নারকেলের পাতায় পাতায় মহাকাল নাচছে যেন! বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দে বুকের ভেতরে কাঁপন সৃষ্টি হচ্ছে। আকাশটা আজ পরাজিত কালো মেঘেদের মিছিলে। চারপাশটা হঠাৎ করেই অন্ধকারে ডুব দিয়েছে নিজেকে আড়াল করতে। মাঝে মাঝে মেঘেদের মিছিল ভেদ করে ঝলকে উঠছে আলোর রেখা। সে আলো পথিককে পথ না দেখিয়ে ভীতির কাঁপনকে বাড়িয়ে তুলছে শতগুণ। বাড়ি ওঠার পথেই যে পুরনো শতবর্ষী আমগাছটা আছে সেখানে হাজারো পাখির অভয়ারণ্য। মেঘের গর্জন আর বাতাসের শব্দে পাখিগুলোও আজ দিশেহারা হয়ে কিচিরমিচির করে চলছে বিরামহীন।
বৃহস্পতিবার সব কথা নাকি সত্যি হয়! মিলে যায় পুরোপুরি। নজরানাও জলের দরে, ১০ টাকা মাত্র। কাচারি ঘরের মাঝ বরাবর ঝুলিয়ে রাখা শিকলের একপ্রান্ত ভক্তিভরে ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলে, বাবা অন্যপাশের শিকল ধরে চোখবন্ধ করেই বলে দিতে দিতে পারে শিকল ধরা ব্যক্তির জীবনবৃত্তান্ত। কোন মূল্যবান জিনিসটা হারিয়ে তুমি দিশেহারা, কে নিয়েছে, খুঁজে পাওয়ার উপায়, কোন অসুখে ভুগছ তুমি, পাসপোর্ট ভিসা হয়ে যাওয়ার পরও কেন বিদেশ যেতে পারছ না, ভালো চাকরির একটা ব্যবস্থা করা… সব বলে দিতে পারে এই শিকল বাবা। তাইতো এত ভিড় আজ। বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দের সাথে গোলাপজল আর আগরবাতির গন্ধ যোগ হয়ে ভারী করে তুলেছে পরিবেশ। ভক্তি, ভরসা আর বিশ্বাসে ভর করে কত দূরদূরান্ত থেকে মানুষগুলো ছুটে এসেছে! বাবার খাদেমরাও মহাব্যস্ত আজ। ঝড়ের মধ্যেও এদিক ওদিক ছুঁটাছুটি করছে। কাচারি ঘরের বারান্দায় রাখা বাবার ফুঁ দেয়া তেল আর পানির ড্রাম থেকে বোতলে বোতলে ভক্তদের মাঝে বিতরণ করছে। বাবার খাস খাদেম তাবিজ দেয়ার কাজটা করে থাকে। দাম বাড়ার সাথে সাথে তাবিজের কার্যক্ষমতাও বাড়তে থাকে।
এত লোকের ভিড়ে কাচারিতে আজ লোকমান সেকের জায়গা হয় না। উঠোনের এক কোণে ছাউনির নিচে কুঁড়ি-বাইশজন লোকের সাথে দাঁড়িয়ে সে। সেই তিনমাস আগে একমাত্র সম্বল ভ্যান গাড়িটা হারিয়ে বাবার দরবারে পা রাখে লোকমান সেক। তারপর প্রতিবার বাবার তেল, পানি পড়া আর তাবিজ নিয়ে বাড়ি ফেরা। কমতি ছিল না বিশ্বাস আর ভক্তিরও। তবুও…
আজ এই প্রবল ঝড়ের মাঝে টলতে টলতে বাড়ির দিকে রওনা হয় সে। ভেসে আসে শিকল বাবার দৃপ্ত কণ্ঠের উচ্চারণ, “ভাবিসনা পেয়ে যাবি। তাবিজটা বালিশের নিচে রেখে ঘুমাবি। তবে মনে রাখবি, ভক্তি আর মনের বিশ্বাসটা খুব জরুরি।”
শুকনো হাসি প্রসারিত হয় লোকমান সেকের ঠোঁটে। আগরবাতি আর গোলাপজলের গন্ধটা ক্রমশ হালকা হতে থাকে।