গ্রাম, শহর কিংবা বলা যায় সারাদেশে রাষ্ট্র হয়ে গেল, একজন সাংবাদিক এসিড ঝলসানো একটি মেয়েকে বিয়ে করেছে। আমাদের বাড়ী, আমাদের পুরো এলাকার প্রতিটি মানুষ তাকে দেবতার আসনে বসালো। মানুষ এমনও হয়! হ্যাঁ নিশ্চয়ই হয়। জগতে এসিড ছোঁড়ার মতো অমানুষ যেমন আছে, এসিডে ঝলসে যাওয়া বিকৃত মেয়েকে সম্মানের সাথে জীবনসঙ্গিনী করার মতো মানুষও আছে। তারা মানুষরূপী দেবতা, আমার বাবা মা সেজদায় নতজানু রইলেন স্বয়ং ঈশ্বর তাঁদের মেয়েকে উদ্ধার করেছেন। একজন মানুষ আরেকজন মানুষের জন্য কতটা কাঁদতে পারে! কতটা চোখের জল ফেলতে পারে! এই ক’বছর অবিশ্বাস্য চোখে বাবা মাকে দেখেছি আর বিস্মিত হয়েছি!
বাবা হাই স্কুলের শিক্ষক। আজকাল স্কুল, কলেজ, ভার্সিটির শিক্ষকেরা সংসারে খুব একটা খারাপ থাকে না, যদি কোচিং প্রাইভেট ঠিকঠাক মতো চালাতে পারে। বাবা অংকের শিক্ষক, প্রায় সব ছাত্রছাত্রীই প্রাইভেট পড়তে চায়। বাবাও ব্যাচ করে প্রাইভেট পড়ায়। দোষের মধ্যে তাঁর একটাই দোষ, সামান্য রাজনীতির চর্চা করে। চার ভাইবোন। বড় দুই দাদা আর ছোট একটি বোন। আমি জারিনা, ছোটবোন যাসিয়া। মফস্বল শহরের জীবন, দাদার আমলের ছোট্ট বাড়ি, গাছগাছালি ঘেরা, বাবার আয়পয়ে আমাদের যাপন যেন নদীর মতো কলকল করে বয়ে যায়। পাড়া প্রতিবেশী সকলেই আমাদের চেনা আত্মীয় পরিজন। বাবার স্কুল থেকে এস এস সি পাশের পরে গেলাম কলেজে, তাও বাড়ির কাছেই। কলেজে দেবার জন্য কাউকে সঙ্গে আসতে হয় না। আমরা দল বেঁধে নিজেরাই চলে যাই। দেশের বড় বড় শহরের মতো এই মফস্বল থানার এলাকাগুলি এখনও অত অনিরাপদ হয়ে ওঠেনি।
একদল মেয়ে আমরা কলেজে যাই, এর মধ্যে কিছু মেয়ের নিজ নিজ মজনু জুটে যায়। আমি ছিলাম কিছুটা চঞ্চল, উচ্ছল সদা হাসিখুশি টাইপ মেয়ে, ছোটবেলা থেকেই আমি গান শিখতাম, গান ছিল আমার সবচেয়ে প্রাণপ্রিয় একটি বিষয়। শিখতে বা গাইতে ভীষণ ভালো লাগত। বিভিন্ন ছেলে নানাভাবে প্রেমের চেষ্টা করলেও আমি নির্বিকার থাকি। অনেকেই ভাবে এ আমার অহংকার, রূপের দেমাগ। তাদের ভাবনায় আমার কিচ্ছু যায় আসে না। কলেজে কিছু ছেলে ছোকরা ছিল যারা লেখাপড়ার ধারে কাছেও ছিল না সরাসরি রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল এবং তারা যে রাজনীতি করত তা ছিল আমার বাবার মতাদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত। তাদের মধ্যে একজন প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে প্রায়ই উত্যক্ত করা শুরু করলে বাবা ওদেরকে ধমক ধামক দিয়েছিল। ওরা বাবার উপর আগে থেকেই প্রচণ্ড খ্যাপা ছিল একদিন জানালা দিয়ে পড়তে বসা আমার দিকে এসিড ছুড়ে মারল। সারাদেশে তখন এসিড মারা একটা হুজুগ শুরু হয়েছিল। বাম হাত বাম গালে ঠেকা দিয়ে দুলে দুলে পড়া মুখস্ত করা আমার আজন্মের অভ্যাস তারা বাম দিকেই ছুঁড়েছিল এই অগ্নিসম তরল, আমার বাম হাত এবং বাম দিকের গলা, কান, গালের কিছু অংশ ঝলসে গিয়েছিল। খাবলা মেরে সেখানকার চামড়া তুলে নিয়েছিল দেখতে নিরীহ এই তরল।
টিভি, কাগজের লোকেরা কোথায় থাকে জানি না কিন্তু অল্প সময়ের ভেতর আমাদের বাড়ি ভরে যায় মানুষ মানুষ আর সাংবাদিক দিয়ে। বাবার ছাত্ররাও অনেকে অনেক বড় বড় পদে চাকরি করেন, খবর শুনে সবাই আক্ষেপ করেন এবং আমার চিকিৎসার সকল রকম সহযোগিতার আশ্বাস দেন। আসলেই অত্যন্ত দ্রুততায় আমাকে ঢাকায় আনা হয় সু চিকিৎসার জন্য। বাবা মা, সংসার স্কুল কোচিং সব ফেলে আমার সাথে ঢাকায় থাকেন যতদিন না আমি সুস্থ্য হই, ভালো হই।
কিন্তু ভয়াবহ এসিডে পোড়া মানুষ কতটা সুস্থ্য হয়! কতটা স্বাভাবিক হয়! এই তরল গরল কেড়ে নিয়েছে আমার স্বাভাবিক আকৃতি দিয়েছে বিকৃতি ও বীভৎসতা। দিয়েছে ভয়, অবিশ্বাস, মানুষের প্রতি ক্লেদাক্ত ঘৃণা আর এক প্রতিবন্ধী জীবন।
দুর্বিসহ ঘটনার পরে গড়িয়ে গেছে আরো শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা। আমার আর লেখাপড়া করা হয়নি। ঐ ঘটনার পর আমি কোনদিন গুনগুন করেও একটা গানের কলি ভাজিনি। ছোটবোন যাসিয়া কলেজে ওঠার পরপরই বাবা বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। সে ছিল বিজ্ঞানের ছাত্রী, এসএসসিতে সে গোল্ডেন জিপিএ পেয়েছিল, তবু বাবা আপদ দূর করেছে, কে না জানে, মেয়েরা আপদই, তাদের লেখাপড়ার খরচ যোগাতে হয়, তাদেরকে রন্টু, স্বপন, আরিফদের থাবা থেকে বাঁচাতে হয়। যাসিয়ার আকুল কান্নায়ও বাবা অটল থাকেন। বাবা যেমন জানে আমিও জানি আমার কোনদিন বিয়ে হবে না আর আমার সেরকম কোন ইচ্ছেও নেই।
কিন্তু এই প্রস্তাব পাওয়ার পর বাবা একেবারে যেন স্বর্গ হাতে পান। এসিড মারার পরে যে দলে দলে মানুষ এসেছিল সেখানে ছোট একটি সাংবাদিকের ঝাঁকও ছিল, এ ছেলে তাদেরই একজন। আমি কিছুতেই রাজি হই না। বাবা মা বড় ভাই ভাবী সবাই রাজী কেবল আমি বাকি। একদিন বাবা মার সম্মতিতে প্রস্তাবকারীর সাথে আমার সাক্ষাতের আয়োজন করে আমার খালা, তার বাড়িতে।
সেখানে তার সাথে আমার প্রথম পরিচয়, প্রথম আলাপ।
– আচ্ছা, জারিনা! তোমাদের এখানে মাইক ভাড়া পাওয়া যায়? কোথায় পাওয়া যায় বলত এক দৌড়ে গিয়ে নিয়ে আসি।
আমি অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকালে বলে– তুমি এতটা দূরে বসেছ যে মাইক ছাড়া কথা বলি কিভাবে? বলেই গা দুলিয়ে হেসে উঠল… ভয় পাচ্ছ! তাকাও, দেখ আমি কোন সন্ত্রাসী নই। তোমাকে আমি অনেকদিন ধরে চিনি। সেই যেদিন ওরা তোমার জানালা দিয়ে… আচ্ছা শোন, এখানে সিগারেট ধরানো যাবেত! পাছে আবার তোমার ময় মুরব্বিরা ধরে ঠ্যাঙাবে নাতো।
– না, না, তা কেন! সিগারেট ধরালে কেউ কিছু বলবে না।
– শোন, আমি একজন সাংবাদিক, জেলেরা যেমন মাছ ধরে ঠিক তেমন নানান খবর ধরা আমার পেশা, মাথা নিচু করে থেকো না তুমি আমাকে দেখে নাও, আমার পেশার কথাও শুনলে এখন বল তুমি কি আমার আট/দশটা সন্তান সন্ততির মা হতে পারবে? হৃৎপিণ্ডে মন্দিরা আর শরীরে দ্রুতলয়ে ছোটা লোহিত কণিকার স্পন্দন নিয়ে আমি নিজের অজান্তে তার স্কেলে সুর মিলিয়ে বলে উঠলাম– কটা! আট/দশটা!
– আচ্ছা তুমি চাইলে আরো বেশী, এই ধর বারো/ চৌদ্দটা
– এসব কি বলছ তুমি!
– ব্যস হয়ে গেল, সহাস্যে সে বলে ওঠল
– কি হয়ে গেল!
– সবকিছু… বলেই সে ঘরবাড়ি দুলিয়ে তার অদ্ভুত হাসি হেসে উঠল, আর আমি অপলক চেয়ে রইলাম ওই মারাত্মক হাসির দিকে।
এরপরেই আমাদের বিয়ের শানাই বেজে ওঠলো জনে জনে, মানুষের মনে মনে…
প্রথম দু এক বছর চমৎকার কাটার পরই বাতাস উল্টো বইতে লাগল। কোথায় এসিডে ঝলসানো মেয়েরা সুইসাইড করেছে, কোথায় এমন ঝলসে যাওয়া মেয়েদের বিয়ে হয় নাই, এসব গল্প সে শোনাতে শুরু করল। এরপর ধীরে ধীরে ব্যস্ততা বাড়তে লাগল, বাসায় আসা কমে গেল। ঘরে থাকার চেয়ে বাইরে থাকার স্থায়িত্ব দিনদিন বাড়তে বাড়তে এমন হয়েছে সে আজকাল মাঝে মাঝে আর ঘরেই ফেরে না। জিজ্ঞেশ করলে সেই গৎবাধা উত্তর কাজ আর কাজ, কতটা কাজ আর কতটা অজুহাত কে জানে! আমিও আর জিজ্ঞেশ করি না। যা বুঝি তার মিথ্যে ব্যাখ্যা শুনতে ভালো লাগে না, কষ্ট হয়। তার চেয়ে এভাবে চলুক, যতদিন চলে। আমি এখন ভীষণ চুপচাপ অন্তর্মুখী একজন মানুষ। ঘর, বারান্দা, আসবাব, দেয়াল পাহারা দেই ঘুরে ঘুরে। ছোটবোন মাঝে মাঝে চিঠি লিখে, আমরা বাবার কাছ থেকে চিঠি লেখা শিখেছিলাম। যাসিয়া বিজ্ঞান ভুলে সন্তানকে মাতৃদুগ্ধ পানের উপকারিতা নিয়ে মগ্ন থাকে, বাচ্চাটা আধোবোলে নাকি অনেক কথা বলে। আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করে, খামেভরা ওর কিছু ছবি আছে আমি প্রায়ই বের করে চেয়ে থাকি… কিছুদিন ধরে আমার শরীরে একটা অস্বস্তি, সত্যি বলতে কি সম্ভবত আমিও একটা সংবাদ জানাতে পারি যাসিয়া আর সাংবাদিক সাহেবকে…
দুপুরবেলা সদ্য স্নান সেরে বের হয়েছি, এখানে শাওয়ারে স্নান করতে আমার খুব একটা ভাল লাগে না। বাড়িতে লাগোয়া বাথরুম থাকলেও ইঁদারার জল বালতি বালতি তুলে গায়ে ঢালতাম কী ভীষণ ঠাণ্ডা একেবারে শরীর মন জুড়িয়ে যেত, তবে এখন এখানকার ব্যবস্থায় অভ্যাস হয়ে গেছে। ডোরবেল বাজল, কপাল কুঁচকে ভাবলাম কে হতে পারে, যদিও এই ট্রুরুং ট্রুরুং শব্দ খুব চেনা কিন্তু সেতো এসময়ে ফেরে না। ঘরে ঢুকে সে আগের মতে করে আমার চোখে চেয়ে রইল নির্নিমেশ। সে সবসময় বলত, তুমি কি জানো! জীবনানন্দ তোমার এই চোখ নিয়েই তাঁর বিখ্যাত কবিতা লিখেছিলেন। আমি দৃষ্টি নামিয়ে নিলাম, কেন যেন বুকের মাঝে ঢিপ ঢিপ করতে লাগল। তবে বিশ্বাসের প্রাচীরে কি চিড় ধরেছে! মানুষ না একে আমি সারমেয়দের বৈশিষ্ট্যে বিশ্বাস করতাম।
– শোন, ঝটপট গুছিয়ে নাও আমরা রাতের লঞ্চে বরিশাল যাচ্ছি। ক্যাবলার মতো তাকিয়ে রইলে কাছে এসে চিবুক ধরে সহজ হয়ে বলে– আরে বাবা, কাজ করে করে মাথার ঘায়ে কুত্তা পাগল অবস্থা, বরিশাল রুটে দারুণ কিছু লঞ্চ হয়েছে, ভাবলাম দুজনে বেড়িয়ে আসি। অনেকদিন হয় কোথাও যাওয়া হয় না, ‘এম ভি গ্রিন লাইন’, ‘সুন্দরবন-১১’ নামে লঞ্চগুলিতে নাকি এসি কেবিন, নানারকম সুবিধা আর ফরমালিন ছাড়া তাজা মাছের মজাদার তরকারী পাওয়া যায়, কি তুমি খুশি হওনি? বরিশাল আগে দেখেছ? নাও নাও ছোট্ট ব্যাগে অল্পকিছু কাপড়চোপড় নিয়ে জলদি রেডি হয়ে নাও।
মনে মনে ভাবি মফস্বলের মেয়ে আমি। আমাদের বাড়ির পাশে গার্লসস্কুল, তার পাশে থানা আর থানার ওপাশ দিয়ে বিশাল পাইথনের মতো চলে গেছে বিশ্বরোড। এই রোডে বড় বড় ঢাকাগামী বিলাশবহুল বাস যাতায়াত করলেও থামেনা আর চলে লোকাল বাস, সেই লোকাল বাসে চড়ে মাঝে মাঝে নানাবাড়ি বেড়াতে যাওয়া ছাড়া আমি আর কোথাও যাইনি। বরিশাল তো অতি দূরের কথা। তবে জানি, ধান নদী খাল এই তিনে বরিশাল। আমি কোনদিন নদীও দেখিনি, তবে দীঘি দেখেছি, নানাবাড়ির দীঘি, তার টলটলে জলে নির্ভয়ে সাঁতার কাটত নানীর রাজহাঁসের দল, সেখানে কত যে মাছ থাকত, আমরা গেলেই লোকেরা জাল ফেলে মাছ ধরত, যাসিয়া কিছুতেই সেমাছ খেত না, বলত মাছগুলো হাঁসের ইয়ে খায় আমি ঐ মাছ খাব না, আমরা সবাই হাসতাম, নানা ওর জন্য বাজার থেকে মাছ আনাতো। দীঘির কিনার দিয়ে ছোট ছোট সাদা ফুল ফুটে থাকত…
এতদিন ধরে যে বিষন্নতার কুয়াশা আমায় জড়িয়ে ছিল তা যেন আস্তে আস্তে ফিকে হতে লাগল, ঠিক ঐ দীঘির জলের মতো। বহুদিন পরে আমরা পরস্পর ভরদুপুরের ভূতে পাওয়া যুগল হয়ে ওঠলাম। সে যখন আমায় আদর সোহাগে চুরমার করে দেয় আনন্দের সাথে সাথে কেন যেন আমার দুচোখের অশ্রু বাধ মানেনা, সেই অশ্রু এসিডদগ্ধ গাল স্পর্শ করার আগেই আমি সঙ্গোপনে মুছে ফেলি।
চমৎকার রঙয়ের চুন্দ্রি প্রিন্টের সালোয়ার কামিজ পড়লাম, উড়না দিয়ে মাথা ঢেকে নিলে এসিডপোড়া বোঝা যায় না। ঘর থেকে বেরুনোর আগে সে বলল– তোমাকে সুন্দর লাগছে, একটা টিপ পরে নাও… হাওয়াই মিঠাই মুখে দিলে গলতে সময় লাগে, মেয়েদের লাগে না, আহলাদে গলতে গলতে টিপের পাতা বাড়িয়ে বললাম
– নাও, পড়িয়ে দাও, দেখ মাঝখানে যেন হয়…
আলুলায়িত বিকেলের হাত ধরে, ঘাটে এসে লঞ্চের কেবিনে চড়ে বসলে ভেঁপু বাজিয়ে লঞ্চ ছেড়ে দিলো। আমি জীবনেও কোনদিন লঞ্চ দেখিনি, কী বিশাল রে বাবা! তিন তলা লঞ্চ, আমরা যে বাসাটায় থাকি প্রায় তার কাছাকাছি। দেখে আমার ভিমরি খাবার যোগাড়। ও আমার হাত ধরে লঞ্চে তুলল। কেবিন দেখে আমি আরো তাজ্জব, এত আরামদায়ক, এত সাজানো গুছানো, টিভিও আছে। কেবিনে থিতু হয়ে বসে সে টিভি অন করল, চায়ের অর্ডার দিল,
– লবস্টার খাবা? আরে ধেরে সাইজ চিংড়ি, খাও খুব মজা। মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম। খাওয়া সেরে, চা পান সেরে আমি আস্তে করে বললাম– চল না লঞ্চটা ঘুরে ঘুরে দেখি… ভাবছি এরই ফাঁকে ওকে সুখবরটা দেব।
– দাঁড়াও আরেকটু রাত বাড়ুক, লোকজনের ভিড়ভাট্টা কমুক…তোমাকে সব ঘুরে ঘুরে দেখাব, তুমি কিন্তু আজ একটা গান শোনাবা, কতদিন হয় তুমি গাও না। এতদিনের জমে ওঠা ক্ষোভ, অভিমান, না পাওয়া নদীর জলে ধুয়ে যেতে লাগল, আহা বেচারা কাজে এত ব্যস্ত থাকে, সময় করে উঠতে পারেনা, কাজটা তো আর যা তা কাজ নয়, সাংবাদিকতা। আমার আরো বুঝদার আরো সমঝদার আরো সহনশীল হতে হবে। ঠিকইতো, আমি কেবল কাজ বলতে বাবার স্কুলের চাকুরি আর প্রাইভেট পড়ানো দেখেছি। একজীবনে আরো কত দেখার বাকি আছে! রাত বাড়তে বাড়তে চাঁদ একেবারে মাথার উপরে চলে এলো তখনও আমরা ডেকে। ডেকেও বহু মানুষ চাঁদর, মাদুর পেতে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। আমরা এককোনে দাঁড়িয়ে পেছনের দ্রুত চলে যাওয়া জলের ঘুর্ণি দেখছি তাতে চাঁদের আলো পরে এক অপার্থিব সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে।
– শোন, টাইটানিকের রোজ জ্যাকের গান শুনবা? এই বলে রেলিং এ পা দিয়ে দুহাত দুদিকে ছড়িয়ে সেলিন ডিওনের “মাই হার্ট উইল গো অন” গান ধরল, আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতে লাগলাম, পুরো গানটাই সে মোটামুটি গাইল। ওর গানে আমি মুগ্ধ হই, ওর হাসিতে আমি পাগল হই, ওর কথায় আমি গলে যাই আসলে ওর প্রতি ভালোবাসাই, সবকিছুর কারণ। ওর এই দুহাত ছড়ানো ভঙ্গি দেখে আমার বুক কেঁপে উঠলে বলল তোমার সবেতেই ভয়, এত ভয় পেলে এঞ্জয় করবে কি করে! এই যে কাছে আসো… আরে এই রেলিং এ পা দাও, ভয় পেওনা, এই যে হাত ধর… আসো… আমি আছি না! আমি উঠে দাঁড়ালাম, আরেকটু উঁচুতে ওঠো আরেক ধাপ, আরেকটা … হ্যাঁ হ্যাঁ এইতো…
এরপরে অনেক নিচের জলের ঘুর্নন ও আমি অকল্পনীয় দ্রুততায় মিলিত হলাম ব্যাখ্যার অতীত এক শুন্যতা নিয়ে। একটা শব্দ হলো ঝপাত, আর তখন কে যেন চিৎকার করে ওঠল…
পাহাড় থেকে নেমে আসা খরস্রোতা জলধারার মতো ঘোলা জল হুড়হুড় করে ঢুকে যাচ্ছে আমার শরীরের সকল ফাঁকফোকর দিয়ে। শতবার ঢোক গিলছি, হাজারবার উগরে দিচ্ছি, দাঁতের নিচে বালি কিচকিচ করছে, চোখ নাক শ্বাসনালী জ্বলে যাচ্ছে, ভাসছি, ডুবছি, মাথা তোলার চেষ্টা করছি একবার পারি তো দশবার ডুবে যাই, চোখে কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না, কানে কোনো শব্দ নেই, ভেতর থেকে দমকে দমকে কাশি আসছে, নাক মুখে শ্বাস নয় কেবল জল ঢুকছে… বালি মিশ্রিত জল আর জল…
জলের নিচে জীবন বিপন্ন হলে কি করতে হয় উজান দেশের মেয়ে আমি কিচ্ছু জানি না।