিজের মননে গ্রন্থিত করতে সক্ষম হবেন তখন আপনা আপনি সেই শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের সেই বহুমুখী জ্ঞান প্রদানে এক ধরনের উদ্দীপনা প্রাপ্ত হবেন। এবং জ্ঞান প্রদান করবার মাধ্যমে যে নির্মোহ আনন্দ তিনি লাভ করবেন সেটির ব্যাপ্তিকে দ্বিগুণ মাত্রায় অর্জন করবার জন্য বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করা তার কাছে বাধ্যতামূলক হয়ে উঠবে। এক্ষেত্রে যখন তিনি বুঝতে সক্ষম হয়ে উঠবেন, জ্ঞান অর্জনের নেপথ্যে শারীরিক সক্ষমতা একটি অবশ্য পূরণীয় শর্ত তখন তিনি অবলীলায় শারীরিক চর্চায় নিজেকে যেমন নিয়োজিত রাখবেন, পাশাপাশি তার শিক্ষার্থীদের সহজেই বোঝাতে সক্ষম হবেন যে– খেলাধুলায় অংশগ্রহণ শিক্ষা গ্রহণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এ প্রেক্ষিত বিবেচনায় তিনি শিক্ষার্থীদের আরো দৃঢ়ভাবে বোঝাতে সক্ষম হবেন যে, এই খেলাধুলায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে নেতৃত্বের গুণাবলী অর্জন করা যেমন সম্ভব, তেমনি প্রতিকূল পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করা অধিকতর সহজ। এক্ষেত্রে শিক্ষক যদি শারীরিক সক্ষমতা বজায় রাখবার ক্ষেত্র হিসেবে বাই-সাইকেল চালনা কিংবা এর থেকে অধিকতর সহজ কোনো পন্থা অবলম্বন করেন তবুও তার মননে কোনো ধরনের হীনমন্যতা কাজ করবে না। যেহেতু তিনি সেই নির্মোহ আনন্দটুকু অর্জনে সততই অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকবেন তার নিজের কাছেই। এ প্রেক্ষিতটি বিবেচনায় তিনি কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক সেটিও সেক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে না। যে বিষয়টি তার জন্য প্রথম অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচ্য হবে সেটি হলো– শিক্ষার্থীদের পাঠদানের ক্ষেত্রে তাদের মনোজগতে অকৃত্রিম আগ্রহ সৃষ্টি করা এবং সেই শিক্ষার্থীরা যাতে উৎকর্ষের সর্বোচ্চ সীমায় অধিষ্ঠিত হতে পারে সেজন্যে তাদের অনুপ্রেরণা প্রদানের পাশাপাশি নিজেকে যোগ্য থেকে যোগ্যতর করে গড়ে তোলা।
শারীরিক এবং মানসিক সক্ষমতা অর্জনের পাশাপাশি যথাযথ পাঠ নিশ্চিতির মাধ্যমে একজন শিক্ষক যখন প্রতিনিয়ত শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রকৃত ভালোবাসা অর্জন করতে সক্ষম হবেন তখন তার জীবনের মানচিত্রটি হয়ে উঠবে সমাজে বসবাসরত অন্যান্য মানুষের থেকে পুরোপুরি পৃথক। হয়ত শিক্ষকতা পেশায় প্রবেশের পূর্বে ক্ষমতাসম্পন্ন কোনো চাকরিতে প্রবেশ করতে না পারার জন্যে যে অব্যক্ত যন্ত্রণা তার অন্তর্মনে প্রোথিত রয়ে যাবে, তা তার অবচেতনায় চিরতরের জন্যে নির্বাপিত হয়ে যাবে। তার কাছে এই শাশ্বত সত্য বিষয়টিই প্রতিটি মুহূর্তে ক্রিয়াশীল রয়ে যাবে এই ভেবে যে, মানসিক ক্ষমতা অর্জনের মাধ্যমে নানামুখী মানসের ভালোবাসাগুলোকে নিজের করে নেবার মাধ্যমে সীমাহীন আত্মতৃপ্তি অর্জন খুবই সম্ভব। যেহেতু নিয়ত তিনি মানসিক সক্ষমতা অর্জনের সুযোগটি লভিত হবার দিকে ধাবিত হবেন সেহেতু তার মেধার পুরোটুকু সমর্পণ করবার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের হৃদাসনে চিরতরে অধিষ্ঠিত হবার সুযোগটি কোনোভাবে হাতছাড়া করবার চেষ্টা করবেন না। এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত অধ্যয়নের প্রতি নির্মোহ আকর্ষণ এবং শিক্ষার্থীদের অনবরত মূল্যবোধের শিক্ষা প্রদান করবার মাধ্যমে সবার কাছে তিনি হয়ে উঠবেন অনন্য। অবশ্যম্ভাবীরূপে তার এই সরল জীবন তার শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিটি মানুষকে সহজেই আকৃষ্ট করবে এবং তাকে অনুসরণ করে জীবন যাপনের চেষ্টা করবে শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ। এই পরিস্থিতিতে একজন শিক্ষক নিজেকে শিক্ষার্থীদের আরো কাছাকাছি আসবার চেষ্টা করবেন যাতে করে শিক্ষার্থীরা তার আচরণের দ্বারা প্রভাবিত হবার সুযোগটি গ্রহণ করতে পারে। চূড়ান্ত অর্থে তার এই ধরনের যাপিত জীবন পদ্ধতির মাধ্যমে এটি সহজেই স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, প্রকৃত জ্ঞানীরা সত্যিকার অর্থেই হয়ে ওঠেন সমাজের সবার। এবং এভাবেই “মূল্যবোধ” নামীয় যে গুণটিকে অর্জন করবার অভিপ্রায় নিয়ে শিক্ষার সূচনা হয় তার ভিত্তিমূল স্থাপিত হয়ে থাকে।
মূল্যবোধের এই ভিত্তিমূলটিকে দৃঢ় থেকে অধিকতর দৃঢ় করে তুলবার ক্ষেত্রে কিছু সংখ্যক শিক্ষক তাদের লেখনীর মাধ্যমে জাতিকে সঠিক পথের নির্দেশনা প্রদান করবার ক্ষেত্রে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এবং রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিটি মানুষ তাদের এই উদ্যোগটিকে সানন্দে গ্রহণ করে থাকেন। যেহেতু বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে অর্জিত জ্ঞান এবং অধ্যয়নের সমন্বয়ে তারা তাদের লিখিত বিষয়টিকে জাতির সামনে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও সাবলীলভাবে উপস্থাপন করেন, যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীসহ সকল স্তরের পাঠক নির্দিষ্ট বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করবার মাধ্যমে সচেতন মানসিকতা সৃষ্টি করতে পারেন। শুধু তাই নয়, পঠন-পাঠনের ক্ষেত্রে যে কোনো বিষয়কে হৃদয়গ্রাহী করে পরিবেশন করবার নিমিত্তে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়গুলোকে অনেক শিক্ষকই সুশৃঙ্খলভাবে পরিবেশন করে থাকেন ওই লেখনীর মাধ্যমে। সন্দেহাতীতভাবে শিক্ষার্থীরাও তখন এই ধরনের উদ্যোগ অত্যন্ত ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করে থাকে। লেখালেখি কিংবা গবেষণাধর্মী এই অভ্যাসটিকে ধারাবাহিকভাবে অনুশীলনের মাধ্যমে একজন শিক্ষক বিদেশী ডিগ্রি অর্জন কিংবা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হয়ে থাকেন বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে, যা জাতি হিসেবে আমাদের জন্যে সীমাহীন গর্বের। এক্ষেত্রে যে বিষয়টি এইসব শিক্ষকবৃন্দের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে তা হলো– বিদেশ বিভুঁইয়ে অবস্থানকালীন তাঁরা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি কত পরিমাণে নিজেদেরই মধ্যে ধারণ করতে সক্ষম হন? দেশীয় সীমানা পেরিয়ে বিদেশে অবস্থান করে নিজের দেশকে যদি ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা যায় সেক্ষেত্রে অবশ্যই একটি সার্থক অর্জন হিসেবে পরিগণিত হবে সেই শিক্ষকের এই কর্মটি। কিন্তু যদি কোনো শিক্ষক আজীবন বিদেশে অবস্থান করেন এবং তার সন্তানরা শৈশব থেকেই বিদেশী সংস্কৃতির দ্বারা পরিচালিত হতে থাকে, তাহলে দীর্ঘ প্রেক্ষিত বিবেচনায় বিষয়টি আমাদের জন্য কতটুকু ইতিবাচক হিসেবে বিবেচিত হবে সেটি ভেবে দেখা সবার জন্যেই অতীব প্রয়োজনীয়।
এই প্রেক্ষিতটি বিবেচনায় ধ্রুপদী শিক্ষাবিদ এবং মানব প্রকৃতিবাদী দার্শনিক মাইকেল ইকুয়েম দ্য মনটেইন এর জীবনাচরণটি আমরা উল্লেখ করতে পারি। জ্ঞানার্জনের জন্যে তিনি পৃথিবীর বহু দেশ ভ্রমণ করেছিলেন কিন্তু কখনোই ভিন্ন কোনো সংস্কৃতির কাছে তাঁর নিজ জাতীয় সংস্কৃতিকে সমর্পিত করেন নি। বরং নিজের সংস্কৃতিটিকে অপরের মাঝে প্রোথিত করবার চেষ্টা করেছিলেন। শুধু তাই নয়, সবসময়ের জন্যেই তিনি বিদেশীদের সম্পর্কে জানবার এবং বুঝবার আপ্রাণ প্রয়াসটিকে অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন। এমনকি সেই সময়ে কোনো দেশের রাজা যখন তাকে কোনো কাজের জন্যে রাজদরবারে আহ্বান জানাতেন তখন শুধু কাজটি সম্পন্ন করবার জন্যেই সেখানে গমন করতেন, কিন্তু কখনোই তিনি সেই দরবারে দীর্ঘ সময় অবস্থান করতেন না। অবস্থান না করবার পেছনে যে কারণটি স্পষ্টতই অন্তরিত সেটি হলো– রাজদরবারে অবস্থান করবার কারণে যদি তিনি কোনোভাবে তাঁর স্বাভাবিক জীবনাচরণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। অর্থাৎ, দার্শনিক মনটেইন এর জীবন দর্শন আমাদের এ শিক্ষাই প্রদান করে যে, একজন শিক্ষককে তার স্ব-কর্মে ব্যুৎপত্তির শীর্ষে অধিষ্ঠিত হবার ক্ষেত্রে শিক্ষকতা পেশায় প্রবেশের শুরু থেকে তার জাতীয় সংস্কৃতির কাছে দায়বদ্ধ থেকে একটি নির্দিষ্ট জীবন যাপন পদ্ধতির দিকে মনোনিবেশ করা প্রয়োজনীয় এ কারণে যে, ভবিষ্যতে এই বিষয়টি নিয়ে যেন কোনো ধরনের দ্বিধাদ্বন্দ্বের সৃষ্টি না হয় কিংবা সমাজের উচ্চমাত্রার ধনিক শ্রেণির জীবন যাপন পদ্ধতি প্রত্যক্ষ করবার পর কোনো ধরনের “না পাওয়ার” অনুভূতিটি জাগ্রত হয়। সুতরাং একজন শিক্ষক, তিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি লেখালেখি অথবা গবেষণা কিংবা অন্য যে কোনো সৃষ্টিশীল কাজেই ব্যাপৃত থাকুন না কেন, তার একটি নিজস্ব জীবন দর্শন থাকবে যার ওপর ভিত্তি করে তার সমগ্র জীবনটিকে তিনি যাপন করতে থাকবেন। এক্ষেত্রে এমন কোন প্রলোভনে তার প্রলোভিত হওয়া সমীচীন হবে না যার দ্বারা তার ওই স্বাভাবিক জীবন যাপনের প্রবাহটি বাধাপ্রাপ্ত হয়।
এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য হিসেবে প্রতিনিয়ত আমাদের জানান দেয় যে, কোনো জাতির গড় সাংস্কৃতিক আচরণ যখন প্রকৃত মূল্যবোধকে স্পর্শ করতে সক্ষম হবে না তখন সমাজের সর্বস্তরে সৃষ্টি হবে স্থিতিশীলতার সংকট। সেক্ষেত্রে সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নৈমিত্তিক কোনো কাজেই পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করা সম্ভব হয়ে উঠবে না। শ্রমিক শ্রেণি যে কাঙ্ক্ষিত আকাঙ্ক্ষাটুকু শিক্ষিত সমাজের কাছ থেকে প্রত্যাশা করবে সেটি পূরণ করা হবে অকল্পনীয় এবং পরিপূর্ণভাবে দুঃসাধ্য। শুধু শ্রমিক শ্রেণি নয়, যে কোনো পর্যায়ের মানুষ, যখন কোনো সেবা পেতে ইতিবাচক প্রত্যাশা নিয়ে দারস্থ হবেন তখন মূল্যবোধের সংকটটি ঘনীভূত হয়ে উঠবে দায়িত্বরত কর্মকর্তা কিংবা কর্মচারীবৃন্দের আচরণে। এমনকি যে শিক্ষকসমাজ মূল্যবোধের দীক্ষা প্রদানে সদা নিয়োজিত তারাও হয়ত বাদ পড়বেন না প্রকৃত সেবাটুকু প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সেই দায়িত্বহীন ব্যক্তির নেতিবাচক আচরণটুকু গ্রহণে। মেডিক্যাল, ব্যাংক, অফিস-আদালত থেকে শুরু করে যেখানেই কার্য সম্পাদনের জন্যে গমন করুন না কেন প্রত্যাশিত সেবাটুকু নিশ্চিত করবার ক্ষেত্রে প্রতিটি মানুষকেই সম্মুখীন হতে হবে অবর্ণনীয় সমস্যার। তাই, কোনো সন্দেহ ব্যতিরেকে সকল শিক্ষকবৃন্দের যে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো জরুরি সেটি হলো– অন্তত সমাজের প্রতিটি মানুষ যেন ন্যূনতম মূল্যবোধের আলোয় আলোকিত হয়ে তাদের পেশাগত এবং ব্যক্তিজীবনকে ইতিবাচকভাবে পরিচালিত করবার প্রয়াস পায়।
এ প্রেক্ষিতটির বিশ্লেষণে দার্শনিক ইমাম ইবনে আল রাজাদের একটি জ্ঞানগর্ভ মন্তব্য বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। জ্ঞানের স্তরকে তিনি তিনটি স্তরে বিভক্ত করেছেন এবং বলেছেন– ‘যে ব্যক্তি জ্ঞানের প্রথম স্তরে প্রবেশ করবে, সে অহংকারী হয়ে উঠবে যেন সবকিছুই সে জেনে ফেলেছে, দ্বিতীয় স্তরে প্রবেশ করবার পরে সে বিনয়ী হবে এবং তৃতীয় স্তরে প্রবেশ করবার পরে সে নিজের অজ্ঞতা উপলব্ধি করতে পারবে।’ সুতরাং, একজন শিক্ষিত ব্যক্তি হিসেবে এই প্রত্যাশাটিই সক্রিয় থাকবে যে– জ্ঞানের সর্বোচ্চ স্তরটিকে স্পর্শ করবার সেটি সম্ভব না হলে ন্যূনপক্ষে দ্বিতীয় স্তরটিতে পৌঁছানো। যেহেতু সেই ব্যক্তিটি স্পষ্টতই উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন যে– জ্ঞানের প্রথম স্তরে অবস্থান করা তার জন্যে শুভপ্রদ বলে বিবেচিত হবে না। যে কোনো মূল্যেই হোক জ্ঞানের দ্বিতীয় স্তরে অধিষ্ঠিত হয়ে বিনয়কে নিজের মধ্যে ধারণ করে প্রাণপূর্ণ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবেন তৃতীয় স্তরটিতে পৌঁছানোর জন্যে। এবং যে গুণটির ওপর ভিত্তি করে এটি খুবই সম্ভব হয়ে উঠবে যে– জীবনের অব্যাহত প্রবাহটিকে একটি স্থিতিশীল রূপ প্রদান করা। এখন কোনো জাতিকে যদি প্রকৃত জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে হয় তাহলে কোনো সন্দেহ ছাড়াই জ্ঞানের সর্বোচ্চ স্তরটিকে স্পর্শ করবার বিষয়টি অগ্রগণ্য হয়ে উঠবে। যদি সেটি সম্ভব না হয় অন্তত দ্বিতীয় স্তরটিকে স্পর্শ করা হবে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। দ্বিতীয় স্তরে প্রবেশ করবার মাধ্যমে রাষ্ট্রিক সকল কাজে পেশাদারিত্ব সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। এবং এই সম্ভাব্যতাই জাতিটিকে সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীতকরণে একটি সোপান হিসেবে গৃহীত হবে যা দেশীয় এবং বিদেশ থেকে আগত ব্যক্তিবৃন্দের ইতিবাচক আস্থা সৃষ্টির ক্ষেত্রে কার্যকরী হবে। যেহেতু ব্যক্তির ন্যায় সেই জাতিটিও অবর্ণনীয় সমস্যায় উপনীত হতে পারে যদি জ্ঞানের প্রথম স্তরে অবস্থান করে। তাই, একটি জাতিকে প্রকৃত জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে চাইলে শিক্ষকসমাজসহ রাষ্ট্রীয় পর্ষদকে উপর্যুক্ত বিষয়টির দিকে দৃকপাত করে শিক্ষা প্রদানের বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা মঙ্গলজনক হয়ে উঠবে।
এখন উপর্যুক্ত ভাবনাগুলোকে চুলচেরা বিশ্লেষণের মাধ্যমে অনায়াসেই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে– একজন ব্যক্তি, যিনি শিক্ষক হিসেবে নিজের সমগ্র জীবনটিকে যাপিত করবার ক্ষেত্রে আগ্রহী হয়ে উঠবেন, শুধু তার মতো ব্যক্তিরই শিক্ষকতার মতো মহান ব্রততে প্রবেশ নিশ্চিত করবার মাধ্যমে জাতিকে ক্রমাগত সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভবপর হবে। যেহেতু এই ধরনের ব্যক্তিবর্গ নিজেদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করেই এই পেশায় প্রবেশ করবেন। তাদের কল্পলোকে পূর্বাহ্নিকভাবেই শিক্ষা প্রদানের ইতিবাচক পরিকল্পনাগুলো ছন্দোবদ্ধ আকারে গ্রন্থিত হতে থাকবে। এবং তারা সহজেই উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন যে, কোনো জাতিকে প্রকৃত জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করবার নেপথ্যে প্রকৃত শিক্ষা প্রদানের কোনো বিকল্প নেই এবং তারাই চূড়ান্ত অর্থে জাতিটিকে উন্নতির পাদপ্রদীপে নিয়ে আসবার ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করবেন। এক্ষেত্রে তাদের মধ্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কোন ব্যক্তিস্বার্থ যদি পরিলক্ষিত হয়েও থাকে তবে সেই স্বার্থটিকে পরিত্যাগ করবার ক্ষেত্রে তারা ন্যূনতম কার্পণ্য বোধ করবেন না। কিন্তু, যখনই শিক্ষকতা পেশায় প্রবেশের পূর্বে কোনো ব্যক্তি শিক্ষকতা বহির্ভূত ভিন্ন কোনো স্বার্থের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করবেন তখনই যে প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে রাষ্ট্র তার শিক্ষাব্যবস্থাকে পরিচালনা করবেন তা সার্থক রূপে উন্নীত হবে না।
এখন প্রশ্ন উত্থিত হওয়া স্বাভাবিক, তাহলে কি শুধুই শিক্ষকবৃন্দ সমাজের উন্নয়নে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যাবেন? শিক্ষার্থী, সমাজ কিংবা রাষ্ট্র তাদের কীভাবে মূল্যায়ন করবে? মূল্যায়নের ক্ষেত্রে প্রথমত শিক্ষার্থীদের কথা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে যে, শিক্ষকের প্রতি শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নটি হবে পুরোপুরি নির্ভেজাল। কোনো শিক্ষক যদি একজন শিক্ষার্থীর প্রতি প্রকৃত ভালোবাসা সৃষ্টি করতে সক্ষম হন তবে আপনা আপনি সেই শিক্ষার্থীর ওপর তিনি এক ধরনের অধিকারের বোধ নিজের মানসলোকে তার অজান্তেই প্রতিষ্ঠা করে নেবেন, যে অধিকারের ওপর ভিত্তি করে সেই শিক্ষক তার শিক্ষার্থীটির কাছ থেকে সারাজীবন লাভ করবেন অনিঃশেষ শ্রদ্ধাবোধ। যখনই, যে পরিস্থিতিতেই সেই শিক্ষার্থীটি থাকুক না কেন, শিক্ষকের প্রসঙ্গ আসলে সেই শিক্ষকের অবিকল অনুকৃতিটি তার দৃষ্টিসীমায় আপনা আপনি স্থাপিত হয়ে যাবে। তখন তিনি সবার কাছে গর্ব করে বলবেন– উনি আমার শিক্ষক ছিলেন। শুধু তাই নয়, সন্তানদেরও কাছে সেই শিক্ষকের কথা ব্যক্ত করে প্রশান্তি বোধ করবেন এবং চেষ্টা করবেন তার সন্তানরাও যেন তার মতো করে শিক্ষকদের শ্রদ্ধা করতে শেখে। দ্বিতীয়ত সমাজ অথবা রাষ্ট্র কর্তৃক শিক্ষকের মূল্যায়ন। এক্ষেত্রে একজন শিক্ষকের প্রথমেই যে বিষয়ে মনোযোগী হওয়া জরুরি তা হলো– সমাজ অথবা রাষ্ট্র কীভাবে মূল্যায়ন করলো সেই চিন্তাটি যদি একজন শিক্ষক সবসময়ই তার চিন্তার জগতে ক্রিয়াশীল রাখেন, সেক্ষেত্রে মূল লক্ষ্য থেকে সরে আসবার বিষয়টি সেই শিক্ষকের ক্ষেত্রে শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। একজন শিক্ষক হিসেবে স্বাভাবিক যে কর্তব্য সেটি সঠিকভাবে পালন করবার দিকে আগ্রহী হওয়াই বোধকরি সুবিবেচনার পরিচায়ক হবে সেই শিক্ষকের ক্ষেত্রে। কিন্তু কোনো রাষ্ট্রে শিক্ষকবৃন্দকে যদি অর্থনীতিসহ অন্যান্য যে কোনো প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয় এবং সে প্রতিবন্ধকতা অপসারণে রাষ্ট্রযন্ত্র যদি সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপটি গ্রহণ না করে, সেক্ষেত্রে সেটি সেই রাষ্ট্রের শিক্ষার মান উন্নয়নে ইতিবাচক বিষয় হিসেবে বিবেচিত হবে না। সংগত কারণেই শিক্ষকবৃন্দও শিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে আগ্রহ বোধ করবেন না ওই আর্থিক দীনতাসহ নানামুখী প্রতিবন্ধকতার কারণেই।
এই প্রেক্ষিতটির প্রকৃততা নির্ণয়ে বাংলা সাহিত্যের ধ্রুপদী ঔপন্যাসিক বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের অমর সৃষ্টি “অনুবর্তন” উপন্যাসটি তীক্ষ্ণ অনুসন্ধিৎসু মনন দ্বারা বিশ্লেষণ করলে এটি সহজেই স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, কোনো সমাজে কিংবা রাষ্ট্রে স্কুল থেকে শুরু করে যে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকবৃন্দকে যদি অধ্যয়নের মূল কাজ থেকে সরে এসে সার্বক্ষণিক সাংসারিক ব্যয় নির্বাহের চিন্তা করতে হয়, সেক্ষেত্রে সেখানে প্রকৃত শিক্ষা কখনই প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারবে না। আর প্রত্যেক শিক্ষার্থীদের অন্তর্জগতে মূল্যবোধ সৃষ্টি করা হয়ে উঠবে অত্যন্ত দুরুহ ব্যাপার। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র যদুনাথ মুখুজ্জকে সাংসারিক জীবনে এতটাই নিদারুণ সংকটে পতিত হতে হয়েছিলো যে, শেষ পর্যন্ত অর্থাভাবে তার ব্যক্তিগত জীবনের সাজানো স্বপ্নগুলো এক এক করে ঝরা পাতার মতো ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। শিক্ষক যদু মুখুজ্জের মতো অবস্থা যদি কোনো সমাজে পাঠদানরত শিক্ষকবৃন্দের জীবনজুড়ে দৃশ্যমান হয়ে উঠে তাহলে সেটি হবে সেই সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের জন্যে অত্যন্ত পরিতাপের। সুতরাং কোনো শিক্ষক নিজেই যদি সমস্যার সীমাহীন শৃঙ্খলে আবদ্ধ থেকে অন্যকে সমস্যা থেকে উত্তরণের পরামর্শ প্রদান করবার কাজে ব্যাপৃত থাকেন তবে তা প্রথম অর্থেই নিশ্চিতভাবে অবাঞ্চিত হিসেবে গণ্য হবে।
এক্ষেত্রে রাষ্ট্র যদি শুরুতেই শিক্ষকবৃন্দের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা প্রদানে সক্ষম হন, শিক্ষাসংক্রান্ত জাতীয় সমস্যা নিরসন করবার নিমিত্তে শিক্ষকবৃন্দের মতামত যাচাইয়ের মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে একনিষ্ঠভাবে ব্রতী হন, তাহলে সেই রাষ্ট্রের শিক্ষার উন্নয়ন সম্ভব হবে বলে প্রত্যাশা করা যেতে পারে খুব স্বাভাবিকভাবেই। কারণ সেই রাষ্ট্রের শিক্ষকবৃন্দের সংসার কিংবা চিকিৎসার ব্যয় নির্বাহের ক্ষেত্রে যেমন কখনোই অতিরিক্ত দুশ্চিন্তার ভার বহন করতে হবে না, একইভাবে সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিতির ক্ষেত্রে কোন ধরনের সংকট লক্ষ করা যাবে না। সেক্ষেত্রে সেই ধরনের রাষ্ট্রের প্রত্যেক শিক্ষকই প্রতি মাসেই তার চাহিদানুযায়ী গ্রন্থ ক্রয় করবার মাধ্যমে নিজেকে যেমন ঋদ্ধ করতে সক্ষম হবেন, একইভাবে শিক্ষার্থীদের মননের গভীরে মূল্যবোধ নামীয় বীজটির প্রস্রবণ ঘটাতেও সফল হবেন অতি সহজেই। এখন যুদ্ধবিধ্বস্ত কোনো রাষ্ট্র কিংবা নব্য স্বাধীন কোনো রাষ্ট্র অথবা আকস্মিক অর্থনৈতিক সংকটের কারণে পতিত কোনো রাষ্ট্রের উন্নয়নের ক্ষেত্রে সেই রাষ্ট্র যদি শিক্ষকবৃন্দের যথাযথ সম্মান প্রদানের সক্ষমতা না রাখেন, সেক্ষেত্রে সেই রাষ্ট্রের উন্নয়নের ক্ষেত্রে কারা মূল ভূমিকা পালন করবেন? অবশ্যই শিক্ষকবৃন্দ। এবং এ ক্ষেত্রে সেই প্রজন্মের শিক্ষকবৃন্দকে অবশ্যই জাতির কাছে দায়বদ্ধ থেকে নিজেদের উৎসর্গ করবার বিষয়টি প্রধান শর্ত হয়ে দাঁড়াবে। কারণ, যেভাবেই আমরা রাষ্ট্রিক উন্নয়নের ছক আঁকি না কেন, শিক্ষার উন্নয়ন ব্যতীত কোনোভাবেই অন্য কোনো মৌলিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। যেহেতু সকল উন্নয়নের মূলেই রয়েছে শিক্ষার অবদান এবং যেখানে শিক্ষকের ভূমিকাটি অনস্বীকার্য। শিক্ষকবৃন্দ তাদের নৈতিক এবং মানবিক দীক্ষা প্রদানের মাধ্যমে উপহার দিতে পারেন একটি যুদ্ধহীন শান্তিপূর্ণ পৃথিবী, আনবিক বোমার পরিবর্তে পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তকে কানায় কানায় পূর্ণ করে তুলতে পারেন মানবিক বোমায়। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রের ক্রান্তিক মুহূর্তগুলোতে যথাযথ ভূমিকা পালন করবার মাধ্যমে নিজেরা প্রাপ্ত হয়ে থাকেন সীমাহীন প্রশান্তির। এ কারণেই শিক্ষকতা ব্রতটি পৃথিবীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্রত হিসেবে আজ অবধি স্বীকৃত। সেই প্রেক্ষিত বিবেচনায় এই মহান ব্রতে নিয়োজিত মানুষগুলো যখন ঐক্যবদ্ধভাবে অনুন্নত কোনো জাতিকে যে কোনো নেতিবাচক অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে উন্নয়নের শীর্ষে অধিষ্ঠিত করবার প্রাণান্ত প্রয়াস গ্রহণ করবেন তখনই সেটি অবশ্যই সার্থক রূপে উন্নীত হবে– এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
তথ্যসূত্র:
১. ক্লাইভ বেল, সভ্যতা, অনুবাদ– মোতাহের হোসেন চৌধুরী, প্রকাশকাল মে ২০১৫, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, বাংলামোটর, ঢাকা-১০০০। পৃষ্ঠা নং ১৩।
২.অনুবর্তন, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়, প্রকাশকাল নভেম্বর-২০১৫, সালাউদ্দিন বইঘর, বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০।
৩. শিক্ষাদর্শন, খন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান, অগস্ট-১৯৮০, পাঠ্যপুস্তক বিভাগ, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, পৃষ্ঠা নং-১৩৮।