মোস্তাফিজ ফরায়েজী
সস্পাদক, দর্পণ ম্যাগাজিন
মোস্তাফিজ ফরায়েজী

আর্নেস্ট হেমিংওয়ে এবং ছয় শব্দের গল্প

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

বিখ্যাত মার্কিন ঔপন্যাসিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে একবার একজনের সাথে বাজি ধরেছিলেন ছয় শব্দে গল্প লেখার জন্য। হেমিংওয়ে সেই গল্পটি লিখে দশ ডলার বাজিতে জিতে নিয়েছিলেন।

 
গল্পটির বঙ্গানুবাদ করলে গল্পটি ছিল এরকম—
 
‘বিক্রির জন্য: বাচ্চাদের জুতো। সম্পূর্ণ অব্যবহৃত।’
 
যদিও উপরোক্ত ঘটনার কোনো তথ্যপ্রমাণ আজও পাওয়া যায়নি। তবে সময়ের সাথে সাথে ছয় শব্দের গল্পের জনপ্রিয়তা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে ঘটানাটি অনেকের কাছেই মিথের মতো হয়ে গেছে।
 
ছয় শব্দের গল্পের কাঠামো খুব সরল। থাকতে হবে ছয়টি শব্দ। সেই ছয়টি শব্দ হতে পারে এক লাইনে, দু লাইনে… এমনকি গল্পে থাকতে পারে ছয় লাইনও। কিন্তু একটি স্বার্থক ছয় শব্দের গল্প লেখা কখনোই সহজ কাজ নয়।
 
আর্নেস্ট হেমিংওয়ে একবার বলেছিলেন, তার জীবনের সেরা কাজ হচ্ছে ‘ছয় শব্দের গল্প’। একবার ভেবে দেখুন, কেন প্রতাপশালী একজন ঔপন্যাসিক তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাসসমূহকে ফেলে রেখে একটিবারের জন্য হলেও কথাটি বলতে গেলেন?
 
যাই হোক, আর্নেস্ট হেমিংওয়ের স্বার্থক ছয় শব্দের গল্পের পর এটি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির কেউ অবকাশ পাননি; বরং অবাক হয়েছেন, শ্রদ্ধা করেছেন হেমিংওয়ের ছয় শব্দের গল্পকে। বর্তমানের কথা না বললেই নয়, এখন তো ছয় শব্দের গল্প মুখে মুখে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পাতায় পাতায়।
 
কিন্তু মোদ্দাকথা হচ্ছে, এখনো কেউ কেউ ছয় শব্দের গল্পকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চান। ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানে ২০০৮ সালে ইংরেজ সাহিত্য সমালোচক নিকোলাস লিজার্ড একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন, তার শিরোনাম ছিল ‘Six words can’t tell good stories’ যার অর্থ ‘ছয়টি শব্দে ভালো গল্প বলা যায় না’। কিন্তু নিবন্ধটি অনলাইনে প্রকাশ হবার পর পরই ছয় শব্দের গল্পে ভরে যায় মন্তব্যের জন্য নির্ধারিত স্থান। ছয় শব্দের গল্পের জনপ্রিয়তা এখন এমনই।
 
কিন্তু কেন? কী ছিল হেমিংওয়ের গল্পে? ছয় শব্দে হেমিংওয়ে কী বুঝাতে চেয়েছেন? কেন সেটি একটি স্বার্থক গল্প? কেন তার গল্পসূত্র পরবর্তীতে এতো জনপ্রিয় হল। এটি বুঝতে হলে আপনার অনুধাবন শক্তি প্রবল হওয়া প্রয়োজন। আইনস্টাইন বলেছিলেন, ‘তুমি যদি কোনোকিছু সহজভাবে ব্যাখ্যা না করতে পারো, তাহলে তুমি সেটা বুঝতে পারোনি।’ আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ছয় শব্দের গল্প পাঠককে কল্পনার জগতে প্রবেশ করিয়েছেন, যেটা হয়ত একটা উপন্যাসের স্বাদের চেয়েও বেশি। তাই হেমিংওয়ের এই গল্পটিকে অনেকে ছয় শব্দের উপন্যাসও বলে থাকেন। আপনি যদি এর মাহাত্ম্য না বুঝতে পারেন তাহলে এটি নিছক ছয়টি শব্দ, কিন্তু যদি বুঝতে পারেন তবে এটা মহাসমুদ্রের মতো। 
 
এবার ভাবনার জগৎ প্রসারিত করুন। গল্পটি পুনরায় পড়ুন- ‘বিক্রির জন্য: বাচ্চাদের জুতো। সম্পূর্ণ অব্যবহৃত।’ কী? কিছু পেলেন? নাকি গল্পটাকে শুধুমাত্র একটা নিছক বিজ্ঞাপনই মনে হচ্ছে আপনার কাছে? যদি এটাকে আপনার কাছে বিজ্ঞাপন মনে হয়ে থাকে তাহলে আপনাকে স্বাগতম। কেননা, আপনি সঠিক পথেই আছেন। এবার ভাবুন, এই বিজ্ঞাপনটি কে দিতে পারে? একজন জুতো ব্যবসায়ী? তা হতে পারে, তবে তখন গল্পটিকে মেকি মনে হবে। এবার ভাবুন, বিজ্ঞাপনদাতা সদ্য শিশু হারানো কোনো এক মা। ভাবুন, বিজ্ঞাপনদাতা হারিয়ে যাওয়া সন্তানের শোকে শোকার্ত কোনো এক মা। ভাবুন, বিজ্ঞাপনদাতা গর্ভে সন্তান নষ্ট হয়ে যাওয়ায় শোকার্ত এক মা। ভাবুন, বিজ্ঞাপনদাতা দরিদ্র কোনো এক বাবা যে তার সন্তানের জন্য জুতো কিনে ক্ষুধার তাড়নায় জুতোটি বিক্রির বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন। অথবা ভাবুন, বিজ্ঞাপনদাতা সন্তান জন্ম দিতে ব্যর্থ কোনো এক দম্পতি। এবার থামবেন? নাহ, আপনি চাইলে আরও ভাবতে পারেন। আরও গল্পের ভুবন ঘুরে আসতে পারবেন ছয় শব্দের উপর ভ্রমণ করেই। ছয় শব্দের গল্প প্রবাহমান নদীর স্রোতের মতো। আপনি যত ভাববেন, তত আপনি অবাক হবেন। আপনার ভাবনা শেষ হবে না, তবু যে কোনো উপায়ে ভাবনা শেষ করে পুনরায় আপনি হেমিংওয়ের ছয়টি শব্দের দিকে তাকান। আপনি দগ্ধ হবেন, ব্যথিত হবেন, বলে উঠবেন— অসাধারণ!


ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu