কাজী মহম্মদ আশরাফ
জন্ম: ১জানুয়ারি, ১৯৭৭, ৯ সুলতান সিকান্দার শাহ রোড, নারায়ণগঞ্জ। পৈতৃকবাস : মুন্সীগঞ্জ। উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত গ্রন্থ: আকালু (উপন্যাস)
কাজী মহম্মদ আশরাফ

ভাতের সংস্কার

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

ভাত নিয়ে আমার প্রিয় কুসংস্কার আছে। ঐশীবাণীর মতো পবিত্র।

খাওয়ার সময় ভাত পড়লে টুকিয়ে খেতে হয়। এটা আমার মায়ের কথা। একটা ভাত পড়লে সত্তরটা করে সাপ হয়ে কামড়ায়। মায়ের কথাটাই মক্তবের ছোট হুজুরের কাছে শুনেছি। ওয়াজ-মাহফিলে বড় হুজুরদের কাছে শুনেছি। বাজারে চায়ের দোকানে প্রবীণ কৃষকের কাছে, হাটবারে হাটে গিয়ে অভিজ্ঞ ব্যবসায়ীর কাছে, খেয়াঘাটে গাঙ পার হওয়া শ্রমিক সরদারের কাছে শুনেছি।

আমার মা কোনোদিন ভাত ফেলে নাই। কিন্তু ১৩৮১ সনের আকালের বছর মা ভাতের অভাবেই মারা গেছেন। আমি তখন ছোট। ছোট বোনটি মাত্র হয়েছে। বাবার সামান্য বেতনের চাকরি। তখনো বেতন ব্যাংকে দেওয়া চালু হয়নি। নগদ টাকায় দেওয়া হতো। ছিনতাইকারীদের তখন হাইজ্যাকার বলা হতো; তারা বাবার টাকা অস্ত্র ঠেকিয়ে পকেট থেকে নিয়ে গেছে। বাড়িতে মোটামুটি অভাব-অনটন ছিল। এর মধ্যে সন্তানদের মুখে খাবার দিতে গিয়ে মা অল্পাহারী হতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু শরীর তা মানল না। অসুস্থ হয়ে পড়লেন। কয়েকদিন পরে আর বাঁচানো গেল না।

ভাষা নিয়ে সংগ্রামের কয়েক বছর আগে এই দেশে ব্রিটিশ পুলিশের জুলুম বেড়ে গিয়েছিল। ‘জান দিব ধান দিব না’– আন্দোলন চলছে। ফসলের জমিন থেকে জমিদারের লাঠিয়ালরা ধান কেটে নিয়ে গিয়েছিল। সামান্য জমির সামান্য ফসল; বছরের কয়েকটা মাস চলে। লাঠিয়ালরা নিয়ে গেলে খাবে কী! স্বামী-সংসার ও সন্তানদের আর নিজের মুখে ভাত দেবে কোথা থেকে! কয়েকবাড়ির লোকজন লাঠি হাতে প্রতিবাদ করতে গেলে জমিদার পুলিশ ডেকে আনে। দিন শেষে মশালের আগুন নিয়ে থানা ঘেরাওয়ের সময় পুলিশ গুলি চালালে আমার মা, পাশের বাড়ির অরুণ জেঠা, রহিম চাচা ও নিমাই দাদুসহ চার জন মারা যান।

ভারত যখন অখণ্ড ছিল– সেই তেরশ পঞ্চাশ সালের আকালের বছর ভাতের অভাবে মা গ্রামের একজন খারাপ লোকের সঙ্গে পুরনো ভাঙ্গা দালানে দেখা করতে গিয়েছিলেন। একমুঠ চাল দিয়েছিলও লোকটা। কিন্তু সমাজে মায়ের নামে ছিঃ ছিঃ পড়ে গিয়েছিল। তখনকার সমাজে এমন অবস্থা খুব অস্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু মা ভাত রান্না করে সন্তানদের কাছে বসে খাইয়েছিলেন। রাতে কখন যে গরুর ঘরে গিয়ে গরুশূন্য ঘরটার বাঁশের আড়ায় ঝুলে পড়েছিলেন কেউ দেখেনি। পরদিন সবাই মায়ের লাশ উদ্ধার করেছিল।

আজকে যেখানে শিল্প-কারখানা সেটা ছিল চর। কয়েক বছর আগেও এই নতুন চর পড়তে দেখেছে আমাদের পূর্ব পুরুষরা। আগে এখানে নদী ছিল। এরও প্রায় দেড়শ বছর আগে এখানেই মূল জমি ছিল। আর সেখানে ছিল নীলকরদের নীলকুঠি। গৃহস্থদের ধরে ধরে নীল চাষ করতে বাধ্য করত। অনেকে বাধ্য হয়ে নীল চাষ করত। তাতে হাতে সামান্য পয়সা আসত কিন্তু ঘরে খাবার থাকত না। কেউ কেউ পালিয়ে গেল নীল চাষ করবে না বলে। মেঘনার ওইদিকে নতুন চরে চলে গেল। সেখানে চরের নতুন জমিতে আবাদ করলে দুই বছর খাজনার রেয়াত পেত। এভাবে চরাঞ্চলে জনসংখ্যা-খানাসংখ্যা বেড়ে চলল। কিন্তু এখানে মূল ভূমিতে গৃহস্থদের মরণদশা! সাহস করে অনেকে প্রতিবাদ করল। নীল চাষ করবে না, ধান চাষ করবে। কুঠিয়াল সায়েবরা পাকা ধান কেটে নিয়ে যেত। কচি ধানের চারাগুলো কী ওষুধ দিয়ে পুড়িয়ে দিত। শেষ পর্যন্ত গৃহস্থেরা ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ করল। এই দেশে তখন ফরাজিদের আনাগোনা। ফরাজিকান্দা, ফরাজিবাড়ি, ফরাজিঘাট, ফরাজিবংশ এসব নাম তাদের নামেই হয়েছে। ফরাজিদের ধর্মীয় কথাবার্তা এই অঞ্চলের মানুষজন খুব একটা পছন্দ করত না। তারা ঈদ করতে দিত না, মহররম করতে দিত না, জুমার নামাজ পড়তে দিত না। হিন্দুদের এই দেশে বারো মাসে তেরো পার্বণ। এখানে থাকতে হলে মুসলমানদেরও আনন্দ-উৎসব নিয়ে থাকতে হতো; না হলে মন ছোট হয়ে থাকত। তাই ফরাজিদের সঙ্গে বনিবনা হতো না। কিন্তু নীল কুঠিয়ালদের বিরুদ্ধে কৃষকদের সংগ্রামে ফরাজিরা উৎসাহ দিত, সাহস জোগাত, বুদ্ধি ও কৌশল শেখাত। সম্মিলিত সশস্ত্র নীলবিদ্রোহে আমার বাবা ও তার ভাইয়েরা, মা এবং তার ভাইয়েরা অংশ নিয়েছিলেন। নিষ্ঠুর ইংরেজরা আমার মা, রমা কাকি, আর কয়েকজন নারীযোদ্ধাকে দৌড়ে ধরে ফেলেছিল। কুঠিতে নিয়ে চাবুক মেরে মেরে নির্যাতন করে মেরে ফেলেছিল। মামারা, কাকারা আর বাবা অস্ত্র কোথায় লুকিয়ে রেখেছে তা বের করার জন্য নির্যাতন করেছে। মায়ের রক্তাক্ত লাশ পেছনের খালে পাওয়া গিয়েছিল।

এর আগে এগারো শ ছিয়াত্তর সনের বড় অভাবের বছর আমার বাবা রুজির উদ্দেশে দূরে কোন শহরে চলে গিয়েছিলেন। মা ভাতের অভাবে বড় ভাইকে বেচে দিয়ে যে সামান্য টাকা হাতে পেয়েছেন রাতে বেড়া কেটে দস্যুরা তাও নিয়ে গিয়েছিল। অভাবের তাড়নায় জমিদারের এক কর্মচারীর সঙ্গে মা খাতির করতে শুরু করেন। বাবা দেশে ছিলেন না তবু আমার মা সে বছর আমার ছোট ভাইটির জন্ম দেন। আমাদের নানীও  অনেক বছর পরে সে বছর আমার ছোট খালাকে জন্ম দিয়েছিলেন। অথচ আমার নানা মারা গিয়েছেন অনেক বছর আগে। সামান্য কয়টা ভাতের জন্য আমার মা আর নানী তাদের সন্তানদের বংশধারা পরিবর্তন করে ফেলেছিলেন। বাবা আর ফিরে আসেননি। মাকে সেবার গলায় কলসি বেঁধে মরতে হয়েছিল।

একবার মোগল শাসকরা কোন পরগণার রাজার সঙ্গে যুদ্ধ করবে বলে হাজার হাজার সৈন্য এসে উঠেছিল আমাদের নানা বাড়ির আশে পাশে। সবার বাড়ির গোলার ধান, খোঁয়ারের মোরগ-মুরগি আর গোয়ালের গরু-বাছুর ধরে নিয়ে খেয়েছে তারা। কিন্তু সেই যুদ্ধে তারা জিততে পারেনি। পরাজিত হয়ে ফিরে যাওয়ার সময় অবশিষ্ট যা ছিল সব লুট করে নিয়ে গেছে। আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। যাতে বিজয়ী সৈন্যরা এসে এখান থেকে কিছু সংগ্রহ করতে না পারে। কয়েকদিন পরে বিজয়ী সৈন্যরা এসে যা পেয়েছে সব নিয়ে গেছে। পারলে ভিটার মাটি আর গাছের শেকড়সুদ্ধ তুলে নিয়ে যায় অবস্থা। জেলেদের ভাঙা নাওগুলো পর্যন্ত ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। এই এলাকায় তখন ঘরে ঘরে ভাতের অভাব দেখা দিয়েছিল। সে বছর মায়ের মতো অনেক দুর্বল শরীর ভাতের অভাবে রক্ত-আমাশয়ের কাছে পরাজিত হয়েছিল। মা মারা গিয়েছিলেন।

এরও অনেক বছর আগে। সারা ভারত যখন মোগল-পাঠান সুলতানরা শাসন করে তখনো এই দেশ আর্যদের বংশধর বলে দাবিদার ব্রাহ্মণ্যবাদী ক্ষত্রিয় শাসকদের অধীন। তাদের কাছে অচ্ছুত ছিল আমাদের মায়ের বংশধরেরা। কেউ মাছ ধরতেন, কেউ পরের জমি চাষ করতেন, কেউ বাঁশ ও বেতের কাজ করতেন। হাটবারে হাটে গিয়ে হাটের একপ্রান্তে, নদীর নিচু পারে বসে সে সব বেচাকেনা করতেন। সমাজে তাদের কোনো অধিকার ছিল না। হাজার প্রথার কাছে বন্দি ছিল তাদের আয়-উন্নতির সব উপায়। ব্রাহ্মণ্যবাদীদের নানারূপ অত্যাচারের বিরুদ্ধে একবার কৃষক-জেলে-কামার-কুমার আর হাটের মুটেরা বিদ্রোহ করে বসেছিলেন। এর পরে শাস্ত্রকাররা তাদের ঘেরাও করে রেখেছিল। বেচাকেনা, লেনদেন সব বন্ধ করে ভাতে মারার-পানিতে মারার ব্যবস্থা করেছিল। নদীতে নামতে দিত না। জমিতে হাঁটতে দিত না। আমাদের জন্য খাবার সংগ্রহ করতে হাটবারে মা হাটে গিয়েছিল ভিক্ষা করতে, তখন ভিক্ষা তো নিতে দেয়ইনি বরং হাটের মধ্যে মাকে পিটিয়ে হত্যা করেছিল ক্ষত্রিয় সেনারা।

এরপর থেকে আমি ভাত ফেলি না। এঁটো ভাত কুকুরকে দিলেও ভাঙাপাত্র পরিষ্কার করে তাতে দেই। ঘরে প্রতিদিন যে পরিমাণ ভাত ফেলা হয় মাঝে মাঝে কান্না পায়। যদি এই কয়টা ভাত আমার মা খেতে পেতেন তাহলে তাকে এতবার মরতে হতো না। পড়ে থাকা প্রতিটি ভাত সত্তরটি করে সাপ হয়ে আমার মগজের ভেতরে, বিবেকের মধ্যে কামড়ায়। ভাত নিয়ে আমি এখনো এই বিশ্বাস নিয়ে, এইসব প্রথা নিয়ে জীবন যাপন করি।


 

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu