গল্প শুরুর গল্প:
প্রশ্ন উঠতে পারে তোয়া কে? তোয়া আমার ঘরের আকাশ। আমাদের সবার ঘরেই এমন আকাশ থাকে। আমাদের ভুলেই এই আকাশগুলো কংক্রিটের দেয়াল হয়ে যায়।
কাবুলিওয়ালা গল্পের মিনির মতো ওর জন্মের পর সে খুব বেশি সময় চুপ থেকে নষ্ট করেনি। গাছ, ফুল, পাখি, আকাশ, বাতাস, মাছ, মানুষ তো আছেই; বাড়ির দেয়াল, নানামনির গাড়ির চাকা, বাড়ির লিফট, বাস, লঞ্চ সবার সাথেই তার বন্ধুতা।নিজের খেলনা গাড়ির চাকা নষ্ট হলে সে নানামনির জিপের চাকাকে প্রশ্ন করে, ‘ আচ্ছা তোমার বাবুটা এত ঘন ঘন সিক হয় ক্যানো, হ্যা? সারাদিন এত বাইরে ঘুরলে হবে? ওদের দিকেও একটু খেয়াল রাখো।’ বাজার থেকে ক্লান্ত হয়ে ফিরে আমাদের জয়নাল চাচা এক কাপ চা নিয়ে বসতেই তার ধমক, ‘বলি দাদু নিজে একা একা চা খাও। রুই ফিস আর চিকেনকে জিজ্ঞেস করেছো, ওরা চা খাবে কিনা?’ এই হলো তোয়া। যার ভালোবাসা আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে পাহাড়ের নিশ্চিন্ত ঘুমের মতোন। তো সেই তোয়ার কিছু কিছু কাহিনী, সংলাপ যখন এখনকার সামাজিক নানা অবক্ষয়, অসঙ্গগতিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়— তখন মনে হলো তোয়ার সেই ভালোবাসা আর অবুঝ মনের সহজ প্রশ্নগুলো পাঠকের দরবারে তুলে দেই।
আমি না পারি কেউ তো পারবেন ওর এই সমস্যা আর প্রশ্নগুলোর সমাধান দিতে।
(১)
শরৎচন্দ্র যখন ড্রাইভার
– মাম্মাম ওঠ না।
– হুম।
– কী হু হু করছো, ওঠ না।
– আরে বাবা বলো না কী হয়েছে।
– আচ্ছা শোনো, স্যরি। হ্যা?
– হুম। কিন্তু কী কারণে স্যরি?
– কাল এই লোকটার বই কিনতে মানা করেছিলাম, তাই। আমি তো জানতাম না লোকটা এত পুওর।
– কোন লোকটা?
– আচ্ছা একটা কাজ করো না।
– কী?
– নানামনি না লোকটাকে চাকরিটা দিতে চাইছে না। তুমি একটু যাও না। তুমি বললেই নানামনি চাকরিটা ওকে দেবে।
– আচ্ছা।
– কী আচ্ছা আচ্ছা করো। সারা রাত বই লেখে আর দিনে ড্রাইভারের জব করে। আহা কী কষ্ট বেচারার। যাও না। প্লিজ প্লিজ প্লিজ।
– এর মধ্যে বাবা ডাকলেন। বাবার ডাকে উঠে গেলাম ওর কথার পাত্তা না দিয়ে। ছোটদের সব কথা ধরতে নেই। পাঁচ মিনিট পরে ফিরে এসে দেখি তার চোখ ছলছল।
– ইউ আর সো আনকাইন্ড (ক্রুয়েল শব্দটির সাথে তার তখনও অতটা পরিচয় ঘটেনি)।
– কেন? কী করলাম আমি?
– আজ থেকে ওর বই আর পড়বে না তুমি। তোমার জন্যেই জবটা পেলো না পুওর রাইটার।
– আহা মা ওর ড্রাইভিং লাইসেন্স নকল। আর কী সব বলো। ও রাইটার কে বললো তোমাকে?
— আমাকে মিথ্যে বলো না। নানামনি জিজ্ঞেস করেছিলো লোকটার নাম। আমি শুনেছি। ও বলেছে, “স্যার আমার নাম শরৎচন্দ্র।” আর এই যে দেখো তোমার বইয়ের রাইটারের নামের জায়গায় ওরই তো নাম।
আমি হাসবো না কাঁদবো বুঝে ওঠার আগেই সে তার কথা বলেই চললো, “আর যে বললে ওর ড্রাইভিং লাইসেন্স নকল, তো কী হয়েছে? নকল লাইসেন্স দিয়ে যদি এতগুলো বছর গাড়ি চালাতে পারে আর এখন গাড়ি চালাতে পারবে না? আর ওকে রেখেই না হয় আসল ড্রাইভিং লাইসেন্স এর ব্যাবস্থা করে দিতে। ওকে বিদায় করে দিয়ে কী লাভ হলো?” বলেই ছোট্ট দুটি পায়ে ধুপধাপ আওয়াজ তুলে কোথায় গেল কে জানে।
আমি অপার হয়ে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। অজান্তেই কী রূঢ় সত্যিটা আমায় শুনিয়ে গেল সে। সত্যিই তো। প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতা হয়তো তার নেই কিন্তু অভিজ্ঞতা তাকে যে শিক্ষাটুকু দিয়েছে তাই বা কম কি? আমি ইচ্ছে করলেই তাকে আসল লাইসেন্স এর ব্যবস্থা করে দিয়ে তার জীবিকার পথটা সৎ ও সাবলীল করতে পারতাম। ওর ক্ষুদ্র মগজে যে চিন্তাটুকু খেলা করলো তা আমার প্রাতিষ্ঠানিক সার্টিফিকেটধারী মাথায় কেনো ঢুকলো না? না এই কাগুজে শিক্ষার চাপে মগজের সত্যিকারের জ্ঞানজ্যোতি তার দ্যুতি ছড়ানোর পথ পাচ্ছে না? এড়িয়ে যাবার কর্দমাক্ত চিন্তা কবে দূর হবে আমাদের?
অনেক ভূখন্ড ও জাতির কর্ণধার তাদের প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানের চেয়ে প্রতিষ্ঠালব্ধ অভিজ্ঞতা দিয়ে দেশ ও জাতিকে কয়েক দশক এগিয়ে দিয়েছেন। আমাদের তো সেটুকুরও অভাব। পুরো দেশটার সর্ব অঙ্গেই যখন নকলের ধকল আর অভিজ্ঞতাহীনতার সমৃদ্ধ আবাদ তখন আর ছোট্ট এক গাড়ির ড্রাইভারের নিয়োগ নিয়ে এত চিন্তা করে কী হবে?
সৎ চিন্তাগুলোও মনে হয় ওর ছোট্ট পায়ের মতো। মগজে কিছুক্ষণের জন্য ধুপধাপ আওয়াজ তোলে।তারপর কোথায় যেন হারিয়ে যায়…
(২)
মমতাময়ী মান্না দে
– মাম্মাম গানটাকে দাঁড়াতে বলো।
– কেন, কী সমস্যা?
– আহা বলোই না।
– ওর সময় নেই।
– না দাঁড়াতে বলো।
এমনিতেই মেজাজ সকাল থেকে খারাপ হয়ে আছে তার মধ্যে এই আবদার আরও মেজাজ গরম করে দিলো। তবু না শুনে উপায় নেই। কারণ এই ক্ষুদে প্রাণের এতই শক্তি যে তার কারণে আমার আপন বাবা-মাও আমার সাথে পরপর ভাব ধরে। বকা দেয়া মাত্রই বাবার চেহারা দেখলে মনে হয় এইমাত্র তিনি একটা খুনের আসামী দেখলেন। আর মায়ের চেহারা “কোন কুক্ষণে তোর মতো মেয়ে পেটে ধরছিলাম” টাইপ। তাই বাধ্য হয়ে গানকে দাঁড় করাতে হলো মানে বন্ধ করতে হলো।
– করলাম এবার বল কী বলতে চাস?
– আমি তোমাকে গান বলবো।
– উফ আর কত উল্টাপাল্টা বলবি? গান বলবি না বল গান শোনাবি।
– না আমি শোনাবো কী করে? কান তো তোমার কাছে। শুনে নেবার কাজ তো তোমার। আমি বলবো, তুমি শুনে নেবে। গান শিখলে বলতাম গান গাইবো। আমি তো গান শিখিনি। তাই গান বলবো।
হে আল্লাহ চাইছিলাম মেয়ে। তুমি দিলা মাস্টার। এরে আমি কী শিখাবো? জন্মাবধি সেই আমারে শিখাইতেছে।
– আচ্ছা বল তোর গান।
– আমার গান না। মান্না সাহেবের গান। তোমার প্রিয় তাই আমি বলবো। যাতে তোমার মেজাজ ভালো থাকে।
– আচ্ছা শোনা।
কন্যা গান ধরলো, “দ্বীপ ছিলো শিখা ছিলো শুধু তুমি ছিলে না বলে…… ”
– কী হলো থামলি কেন?
আবার গাইতে চেষ্টা করলো। কিন্তু বারবার তুমি ছিলে না বলে থেমে যাচ্ছে আর এদিক ওদিক তাকিয়ে কী যেন খুঁজছে। ততক্ষণে আমি পুরাই বিস্মিত, পুলকিত আনন্দে গদগদ। নাহ মেয়েটা আমার কত খেয়াল রাখে। প্রিয় গান শুনিয়ে মন ভালো করতে চাইছে। কেন যে এতটুকুন মেয়েকেও বকি মাঝে মাঝে। নিজের ওপর নিজেরই রাগ হয়।
– পেয়েছি! পেয়েছি!
ওর চিৎকারে চিন্তায় ছেদ পড়লো।
– কী পেয়েছিস?
ও সেই স্বর্গীয় হাসি ছড়িয়ে বল্লো, “গানটা ভুলে গিয়েছিলাম। এখন মনে পড়েছে।” আমাকে কোনো কথার সুযোগ না দিয়ে গাইতে লাগলো, “দ্বীপ ছিলো শিখা ছিলো শুধু তুমি ছিলে না বলে লাইট জ্বললো না।”
অনেক কষ্টে হাসি থামালাম। বুঝলাম গান থেমে যাবার কারণ। আলো শব্দটি ভুলে গিয়ে যত বিপত্তি। তবে আমার স্মার্ট কন্যা আলোর সমার্থক শব্দ বের করতে সময় নেয়নি। আর সেই প্রথম আমার মনে হলো, ধুর মান্না সাহেবের চেয়েও কেউ একজন আছে যার কন্ঠে এই গানটা অনেক প্রাণময়।
(৩)
বিশেষজ্ঞ বিড়ম্বনা
বাবার পড়ার ঘরের চেয়ারটা সবসময় আমার কন্যা রত্নটির দখলে থাকে। সময়টা ২০০৮-এর দিকে। মেয়েকে খুঁজতে বাবার রুমে ঢুকতেই দেখি ফ্লোরে বসেই গভীর মনযোগে তিনি পেপার পড়ছেন। পেপার পড়া শিখে অবধি এটাই তার প্রধান কাজ।
– মা কী করো?
– পেপার পড়ি।
– বাব্বাহ! কী পড়ছো পেপারে?
– ঠিক পড়ছি না মাম্মাম। খুঁজছি।
– কী খুঁজছ?
– একজন ভালো ডাক্তার।
– ওমা! কার জন্যে? কী হয়েছে?
– এখানে এসো। পেপারটা হাতে নাও। প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা দেখো। একদল আর এক দলকে দোষ দিচ্ছে, একজন আর একজনকে মারছে, শিশুদের টর্চার করছে, মা- বাবাকে কষ্ট দিচ্ছে, ছিনতাই করছে, চুরি-ডাকাতি করছে, অন্যের জিনিস কেড়ে নিচ্ছে। পুরো পেপার জুড়ে এসবই খবর।
– সে না হয় হলো। কিন্তু এ জন্যে ডাক্তার কী করবে?
– কাল ক্লাসে টিচার শিখিয়েছেন জ্বরের মাত্রা বেশি হলে মস্তিষ্কে রক্ত প্রবাহ স্বাভাবিকের চেয়ে কম হয়। তখন মানুষ উল্টো পাল্টা আচরণ করে এবং প্রলাপ বকে এবং নিজের অজান্তেই নিজের এবং সবার ক্ষতি করে। মা আমি কনফার্ম আমাদের দেশের বড় বড় মানুষদের অনেক জ্বর। যার জন্যে এরা উল্টাপাল্টা বকছে ও আজব আজব কাজ করছে। জ্বর তো ছোঁয়াচে তাই সব সাধারণ মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে। খুব তাড়াতাড়ি একজন ভালো ডাক্তার দরকার জ্বর নামাবার জন্যে।
বলেই পেপারটা আমার হাতে দিয়ে ধুপধাপ পা ফেলে যেতে যেতে বললো, “একজন ভালো টিচার খুঁজো তো যিনি ভালো করে পড়তে শিখাবেন। লিখতে না শিখালেও চলবে।”
কী আজব! শুধু পড়তে শিখাবে, লিখতে শিখাবে না। এ আবার কেমন কথা? যেমন ধুপধাপ করে গেল, তেমনি ধুপধাপ করে ফিরে এলো।
– পেইজ নাম্বার তিন এ দেখো একজন পুলিশ অফিসার আংকেল এক শিশুকে কোর্টে চালান করেছে। শিশুটির বয়স ওখানে উল্লেখ ছিলো। উনি যদি পড়তে জানতেন তবে কী একটি সাত বছর বয়সী শিশুর কোর্টে চালান দেবার কাগজে সই করতে পারতেন? আবার এটা দেখো দেয়ালে নির্বাচনী প্রচারণা হচ্ছে। পাশেই ছোট করে লেখা “দেয়ালে লেখা ও পোস্টার লাগানো নিষিদ্ধ”- এটা পড়তে পারলে ও কী লিখতো? তার মানে ও লিখতে পারে। পড়তে পারে না। আবার সাতের পাতায় দেখো এক ডাক্তার আংকেল রিপোর্ট এ যে অসুখের কথা লেখা আছে তিনি তা না করে অন্য অসুখের ট্রিটমেন্ট করলেন। তার মানে ক্লিয়ার উনিও রিপোর্ট পড়তে পারেন নি। এত বড় বড় মানুষদেরই যখন এই অবস্থা তখন অন্যদের কী অবস্থা বুঝো। এরপরও কী তোমার সন্দেহ আছে যে আমাদের বেশির ভাগ মানুষ লিখতে পারেন, পড়তে পারেন না। সো এমন একজন টিচার দরকার যিনি ভালো পড়াতে পারেন আর একজন ভালো ডাক্তার দরকার যিনি জ্বর নামাতে পারেন। বুঝলে?
আমি তো যা বোঝার বুঝলাম। আপনারা কী বুঝলেন?