আহমেদ তানভীর
সম্পাদক ও প্রকাশক সাহিত্যপত্রিকা ‘ৎ’ (খণ্ড-ত)
আহমেদ তানভীর

চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের অপূর্ব সময়চিত্র ছোটকাগজ ‘বৃত্তান্ত’

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

“… যখন হতাশার কাসুন্দি। ঠিক তখনই কে যেন ডেকে উঠল ভোরের আজানের মতো। কারা যেন এগিয়ে এল গুটি গুটি পায়। তাকিয়ে দেখি কচি কচি মুখ, কচি কচি হাত-পা, দেহ তো নয় যেন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আগুন। ওরা কারা! ওরা কি দেবদূত নাকি আসমানের ফেরেশতা! কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখি, ফটাফট ছিঁড়ে গেছে হাজার বছরের গোলামির জিঞ্জির। ফেটে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে পাষাণ দেয়াল। সামনে কেবল উদার আকাশ আর শাদা পায়রা কোটি কোটি। …”

ঠিক এভাবেই শব্দছবি তথা সময়ছবি এঁকেছেন সম্পাদক শাদমান শাহিদ। তার সম্পাদিত ছোটকাগজ ‘বৃত্তান্ত’-এর “চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের কবিতা” শীর্ষক সংখ্যার (আগস্ট ২০২৪) সম্পাদকীয় পাঠকালে মানসচক্ষে জ্বলজ্বল করে ওঠে জিঞ্জির ছেঁড়ার প্রতিটি ক্ষণ। সাত ফর্মায় মুদ্রিত একশো ষোলোটি কবিতা কি কেবলই কবিতা! না। এ এক অনবদ্য ইতিহাসের জীবন্ত পোস্টার, সময়কে ধারণ করা এক অপূর্ব দলিল।

“সাঈদ সাঈদ বলে ডেকে ডেকে পাড়া মাত করি,
ও পুত্র, বাপ আমার, ফিরে আয় ফ্যাসিবাদ উৎখাত করি।”

– আবদুল হাই শিকদার

চরণে চরণে এভাবেই উঠে এসেছে চব্বিশের গণহত্যা, গণজোয়ার, বুকে চেপে রাখা জগদ্দলের গোপন স্বর, শিকল ভাঙার গান। আরো কিছু কবিতাংশ উদ্ধৃত করতেই হচ্ছে।

“রক্তের অদ্ভুত এক শব্দ আছে,
যা আমাদের ঘুমুতে দেয় না,
সেই শব্দ কোনোদিন তোমরা পাবে না,
কারণ তোমরা কালো পাহাড়ে হেলান দিয়েছ।”

– নাসরীন জাহান

“রাজপথে গেলে…
আমাদের সন্তানেরা সমুদ্র হয়ে যায়।”

– পারভেজ চৌধুরী

“কথা কইয়ো না’ গান শুনতে শুনতে
যেটুকু কথা হয়-ফিসফিসিয়ে
তাই বাক-স্বাধীনতা।”

– সোহেল হাসান গালিব

“থরথর করে কাঁপছে স্বৈরাচার; শুকনো বোঁটায় ঝুলতে থাকা পাকা
সিঁদুরে আমের মতো দুলছে দুঃশাসন যৌবনের ঝড়ে। এ-কি জীবনের
উন্মাদনা দিকে দিকে! যে ছিল নিষ্প্রাণ, আজ সে জীবন্ত, যে ছিল নিশ্চল,
আজ সে ঝটিকা হয়ে ছুটছে অশ্বের মতো। তাই দেখে মৃত্তিকায় পড়ে থাকা
ঝরা পাতারাও জীবন্ত ফড়িং হয়ে নৃত্য জুড়ে দিয়েছে একসাথে উন্মত্ত বাতাসে।”

– সায়ীদ আবুবকর

“আমি জেগে আছি, আমি জেগে আছি, আমার আসে না ঘুম
বুলেটবিদ্ধ শরীরে আমার আগুনের মওসুম”

– জুলফিকার শাহাদাৎ

এতো উৎকণ্ঠা, এতো মুক্তিতিয়াস! আহা… মানুষের আত্মায় ছড়িয়ে যাওয়া আগুনের গন্ধ ঘুমোতে দেয় না। মানসমুক্তির কাল বুঝি এলো! কতশত রক্তফোঁটায় ফুটতে যাচ্ছে প্রিয় ফুল। বুকভরে শ্বাস নেবো বলে ঘুম আসে না!

“আপনার এই সবকিছু মিথ্যা মনে হবে। ফলে আপনি সাহস করে চোখ পুরো
খুলে ছবিটা দেখতে যাবেন, কিন্তু পারবেন না। কেননা চোখ পুরো খুললে
আপনার নিজেকেই সিমার মনে হবে।”

– ইমতিয়াজ মাহমুদ

“মায়ের কান্নার সুর দূরে শোনা যায়
ক্ষোভের বারুদে জানি আবার জ্বলবে দেশলাই।”

– ফজলুল হক তুহিন

“পাখির হৃদয় দেখো রক্তাক্ত আখ্যান ঘাতকের গুলি খেয়ে বিজয়ের হাসি
সাহসে প্রেরণা আজ উজ্জ্বল মুকুট শ্রদ্ধানত তারাগুলো মৃত্যুর চুম্বন।”

– নিলয় রফিক

“সময় বলছে বন্ধু-
এখন ভয় পাওয়া অপরাধ
এখন ভয় পাওয়া পাপ!”

– তরুন ইউসুফ

“আমাকে যদি সে নিক্ষেপ করে তার নিজস্ব জাহান্নামে, সেখান থেকেও তার
দিকে ছুঁড়ে দেব আপন মাথা, তবুও মাথা নোয়াব না।”

– শামশাম তাজিল

 “হে ফ্যাসিস্ট!
আজ হেঁটে যাব তোমার সিনা বরাবর।
সমস্ত ব্যারিকেড ভেঙে
ঢুকে পড়েছি দেখো নির্ভয়ে।”

– সাইদ উজ্জ্বল

“আমি জানি,
জনতার মিছিল থেকে একটি কবিতা
কীভাবে একটি স্বাধীন পাখি হয়ে উড়ে যায়!
উড়ে যেতে যেতে
কীভাবে পাখিটি রাজার মুকুট নাড়িয়ে যায়।
তাই বলি-
আমি যদি মারা যাই,
যদি আমাকে ওরা গুম করে দেয়
তোমরা আমার কবিতাটিকে মিছিলে নিয়ে যেয়ো।”

– রিগ্যান এসকান্দার

“সবুজ পাখি হয়ে যাওয়া প্রতিটি শিশুর কবর
হবে আজ থেকে আমাদের তীর্থস্থান”

– শাদমান শাহিদ

এরকম আরো আরো কবিতায় কবিরা এঁকেছেন নিখুঁত সময়চিত্র চব্বিশের। প্রতিটি পৃষ্ঠার শব্দেরা কথা বলছে অবলীলায়, কথা বলছে আল নোমানের আঁকা শিহরণ জাগানিয়া প্রাসঙ্গিক প্রচ্ছদটিও। জানান দিচ্ছে এক অভূতপূর্ব ইতিহাস। মহাকালের এই অমূল্য অংশকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দিতে ‘বৃত্তান্ত’-এর সূচনা সংখ্যা তথা “চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের কবিতা” শীর্ষক সংখ্যাটি অতি অবশ্যই সংগ্রহ ও সংরক্ষণযোগ্য। সংকলনটির পাঠবহুলতা একান্তভাবে প্রত্যাশা করি। একই সঙ্গে পবিত্র প্রত্যাশা- ‘বৃত্তান্ত’-এর যাত্রাপথ ও চলনকাল দীর্ঘ হোক। সম্পাদক, লেখক ও প্রচ্ছদশিল্পীসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে অশেষ কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা।

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu