আহমেদ শরীফ শুভ-এর ছোটগল্প
খায়রুন্নেসা যতোটা ভয় পাবেন বলে সবাই ভেবে নিয়েছিল ততোটা ভয় পেয়েছেন বলে মনে হলো না। আবার এমনও হতে পারে তিনি একটা নিরুদ্বেগের মুখোশ পড়ে আছেন। তিনি ঘাবড়ে গেলে ইব্রাহিম সাহেব সাহস রাখতে পারবেন না। তিনি ভীতু মানুষ। এমনিতেই সাধারণের কাছে ‘অপারেশন’ শব্দটি ভয়ের। তার উপর যদি জরায়ু কেটে ফেলে দেবার বিষয় হয় তা তো বাড়তি চিন্তার ব্যাপার হবেই।
সমস্যাটি তেমন কিছু নয়। মাঝেমাঝে একটু আধটু রক্ত ঝরছিল। পঁয়ষট্টি বছর বয়সে বিব্রতকর তো বটেই। তেমন কারো সাথে আলাপও করা যায় না। পাশের ফ্ল্যাটের পলাশের মায়ের সাথে কথায় কথায় একদিন বলে ফেললেন। তার মন্তুব্য শুনে খায়রুন্নেসা চিন্তিত হয়ে পড়লেন।
– আপা, একদম অবহেলা করবেন না। শুনেছি জরায়ুতে ক্যান্সার হলে এমনটা হয়।
খায়রুন্নেসা অবশেষে বড় মেয়ের সাথে আলাপ করলেন। জিনাত একরকম জোর করেই মাকে নিয়ে গেল তার স্কুলের সিনিয়র আপা ডাঃ লায়লার কাছে। শারীরিক পরীক্ষা আর আলট্রাসাউন্ড করার পর মনে হলো জরায়ুতে ছোট একটা টিউমার।
– খালাম্মার জরায়ুতে ছোট একটা টিউমার হয়েছে। এটা ক্যান্সার মনে হচ্ছে না। তবুও হিস্টেরেকটমি করে জরায়ু ফেলে দেয়াই ভালো। এই বয়সে তো জরায়ুর আর দরকার নেই। তা ছাড়া ব্লিডিং আস্তে আস্তে বাড়তে পারে। টিউমারটাও বড় হয়ে নানা ঝামেলা করতে পারে।
জিনাত জানে এই নিয়ে কথা বাড়লে খায়রুন্নেসা স্বচ্ছন্দ্যবোধ করবেন না। ‘এই বয়সে জরায়ুর আর দকার নেই’ কথাটা মায়ের জন্য একটু বিব্রতকরও বটে। মায়ের হিস্টেরেকটমি করতে হবে এই ভাবনা তার মধ্যেও কেমন জানি একটা শূন্যতার ভাব নিয়ে আসে। আহারে! এখানে তার ভ্রূণ বেড়ে উঠেছিল। একি তার জন্মভূমি নয়, নাকি ওটা ভ্রূণভূমি? এই ভ্রূনের নিবাস তাহলে মাটিতে মিশে যাবে সহসাই? বুকের গভীর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে জিনাতের।
ছেলেমেয়েরা মাকে অভয় দেয়ার চেষ্টা করে। জিনাত বলে– তোমার অপারেশন করবেন যে লায়লা আপা, উনার নিজেরও তো হিস্টেরেকটমি হয়েছে দুই বছর আগে। বিদিশা জানালো ওর ব্যাঙ্কের সহকর্মী তাসলিমার কথা। মাত্র পঁয়ত্রিশেই জরায়ু ফেলে দিতে হয়েছে। না হলে নাকি বিপদ হতো। ওর স্বামীর বন্ধুর স্ত্রীর শিরিনেরও একই অবস্থা। সবাই দিব্যি ভালো আছে। অপারেশনের পর ঝঞ্ঝাটমুক্ত জীবন। তারপর রাশেদ এসে এমনভাবে তার পরিচিত কয়েকজনের অপারেশনের গল্প শুরু করলো যেন হিস্টেরেকটমি খুব মজার একটা বিষয়।
– যা, ভাগ! মেয়েদের এই সব ব্যাপারে নাক গলাতে তোকে কে বলেছে? – জিনাত ধমক দিয়ে ভাইকে থামালো।
খায়রুন্নেসা ভয় না পান কিংবা নিজের ভীতি আড়াল করে রাখুন, ইব্রাহিম সাহেব উৎকন্ঠা লুকাতে পারলেন না।
– অপারেশনের কি সত্যিই দরকার? এই সব তো টিউমার হোমিওপ্যাথিক ওষুধেই ভালো হয়ে যায়।
বিদিশা ধমক দিয়ে বললো– বাবা তুমি চুপ কর তো। তুমি কি ডাক্তার? অপারেশন না করে রেখে দিয়ে খারাপ কিছু যদি হয়, তখন? তুমি সামলাবে। এই সব হোমিওপ্যাথির গল্প বাদ দাও তো। ইব্রাহিম সাহেব কথা বাড়ানোর সাহস পেলেন না।
অপারেশনের দিনই প্রথম খায়রুন্নেসাকে একটু উৎকন্ঠিত মনে হলো। অপারেশন থিয়েটারে নেয়ার আগে জিনাত কেবিন থেকে বের হয়ে বাবা মাকে একান্তে কয়েক মিনিট সময় কাটানোর সুযোগ করে দিল। মায়ের ট্রলির সাথে ওটি’র ওয়েটিং স্পেসে ঢুকে ডাঃ লায়লার সাথে কথা বলে বাইরে এসে বাবার সাথে অপেক্ষা করতে লাগলো। আপনজন যখন অপারেশন থিয়েটারের ভেতরে থাকে তখন যারা বাইরে অপেক্ষা করে তাদের জন্য পুরো সময়টাই উদ্বেগের, তা যত ছোট অপারেশনই হোক না কেন। জিনাত জানে এটা উৎকন্ঠিত হবার মতো কোন অপারেশন নয়। ডাঃ লায়লার অভিজ্ঞতার উপরও তার আস্থা অগাধ। অথচ অকারণেই তার মন খারাপ লাগছে আজ। বারান্দায় পায়চারিরত বাবার চোখ থেকে আড়াল হওয়ার জন্য সে অন্য দিকে সরে গেলে। উদ্বেগ, উৎকন্ঠা নেই। তবুও এভাবে চোখ থেকে জল বেরিয়ে যাচ্ছে, বুকের গভীর থেকে বের হচ্ছে দীর্ঘশ্বাস। অকারণে?
অপারেশনে বেশি সময় লাগলো না। ওটি থেকে বেরিয়ে এসে ডাঃ লায়লা জানালেন সব কিছু ঠিকঠাকমতোই হয়েছে। রোগীকে রিকভারি রুমে নেয়া হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান ফিরে এলেই কেবিনে দিয়ে দেয়া হবে। ফেলে দেয়া জরায়ু হিস্টোপ্যাথলজি পরীক্ষার জন্য ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। তবে চোখের দেখায় মনে হচ্ছে বিনাইন টিউমার, ক্যান্সার না। রিপোর্ট দেখেই কনফার্ম হতে হবে।
খায়রুন্নেসার জ্ঞান ফিরলে তাকে কেবিনে নিয়ে আসা হলো। ইব্রাহিম সাহেব চুপপাপ তার হাত ধরলেন। একটু ঠাণ্ডা মনে হচ্ছে। জিনাত এসে মায়ের মাথা আর বুক জড়িয়ে ধরলো।
– মা, ব্যথা পাওনি তো!
– এখন একটু ব্যথা করছে। কিন্তু অপারেশনের সময় তো এনেস্থেসিয়ার জন্য কিছুই টের পাইনি।
আর কিছু বলার আগেই জিনাত ফুঁপিয়ে কান্না শুরু করে দিল। ইব্রাহিম সাহেব কিছু বুঝে উঠতে পারলেন না। পায়ে পায়ে বেরিয়ে গেলেন বারান্দার দিকে। খায়রুন্নেসার চোখ থেকেও পানি গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোঁটা। সেটা বেদনার নয়, মেয়ের কান্নার প্রতিক্রিয়া।
– কাঁদছিস কেন মা? আমি তো ভালোই আছি। অপারেশন ভালোমতোই হয়েছে। ব্যথাও তেমন নেই।
জিনাত উত্তর দেয় না। ওড়নার আঁচলে চোখ মুছে। মায়ের ব্যথার কথা ভেবে ও কাঁদছে না। ওর মন খারাপ মায়ের শরীর থেকে ফেলে দেয়া জরায়ুর জন্য। ওখানেই তার ভ্রূণ বেড়ে শরীর হয়েছিল। ওখান থেকেই তার যাত্রা শুরু হয়েছিল পৃথিবীতে। তার এই ভ্রূণভূমি ল্যাবরেটরিতে কাটাছেঁড়া হবে। তারপর বিসর্জন কোথায় হবে কে জানে! ল্যাবে পরীক্ষা শেষ হলে তার পরিণতি কি হয়? জানতে মনে চায়। নার্স ওষুধ নিয়ে কেবিনে ঢুকলে ঔৎসুক্য থামিয়ে রাখতে পারে না।
– আচ্ছা সিস্টার, আপনারা ল্যাবে যেসব স্যাম্পল পাঠান, টেস্টের পর সেগুলো কি করে?
– তা তো ঠিক বলতে পারবো না। তবে মনে হয় সিটি কাউন্সিলের লোকেরা এসে এগুলো নিয়ে যায়, তারপর কোথাও পুঁতে ফেলে। কেন আপা?
– না। এমনিতেই জানতে চাইলাম।
জিনাতের বুক থেকে আরেকটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে যায়। যেখানে সে ভ্রূণ থেকে বেড়ে উঠে মানুষের শরীর পেয়েছিল সে ভ্রূণভূমি মাটিতে মিশে যাবে সহসাই। এত বছর পর মায়ের জরায়ুর প্রতি সে এক অদ্ভূত এটাচম্যান্ট অনুভব করে। আগে কখনো এমনটি মনে হয়নি। একটা অদ্ভূত বিষন্নতা তাকে ভর করে।