দর্পণ ডেস্ক
একটি পূর্ণাঙ্গ ম্যাগাজিন। শিক্ষা, সাহিত্য ও গবেষণামূলক ম্যাগাজিন দর্পণ। ২০১৯ সালে ব্যতিক্রমধর্মী ম্যাগাজিন দর্পণ তার যাত্রা শুরু করে। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে দর্পণ "গল্পবাজ" ম্যাগাজিন আত্তীকরণ করে।
দর্পণ ডেস্ক

সংস্কৃতি বিকাশের ক্রমান্বয়িকতা: উন্নততর সভ্যতার উত্থান, সাহিত্যের ভূমিকা – সরদার মোহম্মদ রাজ্জাক

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

(প্রথম পর্ব)

মানুষের জীবন প্রবাহের সঞ্চালনগত পদ্ধতির বিন্দু থেকে বৃত্ত পর্যন্ত প্রতিটি স্তর থেকে তার পারিপার্শ্বিকতার বিশাল ক্যানভাসে যার স্পষ্ট এবং বিশুদ্ধ প্রতিফলন সত্যিকার অর্থে তাই-ই তো সংস্কৃতি। এবং তাই যদি সংস্কৃতি হয় তাহলে তো তাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি পূর্ণাঙ্গতা হিসেবে বিবেচনা করা অবশ্যই একটি অনিবার্যতা এবং সেই অনিবার্যতার কার্যকারিতা মানুষের সার্বিক চিন্তা প্রবাহ, মননশীলতা, সৃজনশীলতার ধংসাত্মক প্রবণতাসহ পরিপূর্ণ চৈতন্যতায় প্রবলভাবে ক্রিয়াশীল। আর এই ক্রিয়াশীল বলেই সংস্কৃতি শুধুমাত্র বিপুলই নয় পুরোপুরি সুবিপুল। সংস্কৃতিতে কেন্দ্রীভূত যেমন উত্থান এবং পতন ঠিক তেমনি প্রাণের সঞ্চার এবং মৃত্যুর বীভৎসতা– অথচ এর মধ্য দিয়েই বিচলন বিভিন্ন প্রকারের বস্তুনিষ্ঠতার স্বাভাবিকতা এবং এ স্বাভাবিকতার সূত্র ধরেই প্রচণ্ড বাস্তবতার নিরিখে মানুষে মানুষে সম্প্রীতি পাশাপাশি বিভেদ, প্রতিদ্বন্দিতা, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা আর জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের প্রবল প্রবণতা, বিজয়ের দুর্নিবার স্পর্ধা সমাজ বির্বতনের ক্রম বিকাশমান ধারার একটি বিশেষ স্তরে এসে এ আকাঙ্ক্ষার উত্থান অবশ্যম্ভাবী।

মার্কসীয় দৃষ্টিকোণ থেকে শ্রমবিভাগ, ব্যক্তিগত মালিকানা এবং সামাজিক অসাম্য থেকে শ্রেণী সমূহের অনিবার্য উদ্ভবের মতো কমিউনিজমের আওতায় সেগুলোর বিলোপও অনিবার্য বটে। এখন এই শ্রেণীসমূহ বলতে অত্যন্ত সহজ অর্থে আমরা কী বুঝবো? মার্কসের যুক্তি তত্ত্বে ধনিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে বিত্তহীনদের উত্থান এবং আন্দোলন, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে নিম্নশ্রেণীর সাধারণ মানুষের সংগ্রাম যা অবশ্যম্ভাবীরূপে ঘটেছিল আমাদের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের নিগূঢ় গভীরতায় এবং ক্রমান্বয়িকভাবে যা ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়েছিল অর্জনের একেবারে শেষ প্রান্তে। আমরা পেয়েছিলাম একটি বিশুদ্ধ অর্জন মহান স্বাধীনতা।

এখানে প্রসঙ্গক্রমে ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের কয়েকটি বিশেষ উক্তি যা তার গভীর চিন্তাস্রোতের গভীরতর গুরুত্ব থেকে উৎসারিত বলে আমার বিশ্বাস– উল্লেখযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

০১। “রাজনীতির ক্ষেত্রে জনগণ সর্বদাই প্রবঞ্চনা এবং আত্মপ্রবঞ্চনার নির্বোধ শিকারে পরিণত হয়েছে। এবং তা চলতেই থাকবে যতদিন তারা যাবতীয় নৈতিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক বাক্য বিন্যাস ঘোষণা ও আশ্বাসের অন্তরালবর্তী কোন না কোন শ্রেণীর স্বার্থগুলি আবিস্কার করতে না শিখবে।

০২। এটা যুক্তিযুক্ত যে শ্রেণী সংগ্রামকে ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় একটি স্থায়ী উপাত্ত হিসেবে একটি নির্দিষ্ট সংগঠনের জীবন কালে তার প্রতিটি পর্যায়ে একটি বিশেষ ঐতিহাসিক যুগে অভিন্ন প্রভাবশালী উপাত্ত হিসেবে দেখা সঠিক নয়। শ্রেনী সংগ্রামের অসংগঠিত, স্বতস্ফূর্ত ধরণগুলি তার পরিপক্ক উদ্দেশ্যমুখী ধরণগুলির তুলনায় সমাজ রূপান্তরের গতিবেগ ও চারিত্র্যকে অনেক মাত্রায় প্রভাবিত করতে পারে। এক্ষেত্রে বিশেষ রাজনৈতিক রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলির অভাব বা অস্তিত্বের গুরুত্ব সমধিক, যেগুলির দৌলতে বৈরগর্ভ শ্রেণীর আকাঙ্ক্ষাগুলি চরম অবস্থায় এসে পৌঁছায়।

স্বৈরতন্ত্রের পতন এবং বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অভ্যূদয় হলো মানব ইতিহাসের এক যুগসন্ধিক্ষণ। এই শেষোক্ত ব্যবস্থায় পার্লামেন্ট হয়ে ওঠে শাসক শ্রেনিগুলোর আধিপত্য রক্ষার মূল ধরণ– সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বার্থগুলির সংঘাতের মূল মল্লভূমি। অতঃপর বুর্জোয়া গণতন্ত্রের পতন এবং প্রোলেতারিয় গণতন্ত্র দ্বারা এর প্রতিস্থাপন এবং নিজের উপযোগী সমাজ বিকাশের পুঁজিতান্ত্রিক সমাজের আমুল পরিবর্তন সাধনে ইচ্ছুক একটি শ্রেণি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলি উদ্ভবের ফলে বৃহত্তর পরিবর্তনের সূত্রপাত।” – সামন্তবাদ ও রাজনীতি।

এখন উল্লেখিত উদ্ধৃতাংশের মূল কথাই হলো প্রবঞ্চিত, আত্মপ্রবঞ্চিত একটি বিশেষ শ্রেণীর সুগঠিত ঐক্যবদ্ধতা যা নিতান্তই সাধারণ জনগণ দ্বারাই প্রতিষ্ঠিত এবং নিয়ন্ত্রিত এবং সাধারণ জনগণই হলো রাজনীতি, সমাজনীতি এমনকি অর্থনীতির ও সর্বশেষ কথা।
প্রকারান্তরে সার্বিক সংস্কৃতি নির্মাণের মৌলিক উপাদান যাকে কোনো অর্থে এবং কোনো ক্রমেই অস্বীকার করা সম্ভব নয়। আমাদের জাতীয় মুক্তি আন্দোলন এবং বিশুদ্ধ স্বাধীনতা যা একান্ত এবং একনিষ্ঠ প্রমাণ।

প্রখ্যাত দার্শনিক বারট্রান্ড রাসেলের Philosophical Liberalism নিবদ্ধটির প্রথম কথাই হলো–

The rise of liberalism, in politics and philosophy, provides material for the study of a vary general and very important question, namely what has been the influence of political and social circumstances upon the thoughts of eminent and original thinkers, and conversely, what has been the influence of this men upon subsequent political and social developments?

অর্থাৎ রাজনীতি এবং দর্শনে ‘মুক্তিবাদ’-এর উত্থান অত্যন্ত উচ্চাঙ্গের চিন্তাবিদদের চিন্তায় রাজনৈতিক ও সামাজিক পারিপার্শ্বিকতার প্রভাব কতখানি, বিপরীতক্রমে পরবর্তীতে রাজনৈতিক এবং সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সেইসব লোকদের প্রভাব কতখানি, সহজ অর্থে পরবর্তী সামাজিক ও রাজনৈতিক বির্বতনে Eminent and Original thinker -বৃন্দের ভূমিকা কতুটুকু এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক বির্বতনের অনিবার্যতা তাদেরকে কতটুকু প্রভাবিত করতে পেরেছে?

দুটি বিষয় এখানে পাশাপাশি সমান্তরাল– যা প্রয়োজন এবং প্রয়োজন পূরণের ক্ষমতা। প্রয়োজনের সঙ্গে যখন প্রয়োজন পূরণের ক্ষমতা সৃষ্টি হবে ঠিক সেই সন্ধিক্ষণে জন্ম নেবে নতুন একটি সংস্কৃতি যা শাখা প্রশাখায় পত্র পল্লবে পল্লবিত হতে থাকবে ক্রমান্বয়িকভাবে, গড়ে তুলবে নবতর সভ্যতারও।

Selected works from mao tse tung গ্রন্থের Volume-IV G-এ উল্লেখ করা হয়েছে

The peoples liberation army issued a manifesto in October 1947 which stated in part united workers, peasants, soldiers, intellectuals and businessmen, all oppressed classes all peoples organizstion, democratic parties minority nationalities, overseas Chinese and other patriots, from a nation united front, overthrow the dictatorial chiang- kai shek government and establish a coalition government.

স্পষ্টতই এখানে লক্ষণীয় যে বিভিন্ন শ্রেণীভুক্ত বিপুল জনগোষ্ঠিকে একটি বিশেষ রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং তার অধিনায়কের বিরুদ্ধে সেই বিশাল জনগোষ্ঠির আকাক্ষা পূরণে ব্যর্থ হবার কারণেই অত্যন্ত সাবলীলভাবে এবং সুগঠিতভাবে একত্রিত হয়ে চরম আঘাত হেনে সেই সংশ্লিষ্ট অজনপ্রিয় সরকারের পতন ঘটানোর জন্য উদাত্তভাবে আহ্বান জানানো হয়েছে।

অবশ্যম্ভাবীরূপে সাধারণ জনগোষ্ঠীর আকাঙ্ক্ষা পূরণের লক্ষ্যে সামাজিক পরিবর্তনের প্রয়োজনে এখানে আকাঙ্ক্ষা এবং আকাঙ্ক্ষা পূরণের ক্ষমতার প্রথম এবং প্রধান উপাদান– অত্যন্ত সুসংহত ঐক্য একীভূত হতে পেরেছিল বলে বিশাল এক অসাধারণ বিপ্লাবের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের মৌলিক সত্ত্বার একটি নতুন সাংস্কৃতিক সভ্যতার। ১৯৬৯ সালে যা শুরু হয়েছিল আমাদের এ বাংলাদেশে এবং যার চূড়ান্ত পরিণতি কী ঘটেছিল ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর বিশেষ দিন ১৬ তারিখে সকল শ্রেণী, জাতি, গোত্রভুক্ত বিপুল জনগণের সশস্ত্র বিপ্লবের মধ্য দিয়ে জাতির চূড়ান্ত আকাঙ্ক্ষা– মহান স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে, সঙ্গে সঙ্গে উত্থান ঘটেছিল নতুন একটি উচ্চমার্গীয় সংস্কৃতি এবং সভ্যতার। ঔপনিবেশিক চিন্তাধারা এবং সে চিন্তাধারা থেকে উৎসারিত বিভিন্ন অজনপ্রিয় নিপীপড়নমূলক ব্যবন্থাকে আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করে আমরা পেয়েছিলাম একটি আত্মমযার্দাশীল স্বাধীন জাতির মর্যাদা এবং পরিচিতি।

যে মর্যাদা এবং পরিচিতিটি হয়ে উঠেছিলো একটি নবতর সংস্কৃতি এবং সভ্যতার অবিসংবাদিত ধারক এবং বাহক। তাই সর্বশেষ অর্থে সংস্কৃতি অবশ্যই মানুষেরই সৃষ্টি কিন্তু সে সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে আবার মানুষের মধ্যে উন্নততর চিন্তাস্রোতের ক্রমবিকাশ এবং জীবনপ্রবাহের প্রচণ্ড বেগে তাড়িত হয়ে আরও অধিকতর উন্নত জীবন প্রবাহের অনুসন্ধান– যুগ যুগ ধরে যা অবশ্যই ক্রমান্বয়িক এবং যা চিরকালেই চিরন্তন ইতিহাস। যেহেতু সমগ্র জনগোষ্ঠির ঐক্যবদ্ধতা সামষ্টিক জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণের লক্ষ্যে সুগঠিত একটি ঘণিভূত নবতর সংগ্রামের সিংহদ্বার উন্মোচণের সূচনা এবং একই সাথে ওই উন্মোচিত পথ ধরে সকল বিঘ্ন বিপত্তিকে অগ্রাহ্য করে প্রবল গতিতে সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে জন-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের স্বর্ণ-চাবিটিকে নিজেদের আয়ত্বাধীন করে ওই চাবিটির ওপর সকলের সমান অংশীদারিত্বকে প্রতিষ্ঠা করে একটি যুগান্তকারী সংস্কৃতিকে সৃষ্টি করা– যেটি সংস্কৃতি-বিবর্তনের স্বাভাবিক এবং স্বতঃস্ফূর্ত ধারাবাহিকতারই একটি স্বভাবজঃ রূপ এবং যেটি শাশ্বত। যেমনটি সৃষ্টি হয়েছিলো ফরাসী, রুশ, চীন এবং সর্বশেষ বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের নেপথ্যে অভূতপূর্ব গণবিপ্লবের মধ্যে দিয়ে। এর পূর্বে অন্যান্য অনেক রাষ্ট্রে এমন কি আমেরিকাতেও বিপ্লব সাধিত হয়েছিলো কিন্তু সে বিপ্লবগুলি তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনে পুরোপুরি মাত্রায় সফল হতে পারেনি। পূর্ণমাত্রায় সফল হয়েছিলো ফরাসী, রুশ, চীন এবং বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্র সমূহে। যে বিপ্লবগুলির শুরুটি হয়েছিলো ফরাসী বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে। ১৭৭৯ খৃষ্টাব্দের ১৪ জুলাই ফ্রান্সের বাস্তিল দুর্গের পতনের মাধ্যমে ফরাসী জনগণ তাদের সামষ্টিক ঐক্যবদ্ধতার ভেতর দিয়ে তাদের বিপ্লবটিকে সফল করে তুলতে সক্ষম হয়েছিলো। যে কারণে ফরাসী রাষ্ট্রটিকে বলা হয় ‘বিপ্লবের সূতিকাগার’। এই যে বিপ্লব সংঘটনের মধ্যে দিয়ে পরিবর্তন, অথবা অন্য যে কোনো উপায়ে ইতিবাচক পরিবর্তন- এর নেপথ্যে যে বিষয়টি সার্বক্ষণিকভাবে ক্রিয়াশীল সেটি অবশ্যই– ‘প্রয়োজন’।

তবে বিবেচনার বিষয় এটি যে, সকল পরিবর্তনই ইতিবাচক ফল প্রদান করে কিনা? এটি অস্বীকার করবার উপায় নেই যে, সব পরিবর্তনই ইতিবাচক ফল কখনও কখনও প্রদান করে না। যেমন- ১৯১৭ খৃষ্টাব্দের ২৫ অক্টোবর ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের নেতৃত্বে ‘বলশেভিক’- পার্টির মাধ্যমে রুশ জনগণের সামষ্টিক আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে স্বৈরতান্ত্রিক ‘জারতন্ত্র’-কে (রাজতন্ত্র) উৎখাতের লক্ষ্যে যে অসাধারণ বিপ্লবটি সংঘটিত করা হয়েছিলো এবং যে বিপ্লবটির ভেতর দিয়েই মূলতঃ রাষ্ট্রটিতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যে পরিবর্তনটির সূচনা করে সেটিকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো এবং ’৯০-এর দশকে এসে যখন সেই পরিবর্তনটি জনগণের ভাগ্যকে একটি উচ্চতর স্তরে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছিলো ঠিক তখনই অর্থাৎ ১৯৯০-এর দশকেই এসে আবার সেই পরিবর্তনের বিরুদ্ধে ওই সময়ের সোভিয়েত রাষ্ট্রপতি মিখাইল গর্বাচেভ বিশ্বের সবচাইত ক্ষমতাধর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আঁতাত করে মার্কিন প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী মার্কিন এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নিজের দেশের জনগণের ভাগ্য বিপর্যয় ঘটিয়ে রাষ্ট্রটির সর্বময় ক্ষমতা নিজের হাতে কুক্ষিগত করবার স্বপ্নে বিভোর থেকে মার্কিন নীতি নির্ধারকদের মস্তিস্ক প্রসুত ‘প্রেস্ত্রেইকা’ এবং ‘গ্লাস্ত্নস্ত্’- (‘পরিবর্তন’ এবং ‘গণতন্ত্র’)- নামীয় দু’টি ফরমুলা আবিষ্কার করে এবং সে ফরমুলা ক্ষমতার জোরে জনগনের ওপর চাপিয়ে দিয়ে অর্থাৎ তাদের ওপর জোর পূর্বক আরোপ করে যে পরিবর্তনটি করা হলো তা সমাজতন্ত্রকে পুরোপুরি উৎসাহিত করে ‘নিরঙ্কুশ পুঁজিতন্ত্রে’- ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কিছু নয়। এই আরোপিত পরিবর্তনের কারণেই ৯০-এর দশক থেকে এখন পর্যন্ত ‘সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন’– সম্পূর্ণত-ই ‘পুঁজিতান্ত্রিক রুশ ফেডারেশন’। এই পরিবর্তনটিতে প্রকৃত অর্থে দেশটির সামষ্টিক জনগণের মোটেই স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিলো না এবং তাদের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনও এতে ঘটেনি। ফলতঃ জনগণের মঙ্গলের জন্যে ইতবাচক কোনো ফলও বয়ে আনেনি। বরং সে সময় এবং তৎপরবর্তী কিছুকালের মধ্যেই দেশটির অর্থনীতি সম্পূর্ণভাবেই ধ্বংস হয়ে যাবার কারণে জনগণের জীবনে দুর্বিষহ দুর্ভোগের অভিশাপ নেমে এসেছিলো। এবং ধনীদের তুলনায় দরিদ্রের সংখ্যা ১:৩ অনুপাতে বৃদ্ধি পেয়ে তাদেরকে ভিক্ষের থালা হাতে তুলে নিতে হয়েছিলো। একটি পাউরুটির জন্যে সারিবদ্ধ হয়ে দীর্ঘ সারিতে দাঁড়িয়ে থেকেও দিন শেষে রুটিটি না পেয়েই অনেককে প্রতিদিন ফিরে যেতে বাধ্য হতে হয়েছিলো।

১৯১৭ খৃষ্টাব্দের একটি পরিবর্তনের মধ্যমে নতুন করে জনগণের ভাগ্য গড়ে তুলবার যে বিশাল কর্মযজ্ঞটি শুরু হয়েছিলো ১৯৯০ খৃষ্টাব্দের পরিবর্তনে জনগণের ভাগ্য গড়বার সেই প্রক্রিয়াটিকে ধ্বংশ সাধনের মধ্যে দিয়ে আবার জনগণকে দুর্ভাগ্যের অন্ধকারে ডুবিয়ে দেয়া হলো। বর্তমানে আবার ওই দুর্ভাগ্যের পরিবর্তনকে চুরমার করে দিয়ে নতুন আর একটি পরিবর্তনের সূচণা করবার জন্যে সে দেশটির সামষ্টিক জনগণ ঐক্যবদ্ধ হবার প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে হলেও শুরু করেছে। এবং এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে শ্লথ গতিতে হলেও রুশ অর্থনীতি এখন অনেকটাই শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। তাহলে চূড়ান্ত বিশ্লেষণে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, সব পরিবর্তনই সুফল বয়ে আনে না। তবে সামষ্টিক জনগণের অংশ গ্রহনের মাধ্যমে যে পরিবর্তন সাধিত হয় তার সাথে বিশেষ কোনো গোষ্ঠিস্বার্থে আরোপিত পরিবর্তনের তুলনা করা যায় না। যেহেতু একটি অপরটির সম্পূর্ণ বিপরীত চারিত্র্য মণ্ডিত। একটি ইতিবাচক, অন্যটি নেতিবাচক। ইতিবাচক পরিবর্তনে জনগণের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়িত হয়, নেতিবাচক পরিবর্তনে আকাঙ্ক্ষা পরিত্যাক্ত হয়। যেখানে ইতিবাচক পরিবর্তনে মানুষের জীবন যাপন পদ্ধতি হয় ইতিবাচকতার নীরিখে এক রকমের, নেতিবাচক পরিবর্তনে সেই জীবন যাপন পদ্ধতিটিই হয়ে যায় একেবারেই বিপরীত। যেহেতু পরিবর্তনটি হয় গোটা সংস্কৃতির। কিন্তু এই জীবন যাপন পদ্ধতিটি যদি কোনো ব্যক্তি কেন্দ্রিক আবর্তে আবর্তিত হ’তে থাকে সে ক্ষেত্রে কখনই অখণ্ড সংস্কৃতি নির্মিত হবে না। কারণ সংস্কৃতি সব সময়ের জন্যেই সামষ্ঠিক। এ কারণে যে, মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। সমাজ ব্যতীত একক জীবন যাপন করা কোনোভাবেই কোনো স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় হেতু ওই সমাজভুক্ত মানুষগুলির সামষ্টিক সাধারণ জীবন যাপন পদ্ধতিটিই সংস্কৃতি নির্মাণের মূল উপাদান।

সেইহেতু বলা যায় সমাজবদ্ধ সামষ্টিক মানুষের জীবনের গতি প্রকৃতিই সংস্কৃতি পরিবর্তনের মূল শর্ত। কেননা মানুষের জীবন যাপন পদ্ধতি থেকেই সংস্কৃতির উদ্গম এবং বিকাশ। এবং সংস্কৃতির বিকাশমানতার এ পথ বেয়েই ‘সভ্যতা’র উত্থান। গ্রীক সভ্যতা, মিশরীয় সভ্যতা, সিন্ধু সভ্যতাসহ অন্যান্য সভ্যতা যার সন্দেহাতীত প্রমাণ। কেননা ওইসব সভ্যতা তখনই উত্থিত হতে সক্ষম হয়েছে যখন ওইসব রাষ্ট্রের সংস্কৃতি সময় প্রবাহের ভেতর দিয়ে পরিপুষ্টতা লাভ করেছে। পুষ্টিহীন সংস্কৃতি কখনই সভ্যতার জন্মদানে সক্ষম হয় না।

(দ্বিতীয় পর্ব)

সাহিত্য চিরন্তণ জীবনমুখী। কখনই জীবনবিমুখ নয়। জীবনবিমুখ হলে সাহিত্য আর সাহিত্য থাকে না, ভিন্ন কিছু হয়ে যায়। সাহিত্যের ধর্মই সত্যকে ধারণ করা। সাহিত্য সত্যকে ধারণ করে, অসত্যের কোনো স্থান সাহিত্যে নেই। সংস্কৃতি যেহেতু সত্যের একটি নিরঙ্কুশ একক সেইহেতু সাহিত্য সংস্কৃতিকে ধারণ করবে– এটিই স্বাভাবিক। যদিও সাহিত্য সংস্কৃতিরই একটি শাখামাত্র তবুও ওই শাখাটিতেই সাহিত্য সংস্কৃতির পত্র পল্লবকে পল্লবায়নের মাধ্যমে বিকশিত করে। সাহিত্যকে যদি একটি পূর্ণাঙ্গ ‘কাণ্ড’- বিবেচনা করা যায় তাহলে শাখা প্রশাখাগুলি তার সংস্কৃতিরই পত্র পল্লবে শোভিত। পক্ষান্তরে সংস্কৃতিকে যদি একটি পূর্ণাঙ্গ ‘কাণ্ড’- বিবেচনা করা যায় তাহলে সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত, নৃত্য, চিত্রকলা, রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতিসহ যা কিছু আছে সবই তার শাখা প্রশাখায় শোভিত পত্রপল্লব।

সাহিত্য এবং সংস্কৃতি কেউই কারো পরিপূরক নয়। সাহিত্য সংস্কৃতি থেকেই রসদ সংগ্রহ করে তার জীবনায়ণ ঘটায় একইভাবে সংস্কৃতিও তার বহুবর্ণিল অবয়ব নিয়ে সাহিত্যেই আশ্রয় গ্রহণ করে। কেননা দু’টি বিষয়ই মানুষের জীবনাচারজাত। এবং এই জীবনাচারের পরতে পরতে অঙ্গাঙ্গি নিবিড়তায় সম্পৃক্ত বিশাল প্রকৃতির বর্ণ, গন্ধ, সুষূমাকীর্ণ অস্তিত্ব। এখন এই প্রেক্ষাপটে আমরা যদি একেবারে আদি পর্বের দিকে দৃষ্টি না দিয়েও সংক্ষিপ্তাকারে আদি পরবর্তী কাল পর্ব থেকে শুরু করে অতি সাম্প্রতিক কালের বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র তথা জাতির সাহিত্য এবং দর্শন-এর পটভূমির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করবার চেষ্টা করি তাহলে প্রত্যক্ষতার গভীরতায় স্পষ্ট হবে যে, সকল রাষ্ট্রের সংস্কৃতিকেই সেই সব রাষ্ট্র তথা জাতির সাহিত্য এবং দর্শণই ধারণ করে সেই সংস্কৃতির বিশিষ্টতা এবং বার্তাকে অন্যান্য রাষ্ট্র তথা জাতির সম্মুখে উন্মুক্ত করে সংস্কৃতির মর্মবাণীটিকে অতি সহজেই তাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। অতি সহজেই বলা হলো এ কারণে যে,সংস্কৃতি এবং সাহিত্যকে ভৌগোলিক সীমার ভেতর কোনোভাবেই বৃত্তায়িত করা যায় না।

(অত্যন্ত সংক্ষিপ্তাকারে)-খৃষ্টপূর্ব অষ্টম শতকের মহাকবি হোমার (যিনি ‘ইলিয়াড’ এবং ‘ওডিসি’- নামীয় দু’টি মহাকাব্য রচনা করে বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসকে অপার সমৃদ্ধি দান করেছেন)। পরবর্তীতে গ্রীক দার্শনিক সক্রেতিস, প্লেটো, এ্যারিস্টটল থেকে শুরু করে নাট্যকার সফোক্লিস, ইউরিপিডিস, এসকাইলাস, আলবেয়ার কাম্যু, ইবসেন তৎপরবর্তী পশ্চিমা বিশ্বের বৃটিশ সাহিত্যিক জিওফ্রে চসার এবং চসারের পর ‘নবজাগরনের প্রাক প্রস্তুতি পর্ব’-কালের সাহিত্যিক টমাস মুর এবং তৎপরবর্তী শেক্সপিয়ার, বেন জনসন, বোমন্ট ফ্লেচার, ফ্রান্সিস বেকন, এডমন্ড স্পেন্সার, রোমান্টিক যুগে– ওয়ার্ডসওয়ার্থ, এস টি কোলরীজ, শেলী, কীটস, টমাস মুর, চার্লস ল্যাম্ব, স্যার ওয়াল্টার স্কট, জর্জ এলিয়ট, জন স্টুয়ার্ট মিল, জন কীটস, ভিক্টোরীও যুগের- আলফ্রেড টেনিসন, রবার্ট ব্রাউনিং, ম্যাথু আরনল্ড, ফিশ্ট জেরাল্ট, চার্লস ডিকেন্স, জন স্টুয়ার্ট মিল, কার্লাইল, সপ্তদশ শতকের- মিল্টন এবং ড্রাইডেন, উনবিংশ শতাব্দির অসাধারণ জার্মান সাহিত্যিক এবং দার্শনিক জোহান উলফ্গ্যাং ফন গ্যেটে, ওয়াল্ট হুইটম্যান (আমেরিকান কবি), অসাধারণ শক্তি সম্পন্ন চিন্তবিদও সমাজ সংস্কারক ফ্রেডারিক নীট্শে, বিংশ শতাব্দিতে এসে– জন গলসওয়ার্দি, অর্নল্ড বেনেট, সমাসেট মম, টি এস এলিয়ট, ইয়েটস, রবার্ট ব্রিজেস, হপকিন্স, জর্জ অরওয়েল, জর্জ টমসন, উইনস্টোন চার্চিল, ভার্জিনিয়া উলফ, অস্কার ওয়াইল্ড, জর্জ বার্নাড শ, ডি এইচ লরেন্স, ইএম ফস্টারসহ অন্যান্য সাহিত্যিকবৃন্দ, মার্কিন সাহিত্যিক আর্নেষ্ট হেমিংওয়ে এবং আমেরিকা ও লাতিন আমেরিকার গুন্টার গ্রাস, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজসহ উল্লেখযোগ্য সাহিত্যিকের পাশাপাশি পূর্ব ইউরোপ, এশিয়া এবং আফ্রিকার সাহিত্যিক, বিশেষতঃ পূর্ব ইউরোপ এবং এশিয়ার ভেতর সোভিয়েত সাহিত্যিক– ম্যাক্সিম গোর্কি, লিও টলষ্টয়, মিখাইল ফিওদর দস্তয়ভস্কি, আন্তন চেখভ, পরবর্তী কালের বরিস পাস্তারনাক, মিখাইল সলোখভ, আলেকজান্ডার সোলঝিনিৎসিন এবং ভারত উপমহাদেশের বিশেষতঃ ভারতের মহাকবি কালিদাস ও কালিদাস পরবর্তীকালের কবি বিহারী লাল, ঈশ্বর গুপ্ত এবং বিংশ শতাব্দির রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মাইকেল মধুসুদন দত্ত, শরতচন্দ্র চট্টোপাধ্যয, কাজী নজরুল ইসলাম, মানিক বন্দোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় এবং আমাদের দেশের ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, এস ওয়াজেদ আলী, মোতাহের হোসেন চৌধুরী, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক, শামসুর রাহমান, আব্দুল মান্নান সৈয়দ, আল মাহমুদ, হায়াৎ মামুদ, নির্মলেন্দু গুণ, রফিক আজাদ, আলাউদ্দিন আল আজাদ, হুমায়ুন আজাদ, সৈয়দ আলী আহসান, আবুল ফজল, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, সাঈদ আহমেদ, ড. সেলিম আল দীন, ঔপন্যাসিক শওকত আলী, প্রখ্যাত কলামিষ্ট, চিন্তাবিদ এবং সাহিত্যিক মুনতাসীর মামুন, শাহরিয়ার কবির, স্বদেশ রায় প্রমুখ প্রোথিতযশা কবি, নাট্যকার, গল্পকার, ঔপন্যাসিকসহ সকল প্রগতিশীল চিন্তাবিদ, সাহিত্যিকবৃন্দ তাদের স্ব স্ব দৃষ্টিকোণ থেকে স্ব স্ব দেশের তাদের কালের জাতিয় সংস্কৃতিকে তাদের সাহিত্যকর্মে ধারণ করে সারা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে প্রয়োজনে তাদের রচনা সামগ্রীকে ভিন্ন ভাষাভাষীদের কাছে তুলে ধরবার জন্যে সেইসব দেশের মানুষের ভাষায় অনুবাদ কর্মটিও সম্পন্ন করতে হয়েছে। এই ভাষান্তরনের ফলে সাহিত্যের মাধ্যমে একে অপরের সংস্কৃতিকে বোঝার ক্ষেত্রটি শুধু প্রস্তুতই হয়নি বরং প্রসারিতও হয়েছে। যেটি নিঃসন্দেহে একটি সংস্কৃতির সঙ্গে আর একটি সংস্কৃতির ভাব বিনিময়ের মাঝে সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করেছে। এই সেতুবন্ধ সৃষ্টির মূল দায়িত্বটি পালন করছে সাহিত্য। ফলশ্রুতিতে এক দেশের সংস্কৃতি থেকে অন্য দেশের সংস্কৃতির জন্যে প্রয়োজনীয় কিছু থাকলে সেটিকে সে দেশ গ্রহণ করে তাদের সংস্কৃতি ঋদ্ধায়নের মধ্যে দিয়ে তাদের সভ্যতাকে আরও উন্নত করবার নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবার পথকে উন্মুক্ত করেছে। (এখানে প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, উল্লেখিত ব্যক্তিবর্গের রচনাবলী নিয়ে আলোচনা করতে গেলে স্ফীতাকৃতির অসংখ্য গ্রন্থ রচিত হতে পারে। এবং ইতোমধ্যে যা হয়েছেও। সে কারণে বক্ষমান এই অতিক্ষুদ্র-পরিসর আলোচনায় তাঁদের রচনাকর্ম নিয়ে আলোচনা করা উন্মাদের কা- হিসেবেই বিবেচিত হবে। তাই তাঁদের কর্ম সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা প্রদানের চেষ্টা করা হলো মাত্র)।

এখন এখানে দু’টি প্রশ্ন সৃষ্টির অবকাশ প্রাসঙ্গিক–

‘সাহিত্য কী?’ এবং ‘সাহিত্যের কাজটি কী?’

‘……..ভাবকে নিজের করিয়া সকলের করা ইহাই সাহিত্য, ইহাই ললিতকলা। অঙ্গার জিনিসটা জলে স্থলে বাতাসের নানা পদার্থে সাধারণভাবে সাধারণের আছে, গাছপালা তাহাকে নিগুঢ় শক্তিবলে বিশেষ আকারে প্রথমত নিজের করিয়া লয়, এবং সেই উপায়েই তাহা সুদীর্ঘকাল বিশেষভাবে সর্বসাধারণের ভোগের দ্রব্য হইয়া উঠে। শুধু যে তাহা আহার এবং উত্তাপের কাজে লাগে তাহা নহে; তাহা হইতে সৌন্দর্য ছায়া স্বাস্থ্য বিকীর্ণ হইয়া থাকে।’

‘অতএব দেখা যাইতেছে, সাধারণের জিনিসকে বিশেষভাবে নিজের করিয়া, সেই উপায়েই তাহাকে পুনশ্চ বিশেষভাবে সাধারনের করিয়া তোলা সাহিত্যের কাজ।’

‘যে সকল জিনিস অন্যের হৃদয়ে সঞ্চারিত হইবার জন্য প্রতিভাশালী হৃদয়ের কাছে সুর রঙ ইঙ্গত প্রার্থনা করে, যাহা আমাদের হৃদয়ের দ্বারা সৃষ্ট না হইয়া উঠিলে অন্য হৃদয়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠালাভ করিতে পারে না।………….তাহা আকারে প্রকারে, ভাবে ভাষায়, সুরে ছন্দে মিলিয়া তবেই বাঁচিতে পারে; তাহা মানুষের একান্ত আপনার; তাহা আবিস্কার নহে, অনুকরণ নহে, তাহা সৃষ্টি। সুতরাং তাহা একবার প্রকাশিত হইয়া উঠিলে তাহার রূপান্তর অবস্থান্তর করা চলে না; তাহার প্রত্যেক অংশের উপরে তাহার সমগ্রতা একান্তভাবে নির্ভর করে। যেখানে তাহার ব্যত্যয় দেখা যায় সেখানে সাহিত্য-অংশে তাহা হেয়।’

– (তিনটি উদ্ধৃতিই রবীদ্রনাথ থেকে নেয়া )।

এখানে স্পষ্ট যে, সাহিত্য তাই– যা একজনের যে কোনো বিষয়ের ওপর তার চেতনা থেকে উত্থিত সত্যনিষ্ঠ ভাবকে সর্বাগ্রে নিজে আত্মস্থ করে নিয়ে সেই ভাবকে সকলের অন্তরের সম্পদে পরিনত করা। আর সাহিত্যের কাজটিও হলো তাই- যা সাধারণের সম্পদটিকে একান্তই আপনার করে নিয়ে পুনরায় একই পদ্ধতিতে সেই সম্পদটিকে বিশেষভাবে সাধারণের জন্যে উন্মুক্ত করে দিয়ে সাধারণের প্রপঞ্চ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা– যেটি একমাত্র সত্যনিষ্ঠ উপলব্ধ ভাবের প্রসারনের মাধ্যমেই করা সম্ভব। যেহেতু সাহিত্য সব সময়ের জন্যে ভাবগত (Subjective) হবার কারণেই সত্যনিষ্ঠ। অসত্যের কোনো স্থান সাহিত্যে নেই– যা এই রচনার দ্বিতীয় পর্বের শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে।

পানি তৃষ্ণা নিবারণ করে, ধরিত্রীর মৃত্তিকাকে সিক্ত করে ফসল জন্মানোর ক্ষেত্রটিকে উপযোগী করে তোলে। পানি জীবনের অন্য নাম– এসব সবার কাছেই জ্ঞাত বিষয়। এসবের মধ্যে নতুনত্ব অথবা ভাবের কিছু নেই। কিন্তু একজন তৃষ্ণার্ত যখন পানি পান করে এবং সে পানি পান করবার পর তার য়ে ভাব তার অনুভবে অনুভূত হয় অথবা এই পানি পান করাটিই যখন সেই তৃষ্ণার্তকে তার জীবন সঙ্কটে পতিত করে তখন তার যে ভাব তার অনুভবে অনুভূত হয় সেই ভাবের প্রকাশটি যতবারই প্রকাশ করা হোক না কেন সে প্রকাশিত ভাবটি কখনই পুরোনো হবে না। যতবারই ওই তৃষ্ণার্ত ব্যক্তিটি তা প্রকাশ করবে ততবারই ভাবটি নতুন আঙ্গিক নিয়ে সবার কাছে আবির্ভূত হবে। আর সে কারণেই সাহিত্য ভাবগত, বস্তুগত নয়। আর বস্তুগত বিষয়টি জ্ঞানের, ভাবের নয়।

এ প্রেক্ষিতে আর একটি প্রশ্ন অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়– ‘তাহলে সাহিত্যে কি জ্ঞানের কোনো স্থান নেই?’- উত্তরটি হলো– আছে এবং অবশ্যই আছে। যে কোনো বিষয়ে একজন মানুষের চৈতণ্যের গর্ভ থেকে য়ে ভাব জন্ম লাভ করে এবং সে ভাব থেকে যা সৃষ্টি হয় তাই জ্ঞান। কিন্তু জ্ঞান থেকে যা সৃষ্টি হয় তা ভাব নয়। যে সংস্কৃতির কথা আমরা বলে আসছি সেই সংস্কৃতিও ভাবেরই চূড়ান্ত ফল। মূলতঃ সংস্কৃতি একটি ধারণা মাত্র। কিন্তু সে ধারণাটি বিশাল এবং ব্যাপক। মানুষের চৈতণ্যজাত ভাব-সৃষ্ট বোধের অভ্যন্তরে যদি সংস্কৃতির ভাবগত ধারণার জন্ম সম্ভব না হয় তাহলে সংস্কৃতি নির্মানের বিষয়টিও অসম্ভব হয়ে পড়ে। কারণ মানুষের জীবনাচারের পদ্ধতি নির্মানের বিষয়টির পুরোটিই ভাবের অধীন। মানুষ তার ভাবনার পরিমণ্ডলে জীবনাচারের পদ্ধতিটির একটি রেখাচিত্র আগেই অঙ্কন করে নেয়। এবং সেই রেখাচিত্রটিকেই সে তার জীবনাচারের শরীরে প্রয়োগ করে। আর ঠিক তখনই জীবনাচারের পদ্ধতিটি সংস্কৃতির মূল উপাদানের রূপ লাভ করে। আর সাহিত্য সেটিকে ধারণ করে।

জীবনাচার নির্মিতির ক্ষেত্রে মানুষের মননশীলতা, চিন্তবৃত্তি কখনই নিম্নগামীতার দিকে ধাবিত হয না। এটি মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। এ প্রবৃত্তির কারণে মানুষের চিন্তাবৃত্তি উর্দ্ধায়নের দিকেই চিরকাল ধাবমান। মানুষ ইচ্ছে করলেও এটির ব্যতিক্রম ঘটাতে পারে না। এ কারণেই সংস্কৃতি উত্তরোত্তর পরিপুষ্ট হয়, স্বাস্থ্যহীন হয় না, ধ্বংসও হয় না– যদি না সে সংস্কৃতিকে কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ধ্বংস করা হয়। এই ধ্বংস সাধনের বিষয়টিকে এবং এর কার্যকারণকেও সাহিত্য গভীর অনুসন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে উদ্ধার করে নিজের মধ্যে ধারণ করে পুনরায় তা সাধারন মানুষের কাছে উন্মুক্ত করে দেয়। অর্থাৎ সাহিত্যের কাজটিই হলো সাধারণের সম্পদকে নিজের করে নিয়ে আবার তা সাধারণের মাঝেই বিলিয়ে দিয়ে সাধারণের আপনার করে তোলা– যেটিকে রবীন্দ্রনাথ মনে প্রাণে বিশ্বাস করেই তাঁর লেখনীর মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন।

‘জীবনের কল্যাণের জন্য, মানুষের সুখের জন্য এ জগতে যিনি যত কথা বলিয়া থাকেন– তাহাই সাহিত্য।’

‘সাহিত্যে মানুষের সকল আকাঙ্ক্ষার মীমাংসা হয়। তোমার আত্মা হইতে যেমন তুমি বিচ্ছিন্ন হইতে পার না, সাহিত্যকেও তুমি তেমনি অস্বীকার করিতে পার না– উহাতে তোমার মৃত্যু– তোমার দুঃখও অসম্মান হয়।’

‘জাতির জীবনে এই চিন্তার ধারা সৃষ্টি করিয়া দেওয়াই সাহিত্যের সাধনা। মানুষ যদি চিন্তা করিতে না শিখিল, সে কে?– তাহার যদি আত্মবোধ না জন্মিল, তবে ধিক্ তাহার জীবনে। মানুষের ভিতর আত্মবোধ দেওয়াই সাহিত্যের লক্ষ্য।’

‘সাহিত্য-চিন্তা, জ্ঞান ও দৃষ্টি দান করে। চিন্তা, জ্ঞান ও দৃষ্টি ছাড়া শুধু বিশ্বাসে কোন জাতি বাঁচিতে পারে না।’
–(উদ্ধৃতি চারটি মোহাম্মদ লুৎফর রহমান- এর রচনা থেকে গৃহীত)।

উদ্ধৃতি চারটি থেকে একটি বিষয় সন্দেহাতীতভাবে স্পষ্ট প্রতীয়মান যে, সাহিত্যের আকার বিশাল এবং বিস্তৃতি ব্যাপকতর। সাহিত্য চিন্তা করতে শেখায় এবং সে চিন্তা মানুষের মনে ভাবের সৃষ্টি করে। এবং সেই ভাবের নির্যাস আশ্রয় গ্রহণ করে বোধে এবং সে বোধ থেকে যা সৃষ্টি হয় তাই-ই জ্ঞান। আর এই ভাবের নির্যাসলব্ধ বোধের ভেতরেই যে সংস্কৃতির উদ্গম- তা অস্বীকার করবার কোনো উপায় নেই। এবং সংস্কৃতিকে ধারণ করবার একক ক্ষমতাটিও সম্পূর্ণতই সাহিত্যের অধিভুক্ত। সে প্রেক্ষিত বিবেচনায় সংস্কৃতিকে পরিপুষ্ট করে স্বাস্থ্যবান করে তোলার দায়িত্বটিও পরোক্ষভাবে আপনা আপনিই সাহিত্যের ওপরই এসে বর্তায়।

এখন ‘সভ্যতা‘- সৃষ্টি এবং সে সভ্যতাকে উন্নততর অবস্থানে উন্নীত করণের দায়িত্বটি কার? সংস্কৃতির নাকি সাহিত্যের? প্রশ্নটির মর্মমূলকে দুভাগে বিভাজিত করে উত্তরটির অন্বেষণ করলে প্রাপ্তিটি কিছুটা সহজ হতে পারে বলে বোধকরি–

০১. ‘প্রাথমিক’ এবং
০২. ‘পরবর্তী’

প্রাথমিক স্তরে অবশ্যই সংস্কৃতির। দ্বিতীয় স্তরে সাহিত্যের। প্রাথমিক স্তরে অবশ্যই সংস্কৃতির এ কারণে যে, ‘সভ্যতা’- শব্দটির অন্তরেই নিহিত রয়েছে ‘পরিবর্তন’- শব্দটি। এবং যে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন সাধনের প্রথম এবং শেষ শর্তটিই হলো ‘প্রয়োজন’– যা এ রচনার প্রথম পর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। প্রয়োজন ছাড়া কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব হয় না। আর নেতিবাচক পরিবর্তন জনগণের মঙ্গলে আসে না হেতু সেটি পরিত্যাজ্য। যেহেতু নেতিবাচক পরিবর্তন সব সময়ই আরোপিত। আর আরোপিত পরিবর্তনে সামষ্টিক জনগণের অংশগ্রহণ থাকে না এবং তাদের আকাঙ্ক্ষার পরিপূরক হিসেবে কাজ করে না। সেই হেতু আরোপিত পরিবর্তন কোনো পরিবর্তনই নয়। এখন এই ইতিবাচক প্রযোজনটিই যে সংস্কৃতি নির্মানকে অনিবার্য করে তোলে এতে কোনো সন্দেহই নেই।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে প্রয়োজনের প্রশ্নে–
‘দুটি বিষয় এখানে পাশাপাশি সমান্তরাল– যা ‘প্রয়োজন’ এবং ‘প্রয়োজন পূরণের ক্ষমতা’। শুধু প্রয়োজন অনুভূত হলেই হবে না, অনুভূত প্রয়োজন পূরণের ক্ষমতাটিকেও মানুষকে অর্জন করতে হবে। উপলব্ধ প্রয়োজনের বিষয়টিকে যখন পূরণের ক্ষমতা দিয়ে বাস্তবায়িত করা হবে ঠিক সেই সন্ধিক্ষণে জন্ম নেবে নতুন একটি সংস্কৃতি– যা শাখা প্রশাখায় পত্র পল্লবে পল্লবিত হ’তে থাকবে ক্রমান্বয়িকভাবে। এই ক্রমান্বয়িক ধারাবাহিকতার সর্বশেষ স্তরে এসে সংস্কৃতি গড়ে তুলবে একটি নবতর সভ্যতাকে।’ এই সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত হবার পর সংস্কৃতিও পরিবর্তিত হ’তে থাকবে সভ্যতার প্রয়োজন অনুযায়ী।

এখন এই বিশ্বাসে বিশ্বাসী থেকে অনিবার্যভাবে বলতে হবে– প্রয়োজনের অনিবার্যতা থেকেই প্রয়োজন পূরণের ক্ষমতাটির সৃষ্টির পথটিও নির্দেশিত হবে মানুষের চিন্তাশীলতাশ্রিত বোধ থেকে। এবং এই ক্ষমতার মাধ্যমে সৃষ্ট বাস্তবতাই সৃষ্টি করবে সংস্কৃতির এবং সে সংস্কৃতিকে ধারণ করে বিশ্ব পরিমণ্ডলভূক্ত মানব সমাজের কাছে তুলে ধরবে সাহিত্য। তখন অবধারিতভাবে মানুষের চিন্তাশীলতায় আপনা আপনিই স্থান করে নেবে ‘সভ্যতা’- সৃষ্টির বিষয়টি। সভ্যতা সৃষ্টি হবার পরই কেবল সেটিকে প্রয়োজনীয় উন্নততর পর্যায়ে উন্নীত করণের আকাঙ্ক্ষাটি আসবে মানুষের মননে। এর পর আকাঙ্ক্ষাটির বাস্তবায়নকে ত্বরান্বিত করবে সাহিত্য। অর্থাৎ সভ্যতাকে সৃষ্টি করবে ক্রমান্বয়িকভাবে বিকশিত উন্নত সংস্কৃতি এবং সে সংস্কৃতিকে ধারণ করবে সাহিত্য। এবং ধারণ করে সে সংস্কৃতির মর্মবাণীকে বিশ্ব-জনগণের অপনার সম্পদে পরিণত করে নিশ্চিত করবে উন্নততর সভ্যতার উত্থানকে।

‘Now, If the question arises- ‘What is Civilization?’ Certainly the perfect Answer shall have to be, ‘The Civilization is Nothing but a Most Developed Form and shape of a Developed Culture.’ In accordance with this Perspective- Another Question may be raised- ‘what is the Role of Literature?’- Answer- ‘The Role of Literature is to Strengthen the Fundamental Base and Plinth of Civilization.’

তাহলে, বিশদভাবে বক্ষমান গোটা আলোচনাটি বিশ্লেষণ করে স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, উন্নততর সভ্যতার উত্থানকে সম্ভব করে তুলবে উন্নততর সংস্কৃতি এবং ওই সংস্কৃতির মুখ্য বাহন হিসেবে কাজ করে উন্নততর সভ্যতার উত্থানকে ত্বরান্বিত করে সে সভ্যতার ভিতকে অধিকতর শক্তিশালী করে তুলবে সাহিত্য।

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu