আনিফ রুবেদ
‘পাখিসম্প্রীতি’ মুজিব মেহদীর কবিতা। কবিতাটিতে শুধু পাখি আর মহাত্মা গান্ধী এলেও এর ভাবজলের পাথার আরো গভীর, আরও ঊর্মিল। এ কবিতায় মুখোমুখি হয়েছে মানুষ আর পৃথিবীর বাকিসব জীব। মানুষ আর অন্যজীবের মধ্যে জৈবিক ফারাক তেমন কিছুই নেই। তবু মানুষ অন্যদের থেকে নিজেদের আলাদা করেছে। মানুষ দাবি করেছে, তাদের বুদ্ধি আছে। একথা ঠিক যে, মানুষের বুদ্ধি আছে কিন্তু এ বুদ্ধি কি কাজে লাগালো মানুষ! হিসেব করলে দেখা যাবে, বুদ্ধির বেশিরভাগটাই লগ্নিকৃত লাভ আর লোভকে প্রতিষ্ঠিত করতে, যন্ত্রণা উৎপাদনের গোলা আর বারুদ বাড়াতে। যারা বুদ্ধির এসব নেতিবাচক দিকের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন তাদেরকে আমরা মহৎ, মহান, মহাত্মা বা মহামানব হিসেবে জানি। কিন্তু পাখিদের ক্ষেত্রে এমন নাই; মহাপাখি নাই; মহাহরিণ নাই; মহাসিংহ নাই। এর কারণই হচ্ছে তাদের সরল জীবন, লোভ আর লাভের বাইরের জীবন। কবিতাতে এই সরলজীবন, সহজজীবন, সম্প্রীতিময় জীবনের অভিলাষ ব্যক্ত হয়েছে। আমরা দেখি কাম ও ধর্মের বীজে যে সন্ত্রাসবৃক্ষ জন্ম নেয়, পাখিকুলে তার অস্তিত্ব নেই। কারণ পাখিময় জীবন রতিময় ও ধর্মময় জীবনের উর্ধ্বে উঠা এক সহজ ও সরল জীবন। কবিতায় মুজিব মেহদীর অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টি আমাদের সাম্প্রদায়িক কারিকুরিকে প্রবলভাবে এক প্রলয় ধাক্কা দেয়। মুজিব মেহদীর কবিতার এই দীপ্তময় স্বাতন্ত্র্য বোধের আবাসভূমিকে পাখিময় করে তোলে।
পাখিসম্প্রীতি
পাখিঅভিধানে কোনো ধর্মসংস্কার নেই
শালিকের কামকেলীতে কখনো আহত হয় না
কাকের ধর্মীয় অনুভূতি
পাখিকুলে সন্ধ্যারতি নেই
হিজাব-টিজাব নিয়ে নেই মাথাব্যথা
পাখিসমাজে চাপাতি ব্যবসা জমে না
সহস্র প্রজন্ম গেল পাখিদের
কখনো বাঁধে নি কোনো গুরুতর দাঙ্গা
পাখিপাড়ায় কাজেই কারো মহাত্মা গান্ধী হবার সুযোগ নেই
কবি মাসুদার রহমান খুব ছোট একটা মুহূর্তকে এমনভাবে আঁকেন যে এই মুহূর্তচিত্রটার ভেতরেই মহাকাল নিয়ে ভাবনার অবকাশ থাকে। সমগ্র পৃথিবীর সমস্ত বিষয়কে ব্যাখ্যা করার অবকাশ থাকে। আমার পঠিত কবিতাটির নাম ‘দাম্পত্য’ তেমনই একটি কবিতা। খুব সরল কিন্তু বোধের শাখাপ্রশাখাকে বিস্তৃত করে দেয় বিশ্বব্যাপি সম্পর্কের সাথে সম্পর্কের মূল ব্যাপারটা ধরে নিতে। দাম্পত্য মানব-মানবীর ভেতর একটা সম্পর্ক এটাকে টিকিয়ে রাখার জন্য অথবা সুখিসম্পর্ক করার জন্য যে বিশাল বেদনাকে হজম করার কথা বলা হয়েছে তা অতুলনীয়। জগতের সকল মানুষের সাথে সকল মানুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও যদি মিলিয়ে দেখি তবেও দেখতে পাব, মানুষ সুখি হতে চায় এবং এর বিনিময়ে অনেক বড় কিছুকে ছাড়ও দেয়। মাসুদার রহমানের বোধের সূক্ষ্ণতার নিরিখে তার ভাবনা ও চেতনালোকে যে প্রজ্ঞাময় দৃষ্টির সন্ধান মেলে– এই ‘দাম্পত্য’ কবিতাটিতে তা আমাকে বিমোহিত করে এবং তার কবিতার মূহুর্তচিত্র মস্তিষ্কে অনুরণন ঘটায়। একথা দ্বিধাহীনভাবে বলা যায়, মাসুদার রহমানের কবিতার নিজস্বতা যেন তারই স্বমহিমায় উজ্জ্বল।
দাম্পত্য
ঘুমের মধ্যে কথা বলছে বউ
ঘুরেফিরে বলছে ওর ছেড়ে আসা প্রেমিকের নাম
বলুক না
সে না হয় ঘুমের মধ্যে
আমি তো কেবল ওর জেগে থাকাটুকু
নিয়ে সুখি হতে চেয়েছি
রিগ্যান এসকান্দারের কবিতা ‘কবিদের জন্ম ও মৃত্যুর রহস্য’। খুব পরিচিত একটা মিথকে এতো চমৎকারভাবে তিনি ব্যবহার করেছেন যে চমৎকৃত হতে হয়। মানুষের ভেতর শত শত বছরের ব্যবধানে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল একজন দুজন করে এমন কিছু মানুষের সন্ধান পায়, যারা সমগ্র পৃথিবীর মানুষের জন্য কাঁদে। মানুষের কান্না-ব্যাথা থামানোর জন্য নানা বেদনা তারা নিজেরা ভোগ করে, ভালো থাকার জন্য নানা পথনির্দেশনা দেন তারা। মিথে বলা হয়, এসব মানুষের কাছে ঐশ্বরিক বাণী নিয়ে আসেন জিব্রাইল নামক স্বর্গীয় দূত। কিন্তু এসব মানুষ হাজার বছরে দুবার একবার আসেন। বাকি সময় এই স্বর্গীয় দূত কর্মহীন বসে থাকেন এবং ছটফট করেন। কবি রিগ্যান এসকান্দার কবিতায় বলছেন, সর্বসময় মানুষের জন্য কল্যাণময় বোধ নিয়ে জাগ্রত থাকে কবি এবং মারাও যান এই পৃথিবীতে। কবিদের জন্ম হয় সেসব মায়ের গর্ভে যেসব মায়ের গায়ে সেই স্বর্গীয় দূতের ছটফট করার সময়কার পাখা, ঝটপট করার সময়কার বাতাস এসে লাগে। স্বর্গীয় দূত জিবরাইল তার কর্মময় জীবনে যে কল্যাণ বার্তা নিয়ে হাজির হয়েছিলেন, তার কর্মহীন জীবনেও একই কল্যাণ বার্তা নিয়ে তিনি হাজির হন এই পৃথিবীতে। এই চিত্রের মাধ্যমে মিথের মহাপুরুষদের স্থানে কবি সূক্ষ্ণভাবে বসিয়ে দিয়েছেন কবিকে– এ যেন আরেক মিথেরই জন্ম। এই মিথের রূপকার স্বয়ং কবি নিজেই।
কবিদের জন্ম ও মৃত্যুর রহস্য
নবীর মৃত্যুর পর বেকার হয়ে যায় জিব্রাইল।
জিব্রাইলের খবর আসে না।
জিব্রাইলের বার্তা আসে না।
অথচ পৃথিবীতে এখনো রাতবিরাতে নারী ও শিশু ধর্ষণ হয়,
অথচ পৃথিবীতে এখনো দিনদুপুরে মানুষ খুন হয়।
এসব দুঃখ দেখে চাকরি হারানো স্বর্গের দূত জিব্রাইল ডানা ঝাপটায়,
কাঁদে আর বলে— নবী নাই, আমার প্রিয় নবী নাই।
জিব্রাইলের এই ঝাপটানো ডানার বাতাস
সাত আসমান ভেদ করে পৃথিবীতে আসে।
জিব্রাইলের এই ঝাপটানো ডানার বাতাস
পৃথিবীর কোনো কোনো প্রসূতি নারীর গায়ে এসে লাগে।
তাদের মাতৃজরায়ু তখন এক একটি রক্তাক্ত গোলাপ
জিব্রাইলের ডানার বাতাসে যার পবিত্র পাপড়িগুলো কেঁপে কেঁপে ওঠে।
এইসব প্রসূতি নারীদের পেটে তখন কবির জন্ম হয়।
এইসব কবিদের কথা তখন ওহীর মতো মনে হয়।
অতঃপর এইসব কবিরা যীশুর মতো বেদনা নিয়ে একদা পৃথিবীতেই মারা যায়।