কাজী মহম্মদ আশরাফ
জন্ম: ১জানুয়ারি, ১৯৭৭, ৯ সুলতান সিকান্দার শাহ রোড, নারায়ণগঞ্জ। পৈতৃকবাস : মুন্সীগঞ্জ। উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত গ্রন্থ: আকালু (উপন্যাস)
কাজী মহম্মদ আশরাফ

তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

স্বামী বিমান হামলায় মারা যাওয়ার পরে তিনটি মেয়ে নিয়ে তিনি আরেক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। সে যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পরেই নিউজটা প্রথমে বিবিসির প্রতিবেদক উপস্থাপন করেছেন। বড় মেয়ের ডাইরি পাওয়া গেছে। সে নিয়মিত ডাইরি লিখতো। তার ডাইরিতে মায়ের সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। তিনি প্রায়ই বলতেন, “এবার আর আশা নাই। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল প্রায়।”

মেয়েটি তার মাকে বলতো, “মা, আমি স্কুলে পাস করে বিদেশে চলে যাবো। তারপরে বিজ্ঞানী হবো। এমন একটা যন্ত্র আবিষ্কার করবো যাতে বোমা হামলায় কোনো মানুষই আর মারা যাবে না।”

মা বলতেন, “তুই পাগল হয়েছিস! সারা পৃথিবীর সব মানুষ যদি একদিন অসুস্থ হয়ে পড়ে, যদি সর্দি জ্বরের মতো সাধারণ কোনো রোগেও আক্রান্ত হয়, সবাইকে এক দিনে সুস্থ করে তোলার ওষুধ সারা পৃথিবীর সমস্ত গোডাউনেও নাই। এক দিনে সুস্থ করে তোলা সম্ভব না। কিন্তু পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে একদিনেই, শুধু একদিনে কেন, এত ঘণ্টাতেই মেরে ফেলার মতো অস্ত্র মানুষ আবিষ্কার করে রেখেছে। মজুদ আছে বিভিন্ন দেশে। কয়েক হাজার বার মানবসভ্যতা ওরা ধ্বংস করতে পারবে।”

মেজো মেয়ে বলতো, “মা তুমি অস্ত্রকে এত ভয় পাও কেন? দেখো না বিমান হামলার সময়ও স্কুল থেকে দৌড়ে বাসায় চলে আসতে পারি। আমরা কি এসবে ভয় পাই?”

মা তখন মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বলতেন, “তোর বাবাকে তো বিমান হামলা করেই হত্যা করেছে। তোদের যদি কিছু হয়? আমি কোথায় যাবো?”

মেজো মেয়ে বলতো, “মা, প্রাইভেট কারেও মানুষ মারা যায়, ট্রেনেও মানুষ মারা যায়। তাই বলে মানুষ কি প্রাইভেট কার বা ট্রেনকে ভয় পায়? তুমি বিশ্রাম নাও। তোমার কাজ আমি করে দিচ্ছি। তুমি ঘুমাও।”

বিবিসির প্রতিবেদনে এমন সব তথ্য পাওয়া যায়।

স্বামী মারা যাওয়ার পরে তিন মেয়েকে নিয়ে মা এখানে-সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন কিছুদিন। তার পরে বাসায় ফিরে এসেছেন। বাসাটা একটু নিরাপদ। দুই পাশে দুইটি ছয়তলা বিল্ডিং বোমার আঘাতে ভেঙেচুরে আহত শরীরে দাঁড়িয়ে আছে। তবে প্রতিটা ফ্লোর বেশ মজবুত। এখনো কাঠামো টিকে আছে। ভূতুড়ে এই দুই বিল্ডিংয়ের মাঝে তাদের বাসা। এখানে আর লাইট জ্বলে না। দুই বিল্ডিংয়ের মাঝখানের ফাঁকে তাদের অবস্থান বিমান থেকে দেখা যায় না। এই নিরাপত্তার মধ্যেও মা ভয় পান।

রাতে ঘুমাতে পারতেন না বলে প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন। মাঝে মাঝে তিনি মধ্যরাতে জানালার সামনে মোমবাতি হাতে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতেন। একদিন রুটি কিনতে গিয়ে দোকানের টেলিভিশনে খবরে জানতে পারেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাচ্ছে। এর পর থেকে তার ঘুম কমে গেছে।  সর্বক্ষণ শুধু চিন্তা করতেন, চিন্তা না আসলে দুশ্চিন্তা- তিনটি মেয়েকে নিয়ে কোথায় যাবেন? যদি তিনি নিজেও বিমান হামলায় মারা যান! সৈনিকদের গুলিতে মারা যান তখন ওদের অবস্থা কেমন হবে? ওরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? কে ওদের খাবার দেবে? স্কুলে পড়ার খরচ কে দেবে? নাকি সৈনিকরা ধরে নিয়ে যাবে? মেয়ে সন্তানদের ওরা যদি…। ওহ ভাবা যায় না।

যদি কেউ খাবারের লোভ দেখিয়ে ক্ষুধার্ত মেয়েগুলোকে ধরে নিয়ে দালালের হাতে তুলে দেয়! যদি সীমান্তের ওপারে নিয়ে পতিতালয়ে বিক্রি করে দেয়! মা হয়ে তিনি কবরে শুয়েও শান্তি পাবেন না। বুকফাটা আর্তনাদে কবরের মাটি হা করে উঠবে।

তিনি দেখতেন মেয়েরা বিমানের ভাঙ্গা টুকরা, অ্যালুমিনিয়ামের পাত এগুলো দিয়ে খেলা করে। নানা রকম খেলনা বানায়। কয়েকদিন আগে স্কুল থেকে আসার পথে হঠাৎ বিমান হামলা শুরু হলে মেজো মেয়ে দেখতে পায় তাদের চোখের সামনে একটা ছোট্ট শিশু বাবার হাত ধরে খেলনা কিনে ফেরার পথে মারাত্মকভাবে আহত হয়। বাবা মারা যায়, শিশুটির এক হাত উড়ে যায়। রেডক্রসের কর্মীরা অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে এসে তাদের দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যায়। মেজো মেয়ে বিমান হামলার সময় আকাশে তাকিয়ে দেখছিলো। আকাশের বিমানের গতি-প্রকৃতি নিয়ে তার কিছুটা অনুমান হয়েছে। কোন দিকে বিমানের লেজ থাকলে কোন দিকে বোমা পড়তে পারে। কোন দিক দিয়ে বিমানটি ফিরে যেতে পারে। কোন কান বরাবার থাকলে কোন দিকে, কত মিটার দূরে গিয়ে পড়তে পারে। সে এসব এখন বুঝতে পারে। স্কুলে রেডক্রসের রেসকিউ টিমের একদিনের ওয়ার্কশপে এমন অনেক কিছু শিখেছে। সেদিন বিমানটি খুব কাছে চলে আসে যখন, ঠিক মাথার ওপরে, বোমাটি পাঁচ মিটারের মধ্যে পড়বে অনুমান করে সে দ্রুত রাস্তার ম্যানহোলের ভিতর ঢুকে ড্রেনের মধ্যে লুকিয়ে পড়ে। একবার সে মাথা উঁচিয়ে বাচ্চাসহ ভদ্রলোককে ডেকে বলেছিলো, “আংকেল দ্রুত এখানে চলে আসেন, এক্ষুণি বোমা পড়বে।”

ভদ্রলোক তার ছেলেটিকে নিয়ে একবার এদিকে একবার ওদিকে কোন দিকে যাবেন, দিশাহারা হয়ে মারা গেলেন। ছেলেটির ডান হাত উড়ে গেছে। বিমানের ইঞ্জিনের শব্দ দূরে চলে যেতেই মেয়েটি ম্যানহোল থেকে বেরিয়ে আসে। তার গায়ে ময়লা লাগে নাই। আসলে ভেতরে তেমন ময়লা নাই। একেবারে খটখটে শুকনা। সামান্য আছে। অনেক পুরনো ময়লা শুকিয়ে এতদিনে মাটি হয়ে গেছে। আসলে ড্রেনটা যে দিক থেকে এসেছে সেই মহল্লাটি এখন জনশূন্য হয়ে গেছে। মানুষ না থাকলে ময়লা আসবে কোথা থেকে!

মেয়েটি উঠে দেখে রেডক্রসের অ্যাম্বুলেন্স এসেছে। দুজনকেই তুলে নিয়ে গেলো। যেখানে রক্তের দাগ সেখানে শিশুটির খেলনাটিও ভেঙে পড়ে আছে। খেলনার চারটি চাকার মধ্যে দুটি চাকা পেয়ে সে ওগুলো টিসু পেপারে রক্ত মুছে স্কুল ব্যাগে ভরে বাসায় নিয়ে আসে। পরে বোমারু বিমানের ভাঙ্গা অ্যালুমিনিয়ামের শিট ছিদ্র করে তাতে চাকা দুটি লাগিয়ে একটা গাড়ি বানায়। ওটার নাম দেয় অ্যাম্বুলেন্স। একটা সুতা বেঁধে টেনে নিয়ে যায়। ইট, কাঠ, পাথরের টুকরা, লোহার নাট বল্টু ইত্যাদি তার গাড়িতে লাশের মতো শুইয়ে দিয়ে সুতা দিয়ে টেনে নিয়ে যায়। এলাকায় সারা দিনে বিদ্যুতের সমস্যা। কোথায় কোন ট্রান্সফর্মার উড়ে গেছে। তাই বিদ্যুৎ ব্যবহারে সতর্কতার জন্য বাবা নিজেই কিছু মেরামতির কাজ করতেন। ঘরে লাল ট্যাপ ছিলো। সেখান থেকে ট্যাপ লাগিয়ে রেডক্রস লাগিয়ে অ্যাম্বুলেন্স বানিয়ে খেলা করে মেজো মেয়ে। সে নিজেকে বলে, “আমি ডাক্তার। তোমাদের কোনো ভয় নাই। আমি এসে গেছি ওষুধ নিয়ে। তোমাদের ইঞ্জেকশন দিবো। কেউ চিন্তা করবে না। আমি এসে গেছি।”

ছোট মেয়ে গুলির খোসা সংগ্রহ করে। স্কুলে যাওয়া-আসার পথে গুলি কুড়ায়। এগুলো দিয়ে ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে জুস প্যাক, চিপস কিনে খায়। সে মাঝে মাঝে মেজো বোনের সংগ্রহ করা যুদ্ধাস্ত্রের ভাঙ্গা টুকরা-টাকরা চুরি করে ফেরিওয়ালার কাছে বেচে দিয়ে চিপস কিনে খায়। সে তার বড় বোনকে বলতো, “আপু আমি বড় হলে একটা ডিকশনারি লিখবো। সেখানে কোনো যুদ্ধ আর অস্ত্রের নাম থাকবে না। তাহলে লোকে যুদ্ধ করতেই ভুলে যাবে।”

বড় মেয়ের ডাইরির শেষের দিকের পৃষ্ঠায় লেখা আছে, “আমরা কেউ মরতে চাই না। বাঁচতে চাই। আম্মুর ভয় আমরা বাঁচতে পারবো না। তিনি মনে করেন এভাবে ভয়ের সমুদ্রে বেঁচে থাকা যায় না। এর চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো। মা আমাদের নিয়ে হতাশ। কিন্তু আমরা নিজেদের নিয়ে হতাশ নই। পৃথিবীতে মানুষের উপায়ের অভাব নাই। কোনোভাবে একটু পড়ালেখা করতে পারলে কোনো না কোনো ভাবে বেঁচে থাকতে পারবোই। মাকে যতো বুঝাই, কিছুতেই বোঝেন না। তিনি কী চান আমি বুঝি না।”

সে আরো লিখেছে, “গতকাল দেখলাম অনেকগুলো ইঁদুর মারার শক্তিশালী ট্যাবলেট কিনে এনেছেন মা। আমাদের ঘরে ইঁদুরের উৎপাত আছে। কারণ আশেপাশে ফাঁকা হয়ে গেছে। বসতি কমে গেছে। তাই শহরের ইঁদুরদের খাবারের অভাব দেখা দিয়েছে। তাই সবার বাসাতেই ইঁদুরের উৎপাত বেড়ে গেছে। কিন্তু এতগুলো ট্যাবলেট কেনার কী প্রয়োজন মা জানে শুধু। কোথাও ওষুধ পাততেও দেখলাম না।”

বিবিসির প্রতিবেদনে এসব কথা জানা যায়। মর্মান্তিক ঘটনাটি শোনার পরে আর কীই বা বলার থাকে?


 

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu