লেখক সম্পর্কে:
জন্ম ২ জানুয়ারি, ১৯৬৩। পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলায়। বাবার চাকরির সুবাদে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তার ঘুরে দেখার সুযোগ হয়েছে। ছাত্র জীবনের সিংহভাগ সময় কেটেছে নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর উপজেলায়। কলেজ জীবন থেকেই সাংবাদিকতা ও লেখালেখির সাথে যুক্ত। কবিতা, ছোটগল্প, ফিচার, প্রবন্ধ, শিশুতোষ ছড়া-গল্প, লেখেন দেশ বিদেশের অনলাইন পোর্টাল, বিভিন্ন ব্লগ এবং জাতীয় সাপ্তাহিক ও দৈনিক সংবাদপত্রে। তবে তাকে সাহিত্য অঙ্গনে সবচে’ বেশি আগ্রহ সৃষ্টি করে কবিতায়। কবিতায় তিনি প্রেম, দ্রোহ, দুঃখ জাগানিয়া, মাটি আর মানুষ এবং বিপ্লবের কথা বলেছেন। তার কবিতায় নান্দনিকতা ভিন্ন মাত্রায় উঠে এসেছে। সমাজের অসংগতিগুলো অকপটে অসংকোচে নির্দ্বিধায় সহজেই প্রকাশ করেছেন। তুলে ধরেছেন সহজ ভঙ্গিমায়। সম্পাদনা করেছেন সাহিত্য পত্রিকা ‘নোঙর’। বর্তমানে সম্পদনা করছেন সাহিত্য বিষয়ক ছোটকাগজ ‘এবং মানুষ’। বর্তমানে রাজধানী ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। ব্যক্তি জীবনে স্ত্রী ও দুই কন্যার জনক। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা– ১৭টি।
পাণ্ডুলিপি থেকে প্রবন্ধ: “লালন শাহ ও তার ভাবদর্শন: মানবধর্ম-লোকধর্ম”
বিশ্ববিখ্যাত মরমি সাধক ফকির লালন শাহ আজ সারা বিশ্বে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। লালন সঙ্গীতের সুর ও বাণীর সমন্বয়ে এ সঙ্গীত শ্রোতার কানের ভেতর দিয়ে তার মর্মে প্রবেশ করে। এই সঙ্গীতিক গুণে আজ লালন সঙ্গীত অনন্য উচ্চতায় উপনীত হয়েছে। লালন সঙ্গীত নিয়ে আজ দেশ বিদেশে নানামুখি গবেষণায় তাঁকে চিনবার, জানবার চেষ্টা করা হচ্ছে। একদিন যে সাধক বাউল কবি পথে পথে গাঁয়ের মেঠো পথ ধরে অনুসারীদের নিয়ে গানের সাধনায়, অধ্যাত্মিকতায় মগ্ন ছিলেন; আজ তাঁকে আমরা গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি। লালন সঙ্গীত আজ গবেষণার বিষয়। লালন শাহ’র সাধনা আধ্যাত্মিকতায় মগ্নময় হলেও তিনি ছিলেন জীবনবাদী কবি। যদিও তার গানে আমরা তাত্ত্বিক বিষয়াদি গভীরভাবে উপলব্ধি করি। তাঁর গানে আধ্যাত্মিকতার সাথে আদিরস পরিবেশিত হয়েছে নানাভাবে। তত্ত্বকথায় ভরপুর হলেও লালন-সঙ্গীত সাহিত্য-রস বর্জিত নয়। এ কারণেই শত শত বছর পরেও যেমন তাঁকে নিয়ে, তাঁর মরমী বাণী নিয়ে গবেষণা চলছে, হাজার বছর পরেও তা অব্যাহত থাকবে।
লালনের বাউলতত্ত্ব, তাঁর গান বা লালনগীতি ও দর্শনের পরে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক হয়েছে তাঁর জন্ম পরিচয় নিয়ে। লালন শাহ’র জন্ম দিনক্ষণ নিয়ে নানা মুনির নানা মত রয়েছে। তবে এটা ঠিক প্রত্যেকেরই দেওয়া জন্ম তারিখ প্রায় কাছাকাছি হওয়ায় এটাই ধরে নেওয়া যায় যে, লালন শাহ ১৭৭৪ সালে কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী থানার ভাঁড়ারা গ্রামে এক কায়স্থ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ভক্তরা তাঁকে সাঁইজি বলে ডাকতেন (ড. আবুল আহসান চৌধুরী, লালন শাহ, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, পুনর্মুদ্রণ ১৯৯২ পৃ.৩)। প্রায় ১১৬ বছর বয়সে ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর শুক্রবার ভোর ৫টায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ফকিরেরা একে বলেন, ‘গার্শির দিন’ অর্থাৎ কার্তিক মাসের প্রত্যুষা, বাঙলা ১২৯৭ সাল। সে হিসেবে তাঁর জন্ম ইংরেজি ১৭৭৪ খৃষ্টাব্দে। (লালন শাহ’র মৃত্যুর পর কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত ‘হিতকরী’ নামে পত্রিকার সম্পাদকীয় থেকে এ তথ্য পাওয়া যায়। তাঁকে ছোটবেলায় এক সম্প্রদায়ের ফকিরগণ সারঙ্গ কিংবা গোপীযন্ত্র নিয়ে গান গেয়ে ভিক্ষা করতে দেখতেন। সেখান থেকে তার মনে এই সম্প্রদায়ের লোকের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে লালন শাহ এর জীবনের করুণ আখ্যান শুনে বসন্তকুমার পাল (পরবর্তী সময়ে লালনের জীবনীকার) সেই শিশুকাল থেকেই লালনের শিষ্য বনে যান। তার জবানীতে জানা যায় এসব তথ্য।
ফকির লালন শাহের জন্ম ও বংশ পরিচয় সম্পর্কে আরো একটি অভিমত প্রচলিত আছে। মরমী কবি পাঞ্জু শাহ যিনি লালনের আখড়ায় সবসময় তাঁর সাথে থাকতেন, তাঁর দেওয়া বয়ানের উদ্ধৃতি দিয়ে তাঁর দু’পুত্র এ মতের প্রবক্তা। তাঁদের মতে, ফকির লালন শাহ’র জন্ম যশোর জেলার হরিণাকুণ্ড থানার অধীন হরিশপুর গ্রামে একটি মুসলমান পরিবারে। তাঁর পিতার নাম দরিবুল্যা দেওয়ান। দরিবুল্যা দেওয়ানের তিনজন পুত্র সন্তান ছিল। তাঁরা হলেন আলম, কলম ও লালন। তাঁদের মধ্যে লালন সর্বকনিষ্ঠ। লালন শৈশবকালেই পিতৃমাতৃহীন হয়ে পড়েন। এরপর তিনি তাঁর ভাই ও ভাবীদের কাছে লালিত-পালিত হন। বড় ভাই আলম শ্রমিক হিসেবে কলকাতায় কাজ করতেন। আর মেজ ভাই কলম কৃষিজীবী ছিলেন। কিন্তু লালন বাল্যকাল থেকেই গানবাজনা ভালোবাসতেন। তিনি তা নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। তাঁর গুরু ছিলেন তাদেরই হরিশপুর গ্রামের সিরাজ শাহ। তিনি ছিলেন পেশায় পালকিবাহক। লালনের গান শুনে তিনি অভিভ‚ত হন। তাদের মধ্যে সখ্যতা বাড়ে, এক পর্যায়ে লালন তাঁর নিকট দীক্ষিত হয়ে সাধনার উচ্চমার্গে উপনীত হন। সিরাজ শাহ এর মৃত্যুর পর ফকির লালন শাহ কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় কালীগাঙ্গের পাড়ে স্থায়ী আখড়া গড়ে তোলেন। তিনি সেই গ্রামের জোলা নামের এক মুসলমান মেয়েকে দ্বিতীয় বিবাহ করেন। তবে তাঁর জাত-ধর্ম ও জন্মসন তারিখ সঠিকভাবে আবিষ্কার করা সম্ভব না হলেও মৃত্যুর সন-তারিখ নানা তথ্যরাজি দ্বারা পরে প্রমাণিত হয়েছে। তবে লালন কোন জাতের ছেলে তা নিশ্চিতভাবে আজও চিহ্নিত হয়েছে বলে জানা যায় নি। এ দুই মতের অনুসারীরাই তাঁর এ জন্মস্থানের বিষয়টিকে বা জাতের বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেন না, তাদের ভাবনায় রয়েছে লালনের বাণী আর আধ্যাত্মিক চেতনা।
তার ধর্ম পরিচয় নিয়েও যথেষ্ট মত পার্থক্য থাকলেও বসন্তকুমার পালের দেওয়া তথ্যে জানা যায়, লালন সাঁইজি কায়স্থ কুলে চাপড়ায় বিখ্যাত কর মহাশয়দের বংশে জন্মগ্রহণ করেন। এই চাপড়া মহকুমায় গৌরনদীর তীরে অবস্থিত। তাঁর পিতা নাম মাধব কর। শৈশবেই তাঁর পিতৃবিয়োগ ঘটে। লালন সাঁইজি তাঁর আত্মীয়দের সাথে পৃথক হয়ে দাসপাড়া নামক বস্তিতে বাস করা শুরু করেন। সাঁইজির মাতামহের নাম ভস্মদাস। তাঁর কৃষ্ণদাস ও রাজেন্দ্র দাস ওরফে রাজু দাস নামে দুই পুত্র আর রাধামণি, নারায়ণী পদ্মাবতী নামে তিন কন্যা সন্তান ছিলেন। পদ্মাবতীর একমাত্র তনয়ই লালন শাহ। তার বাল্য নাম লালন কর।
লালন শাহ তবে কোন ধর্মের মানুষ বা কোন ধর্মের মানুষের ঔরষজাত সন্তান, এ নিয়ে যথেষ্ট মতবিরোধ রয়েছে। এছাড়া তার জন্মস্থান নিয়েও মতবিরোধ তো আছেই। কেউ বলেছেন তিনি মুসলমান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছেন, আবার কেউ বলছেন তিনি হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছেন। কিন্তু তিনি কি বলেছেন, তাঁর কাছে কোন ধর্ম প্রাধান্য পেয়েছে? আমরা তাঁকে নিয়ে, তাঁর গান নিয়ে যদি বিচার বিশ্লেষণ করি, তবে তিনি হিন্দু-মুসলিম এই দুই ধর্মের বেড়াজালে আবদ্ধ না থেকে বেরিয়ে এসে মানবধর্মের ব্রতে নিজেকে সঁপে দেন। লালন বলেছেন, ‘লালন বলে হাতে পেলে জাত পোড়াতাম আগুন দিয়ে।’ জাত নিয়ে তিনি ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। তাইতো তিনি গেয়েছেন–
“সবাই শুধায় লালন ফকির
কোন জাতের ছেলে।
কারে বা কি বলব আমি
দিশা না মেলে \
হয় কেমনে জাতির প্রমাণ
হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্ট-যবন?
‘জাত’ বলিতে কি হয় বিধান
শাস্ত্রে খুঁজিলে?”
লালন আবার তার জাত নিয়ে বলেছেন–
“সবাই শুধায় লালন ফকির
হিন্দু কি যবন
কারে বা কি বলব আমি
না জানি সন্ধান।
বেদ পুরাণে করছে জারী
যবনের সাঁই হিন্দুর হরি
তাও তো আমি বুঝতে নারি
দুইরূপ সৃষ্টি করলেন…
তার কি প্রমাণ?”
লালন তাঁর বাউল দাস বংশের কোন এক প্রতিবেশীর সাথে মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরের নিকট গঙ্গাস্নানে যাত্রা করেন। তখন রেলপথ ছিল না। তীর্থযাত্রীরা নৌকায় যাতায়াত করতেন। সঙ্গীসহ গঙ্গাস্নান শেষে স্বগৃহে ফিরে আসার সময় লালন বসন্ত রোগে গুরুতর আক্রান্ত হন। এতে তিনি মৃতবৎ অসাড় হয়ে পড়েন। সঙ্গীরা তাকে মৃত মনে করে মুখাগ্নি দিয়ে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেন। [তথ্যসূত্র: তন্ত্রাচার্য শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণব- বসন্ত কুমার পাল]। ভাগ্যক্রমে লালন ভাসতে ভাসতে কালীগঙ্গার পাড়ে এসে ভিড়ে। একজন নিঃসস্তান মুসলমান দম্পতি তাকে নিজ সন্তানের মত করে সেবা দিয়ে সুস্থ করে তোলেন। এদিকে লালনের বাড়ির সবাই মনে করে লালন আর বেঁচে নেই। লালন সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরে গেলে, তার স্বগোত্রীয় লোকেরা মুসলমানের বাড়িতে অন্ন গ্রহণের দায়ে তাকে নিজ ধর্মে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান। এমন কি তার স্ত্রীও ধর্মভীতিতে স্বামীকে মেনে নিতে পারেননি। লালন বাধ্য হয়ে পুনরায় তার আশ্রয়দাতা মুসলমানের বাড়িতে স্থায়ীভাবে থেকে যান। গুরু মানেন সিরাজ সাঁইকে। গুরু সিরাজ সাঁইয়ের মৃত্যুর পর ১২৩০ বঙ্গাব্দে তিনি গড়াই নদীর তীরে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়া গ্রামে এসে স্থায়ীভাবে আস্তানা গাড়েন।
তার জন্ম তারিখ আন্দাজ করে ধরে নেওয়া হয়েছে বলে অনেক লালন গবেষকই মত পোষণ করেন। সেটি খুব বেশি বিবেচ্য বিষয় নয়; লালনের কর্মময় জীবনের সাধনা, মানব প্রেম আর মানুষকে সত্যান্বেষী করে একটি পথের দিশা দেওয়ার যে নিরন্তর সাধনা ছিল তারই নির্যাস লোকধর্মে লালন প্রোথিত করে গেছেন। মরমী চিন্তার ইতিহাস মানুষের ইতিহাসের সমসাময়িক। আর এই মরমি সাধক ফকির লালন শাহ’র বাণী আজো মরমি সাধনার ব্রতী হয়ে জীবন্ত হয়ে মানব মনে প্রেমের সুবাসাত প্রবাহিত করে যাচ্ছে।
লালনের কাছে কোন জাত-পাতের ভেদাভেদ স্থান পায় নি। তাঁর কাছে জাতি-ধর্ম এসব ছিল অর্থহীন। সাধনার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল মানবপ্রেম, মানবধর্ম। আর এই মানবধর্মের প্রবক্তা হিসেবেই তিনি আজ বিশ্বমানবের হৃদয়ে স্থান জুড়ে আছেন। তিনি কেবলমাত্র বাঙালির আন্ত্যজ চেতনার ধ্যানী-যোগী নন, তিনি বিশ্বমানবের সাধনার প্রতীক। লালন জাত-পাত বিচারে তাঁর বিশ্বাসের প্রতিফলন অনেক লালন গীতিতে বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। তাই তার গানে আমরা সেই বাণীর ধ্বনি প্রতিধ্বনি শুনতে পাই–
লালন সবে বলে লালন ফকির
হিন্দু কি যবন;
লালন বলে, আমার আমি
না জানি সন্ধান।
এক ঘাটেতে আসা-যাওয়া
একই পাটনী দিচ্ছে খেয়া
তবে কেউ খায় না কারও ছোঁয়া।
ভিন্ন জল কোথায় পাস?
লালন ফকির কোথায় জন্মেছিলেন তা নিয়ে মতবিরোধ থাকলেও সবার পিছে, সবার নিচে, সবহারাদের মাঝে– যেথায় থাকে সবার অধম, দীনের দীন– সেখানে তিনি বাসাটা বেঁধেছিলেন। ছেঁউড়িয়াতে তাঁর চারপাশে যে-মানুষগুলো ছিল, তারা পেশায় কারিগর সম্প্রদায়ের, তাঁত বুনত, জাতে জোলা– নিম্নবর্ণের মানুষ অন্ত্যজ। লালন সেখানে গিয়েই তাঁর আস্তানা গেড়েছিলেন। এ থেকেই আমরা ধরে নিতে পারি, লালনের ধ্যান-সাধন ছিল নিম্নবর্ণের মানুষকে নিয়েই। নিম্নবর্ণের কাছে সমুদ্রের বার্তা আনতে চেয়েছিলেন, গঙ্গার খবর আনতে চেয়েছিলেন তিনি।
লোকধর্ম কি? মানুষ যখন নিজেই ধর্ম তৈরি করে তাকেই বলে লোকধর্ম– এবং এই লোকধর্মের গল্প অনেক আছে। লোকধর্ম মানুষের একটা আশ্রয়, বাঁচবার একটা প্রতীক। হিন্দু যাকে স্থান দেয়নি, মুসলমান যাকে স্থান দেয়নি, খ্রিস্টান যাকে স্থান দেয়নি, সে বাঁচবে কী নিয়ে? সে ‘মানুষ’ নিয়ে বাঁচবে এবং সেই বাঁচার নামই হচ্ছে লোকধর্মের জন্য বাঁচা, লোকায়ত জীবন। লালন হচ্ছেন সেই লোকায়ত জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতীক, সর্বশেষ্ঠ মানুষ, সর্বশ্রেষ্ঠ সাধক। কিন্তু তিনি একক নন এই জীবনে। ভুঁইফোঁড় নন এইজন্য যে, তাঁর আশেপাশের সমকালের অনেকগুলো মানুষের নাম পাওয়া যায়, অনেকগুলো ধর্ম-সম্প্রদায়ের নাম আমরা দেখতে পাই। জাতে রজক (ধোপা), দাদু ছিলেন ধুনকর মানে তিনি তুলা ধুনতেন, রজ্জব ছিলেন কলাল মানে মদ-বিক্রেতা, নামদেব ছিলেন ছিপি অর্থাৎ রং লাগাতেন। এই মানুষগুলিই ছিলেন আমাদের মস্ত সাধক। তাঁদের গান আমরা পাই, সেই গানের মধ্যে আমরা প্রথমে মানবিক মহিমা পাই পঞ্চদশ শতাব্দীতে। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, লালন ফকির থাকতেন জোলাদের মধ্যে, তাঁতিদের মধ্যে। গগন ছিলেন ডাকহরকরা, লালন শাহ এর গুরু সিরাজ সাঁই ছিলেন পালকিবাহক, পাগলা কানাই ধুয়োজারি করে গান করে বেড়াতেন। লোকধর্ম হচ্ছে আসলে সেটাই– যেটার লক্ষণ, যদি একজন মুসলমান দিপদাপন্ন হয় মুসলমানরা তাকে আশ্রয় দেবে। হিন্দু বিপন্ন হয়ে পড়ে, হিন্দু ধর্ম তার পেছনে দাঁড়াবে। একজন খ্রিস্টানের পিছনে পুরো খৃস্টধর্ম আছে। কিন্তু যারা তার মধ্যে স্থান পায়নি, লোকায়ত মানুষ যারা, যাদের আমরা এতদিন অস্পৃশ্য বলে সরিয়ে রেখেছি– যাদের দিয়ে শুধুমাত্র কিছু কায়িক পারিশ্রম করানো হয়। ব্রাহ্মণের সঙ্গে শূদ্রের পার্থক্য কী? একজন মেথর বা মুচি, অথবা মুদ্দাফরাশ, একজন পালকি-বেহারা, একজন চাষি এরকম করতে করতে আমরা যদি দেখি, দেখব যে তারা প্রত্যেকে কায়িক শ্রম করে আর উচ্চবর্গের লোকজন তেমন কোনো কায়িক শ্রম করে না। কাজেই এসব মানুষের ভেতরই তিনি লোকধর্ম খুঁজে ফিরতেন। আর তিনি পেয়েছেনও; মানুষ প্রেমের সুমহান এমন জ্ঞানতাপস আর কে হতে পেরেছেন; লালন শাহ তাঁদের মধ্যে অনন্য উজ্বলতায় আসীন। পাগলা কানাই হচ্ছেন ১৮০৯ সালের লোক। লালনের সমকালীন আরেকজন গীতিকার পাঞ্জু শাহ’র জন্ম সাল ১৮৫১। এঁরা সবাই প্রায় একই সময়ে জন্মেছিলেন একশ বছরের বৃত্তে। আমাদের সব লোকধর্মের প্রচারকরা জন্মেছেন এই শতাব্দীর মধ্যেই।
লোকধর্মের এই মানুষগুলো কিন্তু কায়াবাদী মানুষ, অন্ত্যজ মানুষ, কাজের মানুষ– কেউ ভাবেন মানুষ নন। মাটিতে এঁদের পা প্রোথিত থাকত, জীবন স্বপ্ন থাকত ওপরের দিকে– এই জীবনকে তারা ভোগ করে গেছেন, জীবনের বিচিত্র ওঠাপড়া দ্বন্দ্বে-ছন্দে থাকা ইতিহাস তাঁরা ভোগ করেছেন। পাগলা কানাই মারা গেলে এক মুসলমান মৌলভীকে ডাকা হয়েছিল তাঁকে জানাজা নামাজ পড়ানোর জন্য ও কবর দেওয়ার জন্য। উনি তা অস্বীকার করেছিলেন কারণ, পাগলা কানাই সেই অর্থে মুসলিম ধর্মাবলম্বী ছিলেন না, উনি নাকি ভ্রষ্ট, উনি ফকির! মৌলভী আসেননি, তবে অনেক মানুষ এসেছিলেন। যারা পাগলা কানাই এর গান ভালোবাসতেন, তারা এসেছিলেন। পাগলা কানাই এর গান ভালোবাসতেন সকলে। যশোর, নদীয়া, পাবনা সমস্ত জায়গা পাগলা কানাই এর নামে সেকালে মুখরিত ছিল। লালন ফকিরের তুল্যমূল্য বিখ্যাত গীতিকার ছিলেন পাগলা কানাই। তাঁর গান সংগৃহীত হয়েছে– কিন্তু তা আর গাওয়া হয় না; কারণ গাইবে কে? গায়ক সম্প্রদায় তো আর তৈরি হয়নি। আবার লালন লেখাপড়া জানতেন না। তাঁর গান সেসময় ভক্তদের মুখে মুখে ঘুরে ফিরতো। মুখস্ত করে রাখতো। এতে কিছু গানের কথা এলাকাভেদে কিছুটা ভিন্নরূপ পেয়ে যেতে পারে বলে অনেক গবেষক মত প্রকাশ করেছেন। তারপরেও তার সুর ও বাণীর কোন হেরফের হয়নি।
পাগলা কানাই এর গান আর তেমন করে গাওয়া যায় না। তাহলে লোকধর্ম তাঁদেরই আশ্রয় করে এগিয়ে যাচ্ছে, যাঁরা দেবতার মূর্তি তৈরি করেনি, মন্দির তৈরি করে নি, মসজিদ তৈরি করেনি, শাস্ত্র তৈরি করেনি, কিন্তু তাঁরা গান তৈরি করেছেন। [সুধীর চক্রবর্তী, লালন শাহ: অভিজাত ও লোকায়েতের সেতুবন্ধন]
লালন বাউল মতাবলম্বী ছিলেন। বাউল মত বাঙালির নিজস্ব। তা মানবতাবাদী ও শাস্ত্র নিরপেক্ষ। বাউলদের ধর্ম যদি থাকে তা হলে তা মানবধর্ম; যার মূল প্রতিপাদ্য মানবপ্রেম। সুফি-বৈষ্ণব ও নাথ-যোগী সবার সাথে প্রভূত মিল তার। আবার যোগদর্শনের অনেক উপাদান তাদের চিন্তার রসদ যোগায়। তারা কোনো বিশেষ ধর্মে-বর্ণে বিশ্বাসী নয়।
লালন জাত-পাতের ধার ধারতেন না। তার কাছে মানবধর্মই ছিল আসল ধর্ম। তাই তিনি বলেছেন– জাতের রূপটা কি তা তিনি এ জগৎ সংসারে খুঁজে পান নি। সুন্নত বা খাৎনা দিয়ে পুরুষজাতিকে মুসলমান করা যায়, এক্ষেত্রে নারী জাতির কি উপায়। নারীকে তো আর সুন্নত দেয় হয় না।
লালন শাহ শিষ্যদের নিয়ে সমভিব্যাহারে যশোর, ফরিদপুর, রাজশাহী প্রভৃতি জেলায় ঘুরে ঘুরে স্বীয় মতবাদ প্রচার করে বেড়াতেন। তাঁর অনুসারীদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান উভয়ই ছিল। তবে মুসলমানের সংখ্যাই ছিল বেশি। যদিও তিনি হিন্দু ধর্ম বা ইসলাম ধর্ম কোনটাই পালন করতেন না। তার ধর্ম ছিল বাউল তত্ত্ব ধর্ম, ফকিরী ধর্ম, একটি সাধনামার্গের ধর্ম। যা বাউল মতবাদ হিসেবে পরিচিত। লালন শাহ যে ধর্মে ধর্মে, মানুষে মানুষে কোন ভেদজ্ঞান করেন নি, তা আমরা তাঁর গানের মধ্যেই জানতে পারি–
সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে
লালন কয় জাতের কি রূপ
দেখলাম না এই নজরে
সুন্নত দিলে হয় মুসলমান
নারীলোকের কী হয় বিধান
বামুন চিনি পৈতে প্রমাণ
বামনী চিনি কিসেরে
কেউ মালা কেউ তসবি গলে
তাইতে কি জাত ভিন্ন বলে
যাওয়ার কিংবা আসার কালে
জাতের চিহ্ন রয় কারে
জগৎ জুড়ে জাতের কথা
লোকে গল্প করে যথাতথা
লালন বলে জাতের ফাতা
ডুবিয়েছি সাধ বাজারে
লালন নিরন্তর ‘মনের মানুষের’ সন্ধান বাইরে করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি সেখানে পান নি। তাঁর ধারণা তাঁকে বাইরে পাওয়া যাবে না। ‘মনের মানুষ’ নিজের মধ্যেই বাস করে। কাজেই তিনি নিজের ভেতরেই অহর্নিশ তার সন্ধান করে ফিরেছেন। লালন বলেছেন–
ক্ষ্যাপা তুই না জেনে তোর আপন খবর
যাবি কোথায়?
আপন ঘর না বুঝে বাইরে খুঁজে
পড়বি ধাঁধায়।
বাউল তত্ত্বের প্রধান বীজমন্ত্রই হলো মানুষকে খুঁজে বের করা। মানুষকে খুঁজে পেলে তবেই সিধ্যি-সাধন পূণ্যতা পাবে, বলেই লালন প্রকৃত মানুষের সন্ধানে মানুষের প্রেমে মজেছেন।
মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি
মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি \
দ্বিদলে মৃণালে সোনার মানুষ উজলে
মানুষ গুরুর কৃপা হলে জানতে পাবি।
মানুষে মানুষ গাঁথা দেখ না
যেমন আলেকলতা
জেনেশুনে মুড়াও মাথা তুই যাতে তরবি।
মানুষ ছাড়া মনরে আমার
দেখবিরে সব শূন্যকার
লালন বলে মানুষ আকার ভজলে তরবি \
আধ্যাত্মিকতায় লালন ফকির শ্রেষ্ঠ এক সাধক। তাঁর গানের বাণী তারই ভেতর সেই ধ্বনি তুলে হৃদয়ে প্রশ্নের উদ্রেক করে। আমি কে? আমি কি আমার ভেতরের পাখিটারে বশ মানাতে পেরেছি? এই যে আধ্যাত্মিকতা তা কেবল একজন লালনই এর ভেদ ভেঙ্গে আমাদের ধ্যানমগ্ন করে তোলেন। আমরা আমাদের ভেতরের খাঁচার পাখিটাকে কি বশ করতে পারি? লালন শাহ’র মনের গহীনে এভাবেই চিরন্তন কামনা ধ্বনিত হয়েছে।
খাঁচার ভিতর অচিন পাখি
কেমনে আসে যায়
তারে ধরতে পারলে মন বেড়ি
দিতাম পাখির পায়ে।
আট কুঠুরী নয় দরজা আটা
মধ্যে মধ্যে ঝরকা কাঁটা
তার উপরে সদর কোঠা
আয়না মহল তায়।
কপালের ফের নইলে কি আর
পাখিটির এমন ব্যবহার
খাঁচা ভেঙ্গে পাখি আমার কোন খানে পালায়।
মন তুই রইলি খাঁচার আসে
খাঁচা যে তোর কাঁচা বাঁশের
কোন দিন খাঁচা পড়বে খসে
ফকির লালন কেঁদে কয়।
বাউল লালন ফকির একদিকে দেহতত্ত্বের সাধনা করেছেন, অন্যদিকে সুফী প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে আল্লাহকে পাওয়ার দুর্বিনীত আকাঙ্ক্ষা তাকে পেয়ে বসে। খোদা সকার কি নিরাকার তা ভেবে দেখতে বলা হয়েছে। সেই সাথে হৃদয়ের তত্ত¡ তাও জানতে বলা হয়েছে। হযরত মুহম্মদ (সঃ) যিনি খোদার নবী তাঁর অপর নাম আহমদ। আহমদ শব্দটি লিখতে আলিফ, হে, মিম ও দাল এ চারটি হরফের প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে থেকে মিম হরফটি বাদ দিলে পাওয়া যায় আহাদ অর্থাৎ খোদাকে। আবার যদি আহাদ শব্দটির মধ্যে মিম হরফটি যোগ করা হয় তখন পাওয়া যায় হযরত মুহম্মদ (সঃ) কে। তাইতো তিনি বলেছেন–
আকার কি নিরাকার সাঁই রাব্বানা
আহাদের আহমদের বিচার হৈলে যায় জানা \
হায় রে আহমদ নামেতে দেখি
মিম হরফে লেখে নবী
মিম গেলে আহাদ বাকী
আহমদ নাম থাকে কিনা \
খুঁজিতে বান্দার দেহে
খোদা সে রয় লুকাইয়ে
আহাদে মিম বসাইলে
আহমদ নাম হয় কিনা \
আল্লাহ প্রীতি থেকে তিনি বলেছেন অপার হয়ে দয়াময়ের কৃপার আশায় বসে আছেন। তারে ফুলসিরাত পার করার আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর ভজন সাধন বুঝি বিফলে যায়, তাই ঘোর সংকটে তিনি দয়াময়ের কাছে আকুল প্রার্থনা করেছেন; তাঁকে পার করে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
আমি অপার হয়ে বসে আছি
ও হে দয়াময়,
পারে লয়ে যাও আমায় \
আমি একা রইলাম ঘাটে
ভানু সে বসিল পাটে–
(আমি) তোমা বিনে ঘোর সংকটে
না দেখি উপায় \
নাই আমার ভজন-সাধন
চিরদিন কুপথে গমন–
নাম শুনেছি পতিত-পাবন
তাইতে দিই দোহাই \
অগতির না দিলে গতি
ঐ নামে রবে অখ্যাতি–
লালন কয়, অকুলের পতি
কে বলবে তোমায় \
লালন সর্বশক্তিমান আল্লহকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এক ও অভিন্ন বিধাতা মেনে নিয়ে বিপদে একমাত্র তার কাছেই ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন–
“ক্ষম ক্ষম অপরাধ, দাসের পানে একবার চাও হে দয়াময় \
ঝড় তুফানে পড়িয়ে এবার বারে বার ডাকি তোমায় \”আবার, যে যা ভাবে সেই রূপ সে হয় \
রাম, রহিম, করিম কালা
এক আল্লাহ জগৎময় \
লালনের গানের সাথে আমরা রবীন্দ্রনাথের কিছু গানের বিশেষ মিল খুঁজে পাই। এতে ধরে নেওয়া যায় যে, লালন রবীঠাকুরকে প্রভাবিত করেছিলেন। শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের জমিদারির কারণে তাঁর সাথে বাউল গগন হরকরা, গোঁসাই গোপাল, সর্পক্ষেপী বোষ্টমী প্রমুখের সাথে দেখা ও আলোচনা হলেও লালন সাঁইজির সাথে প্রত্যক্ষ কোন যোগাযোগ হয়নি। তবে তিনি লালনের ভক্ত ছিলেন। এ কারণেই রবীন্দ্রনাথ ১৩২২(১৯২৫) সালে প্রবাসী পত্রিকার হারামনি বিভাগে লালনের বিশটি গান প্রকাশ করে তাঁকে সুধী সমাজে পরিচিত করান। রবীন্দ্রনাথের আগে কাঙাল হরিনাথ, উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, সরলাদেবী চৌধুরানী, সুবোধ চন্দ্র মজুমদার প্রমুখ লালনের গান প্রকাশ করলেও রবীন্দ্র প্রকাশনাই তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়। আমরা লালনের অনেক গানের সাথে রবীন্দ্রনাথের গানের সাদৃশ্য খুজে পাই। আসলে লালন সাঁইজির জীবন জিজ্ঞাসা রবীন্দ্রনাথকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন–
ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে
ও বন্ধু আমার।
না পেয়ে তোমার দেখা,
একা একা দিন যে আমার কাটে নারে।
লালন আগেই গেয়েছেন–
আমার ঘরের চাবি পরের হাতে
কেমনে খুলিয়া সে ধন দেখব চক্ষেতে।
লালন তার দেহতাত্ত্বিক ভজন এ বলেছেন–
আমার এ ঘরখানায় কে বিরাজ করে।
আমি জনম ভর একদিন দেখলাম না রে \
নড়ে চড়ে ঈশান কোণে
দেখতে পাইনে এই নয়নে
হাতের কাছে যার ভরের হাটবাজার
আমি ধরতে গেলে হাতে পাইনে তারে \
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একই ভাষায় ভিন্নভাবে খুবই জনপ্রিয় এই গানটি লিখেছেন–
আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাইনি
তোমায় দেখতে আমি পাইনি।
বাহির-পানে চোখ মেলেছি, আমার হৃদয় পানে চাইনি।
লালন-মানসের একটি প্রধান দিক হচ্ছে ‘আত্মতত্ত্ব’ অনুসন্ধান। নিজেকে জানবার, চিনবার কথা বারংবার তার বহু গানে বিধৃত হয়েছে। ‘কে কথা কয় রে দেখা দেয় না’, আমি একদিনও না দেখিলাম তারে’, ‘আপন ঘরের খবর নে না’, ‘আমি কি তাই জানলে সাধন সিদ্ধ হয়’, এসব গানের বাণীর ভেতর দিয়ে আমরা তিনি যে ‘আত্মতত্ত্ব’ অনুসন্ধানের অপার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছেন তা বুঝা যায়।
বর্তমান অস্থিরতার বিশ্বে মানব প্রেমের অমর সাধক কবি লালন শাহ এর মরমি বাণীর মর্ম ধ্বনি যদি আমাদের হৃদয়ে ধারণ করি, তবেই আমরা হানাহানিময় এ জগৎ সংসারে কিছুটা হলেও শান্তির পরশ অনুভব করতে পারবো। তিনি যেমন আমাদের শান্তির সুমহান বাণী দিয়ে গেছেন, তেমনি শুধু ধর্মের বেড়াজালে আটকে না থেকে মানুষকে ভালোবেসে তার ভেতরে নিজেকে প্রবেশ করানোর এক অমিয় ঐশিবাণীরূপে তাঁর সঙ্গীত সুধা আমাদের প্রাণের পিপাসা নিবারণ করছে। যার কারণেই তিনি তাঁর অনুসারী ভক্তক‚লের কাছে সাঁইজি উপাধি পেয়েছিলেন। আর লালনের বাণী যখন আমরা গভীর মনোনিবেশে আত্মস্থ করি, তখন মহান এই সাধকের প্রতি শ্রদ্ধায় আমাদের হৃদয় বিগলিত হয়।
পরিশেষে এ কথা বলতেই হয়, মানবধর্ম-লোকধর্মের মরমি সাধক লালন শাহ মানুষকে ভালোবেসে আপন করার যে মানবপ্রেম, মানবধর্মের বাণী প্রচার করে গেছেন; আমরা যদি সঠিক অর্থে তা আত্মস্থ করি, তাহলে আজকের নানান বিভেদ থেকে মুক্তি পেয়ে শান্তির কিছুটা পরশ পেতে পারি।
তথ্যসূত্র :
১. ড. এস.এম. লুৎফর রহমান, লালন-জিজ্ঞাসা, ধারনী সাহিত্য-সংখ্যা, ঢাকা; ১৯৮৪।
২. ড. আবুল আহসান চৌধুরী, লালন শাহ, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, পুনর্মুদ্রণ; ১৯৯২।
৩. ড. খোন্দকার রিয়াজুল হক, মরমী কবি লালন শাহ : জীবন ও সঙ্গীত, বাংলা একাডেমি, ঢাকা; ১৯৯৯।
৪. ওয়াকিল আহমদ, লালন গীতি সমগ্র, বইপত্র, ঢাকা; ২০০৫।
৫. লালন শাহ বহুমাত্রিক মূল্যায়ন, সম্পাদনা : মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান, চয়ন প্রকাশন, ঢাকা; ২০১৭।