সকালবেলা ড্রাইভওয়ে থেকে গাড়ি বের করার সময় মুন দেখলো বাসার ভেতর থেকে সাইফ বের হয়ে এসে তাকে ডাকছে। মুন গাড়িটা একটু পিছিয়ে জানালার কাঁচ নামালো। সে না রেগে যেতে চেষ্টা করছে, তবুও তার চোয়াল শক্ত হয়ে যাচ্ছে।
কোনোমতে রাগটুকু চেপে বলল, “আচ্ছা তোমাকে না বলেছি বের হওয়ার পর পেছন থেকে ডাকাটা অলক্ষুণে?”
সাইফ ভ্রূ তুলে বলল, “একজন সাইন্টিস্টের মুখে এরকম সুপারস্টিশাস কথা শুনলে আমি আসলে ধাঁধায় পড়ে যাই। এই জন্য আমার ব্রেইন মেমোরি ডিলিট করে দেয়।”
মুনের থিসিস এখনো শেষ হয়নি। নামের আগে “ডক্টর” লাগাতে আরও কয়েক মাস লেগে যাবে। তাই “সাইন্টিস্ট” সম্বোধন শুনেই তার মন গলে গেল।
সে লাজুক হাসি গোপন করে বলল, “বলো তোমার বিশেষ কথা, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
“কালকে রাতের জন্য সরি। জানিনা কেন হঠাৎ এত ওভার রিয়্যাক্ট করেছি। ফোন আছাড় মেরে ভেঙে ফেলেছি, না হলে তোমাকে একটা দীর্ঘ এসএমএস লিখে স্যরি বলতাম। আচ্ছা আমার কথা শেষ হয়েছে, তুমি যেতে পারো।”
“আমিও স্যরি। আসলে ল্যাবে কাজের এত প্রেসার ছিল, এর মাঝখানে তুমি সারপ্রাইজ দিতে চলে এসেছো! কাজের ফ্রাসট্রেশান তোমার উপর ঝেড়ে ফেলেছি, স্যরি।”
সাইফ খেয়াল করলো মুন মাফ চাওয়ার পরও কালকে রাতের কথা ভেবে আবার তার রাগ লাগছে। গত কয় মাস ধরে মুন এতই ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিল যে সারাদিনে তাদের একটা স্বাভাবিক আলাপও হত না। তাই সাইফ সেদিন কাপকেক নিয়ে মুনের ল্যাবে গিয়েছিল। মুন খুবই খুশি হয়ে সবার সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে পুরো রিসার্চ সেন্টার তাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়েছে। এমনকি নতুন নিউক্লিয়ার ফিউল আবিষ্কারের কাজ চলছে যেখানে সেখানেও নিয়ে গিয়েছিল। ল্যাবের সাতজন মানুষ ছাড়া কারও প্রবেশাধিকার নেই রুমটাতে। সেই রুমটা থেকে বের হওয়ার সময় সাইফ হঠাৎ বলল, “আচ্ছা রেটিনা স্ক্যানারের সামনে আমি চোখ রাখলে কি হবে?”
এটুকু বলে সাইফ শুধু স্ক্যানারের দিকে এক পা বাড়িয়েছে, তখনি মুন ধাক্কা মেরে তাকে সরিয়ে দিল। প্রস্তুত ছিলনা বলে ঘটনার আকস্মিকতায় সাইফ মাটিতে পড়ে গেল।
মুন প্রায় চিৎকার করে বলল, “তুমি কি পাগল? তোমার চোখ স্ক্যানারের সামনে রাখলে বিল্ডিং-এ তীব্র শব্দে অ্যালার্ম বেজে উঠবে! পুলিশ এফবিআই সোয়াত টিম দৌড়ে আসবে। দেখা মাত্র কিছু না জিজ্ঞেস করে গুলি করে দেবে!”
সাইফ আত্মরক্ষাবশত হোক কিংবা পড়ে যাওয়ার লজ্জাই হোক, সে খুবই ক্ষেপে গেল, বলল, “ওভার রিয়্যাক্ট করার একটা সীমা আছে! আর এতই যখন সিরিয়াস সিকিউরিটির ব্যপার, তাহলে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছ কেন?”
মুন প্রচণ্ড রেগে বলল, “আমাকে ক্ষমা করো। আমি তোমাকে পৃথিবীর, স্যরি পৃথিবীরও না, মহাবিশ্বের অত্যন্ত দুর্লভ একটা জিনিস দেখাতে নিয়ে এসেছি। আমরা নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টারের জন্য পৃথিবীর বাইরের মৌল যাইফুনিয়াম-২৬৭ এর একমাত্র স্যাম্পল দিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করছি। হাতে গোনা মাত্র কয়েকটা মানুষ এর অস্তিত্ব সম্পর্কে জানে। আমার মাথা খারাপ যে, আমি তোমাকে এই বস্তু দেখাতে নিয়ে এসেছি। হয়তো একটা ওপেন কিচেন রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেলে তুমি এর চেয়ে আগ্রহ নিয়ে দেখতে। যাও তুমি বাসায় যাও। ”
বলেই মুন গটগট করে হেঁটে চলে আসছিল, তখন সাইফ দেয়ালে তার ফোন ছুঁড়ে মেরে ভেঙে ফেলল। এত বাড়াবাড়ি করতে দেখে মুনের দুর্দমনীয় ক্রোধ হলেও সে তামাশার ভয়ে সেখান থেকে চলে এসেছিল।
ল্যাবে যাওয়ার উদ্দেশ্যে মুন মন খারাপ করে গাড়ি চালাচ্ছে। তারা যে ঝগড়া একেবারেই করে না, তা না। কিন্তু গতকাল ঘটনাটা একদমই হাতের বাইরে চলে গিয়েছিল। হিংস্র জন্তু-জানোয়ারের মত ঝগড়াঝাটি করা তাদের কারও স্বভাব না। হয়তো তার বাসায় আরও একটু সময় দেওয়া উচিত। এই এক্সপেরিমেন্টটা খুব সম্ভবত বিফলে যাচ্ছে। এত ডলার, এত দিনের পরিশ্রম, মেধা সবই জলে যাবে। অথচ যখন তাকে এই রিসার্চে কাজের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল, সে দিবাস্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল যে সমস্ত পৃথিবীর বিদ্যুৎ ঘাটতি দূর করে তারা নোবেল বিজয়ের ভাষণ দিচ্ছে। ল্যাবে সবারই মেজাজ খিটখিটে থাকে এই গবেষণা বিফল হওয়ার দুশ্চিন্তার জন্য। এভাবে কাজ করা খুবই যন্ত্রণাদায়ক। তার প্রায়ই মনে হয় সে সবকিছু লাথি মেরে ফেলে দিয়ে নিরুদ্দেশে চলে যাবে।
রাত অনেক হয়েছে। আজকেও কাজ শেষ করতে এত দেরি করে ফেলবে মুন ভাবেনি। হাতঘড়িতে সময় দেখে সে চমকে উঠল। ল্যাব একদম খালি। শুধু ডঃ ওয়াকার মাথা গুঁজে কাজ করে যাচ্ছে। এটা কোন অদ্ভুত দৃশ্য নয়। ল্যাবে তিনিই সবচেয়ে বেশি সময় কাটান, সবেচেয়ে পরিশ্রমী বিজ্ঞানীদের একজন তিনি। নিঃসঙ্গ একজন মানুষ, বাসায় যাওয়ার তেমন তাড়া নেই। মুনের তাকে একা রেখে যেতে অপরাধবোধ হল। সে পেছন থেকে বলল, “ডঃ ওয়াকার, কফি খেতে যাচ্ছি, আপনি খাবেন?”
তিনি মনে হল না মুনের কথা শুনতে পেলেন না। পাওয়ার কথাও না, তার হাতে যাইফুনিয়ামের জারের দিকে তাকিয়ে তিনি কোথাও হারিয়ে গেছেন। গাঢ় নীল মৌল কেমন আভা ছড়াচ্ছে, দেখেই বুঝা যায় এর জন্ম পৃথিবীর কোথাও নয়। কোন এক তারার বুকে নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়ায় জন্ম নিয়ে উল্কা হয়ে পৃথিবীতে ছুটে এসেছে। না জানি কি অস্বাভাবিক ক্ষমতা এর মাঝে লুকিয়ে আছে, এত পরিশ্রমেও তার কিছুই বের করা যাচ্ছে না। মুনের সত্যিই রাগে, হতাশায় চোখে পানি চলে আসলো। জীবনে কিছুতেই ব্যর্থ হয়ে তার অভ্যাস নেই। সে জারটির দিকে এগিয়ে আসতেই হঠাৎ তার মনে হল কোন ক্ষ্যাপা শিকারি কুকুরের মত কেউ গরগর শব্দ করছে। সে আর ডঃ ওয়াকার ছাড়া পুরো ফ্লোরে আর কেউ নেই। মুনের গলা শুকিয়ে আসলো, বলল,“ডঃ ওয়াকার, আপনি ঠিক আছেন তো?”
তিনি ফিরে মুনের দিকে তাকালেন। মুন চাপা আর্তনাদ করে পিছনে সরে গেল, সে স্পষ্ট দেখছে ডঃ ওয়াকারের চোখের মণি প্রতিপ্রভা নীল রঙের-জারের যাইফুনিয়ামের মতো। তার মুখের প্রত্যেকটা শিরা উপশিরা যেন তার চামড়া ভেদ করে দেখা যাচ্ছে। গরগর শব্দের সাথে তার মুখ থেকে লালা বেড়িয়ে আসছে। মুনা দৌড়ে অ্যালার্মের দিকে ছুটে চাওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু ডঃ ওয়াকার হ্যাঁচকা টানে তাকে মাটিতে ফেলে দিল। মুখের ভেতরে কোথাও কেটে গেছে অথচ মুন কোন ব্যথা অনুভব করছে না। ষাটোর্ধ্ব একজন বৃদ্ধের গায়ে এ কেমন হিংস্র জন্তুর শক্তি, মুন হাত-পা ছুঁড়ে কোনভাবেই তার হাত থেকে ছাড়া পাচ্ছে না। মুন চিৎকার করে বলল, “ডঃ ওয়াকার প্লিজ! আপনার রেডিয়েশান পয়জনিং হয়েছে, আপনার এক্ষুনি চিকিৎসা দরকার!”
ডঃ ওয়াকার মুনকে একহাতে ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে টেবিলের কাছে নিয়ে গেলেন। হ্যাঁচকা টেনে ড্রয়ার খুলতেই সেটা ছুটে এসে সব মাটিতে ছড়িয়ে পড়ল। ভারী কয়েকটা যন্ত্র ঝনঝন করে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। এই ধাক্কায় তাঁর হাতের যাইফুনিয়ামের জারটি মাটিতে পড়ে চারিদিকে শত টুকরা হয়ে ছড়িয়ে পড়ল। যাইফুনিয়ামের পাউডার সারা রুমে ছড়িয়ে গিয়ে নিয়ন নীল রঙে ছেয়ে যাচ্ছে দেখে মুন তাঁর ল্যাবকোট টেনে তাড়াতাড়ি নাক মুখ ঢেকে ফেলল। ডঃ ওয়াকার গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে তাঁর মুখ চেপে ধরলেন। এই সুযোগে মন ছুটে রুমের বাইরে এসে কাঁচের দরজা লাগিয়ে দিল। ডঃ ওয়াকারের মুখের ফুলে থাকা শিরাগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে মুহূর্তেই তাঁর সমস্ত শরীর রক্তে ভরে গেল। মুন দৌড়ে বের হয়ে অ্যালার্ম চেপে ধরল। তীব্র শব্দে সাইরেন বাজছে তার সাথে লাল আলো জ্বলছে আর নিভছে। ৯১১-এ ফোন করতে করতে মুনের মনে হল সে কোন অন্তহীন দুঃস্বপ্নে আটকে গেছে। একজন রক্তাক্ত মানুষ মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করছে, চারিদিকে বিষাক্ত তেজস্ক্রিয় নীল পদার্থ আর এর সাথে লাল আলো জ্বলে-নিভে কর্কশ অ্যালার্ম কান ফাটিয়ে বেজেই চলছে।
ডঃ ওয়াকারকে বাঁচানো গেল না। ল্যাব পুরোপুরি বন্ধ করে আশেপাশের এলাকা খালি করে ফেলা হয়েছে। ৭২ ঘণ্টা ধরে নানাবিধ পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে মুনসহ সেই বিল্ডিং এর সবাইকে হসপিটালে আটকে রাখা হয়েছে। এমন ভয়াবহ একটা ঘটনা ঘটে যাবার পর সাইফকে এক মুহূর্ত দেখার জন্য, পরিচিত একটা গলা শোনার জন্য মুনের দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল। যাইফুনিয়াম নিয়ে এতই হৈচৈ পড়ে গিয়েছে যে এই মৌল বিষয়ক সব রকমের পরীক্ষা পরবর্তী নির্দেশ পাওয়ার আগ পর্যন্ত নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এর তেজস্ক্রিয়তা মানুষের মস্তিষ্কে বিশেষ পরিবর্তন নিয়ে আসে যার কারণে তারা হিংসাত্মক, পাশবিক আচরণ করতে শুরু করে। তার অনুভূতিতে কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। ডঃ ওয়াকার সবচেয়ে বেশি সময় এই তেজস্ক্রিয়তায় উন্মুক্ত ছিলেন। যার জন্য তাঁর অবস্থা হয়েছিল সবচেয়ে মারাত্নক।
হাসপাতালের বেডে শুয়ে শূন্য ছাদ দেখতে দেখতে মুনের চোখ লেগে এসেছিল। হঠাৎ চোখ খুলে দেখল তাঁর রুমের দরজায় সাইফ দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর মুখে স্বস্তির হাসি, চোখে বেদনার ছায়া। সে বিছানার দিকে হেঁটে আসতে আসতে বলল, “তুমি তো আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে! তোমার পড়াশুনা থেকে একটু ব্রেক নেওয়া উচিৎ। চলো আমরা দেশ থেকে ঘুরে আসি। ”
“আমারও আর কিছু ভাল লাগছে না। চলো যাই। ”, সাইফ বলল।
মুনের গলা ধরে এলো। তার চোখে পানি দেখে সাইফ দ্রুত এসে তার পাশে বসল। চুলে হাত বুলিয়ে বলল, “কেঁদো না। সব ঠিক হয়ে গেছে তো। তুমি এখন নিরাপদ। আমি কখনোই তোমার কিছু হতে দেব না!”
মুন মুখ তুলে সাইফকে দেখল। হঠাৎ কোন ব্যাখ্যাতীত ক্রোধ তাঁর সমস্ত শরীর গ্রাস করছে, তার তীব্রতা এতই বেশি যে তার গা কাঁপছে, বুক জ্বলছে, দ্রুত নিঃশ্বাস পড়ছে। সাইফের সামনেই সে নিঃশব্দে তার পাশের ট্রে থেকে ধারালো কাঁচি তুলে নিয়েছে।
সাইফের ওদিকে নজর নেই, মুনের চোখের দিকে তাকিয়ে সে বলল, “আশ্চর্য ব্যপার তো! তোমার চোখ নীল দেখাচ্ছে কেন?”