হামীম রায়হান

তপুর ভাবনা

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

তপু ক্লাস থ্রি-তে পড়ে। তপুদের বাসা পটিয়া সবুর রোডে। আজ ২১ শে ফেব্রুয়ারি। তপুর স্কুল বন্ধ। তপু জানে আজ মাতৃভাষা দিবস। সেই ভোর থেকে অনেক লোক প্রভাতফেরী করে। ফুল নিয়ে অনেক লোক শহীদ মিনারে যাচ্ছে। স্কুলের সব ছাত্র-ছাত্রীরাও শহীদ মিনারে যাচ্ছে। তপুদের স্কুল থেকেও যাবে। ফুটবল খেলতে গিয়ে পা মচকে ফেলায় এবার তপুর যাওয়া হচ্ছে না। গতবছর সে বাবার সাথে শহীদ মিনার গিয়েছিলো। তখন থেকেই তার মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, ’আমরা কেন শহীদ মিনারে যাই? কেন এই মাতৃভাষা দিবস‌‍?’ আজও প্রশ্নটি মনে আসায় সে আস্তে আস্তে হেঁটে বাবার কাছে প্রশ্নটি করল।

‘বাবা আমরা কেন এই ভাষা দিবস পালন করি?’

‘তার আগে বলোতো আমরা কোন জাতি?’

‘বাঙালি জাতি।’

‘জানো, প্রত্যেক জাতির একটা আলাদা ও নিজস্ব ভাষা আছে। আচ্ছা বলোতো, আমরা কবে স্বাধীনতা লাভ করি?’

‘১৯৭১ সালে। এগুলোতো আমাদের বাংলা বই-এ আছে? এগুলোর সাথে ভাষা দিবসের কী সম্পক?’

‘সম্পক আছে। এসব যে একই সূত্রে গাঁথা ঘটনা। ১৯৭১ এর আগে আমরা তো একবার স্বাধীন হয়েছিলাম।’

‘আরো একবার!’

‘হ্যা, ১৯৪৭ সালে আমরা ব্রিটিশ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে ভারত, পাকিস্তান দুটি দেশ হয়। মূলত, হিন্দু-মুসলমান ভিত্তিতে এ দেশ দুটোর জন্ম। আমরা ছিলাম পাকিস্তানের অংশ। আমাদের এদেশের নাম ছিলো পূর্ব পাকিস্তান। আমরা ভাবলাম এবার হয়ত আমরা শান্তিতে থাকতে পারব। কিন্তু না, ১৯৪৭ সালের ১৯ মার্চ পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে এক জনসভায় ঘোষণা করলেন– উদুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা! সাথে সাথে পূর্ব পাকিস্তানের সবাই প্রতিবাদ করে উঠল। যে দেশের শতকরা ৫৬ জন মানুষের মুখের ভাষা বাংলা, সেদেশে বাংলায় তো হবে রাষ্ট্রভাষা। চলতে থাকে সারাদেশে হরতাল, আন্দোলন। ওই আন্দোলন এত ভয়াবহ রূপ নেয় যে তৎকালীন সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু ছাত্ররা সিদ্ধান্ত নেয় এই ১৪৪ ধারা ভাঙ্গবে। এবং তারা ঠিক তাই করলো। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে মিছিল বের করে। ঠিক তখন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাদের সেনাবাহিনী দিয়ে মিছিলে গুলি চালায়। সেই গুলিতে মারা যায় সালাম, রফিক, জাব্বারসহ নাম না জানা অনেক ছাত্র। তাঁদের মৃত্যুর সংবাদ সারাদেশে দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে। শুরু হয় গণআন্দোলন। শেষ পর্যন্ত শাসকগোষ্ঠী বাৎলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। আর ঐ শহীদের স্মরণে আমরা এই ভাষা দিবস পালন করি। ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘ এই দিবসটিকে আন্তর্জাতিকভাবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। সেই থেকে পৃথিবীর ১৯২টি দেশ এ দিবসটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। এবার বুঝলে কেন আমরা এ দিবস এত শ্রদ্ধা ভরে পালন করি?’

‘হ্যাঁ বুঝলাম।’

কিন্তু তপুর মাথায় একটা জিনিস কোনভাবেই ডুকছে না যে, একজন আরেকজনের সম্পদ নিতে চায়, জায়গা নিতে চায়, কিন্তু মুখের ভাষা! এটা কী করে সম্ভব! মুখের ভাষাতো খোদার দান। তপুদের বাসার পাশের বাসায় চাকমা এক পরিবার থাকে। তারা নিজের ভাষায় কথা বলে। কই তপুরা তো কখনো বলে না, ও ভাষায় কথা বলা যাবে না। বরং তারা যখন কথা বলে তখন তপুর শুনতে ভালোই লাগে। তপু মাঝে মাঝে ভাবে, ‘ইস! তাদের ভাষাটি যদি বুঝতে পারতাম।’

তপুদের বাসার ভেন্টিলেটরে এক জোড়া চড়ুই পাখি বাসা বেঁধেছে। সারাদিন তারা কিচিরমিচির করে মাতিয়ে রাখে। তপু ভাবে, যদি পাখির ভাষা বুঝা যেত! তপু সকালে দাদুর কাছে আরবি পড়ে। আরবি ভাষাটিও তার ইচ্ছে শেখার। সে জানে প্রত্যেক ভাষাকেই সম্মান করতে হয়। এবার সে বাবাকে গিয়ে বলল, ‘চলো বাবা শহীদ মিনারে যায়।’

‘তুই কি হাঁটতে পারবি?’

‘পারব বাবা। ঐ দেখো আমার লাগানো ডালিয়া গাছে একটা লাল টুকটুকে ফুল ধরেছে। ঐ ফুলটাই আমি শহীদ মিনারে নিয়ে যাবো। চলো বাবা, চলো।’

ডালিয়া ফুলটি নিয়ে তপু বাবার হাত ধরে খোড়াতে খোড়াতে রওনা হল শহীদ মিনারে।


 

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu