বাংলা গল্পসাহিত্য রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের কাল পেরিয়ে উত্তরোত্তর নতুন ও ব্যতিক্রমী ধারায় দিনে দিনে এগিয়েছে রবীন্দ্রোত্তর কালপর্বে। ব্রিটিশের ঔপনিবেশিক শাসনের নিষ্পেষণে সময়টা ছিল বিবর্ণ। সে সময়ের মানুষের অন্তর্লোক ছিল গল্পে ঠাসবুনানো। বাংলা গদ্যের অন্যতম সেরা কথাসাহিত্যিক নরেন্দ্রনাথ মিত্র(১৯১৬–১৯৭৫) সে সময়ের মানুষের অন্তর্লোকের ঠাসবুনানো গল্পকেই নিজের অর্ন্তদৃষ্টি দিয়ে নিজস্ব ঘরানায় গল্পের আকারে উপস্থাপন করেছেন।
বাংলা সাহিত্যে মানিক, বিভূতি, তারাশঙ্কর — এই ত্রি-বন্দ্যোপাধ্যায়সহ নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র কিংবা সুবোধ ঘোষ যতটা আলোচিত, তার চেয়ে নরেন্দ্রনাথ মিত্র বেশি বৈ কম আলোচনার দাবি রাখেন না।
তাঁর জন্ম ১৬ মাঘ, ১৩২৩ বঙ্গাব্দ (৩০ জানুয়ারি, ১৯১৬) অধুনা বাংলাদেশের ফরিদপুরে। ভঙ্গা হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন, ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজ থেকে আই-এ । বি-এ পাশ করেন বঙ্গবাসী কলেজ থেকে । লেখালেখির সূচনা বাল্যকালে। প্রথম মুদ্রিত কবিতা ‘মূক’, প্রথম মুদ্রিত গল্প ‘মৃত্যু ও জীবন’। দুটোই ‘দেশ’-পত্রিকায়, ১৯৩৬ সালে। বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য ও নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে একত্রে প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘জোনাকি’ (১৩৪৫ বঙ্গাব্দ)। প্রথম গল্প-সংগ্রহ ‘অসমতল'(১৩৫২ বঙ্গাব্দ) । প্রথম উপন্যাস ‘হরিবংশ’, গ্রন্থাকারের নাম ‘দীপপুঞ্জ'(১৩৫৩ বঙ্গাব্দ)। গল্পগ্রন্থ প্রায় পঞ্চাশটি । উপন্যাস, বিশেষত, ‘দীপপুঞ্জ’, ‘চেনামহল’, ‘তিন দিন তিন রাত্রি’ ও ‘সূর্যসাক্ষী’, দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশকাল থেকেই দারুনভাবে সমাদৃত । চলচ্চিত্রে রূপায়িত বহু রচনার কয়েকটি, সত্যজিৎ রায়ের ‘মহানগর’, অগ্রগামীর ‘হেডমাস্টার’, ‘বিলম্বিতলয়’; রাজেন তরফদারের ‘পালঙ্ক’ । ‘রস’ গল্পটির হিন্দি চলচ্চিত্রের নাম ‘সওদাগর’। ১৯৬২ সালে তিনি আনন্দ পুরস্কার পান। প্রয়াণ ১৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৫ সালে ।
বাংলা ছোটগল্প পরিমণ্ডলে নরেন্দ্রনাথ মিত্র অনেকটাই অনালোচিত-অনালোকিত। অথচ তাঁর গল্পের বিষয় ও কাঠামোগত বিন্যাস বাংলা ছোটগল্প তো বটে, বিশ্ব ছোটগল্পের প্রতিদ্বন্দ্বী। পাঠককে নিমগ্নচিত্তে গল্পপাঠে মুগ্ধতার সাথে ধরে রাখার এক অসামান্য শিল্পশক্তির আধার তাঁর গল্পমালা। শুধু সংখ্যা বিচারে চার শতাধিক গল্পের শিল্পী-স্রষ্টা মাত্র তিনি নন; তিনি প্রচুর ভালো গল্প লিখেছেন। বাংলা ছোটগল্পের ইতিহাসে তাঁকে নিয়ে ক্ষুদ্র পরিসরের আলোচনা ছাড়া আর কোথাও তিনি উল্লেখযোগ্য ভাবে উপস্থাপিত নন। কিংবদন্তীতুল্য নরেন্দ্রনাথ মিত্রের গল্প নিয়ে স্বতন্ত্র পর্যায়ের বিস্তরায়তন আলোচনা হতে পারে। ৫১টি গল্পগ্রন্থ এবং ৩৮টি উপন্যাসের সার্থক কারিগর তিনি। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন সহ অনেকেই তাঁর রচনাকে চলচ্চিত্রে রূপ দিয়েছেন। তাঁর অনেক গল্পই হিন্দি, মারাঠি, রুশ, ইংরেজি, ইতালীয় ভাষায় অনুদিত হয়েছে। কর্মজীবনে অনেক ঘাত-অভিঘাত শেষে তিনি আনন্দবাজার পত্রিকায় যোগদান করেন এবং আমৃত্যু সেখানে কর্মরত ছিলেন। ফরিদপুরের ভাঙা উপজেলার সদরদি গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। দেশ বিভাগের পর তিনি কলকাতায় স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেন। আর তাঁর বাংলাদেশে আসা হয়নি।
নরেন্দ্র মিত্র ‘চাঁদমিঞা’, ‘কাঠগোলাপ’, ‘চোর’, ‘রস’, ‘হেডমাস্টার’, ‘পালঙ্ক’, ‘ভুবন ডাক্তার’, ‘সোহাগিনী’, ‘আবরণ’, ‘সুহাসিনী তরল আলতা’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য গল্পের স্রষ্টা । তাঁর প্রায় পাঁচ শত গল্পে অর্থনৈতিক-সামাজিক-মানসিক টানাপড়েন থাকলেও এক পর্যায়ে গল্পগুলো হয়ে উঠেছে মানব মানবীর জীবনের গল্প।
নরেন্দ্র মিত্রের লেখা গল্প উপন্যাসের উপর আলোচনা করার আগে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের উপর আলোচনা করা যেতে পারে। আগেই বলা হয়েছে তাঁর প্রথম মুদ্রিত কবিতা ‘মূক’, প্রথম মুদ্রিত গল্প ‘মৃত্যু ও জীবন’ দুটোই ‘দেশ’ পত্রিকায় ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত হয়। বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য ও নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে একত্রে প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘জোনাকি’ (১৩৪৫ বঙ্গাব্দ)। প্রথম গল্প-সংগ্রহ ‘অসমতল’ (১৩৫২ বঙ্গাব্দ)। প্রথম উপন্যাস ‘হরিবংশ’, গ্রন্থাকারের নাম ‘দীপপুঞ্জ’ (১৩৫৩ বঙ্গাব্দ)। গল্পগ্রন্থ প্রায় পঞ্চাশটি। উপন্যাসের মধ্যে বিশেষত, ‘দীপপুঞ্জ’, ‘চেনামহল’, ‘তিন দিন তিন রাত্রি’ ও ‘সূর্যসাক্ষী’, দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশকাল থেকেই দারুন ভাবে সমাদৃত। চার দশক ধরে প্রায় পাঁচশো গল্প লিখেছেন তিনি। তাঁর লেখা গল্প সংকলনগুলো হল ‘অসমতল’,‘হলদে বাড়ি’,‘চড়াই- উৎরাই’,‘বিদ্যুতলতা’,‘সেতার’,‘ উল্টোরথ’,‘পতাকা’ ইত্যাদি।অন্যদিকে তাঁর লেখা অন্যান্য উপন্যাসগুলো হচ্ছে ‘রূপমঞ্জরী’,‘অক্ষরে অক্ষরে’, ‘দেহমন’, ‘দূরভাষিণী’, ‘সঙ্গিণী’, ‘অনুরাগিণী’, ‘সহৃদয়া’, ‘গোধুলি’, ‘শুল্কপক্ষ’, ‘চোরাবালি’, ‘পরস্পর’, ‘জলপ্রপাত’, ‘কণ্যাকুমারী’, ‘সুখ দুঃখের ঢেউ’, ‘প্রথম তোরণ’, ‘তার এক পৃথিবী’, ‘সেই পথটুকু’, ‘নীড়ের কথা’, ‘নতুন ভূবন’, ‘জলমাটিরগন্ধ’, ‘শিখা’, ‘অনাত্মীয়া’, ‘নতুন তোরণ’, ‘সূর্যমুখী’, ‘সিঁদূরে মেঘ নির্বাস’ ইত্যাদি।
আমরা নরেন্দ্র মিত্রের ছোটগল্পগুলোর মাঝ থেকে সর্বাপেক্ষা পাঠকপ্রিয় ছোটগল্প ‘রস’ এর উপর স্বল্প পরিসরে আলোকপাত করতে পারি।
‘রস’ তাঁর এক অনবদ্য সৃষ্টি। গল্পটি নিয়ে বহু নাটক, টিভি সিরিয়াল ও চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। হিন্দি চলচ্চিত্র ‘সওদাগর’-এ দুনিয়াখ্যাত অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন অভিনয় করেছেন। নরেন্দ্র মিত্রে নিজের কথা থেকেই উপলব্ধি করা যায় তিনি তাঁর নিজের দেখা ঘটনাপ্রবাহকে গল্পের আকারে রস গল্পে তুলে এনেছেন। এ গল্পে তিনি তাঁর পরিচিতদেরেকে সুপরিচিত করে তুলেছেন, তিনি এ গল্প সম্বন্ধে যা বলছেন, তা থেকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি।
গল্পমালা -১ এর ভূমিকায় ‘রস’ গল্প সম্বন্ধে নরেন্দ্র মিত্র বলেছেন, ‘এ গল্পের যে পটভূমি তা আমার খুবই পরিচিত। পূর্ববঙ্গে আমাদের গ্রামের বাড়িতে পূর্বদিকে ছিল একটি পুকুর। সেই পুকুরের চারধারে ছিল অজস্র খেজুর গাছ। ছেলেবেলা থেকে দেখতাম আমাদের প্রতিবেশী কিষাণকে সে সব খেজুর গাছের মাথা চেঁছে মাটির হাঁড়ি বেঁধে রাখত। বাঁশের নল বেয়ে সেই হাঁড়িতে সারারাত ধরে ঝির ঝির করে রস পড়ত। সেই রস কড়াইতে করে, বড় বড় মাটির হাঁড়িতে করে জ্বালিয়ে গুড় তৈরি করতেন আমাদের মা-জেঠীমারা। শীতের দিনে রস থেকে গুড় তৈরির এই প্রক্রিয়া মায়ের পিঠের কাছে দাঁড়িয়ে থেকে রোজ দেখতাম। আমাদের চিরচেনা এই পরিবেশ থেকে ‘রস’ গল্পটি বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু রসের যে কাহিনী অংশ; মোতালেফ, মাজু খাতুন আর ফুলবানুকে নিয়ে যে হৃদয়দ্বন্দ্ব, খেজুর রসকে ঘিরে রূপাসক্তির সঙ্গে যে জীবিকার সংঘাত তা কোন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে আসেনি। সেই কাহিনী আমি দেখিওনি, শুনিওনি। তা মনের মধ্যে যেন আপনা থেকেই বানিয়ে বানিয়ে উঠেছে।’
গল্পকার তার গ্রামে দেখা একটা সাধারণ ঘটনাকে অবলম্বন করে উঁচুদরের শিল্পোত্তীর্ণ, রস সমৃদ্ধ ‘রস’ গল্পটি রচনা করেছেন। এ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র আছে মোতালেফ গাছি। সে নারী বিলাসী প্রেমিক পুরুষ হলেও জীবন ও যৌবনের চাহিদা মেটানোর জন্য নানান কৌশল অবলম্বন করতে সে কসুর করেনি।
আমরা তার রস গল্পের সারাংশ তুলে ধরে মূল গল্প থেকে আংশিক উদ্ধৃতি দিতে পারি নরেন্দ্র মিত্রে সৃজনশীলতা ও পরিচিত গল্পকে সুপরিচিত আঙ্গিকে রূপদানের ক্ষমতাকে বুঝানোর জন্যে। তাঁর ‘রস’ গল্পের শুরুটা এমন:
‘কার্তিকের মাঝামাঝি চৌধুরীদের খেজুরগাছ ঝুড়তে শুরু করল মোতালেফ। তারপর দিন-পনেরো যেতে-না-যেতেই নিকা করে নিয়ে এল পাশের বাড়ির রাজেক মৃধার বিধবা স্ত্রী মাজু খাতুনকে। পাড়াপড়শি সবাই অবাক। এই অবশ্য প্রথম সংসার নয় মোতালেফের। এর আগের বউ বছরখানেক আগে মারা গেছে। তবু পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের জোয়ান পুরুষ মোতালেফ। আর মাজু খাতুন ত্রিশে না-পৌঁছলেও তার কাছাকাছি গেছে। ছেলেপুলের ঝামেলা অবশ্য মাজু খাতুনের নেই। মেয়ে ছিল একটি, কাটিখালির সেখেদের ঘরে বিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ঝামেলা যেমন নেই, তেমনি মাজু খাতুনের আছেই-বা কী? বাক্স-সিন্দুক ভরে যেন কত সোনাদানা রেখে গেছে রাজেক মৃধা, মাঠ ভরে যেন কত ক্ষেত-খামার রেখে গেছে যে তার ওয়ারিশি পাবে মাজু খাতুন। ভাগের ভাগ ভিটার পেয়েছে কাঠাখানেক, আর আছে একখানি পড়ো পড়ো শণের কুঁড়ে। এই তো বিষয়-সম্পত্তি, তারপর দেখতেই-বা এমন কী একখানা ডানা-কাটা হুরির মতো চেহারা। দজ্জাল মেয়েমানুষের আঁটসাঁট শক্ত গড়নটুকু ছাড়া কী আছে মাজু খাতুনের যা দেখে ভোলে পুরুষেরা, মন তাদের মুগ্ধ হয়।’
মাজু খাতুনকে বিয়ে করার পাড়া প্রতিবেশী মহিলারা মোটেই খুশি নয়। তারা মনে করে দজ্জাল স্বভাবের মাজু তুকতাক করে মোতালেফ গাছিকে বশ করেছে। মোতোলেফের ইচ্ছে ছিল কম বয়সী একটা মেয়েকে বিয়ে করার, সে চেষ্টাও কিন্তু কম করেনি। কিন্তু অল্প বয়সী একটা মেয়েকে বিয়ে করতে অনেক পয়সা কড়ি দরকার। চরকান্দার এলেম শেখের আঠার-উনিশ বছরের মেয়ে ফুলবানুকে মোতালেফ এর বেশি মনে ধরেছিল। কিন্তু ফুলবানুকে পাওয়ার জন্য তার বাবাকে অনেক টাকা দেওয়া লাগবে, তার সে কোথায় পাবে! তবুও ফুলবানুকে পাওয়ার জন্য সে কম চেষ্টা করেনি।আমরা আবার নরেন্দ্র গল্প থেকে উদ্ধৃত দিতে পারি।
‘ইতোমধ্যে অবশ্য এক হাত ঘুরে এসেছে ফুলবানু। খেতে-পরতে কষ্ট দেয়, মারধর করে — এসব অজুহাতে তালাক নিয়ে এসেছে কইডুবির গফুর সিকদারের কাছ থেকে। আসলে বয়স বেশি আর চেহারা সুন্দর নয় বলে গফুরকে পছন্দ হয়নি ফুলবানুর। তালাক নেয়া হলেও ‘চেকনাই ও জেল্লা’ দেহ আর রসের ঢেউ খেলা মন মোতালেফকে টেনেছে বিশেষভাবে; ‘ফরসা ছিপছিপে চেহারা’ আর ‘ঢেউ খেলানো টেরিকাটা বাবরিওয়ালা’ খেজুর রসের কারবারি মোতালেফকেও চোখে ধরেছে ফুলবানুর ।’
ফুলবানুকে বউ হিসাবে পাওয়ার জন্য টাকা দিতে না পেরে মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে মোতালেব ফুলবানুর বাবার কাছ থেকে বাড়ি ফেরার সময় পথে জঙ্গলের ধারে মুখোমুখি হয় ফুলবানুর । ফুলবানু মোতালেফকে বলে-
‘কী মেঞা, গোসা কইরা ফিরা চললা নাকি?… পছন্দসই জিনিস নেবা, বাজানের গুনা, তার দাম দেবা না?… শোনো, বাজানের মাইয়া টাকা চায় না, সোনাদানাও চায় না, কেবল মান রাখতে চায় মনের মাইনষের। মাইনষের ত্যাজ দেখতে চায়, বুঝছ ?’ মোতালেফ ফুলবানুকে ঘরে তোলার জন্য ব্যাকুল। জানায় : ‘শীতের কয়ডা মাস যাউক, ত্যাজও দেখাব, মানও দেখাব। কিন্তু বিবিজানের সবুর থাকবেনি দেখবার ?’
ফুলবানুর কথা শোনার পর থেকে মোতালেফ মরিয়া হয়ে ওঠে ধারকর্জ করে টাকা জোগাড় করতে। কিন্তু ধারকর্জ সে পায় না। কিন্তু সে ফুলবানুকে পাওয়ার জন্য হাল ছাড়ে না। মোতালেফ গাছির প্রত্যাশা পূরণের জন্যই যেন খেজুর গাছগুলো উন্মুখ হয়ে উঠে। যুবতী নারী লোভী রস আহোরণকারী মোতালেফের ভাগ্যে যেন সুদিন আসার আভাস দেখা দেওয়ার কথা নরেন্দ্র মিত্রের কলমে কীভাবে উঠে এসে আমরা দেখতে পারি।
‘কিন্তু নগদ টাকা ধার না-পেলেও শীতের সূচনাতেই পাড়ার চার-পাঁচ কুড়ি খেজুরগাছের বন্দোবস্ত পেল মোতালেফ। গত বছর থেকেই গাছের সংখ্যা বাড়ছিল, এবার চৌধুরীদের বাগানের, অর্ধেক তার। মেহনত কম নয়, এক-একটি করে এতগুলো গাছের শুকনো মরা ডালগুলো বেছে-বেছে আগে কেটে ফেলতে হবে। বালিকাচার ধার তুলে-তুলে জুতসই করে নিতে হবে ছ্যান। তারপর সেই ধারালো ছ্যানে গাছের আগা চেঁছে চেঁছে তার মধ্যে নল পুঁততে হবে সরু কঞ্চি ফেড়ে। সেই নলের মুখে লাগসই করে বাঁধতে হবে মেটে হাঁড়ি। তবে তো দেড়কুড়ি গাছ বেশি হল। গাছ কেটে হাঁড়ি পেতে রস নামিয়ে দিতে হবে। অর্ধেক রস মালিকের রাতভরে টুপটুপ করে রস পড়বে সেই হাঁড়িতে। অনেক খাটুনি, অনেক খেজমৎ। শুকনো শক্ত খেজুরগাছ থেকে রস বের করতে হলে আগে ঘাম বের করতে হয় গায়ের। এ তো আর মা’র দুধ নয়, গাইয়ের দুধ নয় যে বোঁটায় বানে মুখ দিলেই হল।’
কথাসাহিত্যিক নরেন্দ্র মিত্র তার চিরচেনা দৃশ্যপট থেকে আহরিত অনুসন্ধানী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে তার রস গল্পে নারীর মন ও শরীর থেকে পুরুষের রস সংগ্রহের কলাকৌশল তুলে ধরেছেন। একজন গাছিকে খেজুর গাছের শক্ত মাথা থেকে রস সংগ্রহ করতে পরিশ্রান্ত হতে হয়। নিয়মকানুন মেনে খেজুর গাছের মাথায় বাঁধা হাড়িতে সারারাত টুপটাপ শব্দ করে রস পড়ে হাড়ি রসে পূর্ণ হয়।
খেজুর রসের কারবারি মোতালেফের ওস্তাদ রাজেক মৃধা। মোতালেফ রাজেক মৃধার কাছ থেকে খেজুর গাছের শুকনো মাথা ‘ছ্যানদা’ দিয়ে কেটে রস বের করার দক্ষতা অর্জন লাভ করে। রাজেকের কয়েকজন শাগরেদের মধ্যে মোতালেফই পাকা সফল গাছি হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করে। রাজেক মরার পর তার স্ত্রীকে ঘরের বউ করে আনার পেছনে একটা বড়সড় কারণ ছিল। খেজুর গাছ কেটে রস জোগাড় করলেই তো গুড়, পাটালি তৈরি হয় না। মোতালেফে মা মরেছে তার দু’বছর বয়সের সময়। বউটাও অকালে, এখন কে রস জ্বাল দিয়ে গুড় পাটালি বানাবে?
মোতালেফের রস জ্বাল দেওয়ার জন্য মাঝ বয়সী বিধবা মাজু খাতুনকে পেয়ে পয়সার বিনিময়ে রস জ্বাল দেওয়ার ব্যবস্থা করে। কিন্তু রস বা গুড় সামান্য হলেও চুরি করার সন্দেহে তাকে দিয়ে পুরোটা শীতকাল কাজ করায় না। তারপরও সে মজুরি হাঁকে প্রায় দ্বিগুণ। এবার মোতালেফের ভিন্ন ফঁন্দি আটে। ভণিতা না করেই মোতালেফ সরাসরি মাজুকে বলে সে মজুরি প্রদান নয়, ষোলআনা লাভের মালিক বানাতে চায়; বিয়ে করে ঘরের বউ করে নিয়ে যেতে চায়। সামনে রসের সময় আসছে। মাজুর মতো আঁটসাঁট মেয়েমানুষ তার প্রয়োজন। তা না হলে এত গাছের এত এত রস সামাল দেবে কে? তবে, মাজুর সামান্য আপত্তি এ জন্য যে, জগতে যুবতী মেয়ে থাকতে মধ্যবয়সী মাজুকে তার কী দরকার? এমন প্রশ্নের জবাবে মোতালেফ বলে :
‘কমবয়সী মাইয়া-পোলা অনেক পাওয়া যায়। কিন্তু শত হইলেও তারা কাঁচা রসের হাঁড়ি।… তুমি হইলা নেশার কালে তাড়ি আর নাস্তার কালে গুড়, তোমার সাথে তাগো তুলনা?’ নারী-ভুলানো কৌশল আর নারীর মাদকতা ও মিষ্টত্ব বিষয়ে সতর্ক মানুষ মোতালেফ। এমন ‘খাপসুরৎ’ আর ‘মানানসই কথা’র লোক — রসিক-সমর্থ পুরুষ মানুষ, তাকে অগ্রাহ্য করে কী করে মাঝবয়সী মাজু? কাজেই শুরু হলো নতুন এক ‘ভাঙাচোরা-জোড়াতালি-দেওয়া’ সংসার! — যেখানে ঝানু খেলোয়াড় মোতালেফ ‘সঙ’ আর পুরুষের আশ্রয়প্রত্যাশী চিরায়ত বাঙালি নারী মাজু হলো ‘সার’। এখন রস-আসবার কাল। শীতের প্রহর। রাতে শরীরের গন্ধ ও উষ্ণতা নেয়ার সময়! খেজুর গাছ আর রস; রস আর মেয়েমানুষ — সব মিলিয়ে শীতের প্রহরই বটে! ব্যস্ত মোতালেফ। দিনে-রাতে মাজু বিবির কোনো অবসর নেই। ‘এর-ওর বাগান থেকে, জঙ্গল থেকে, শুকনো পাতা ঝাঁট দিয়ে আনে ঝাঁকা ভরে ভরে, পলো ভরে ভরে, বিকেলে বসে বসে দা দিয়ে টুকরো টুকরো করে শুকনো ডাল কাটে জ্বালানির জন্যে। বিরাম নেই, বিশ্রাম নেই, খাটুনি গায়ে লাগে না, অনেকদিন পরে মনের মতো কাজ পেয়েছে মাজুবানু, মনের মতো মানুষ পেয়েছে ঘরে।’
মোতালেফ তার কারবারের জন্য মাঝ বয়সী মাজুকে বিয়ে করলেও তার মনের মতো বউ না পেয়ে মোতালেফ কিন্তু খুশি নয়। কারণ, তার মন জুড়ে ছিল যুবতী নারী ফুলবানু। তাকে বিয়ে করার জন্য দরকার টাকা, আর সেই টাকা জোগাড় করার জন্যই খেজুর রস থেকে গুড় বানানোর জন্যই সে আপাতত মাঝবয়সী মাজুকে বিয়ে করেছে।
তার প্রয়োজন ‘রসের মানুষ’ — যুবতী নারী! মাঝবয়সী শাশুড়ি হয়ে-যাওয়া মাজুকে দিয়ে তার বেশিদিন চলে কি? এক সময় গুড় বিক্রি টাকা থেকে ফুলবানুকে বিয়ে করার জন্য তার বাবা এলেমের হাতে অগ্রিম পঞ্চাশ টাকা গুঁজে দেয় মোতালেফ। তবে, মাজুকে বিয়ে করে ফেলায় এলেমের আপত্তি। কিন্তু মোতালেফ জানায়:
‘তার জন্যে ভাবেন ক্যান্ মেঞাসাব। গাছে রস যদ্দিন আছে, গায়ে শীত যদ্দিন আছে মাজু খাতুনও তদ্দিন আছে আমার ঘরে। দক্ষিণা বাতাস খেললেই সব সাফ হইয়া যাবে উইড়া।’ ফুলবানুর বাবা খুশি হয়; ফুলবানুও। তবে, ‘রসে ভরপুর’ নারী ফুলবানু খানিক গোসা করার ভান করে বলে : ‘বেসবুর কেডা হইল মেঞা? এদিকে আমি রইলাম পথ চাইয়া আর তুমি ঘরে নিয়া ঢুকাইলা আর-একজনারে।’
মাসদুয়েকের মধ্যেই ফুলবানু মোতালেফ নতুন বউ মাজুবানুর গন্ধ এবং তার পুরনো স্বামীর গায়ের গন্ধ ভুলে গিয়ে নতুন রসের সন্ধানে মিলিত হলো। মাজুবিবির স্বভাব-চরিত্র ভার না এই অভিযোগে তাকে তালাক দিয়ে মোতালেফ ফুলবানুকে ঘরে তুলল। মিথ্যা অপবাদ নিয়ে মোতালেফের ঘর ছেড়ে যাওয়ার আগে মাজু বলল:
‘তোমার গতরই কেবল সোন্দর মোতি মেঞা, ভিতর সোন্দর না। এত শয়তানি, এত ছলচাতুরী তোমার মনে! গুড়ের সময় পিঁপড়ার মতো লাইগা ছিলা, আর যেই গুড় ফুরাইল অমনি দূর দূর।’
রসের কারবারী মোতালেফ যৌবনবতী ফুলবানুকে বিয়ে করে ঘরে তুলে দু’দিক থেকেই লাভবান। ফুলবানুর পূর্ণ্ যৌবনের রস ও খেজুর গাছের রস উপভোগ করে মোতালেফের অবস্থা রমরমা। জৈবিক চাহিদা পূরণের জন্য মোতালেফ মাজু বিবির সঙ্গে প্রতারণা করে ফুলবানুকে লাভ করলেও তার নতুন বউ ফুলবানুর কাছ থেকে কাম রস আহরণ করতে পারলেও দিনের আলোয় রস জ্বাল দিয়ে গুড় বানানোর বিষয়ে ফুলবানুর অভিজ্ঞ না থাকায় এদিক থেকে তেমন সুবিধা পায় না ফুলবানু থেকে। নারী ও রসের বিষয়ে মোতালেফের চোখ প্রখর হলেও ভালো সংসারী যে সে নয়, তার খানিকটা পরিচয় আমরা পাই গল্পকারের কহিনিতে। শুধুমাত্র শরীর দিয়ে সংসার চলে না — তাতে সোহাগের দরকার পড়ে সত্যি, কিন্তু তাই বলে ঘর সংসারকে সাজিয়ে তোলার জন্য উভয়কেই একজোট হয়ে কাজ করতে হয়।
এদিকে মোতালেফের কাছ থেকে তালাক পেয়ে মাজু কিন্তু নিরাশ্রয় ভাবে থাকতে পারে না, তারও একটা আশ্রয়ের প্রয়োজন হয়। মাজু পুনরায় বিয়ের পিঁড়িতে বসতে চায়, তবে এবার সোয়মী নির্বাচনে সে সতর্ক। রসের সঙ্গে কিছুমাত্র যার সম্পর্ক নেই, শীতকালের খেজুরগাছের ধারেকাছেও যে যায় না, নিকা যদি বসে মাজু খাতুন তার সঙ্গেই বসবে। রসের ব্যাপারে মাজু খাতুনের ঘেন্না ধরে গেছে। সে কম বয়সী পুরুষকে আর বিশ্বাস করতে পারে না, বিশ্বাস নেই যৌবনকে। শেষমেশ সে পঞ্চাশোর্ধ্ব এক মাঝবুড়োকে বিয়ে করে।
মাজুর মতো অনাথা মেয়েমানুষ বিপদের সময় মোতালেফের পাশে দাঁড়িয়েছিল কিন্তু সুসময়ে তাকে তাড়িয়ে দেওয়ায় বিধাতা যেন মোতালেফের প্রতারণাকে মেনে নিতে পারেননি। যৌবনের তাড়নায় মোতালেফ রসে ভরা যুবতী ফুলবানুকে বিয়ে করার পর মোতালেফ গাছির ঘরে কিন্তু শান্তি যেন আসেনি। এক সময় তার খেজুর গুড়ের কারবার লাটে ওঠে। সৌখিন শাড়ি পরা যুবতী ফুলবানু রসের সৌয়ামীর অপেক্ষায় প্রহর গোনে সেই ফুলবানুকে দিয়ে রস থেকে বাজারে-চলা গুড় বানানো হয়ে ওঠে কী করে! এ কারণেই গুড়ের ব্যবসা, বছর ঘুরতেই লাটে ওঠে মোতালেফের। সংসারে শুরু হয় অশান্তি, যা শেষমেশ মারামারি-গালাগালিতে পৌঁছে।
এক সময় মোতালেফের মন খারাপ হয়। সে নিজের ভুল বুঝতে পারে। মাজুর জন্য যেন তার মন কাঁদে। তার মন চায় মাজুর কাছে ছুটে যেতে। তাই সে একদিন মাজুর নতুন স্বামী নাদির মিঞার বাড়িতে ছুটে যায়। সঙ্গে নেয় রসের হাঁড়ি তাকে খাওয়ানোর জন্য নয়।
মাজু রস জ্বাল দিয়ে খানিকটা গুড় তৈরি করে দিক, সে গুড় অজানা হাটে অচেনা খদ্দেরের কাছে বিক্রি করে মোতালেফ তার হারানো গুড়ের সুনাম ফেরাতে চায়। অতিথি হিসেবে নাদিরের কাছে মোতালেফ সমাদর পায়, কিন্তু ক্ষোভে-লজ্জায় অপমান করতে উদ্যত হয় মাজু। তারপরও কথা থাকে। প্রকৃতির নিয়ম বড় বিচিত্র! ভেতরে ভেতরে বোধ করি মোতালেফের জন্য মাজুরও মন কাঁদে। ভালবাসা মরে না তাই নরেন্দ্রনাথ মিত্র তার ‘রস’ গল্পটির কাহিনী শেষ করছেন এভাবে :
গলাটা যেন ধরে এল মোতালেফের। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে আরো কী বলতে যাচ্ছিল, বাখারির বেড়ার ফাঁকে চোখে পড়ল কালো বড় বড় আর দুটি চোখ ছলছল করে উঠেছে। চুপ করে তাকিয়ে রইল মোতালেফ আর কিছু বলা হল না। হঠাৎ যেন হুঁশ হল নাদির শেখের ডাকে, ‘ও কী মেঞা, হুঁকাই যে কেবল ধইরা রইলেন হাতে, তামাক খাইলেন না, আগুন যে নিবা গেল কইলকার।’ হুঁকোতে মুখ দিতে দিতে মোতালেফ বলল, ‘না মেঞাভাই, নেবে নাই’।’
কথাশিল্পী নরেন্দ্র মিত্র ‘রস’ গল্প ছাড়াও আরো গল্পে বাংলার পরিচিত কাহিনিকে সুপরিচিত করে তুলেছেন।