গল্পটি সুইডিশ কবি ও কথাসাহিত্যিক লিন্ডা বসট্রোম কিনসগার্ডের ‘WISH’ গল্পের অনুবাদ। গল্পটিতে অতি চমৎকারভাবে একটি পরিবারের পরিচয় দেওয়া হয়েছে। গল্পটির অনুবাদ করেছেন নয়ন মাহমুদ ।
আমি দীর্ঘদিন যাবত হৃদয়ের গভীরে এক নির্মল ‘বাসনা’ পুষে রেখেছি। না, সেটি অন্য সকলের মতো ‘বাসনা’ নয়, বরং একটু ভিন্ন, আলাদা, ব্যতিক্রম। হ্যাঁ, আমি মনস্থির করেছি, সেই সুপ্ত ‘বাসনা’ সম্বন্ধে তোমাকে আজ বলব। তোমাকে সবিস্তারে শোনাবো হৃদয়ের সেই গহীনের কথা। তাই বর্তমানে তোমায় একজন মনোযোগী শ্রোতা হিসেবে কামনা করছি।
তুমি আমার কাছে এসেছ, সেকারণে আমি চিরকৃতজ্ঞ এবং আনন্দিত। তোমায় বসার জন্য অনুরোধ করছি– দয়া করে বসো।
এবার তাহলে শোনো, আমি আমার নিজের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি। সর্বদা অদৃশ্য এক ভয় গ্রাস করে রাখে আমায়। আমি এখনও আতঙ্কিত, এখনও ভীত। তুমি কি এ বিষয়ে কিছু বলতে পারো? থাক, তোমায় বলতে হবে না। ছোট্ট পরিসরে আমি-ই তোমায় বলছি, তুমি মন দিয়ে শুনে যাও। শোনো আর ওয়াদা করো, তাদের তুমি দেখে রাখবে। তারা মানে– আমার স্বামী এবং সন্তান-সন্ততি। আমি চাই না তাদের সাথে অপ্রীতিকর কোনো ঘটনা ঘটুক। তাদের প্রতি আমার অনিঃশেষ শুভকামনা সবসময়।
তুমি নিশ্চয়ই জানো, আমি কি সম্বন্ধে তোমায় বলছি? আমি আর এদের দেখে রাখতে পারবো না। আমি আর এভাবে বেঁচে থাকতে চাই না। এই যে দেখছো আজ আমি জেগে আছি, হয়তো আমি প্রতিদিন আজকের মতো জেগে থাকতে পারবো না চিরকাল। আমার ভারী মাথাটা নুইয়ে ফেলা প্রয়োজন। আগামীকাল এক নতুন সূর্যের উদয় হবে– নতুন সকাল আসবে। সেই নতুন সকাল হবে স্বচ্ছ এবং উজ্জ্বল। তার ঘুমন্ত শরীর থেকে চলাচল করবে আলো। আর তুমি, হ্যাঁ তুমি, তুমি চিরকালের জন্য সকল অন্ধকার সরিয়ে নেবে।
এদের দেখে রাখা যতটা সহজ ভাবছ, এটা অতটা সহজ হবে না। কিন্তু আমি আশা করি, এটা তোমার সাধ্যের মধ্যে আছে।
আমাকে আমার ছেলেমেয়েদের সম্বন্ধে বলতে দাও। বর্ণনা করতে দাও, যাতে তুমি তাদের চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করতে পারো, কিংবা তুমি তাদের গভীরভাবে জানতে পারো। আমি তাদের যেভাবে চিনি, তুমিও যদি ঠিক সেভাবে তাদের চেনো– আমি হলফ করে বলতে পারি, তুমি ভুলেও তাদের ক্ষতিসাধন করার চিন্তা মাথায় আনবে না।
তারা এখানে। এইতো এখানে, এখানেই আমরা সবাই একত্রে বসে আছি। ডাইনিং টেবিলের চারপাশে তাকাও। দেখো তারা কীভাবে সংগ্রাম করছে। আমার বাচ্চাগুলো সবাই ছোট, তারা সংগ্রাম করে চলছে তাদের জীবনের সাথে। এবার তাদের ওপর নেমে আসা অন্ধকারকে দেখো। তারা এটা অনুভব করছে, কিন্তু তারা জানে না, মূলত সেটা কী! আমাদের জ্যেষ্ঠ কন্যা আমার পাশে। নাইট ড্রেসের ভেতর তুমি তার শীর্ণ বাহু দেখতে পাচ্ছো? ঠিক যে হাত দিয়ে সে রুটিতে মাখন লাগিয়ে দেয়, সেই হাত?
তার আরেক বোন বসে আছে ঠিক তার বিপরীত পাশে। সে দুধ পান করছে। তার গতিবিধির দিকে লক্ষ করলে দেখবে, প্রায়ই সে লাফায়, বিশেষত যখন সে দৌড়ায় কিংবা হাঁটে। আমার স্বামী বসে আছেন ঠিক তারই পাশে। তিনি সংবাদপত্র পড়ছেন। সঙ্গে পান করছেন কফি। আমাদের কনিষ্ঠ সন্তানের বয়স মাত্র এক বছর। আঙুলের সাথে লেপ্টে থাকা পুডিং সে খাওয়ার চেষ্টা করছে। সমগ্র পাজামায় লেগে আছে পুডিং, দুধ আর জ্যাম।
আমি জানি, তুমি অবশ্যই আমাদের একাকী ফেলে চলে যাবে। কেননা আমাদের একে অন্যকে যেমন প্রয়োজন, তোমার আমাদেরকে সেভাবে দরকার নেই। তবুও বলছি, শোনো।
আমি এখন তোমায় তাদের নাম বলবো। ম্যালিন সবার বড়, ক্রমান্বয়ে অ্যানা এবং সবশেষ জোহানেস। তারা মূলত একই রকম দেখতে। তুমি তাদের দেখতে পারছো? আমি তাদের পেয়ালায় উষ্ণ কোকোয়া ঢেলে দিয়েছি। তাদের উষ্ণ রাখার চেষ্টা করছি। ম্যালিন রাতের পোশাক ওপরে টেনে ওঠায়, হাতের আস্তিন চোষে; ফলে পোশাক কুঁচকে যায়, ভিজে যায়– বিষয়টা দেখেছো? সেও রাতে ভীত হয়ে ওঠে, রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় অনেকে যেমন চিৎকার করে ওঠো– সেও ওঠে। কোনো কিছু তাকে সান্ত্বনা দিতে পারে না। তার শরীর ভয়ে দৃঢ় হয়ে ওঠে। তার চোখ হয়ে ওঠে স্থির, কিন্তু জেনে রাখো, তখন সত্যিই সে জেগে থাকে না। সে আশা করে সমস্ত রাত আমি যেন তার পাশে শুয়ে থাকি। আমি তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে দেয়ালের দিকে মুখ করে শুই, আর সে আমাকে জাপটে ধরে বলে, তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে শোওয়াটা খুবই বিপজ্জনক। আমি বলি, বোকা মেয়ে, মোটেও না। কিন্তু সে আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে বলে, হ্যাঁ মা সত্যি, খুবই বিপজ্জনক, তুমি জানো না।
ওর বয়স মাত্র চার বছর। তার সব অনুভূতি তার মুখে ফুটে ওঠে। যখন সে খেলা করে, তখন সে যা করতে চাই, তা করতে পারে না সবসময়। যখন দেখবে সে টেবিলে পেন্সিল ও পেপার নিয়ে বসেছে, তখন দেখবে সে চিত্রাঙ্কন করতে গিয়ে পেপার-পেন্সিল দিয়ে খেলা করে। সে পেন্সিল দিয়ে একটা রেখা টানলে ভেবে বসে– সে একজন চিত্রশিল্পী। ছোট বালিকার এভাবেই শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। ক্রমান্বয়ে সে এঁকে ফেলে সূর্য, নৌকা এবং শামুক। আসলে সে কি করে তা সে নিজেই ঠিকমতো জানে না।
তুমি কি দেখতে পারছো, সে একদম সোজা হয়ে বসে আছে। সামনের দিকে ঝুঁকে আমায় চোখের ইশারায় কোনো একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছে। কিন্তু আমি তার প্রশ্নের উত্তর জানি না। তুমি কি বুঝতে পারছ, এরকম অবস্থায় সে কী অনুভব করছে?
এবার অ্যানার বিষয়ে বলি। অ্যানা বেশ শক্ত-সমর্থ। নিজের জন্য সে নিজেই যথেষ্ট। তুমি তার দিকে একটু নজর দিলেই তার সুনিপুণ কাজ দেখতে পারবে। সবকিছু সে নিজে করবে। নিজে কাজ করার মধ্যেই সে আহরণ করে আনন্দের অপরূপ স্বাদ। ও মাঝে মাঝে উচ্চস্বরে হাসে। ওর হাসি সব মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে যায়। ও এরকমই।
জোহানেস সর্বকনিষ্ঠ, আমার একমাত্র ছেলে। তার ছোট শরীর বিছানায় গড়াগড়ি করে। সম্ভবত সবকিছু তার কাছে খুবই সহজবোধ্য। এরা বাদে আরেকজন আছে যাকে তুমি দেখতে পাচ্ছ, আমার মনে হয় তুমি অবশ্যই আমার স্বামীকে চেনো। তার সম্বন্ধে বলছি শোনো। তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং অনন্যসাধারণ কিছু অভিলাষ আছে, সেগুলো তো তুমি জানোই। আমি সুনিশ্চিত, সে তোমার অনেক সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করবে, প্রতিবাদ করবে। আচ্ছা, তোমার কী মনে হচ্ছে, তুমি যদি কখনো আমাদের ছেড়ে যাও তাহলে শুধু আমার স্বামীকে ছেড়ে যাওয়াই তোমার জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজ হবে?
আমাদের সকলের দিকে এক এক করে তাকাও এবার। টেবিলের চারদিকে ঘিরে রয়েছি আমরা পাঁচজন। শীঘ্রই আমার মেয়েরা চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়বে। তারা টেবিল ছাড়তেও বিন্দুমাত্র বিলম্ব করবে না। তারা সিনেমা দেখতে আগ্রহী। একই সিনেমা বারবার তন্ময় হয়ে দেখে ওরা। টেলিভিশনে জীবনভিত্তিক এবং পারিবারিক ধাঁচের অনুষ্ঠান দেখে। আবার বনে দীর্ঘ পরিভ্রমণ, উড়ন্ত মাদুর, পরিষ্কার মেঝে, হ্রদে সাঁতার কাটাও দেখে। এটি অনেকাংশে জীবনের মতো, কিন্তু আমাদের জন্য উপযুক্ত নয়।
আমি জানি না, আমার সিদ্ধান্তের পরিবর্তন হবে কি-না। কিন্তু আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। তুমি আর কখনো এখানে ফিরে এসো না। আমি তোমাকে বলছি, তুমি এখনই আমাদের ছেড়ে বহুদূরে চলে যাও। শুভ বিদায়। আরেকটা কথা, আমি তোমাকে যা বললাম, তা কখনো ভুলে যেও না।