নয়ন মাহমুদ
কবি ও কথাসাহিত্যিক
নয়ন মাহমুদ

গল্প পাঠপ্রতিক্রিয়া: জাকির তালুকদারের ‘জঙ্গনামা’

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

গল্প পাঠপ্রতিক্রিয়া: জাকির তালুকদারের ‘জঙ্গনামা’

নয়ন মাহমুদ


(জঙ্গনামা গল্পটি দর্পণের ‘শিশিরভেজা গল্প’ সংখ্যায় ফেব্রুয়ারি ২০২২ সালে প্রকাশিত হয়)

নির্লিপ্ত গ্রামীণ জীবনেও বৈশ্বিক পরিবর্তনের প্রভাব এসে পড়ে। যুদ্ধ অথবা আধুনিক সামগ্রী শুধুমাত্র বাহ্যিক পারিপার্শ্বিকতাকে বদলায় না, মানুষের চেতনার গভীরেও সৃষ্টি করে অন্তর্ঘাত, নিঃসন্দেহে সে-ই পরিবর্তন বহুধা বিস্তৃত। যুদ্ধ পৃথিবীর যে প্রান্তেই সংঘটিত হোক না কেন, নারীদের সম্ভ্রম হানি অবধারিত নিষ্ঠুরতম সত্য হয়ে দেখা দ্যায়। দৈনন্দিন জীবনেও প্রতিনিয়ত নারীদের শিকার হতে হয় নানাবিধ বৈষম্যের। আবার বিয়ে নামক সামাজিক প্রথায় নিজের ইচ্ছাশক্তিকে উপেক্ষা করে নারীকে স্বামী নামক মানুষটির কাছে সঁপে দিতে হয় শরীর। সমাজে ধর্মীয় দ্বন্দ্ব টিকে থাকলেও, নারী সম্ভোগে প্রচলিত ধর্ম কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে না। এক্ষেত্রে রণজিৎ দাশের একটি কবিতা–

‘আমাদের শহরে
প্রত্যেক ধর্মের মানুষদের জন্য
ভিন্ন ভিন্ন দেবালয়;

কিন্তু সকল ধর্মের মানুষের জন্য
একটিই বেশ্যালয়—
কোনো সমস্যা নেই।’

ধর্মান্ধতা ও ক্ষমতা আমাদের জীবনকে ক্রমশ শৃঙ্খলিত ও জটিল করে তোলে। বিশ্বায়ন আমাদের চিন্তার মধ্যে ফেলে গভীরতম ছাপ। ফলে আমাদের মধ্যে জন্মায় বিশ্বাসহীনতা, একাকীত্ব, দুঃস্বপ্ন ও বিষাদ।

পৃথিবীর আদিম মৌলিক কিছু প্রশ্ন। কে আমি? পৃথিবী কোথা থেকে এলো? আমরা কেন বেঁচে আছি? এই প্রশ্নগুলো সহজাত। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে পৃথিবীতে থেকেও বেঁচে থাকার অন্তিম রহস্য আজও আমাদের কাছে অজানা, অনাবিষ্কৃত। রুশ ঔপন্যাসিক তলস্তয় বলেন,

‘আমরা সবাই স্বপ্ন দেখছি, যে বৃদ্ধ বয়সে মৃত্যুবরণ করে, সে পরিপূর্ণ স্বপ্নটি দেখে ফেলে, যে অল্প বয়সে রোগ অথবা দূর্ঘটনার শিকার হয়ে মারা যায়, সে পূর্ণাঙ্গ স্বপ্নটি দেখা থেকে বঞ্চিত হয়, আবার যে আত্মহত্যা করে সে দুঃস্বপ্ন দেখে আৎকে ওঠে।’

জঙ্গনামা গল্পের চরিত্র সোনাভানের জীবনও ঠিক এভাবে স্বপ্ন ও স্বপ্ন বাস্তবতার ভেতর দিয়ে যায়। একটি প্রশ্ন তাকে বারবার তাড়িত করে ‘আলাদা আলাদা জাতের মানুষের আলাদা আলাদা আল্লা আছে কি না?’ দেড় কুড়ি ছয় বছর অর্থাৎ ৩৬ বছরের ব্যবধান: একদিকে মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ ছাপ সোনাভানের মগজে-স্মৃতিতে, প্রাত্যহিক জীবনে পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার নির্মম অভিজ্ঞতা, গ্রামীণ সমাজে আধুনিক সামগ্রীর অনুঃপ্রবেশে বদলে যাওয়া প্রেক্ষাপট, ছেলে রিয়াজুলের বাগদাদে চলে যাওয়া, বুশ ও সাদ্দাম হোসেনের আবির্ভাব, আমেরিকা ও ইরাকের দ্বন্দ্ব, ধর্ম ও ক্ষমতার মিথস্ক্রিয়া এবং অন্যদিকে সবকিছুর ফলে সোনাভানের চেতনার মধ্যে গড়ে ওঠে এক নির্লিপ্ত অবকাশ।

বিস্মিত হতে হয়, গল্পকার জাকির তালুকদারের ‘জঙ্গনামা’ গল্পটির মধ্যে দর্শন, তত্ত্ব, ইতিহাস, বিশ্বায়ন, প্রযুক্তি, গ্রামীণ পটভূমি, নারীবাদী চিন্তা, জাল স্বপ্ন ও স্বপ্নের জাল একীভূত থাকার পরেও কোথাও গল্পটি পাঠ আমাদের বাঁধাগ্রস্ত করে না, ক্লান্ত করে না। গল্পকারের তীক্ষ্ম মন ও মননের বিস্তার গল্পে সজীব প্রাণ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। ইতিহাস আশ্রয়ী ‘জঙ্গনামা’ গল্পটিতে দুর্বোধ্যতা সৃষ্টি মোটেও অস্বাভাবিক ছিল না, অথবা একঘেয়েমির সৃষ্টি হওয়াও ছিল বাঞ্ছনীয়। কিন্তু এখানে গল্পকার সাবলীল শব্দচয়ন, অবচেতন মন ও চিন্তার স্বতঃস্ফূর্ত বিনিময়ের ফলে ‘দুর্বোধ্যতা ও একঘেয়েমি’-র বাঁধা উতরিয়ে গল্পটিকে আমাদের রক্ত ও চেতনার সঙ্গে মিশিয়ে দিতে সমর্থ হন অনায়াসে। এখানেই যেন গল্পকারের মস্ত বড় জিৎ। সংলাপ প্রয়োগে গল্পকার অসাধারণ নৈপুণ্য দেখিয়েছেন। লোভ সংবরণ করতে পারছি না। গল্প থেকেই উদ্ধৃত করছি।

সে কাছে গিয়ে দাঁড়ায়– কন কী করা লাগবি।

জেহাদ! জেহাদ করা লাগবি!

ধুশ! আমি ঐসব মারামারি-কাটাকাটির মধ্যে নাই।

ফজু খোনকার অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে সাবদুলের দিকে তাকায়– মুসলমান হয়া এমন কথা বলতে পারিস!

সাবদুল তাকে বোঝানোর প্রয়াস পায়– আরে যুদ্ধ হচ্ছে হাজার হাজার মাইল দূরে ইরাকে। এই জাগাত বসে আমি-আপনে কী করতে পারে?”

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu